মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭

ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা

ঢাকা গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গার তীরে। যেহেতু ঢাকা ছিল রাজধানী। মানুষ তো আসবেই। যখনই যে এসেছে, নিজের আশাকে সামনে রেখে নিজের ভাষায় কথা বলেছে। বহু অঞ্চলের মানুষ একত্রে মিলে নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে বলতে ঢাকার প্রাচীন জনপদ ঘিরে নতুন একটি ভাষার উদ্ভাবন হয়েছে। নতুন উদ্ভাবিত ভিন্নমাত্রার ভাষাটির নাম ‘কুট্টি’ ভাষা।

আদি ঢাকার আদি মানুষেরা এখনো সেই ‘কুট্টি’ ভাষায় কথা বলে। ‘কুট্টি’ ভাষাকে আজ যদিও ঢাকার আদি ভাষা বলে অনেকে মনে
করে থাকেন কিন্তু ‘কুট্টি’ ভাষা ঢাকার আদি অধিবাসীদের আদি ভাষা নয়। ‘কুট্টি’ ভাষার সৃষ্টি হয়েছে ঢাকার বাইরে থেকে আসা একদল মানুষের নিজস্ব সৃজন কারুকাজের ধারাবাহিকতায়। নতুন এই ভাষা সৃজনকারী কারা? কোত্থেকে এসেছিল এই নতুন ভাষা সৃজনের মানুষেরা? সেই মানুষ, তাদের মনন ও মেধা সম্পর্কে ইতিহাস কী তথ্য রেখেছে আমাদের জন্য?

ইতিহাস ঘেঁটে ‘কুট্টি’দের সম্পর্কে বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক তথ্য জানা গেছে। হাকিম হাবিবুর রহমান রচিত ‘ঢাকা পাচাশ্ বারস্ পহেলে’, এস এম তাইফুর রচিত ‘Glimpses of old Dacca’, নাজির হোসেন রচিত ‘কিংবদন্তির ঢাকা’, হাফিজা খাতুন রচিত ‘Dhakaiyas on the Move’, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ ফিরোজা ইয়াসমীন সম্পাদিত ‘ঢাকাই উপভাষা প্রবাদ-প্রবচন কৌতুক ছড়া’, আবদুল মমিন চৌধুরী ও শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর ও উত্তরকাল’; প্রথম খণ্ড শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘ঢাকা কোষ’, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আনিস আহমেদ রচিত ‘ঢাকাইয়া আসিল’, মালিক খসরু পিপিএম রচিত ‘আন্ধা মিয়ার ঢাকা শহরের বুলির বাজার’ ইত্যাদিসহ আরও বেশ কিছু গ্রন্থে আদি ঢাকার বিভিন্ন সম্প্রদায় বিশেষত কুট্টি ও সুখবাস বা ছোব্বাছি জনগোষ্ঠী এবং তাদের ভাষার উদ্ভব-উত্পত্তি ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এ সকল গ্রন্থে উল্লিখিত বিষয় পর্যালোচনা করে জানা যায়, মুঘল আমলে মূলত কুট্টি সম্প্রদায়, কুট্টি ভাষার উত্পত্তির কাল। আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে পূর্ববঙ্গে চাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল। এবং সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট কেন্দ্রে পরিণত হয়। চাল রপ্তানিকারকরা ছিল মাড়োয়ারি ও ভারতের মধ্য অঞ্চলের মানুষ। তারা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধান সংগ্রহ করত। সংগ্রহ করা বিপুল ধান ঢেঁকিতে ভানতে বা কুটতে হতো। এই ধান ভানা বা কোটার কাজে প্রচুর শ্রমিক নিয়োগ করতে হতো। এসব ধান কুটতে ঢাকার আশপাশ এলাকা থেকে শ্রমিক আসত। ধান কোটা বেশ পরিশ্রমলব্ধ কাজ। সুতরাং ধান কোটা শ্রমিকেরা ধান কুটেই ঢাকা ছেড়ে চলে যেত না। তারা আশেপাশেই থাকতে শুরু করল। যেহেতু ঐসব মেহনতি মানুষ কাজ করছে, একসঙ্গে থাকছে, গল্প করছে, সুখ-দুঃখ বিনিময় করছে, তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে একটি ভাষার জন্ম দিল। ধান কুটতে কুটতে তাদের আসল নাম ফেলে দিয়ে মাড়োয়ারিরা সংক্ষেপে ‘কুট্টি’ হিসেবে ডাকতে শুরু করলে, কালের পরিক্রমায় তারা ‘কুট্টি’ হিসেবেই পরিচিতি অর্জন করে। অর্থাত্ ধান কোটার কোটা থেকে ‘কুট্টি’ শব্দ বা সম্প্রদায়ের উত্পত্তি।

আরও একটি তথ্যে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার শহুরে সম্প্রদায়ে একটি সনাতন সামাজিক বর্গ হিসেবে কুট্টিদের উদ্ভবের মূলে ছিল ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ঢাকায় সংঘটিত গুরুতর দুর্ভিক্ষের কারণে ঢাকার মধ্য অঞ্চল থেকে একশ্রেণির শ্রমিক এসে ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় বসবাস করতে থাকে। এই শ্রমিকদের প্রধান কাজ ছিল ধান কুটে চাল বের করা। এবং যে সকল জমিদার ঢাকায় বসবাস করতে আসত, তাদের দালানকোঠা তৈরির জন্য ইট ভেঙে দিতে হতো। সেই ইট ভাঙা বা কোটার কাজও করত ঐ শ্রমিকেরা। তাদের কোটা থেকে ‘কুট্টি’ শব্দের যা একটি গোষ্ঠী নতুন নাম ধারণ করে সমাজে থেকে যায়। সেই থেকে যাওয়া মানুষরাই পুরান ঢাকার মানুষ। যে মানুষেরা নিজেরা একটি ভাষা তৈরি করেছে নিজেদের জীবনধারণ ও জীবনে প্রয়োগের জন্য। তারা হয়তো জানত না নিজেদের অজান্তেই একটি ভাষার জন্ম তারা দিচ্ছে বা দিয়েছে। কালের বিবর্তনে ঢাকা শহরে, পুরান ঢাকা মানে কুট্টিদের ঢাকা, কুট্টি ভাষা নতুন রূপ পরিগ্রহ করে আজকের জায়গায় পৌঁছেছে।

এদের পুরাতন আবাসস্থল ধোলাইখাল এলাকায় হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দ্রুত নগর সম্প্রসারণের কারণে তারা ধোলাইখালের আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে আবাস গড়ে তোলে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ে এদের আবাসস্থল ছিল পুরান ঢাকার ধোলাইখালসহ তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, পাটুয়াটুলি, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, গ্লোরিয়া, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দা, মৈশুন্দি, মদনমোহন বসাক রোড, নবাবপুর, ওয়ারী, বনগ্রাম, হাটখোলা, টিকাটুলি, কায়েতটুলি, নবাবগঞ্জ। এদের উচ্চারণে বাংলা বর্ণমালার মহাপ্রাণ ধ্বনি যেমন ঘ, ধ, ড়, ভ ইত্যাদি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। মহাপ্রাণ ধ্বনিবিশিষ্ট বর্ণ ঝ এবং ঢ-এর কিছুটা সঠিক ব্যবহার লক্ষণীয়। একই সাথে যথাক্রমে শ, ষ, স-এর উচ্চারণ ছ এবং ছ-এর উচ্চারণ চ হিসেবে করে থাকে।

এই বিষয়ে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. রঙ্গলাল সেন রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর ও উত্তরকাল ///প্রথম খণ্ডে তাঁর ‘মুঘল আমল থেকে রাজধানী ঢাকার সমাজ ও সমাজ কাঠামো’ প্রবন্ধে এস এম তাইফুর রচিত Glimpses of old Dacca গ্রন্থের আলোকে উল্লেখ করেছেন, ‘উপযুক্ত সামাজিক বর্গ শ্রেণী ব্যতীত এস. এম তাইফুর মুঘল ঢাকায় বসবাসরত অন্য চারটি সনাতন পেশাজীবী গোষ্ঠী শনাক্ত করেছেন। এসব হল : কুট্টি, খোসবাস কিংবা সুখবাস, বসাক এবং শাঁখারি। প্রথম দুটি গোষ্ঠি মুসলমান, আর শেষোক্ত দুটি হিন্দু। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা উচিত যে, রাজধানী ঢাকার শহুরে সম্প্রদায়ে একটি সনাতন সামাজিক বর্গ হিসেবে কুট্টিদের উদ্ভবের মূলে ছিল ১৭৬০ খিস্ট্রাব্দ থেকে নিরবচ্চিন্নভাবে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ঢাকায় সংঘটিত প্রচণ্ড ভূমিকম্পের ফলে বিরাট সংখ্যক লোক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিন্তু, বিশেষ করে, ১৭৬৯—১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বারংবার সংঘটিত গুরুতর দুর্ভিক্ষের ফলে কুট্টি বলে কথিত এক শ্রেণীর শ্রমিক ব্যাপক সংখ্যায় ঢাকার মধ্যাঞ্চল থেকে এসে শহরের ধোলাইখাল এলাকার কতক অংশে বসতি স্থাপন করে। এদের প্রধান কাজ ছিল ধান কুটে চাল বের করা এবং যে সকল জমিদার ঢাকায় বসবাস করতে আসতেন, তাদের দালান-কোঠা তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় ইট ভেঙ্গে দেওয়া। কুট্টি এক বিশেষ ধরনের ভাংলা উপভাষায় কথা বলে, যা তাদেরকে অন্য বাঙালিদের কাছে উপহাসের পাত্র করে তুলে। কারণ, অন্যদের ব্যবহূত ভাষা অধিকতর মার্জিত বলে মনে করা হয়।’

একই প্রবন্ধে অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন হাফিজা খাতুন রচিত Dhakaiyas on the Move গ্রন্থের বিবরণ উল্লেখ করেন, ‘হাফিজা খাতুন মুঘল শহর ঢাকার অন্যতম আদি বাসিন্দা হিসেবে কুট্টিদের উত্পত্তির উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে পূর্ববঙ্গে চাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি বাণিজ্যের পণ্যে পরিণত হয়। ঢাকা ধান-চাল ব্যবসার বিরাট এক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। চাল রপ্তানিকারকরা সকলেই ছিল মাড়োয়ারি ও ভারতের মধ্যাঞ্চলের ব্যবসায়ী। তারা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলার অভ্যন্তর থেকে ধানচাল সংগ্রহ করত এবং তারা ধান ভানার কাজে স্থানীয় বিপুল সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ করত। এসব ধান ভানার লোকেরা যারা ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আসত তারাই কুট্টি নামে অভিহিত হয়। হিন্দুস্থানী ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় ধান ভানার কাজে নিয়োজিত লোকদের মধ্যে পরস্পরিক কথোপকথনের মাধ্যম হিসেবে যে এক বিশেষ উপভাষার বিকাশ ঘটে, সেটাই কুট্টিদের ভাষা বলে গণ্য হয়।’

অধ্যাপক রঙ্গলাল সেনের বিবরণ থেকে ঢাকার কুট্টিদের উত্পত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ঢাকার এই আদি অধিবাসীরা লেখাপড়ার প্রতি তেমন উত্সাহী ছিলেন না। ছিলেন না নিজেদের সম্পর্কে খুব একটা সচেতনও। ফলে কালের বিবর্তনে, সময়ের তীব্র অভিঘাতে তারা এখন প্রায় বিলীয়মান এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। গবেষকেরা গবেষণা করে অনেক তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছেন, প্রত্যেকেই একই তথ্য দিলেও কিছুটা পার্থক্য থাকছে। আবার যুক্ত হচ্ছে নতুন তথ্য, নতুন উপাত্ত। নতুন তথ্য যুক্ত ও পার্থক্যর সুতার ভেতরে থেকে যাচ্ছে অনেক মশলা।

আরও জানা যায়, কুট্টিদের এই ভাষা সাধারণের গ্রাহ্য ছিল না। মাড়োয়ারি, সরকারি কর্মচারী, জমিদার বা ভূস্বামীরা কুট্টিদের ভাষা ব্যবহার করত না। কিন্তু পুরান ঢাকার অন্ত্যজ শ্রেণি, প্রান্তিকজন, যারা উঠে এসেছিল মাটি থেকে, মাটির গভীর গহ্বর থেকে, তারা আজও টিকে আছেন। কেবল কি টিকে আছেন? সেই প্রান্তিক মানুষেরা একটি নতুন ভাষারও জন্মদাতা। সাধারণে যার পরিচিতি পুরান ঢাকার ভাষা। পুরান ঢাকার ভাষা বা কুট্টিদের ভাষা যে নামেই বলি না কেন, এই ভাষাটার উচ্চারণ বড় মধুর। সহজ সরল অন্তসলীলে খুব দ্রুত এই ভাষা প্রবেশ করতে পারে।

‘কুট্টি’ শব্দটি আজকাল গালি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে জেনে খুবই মর্মাহত হয়েছি। আবার অনেক গবেষক এদের ভাষাকে উপভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে মানবিকতার সামান্য স্পর্ধা নিয়ে বলতে চাই, যারা মাতৃজঠর থেকে জন্মের পর বাবা-মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে এই ভাষা শিখতে সক্ষম হয়েছে বা যা তাদের মাতৃভাষা, তাকে উপভাষা না বলে ভাষা বলাই শ্রেয়।

প্রচুর চুটকি, হিউমার আর গালগল্প ধারণ করে ‘কুট্টি’ ভাষা নিজস্ব শক্তি প্রকাশ করেছে। পুরান ঢাকার মানুষদের জীবন আধুনিক ঢাকার মানুষদের থেকে আলাদা। পুরান ঢাকার মানুষদের জীবনযাপন বেশ সরল। মনে ও মননে আন্তরিক। হাসিখুশি তাদের মুখশ্রী। অতিথিপরায়ণ। আড্ডাবাজ। অন্যর বদনাম করে না। তাদের আর একটি বৈশিষ্ট্য, প্রবল ধর্মভীরু। কিন্তু ধর্ম নিয়ে ব্যবসাও করে না। অনেক কাল আগে থেকে পুরান ঢাকার মানুষদের আচরণের সঙ্গে তাদের ভাষারও একটা সাযুজ্য আছে।

তাদের, কুট্টিদের হিউমার নিয়ে প্রচুর গল্প চালু আছে। সেই প্রচুর থেকে একটি মাত্র গল্প উপস্থাপন করছি। এই গল্পটির ভেতর দিয়ে কুট্টি বা পুরান ঢাকার আদি অধিবাসীদের সরস ও কৌতুকপূর্ণ মনের প্রকাশ পাওয়া যাবে নিঃসেন্দহে।

‘এক বন্ধু তার আর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করছে, আব্বে ছল্ল ু, তর বাপে নাকি হজ করবার যাইবো?

জবাব দেয় ছল্ল ু, যাইবার পারে, হালায় ছয়তান আছে।’

কুট্টিদের আত্মপ্রকাশ ও ভাষার বিকাশ সম্পর্কে নাজির হোসেন তাঁর কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থের ভূমিকায় আরও পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মোগল আমলে ঢাকাবাসীদের মধ্যে যারা মোঘল শাহীর অধীনে চাকরি করতেন অথবা জমিদার কিংবা ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে জড়িত ছিলেন তারা নিজেদের উঁচু স্তরের লোক ভাবতেন। তত্কালে যন্ত্রের কোনো প্রচলন ছিল না। মানুষকে নিজেদের চাহিদা মেটাবার সব রকম উপকরণ হাতেই তৈরী করতে হতো। এইসব পেশাজীবীদের অনেকেই ধান কুটতো, যব কুটতো, ডাল কুটতো, ডাল কুটতো, সুরকি কুটতো, ইট কুটতো অর্থাত্ যে কোনো ধরনের কুটার কাজ যারা করতেন, তারা চিলেন খুবই দরিদ্র। ...অন্যদিকে তারা কুটার কাজ করতেন বলে শহরের উঁচু স্তরের লোকেরা এইসব কোটার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ‘কুটিয়াল’ বলতো। সাধারণভাবে এদের কুট্টি বলেই ডাকতেন। পেশাই যে কালে পদবীতে পরিণত হতো ইতিহাসে সে রকম ভূরি ভূরি প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে।’

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকা কোষ গ্রন্থে অনুপম হায়াত্-এর লেখা আর একটি টীকা— ঢাকার এক প্রাচীন অধিবাসীদের ‘কুট্টি’ নামে অভিহিত করা হয়। কুট্টি শব্দটি এসেছে ধান কুটা বা ধান ভাঙা থেকে। ঢেঁকির মাধ্যমে ধান হতে চাল ও তুষ আলাদা করার পদ্ধতির নাম ‘ধানকুটা’। ধান কুটে জীবন যাপন করত বলে এদেরকে ‘কুট্টি’ বলা হয়। এরা একটি পেশাজীবী সম্প্রদায়।

জানা যায় যে, ১৭৬৯ থেকে ১৭৭০ সালের দিকে যখন বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তখন নাসিরাবাদ [ময়মনসিংহ], কুমিল্লার সুধারাম [নোয়াখালী], জালালপুর [ফরিদপুর], মুন্সিগঞ্জ ও অন্যান্য এলাকা হতে দরিদ্র শ্রেণির লোকজন জীবিকা অর্জনের জন্যে ঢাকায় এসে ভিড় জমায় এবং ধোলাইখাল এলাকায় বসতি স্থাপন করে। তখন শহরের ধনী জমিদারেরা খাজনার পরিবর্তে প্রজাদের কাছ থেকে যে ধান আদায় করত, এসব লোক সেই ধান ঢেঁকিতে কুটত বা ভানত এবং এ বাবদ প্রাপ্ত মজুরি বা অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। এ জন্যই ধান কুটা কাজে নিয়োজিত শ্রেণির লোকরা ‘কুট্টি’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে বংশবৃদ্ধি ও পেশাগত কারণে কুট্টিরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এরা মুসলমান। এদের নিজস্ব বিভিন্ন সামাজিক রীতি—নীতি রয়েছে। এসব রীতি—নীতি জাঁকালোভাবে পালিত হয়। এদের মুখের ভাষা বাংলা হলেও কিছুটা উর্দু মিশ্রিত। এদের কথা বলার ঢং বা উচ্চারণে বিশেষ টান রয়েছে। কুট্টিরা বংশানুক্রমে ঢাকাবাসী এবং নিজেদের পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের অনুসারী।

দিনবদলের পরিপ্রেক্ষিতে কুট্টিদের আবাস ও পেশার পরিবর্তন হয়েছে। সেই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক রীতিরও পরিবর্তন হয়েছে। এখন তাদের ‘কুট্টি’ বললে অপমানিত বোধ করে। দরিদ্র শ্রেণির ঢাকাবাসী, কোচওয়ান ও দোকানদারদের মধ্যে ঢাকাইয়া ভাষা অর্থাত্ ‘কুট্টি’ ভাষার প্রচলন দেখা যায়। তাদের চলনে-বলনে, রঙ্গরসিকতায় এর প্রকাশ ঘটে।

কুট্টিদের সম্পর্কে উদ্ধৃতিগুলোর ভেতর লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রত্যেকটি লেখা বা উদ্ধৃতি একটি থেকে অন্যটি পৃথক কিন্তু তথ্যে পূর্ণ। একটি জাতি বা সম্প্রদায় তো একদিনে যাদুমন্ত্রে গড়ে ওঠে না। দীর্ঘ যাত্রায়, অনেক ত্যাগে, সীমাহীন শ্রমে, অতুলনীয় ত্যাগে, অবর্ণনীয় তিতিক্ষায় এবং গ্রহণ-বর্জনের কঠিন প্রস্তরে গড়ে ওঠে। আজ, এই কালে সেই ধূসর সময়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাকালে কিছুটা অস্পষ্টতা, কিছুটা কুয়াশা, কিছুটা দ্বিধার মেঘ দেখা যেতেই পারে। কিন্তু সমকালীন মানুষদের দায় হচ্ছে, ঐ কুয়াশার চাদর ভেদ করে ইতিহাসের সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও চলমান সময়ের কাছে উপস্থাপন করা। আদি ঢাকার আদি অধিবাসীদের অন্য সম্প্রদায়ের নাম খোসবাস বা সুখবাস বা ছোব্বাছি। ঢাকার এই দুটি ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে উর্দু ভাষার সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় ভাষা দুটির ভাষিক উপাদানে বহুল উপস্থিতি থেকে। ঢাকাই ভাষার উর্দু মিশ্রণের কারণ দিল্লি থেকে আগত মুঘল সৈন্যদের ব্যবহার করা ভাষা। এই দুটি ভাষায় উর্দু ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার ভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়। ‘কুট্টি’ ভাষা গড়ে উঠেছে ‘বাংলা’ এবং ‘উর্দু’ ভাষা— উভয়কে সমানভাবে আশ্রয় করে। অন্যদিকে সুখবাস ভাষা— ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে— উর্দুপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও এতে রয়েছে বাংলা ভাষার উপাদান। অধিকন্তু কুট্টি ভাষার মতো এ ক্ষেত্রেও রয়েছে ফারসি, হিন্দি ভাষার প্রভাব। তারা ঢাকাইয়া বাংলা ভাষায় কথা বলতে সক্ষম। তবে কুট্টিদের মতো তারাও বাংলা বর্ণমালার মহাপ্রাণ ধ্বনি সকল ক্ষেত্রে উচ্চারণ করে না।

এ প্রসঙ্গে আনিস আহমেদ ঢাকাইয়া আসিল গ্রন্থে মুন্সী রহমান আলী তায়েশ বিরচিত তাওয়ারিখে ঢাকা (১৯১০) গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘প্রায় ১০০ বছর ঢাকা ছিল বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা— এই তিন প্রদেশের রাজধানী। এ সময় যত সুবেদার দিল্লি থেকে এখানে এসেছেন, সকলেই দিল্লির সব শ্রেণির লোকজন নিজেদের সাথে নিয়ে এসেছেন। বিদ্বান, কেরানি, যোদ্ধা, কারিগর, শিল্পী, ব্যবসায়ী, দর্জি, স্বর্ণকার, শালকার, আমুদে, রুটি প্রস্তুতকারী, ময়রা সকলেই দিল্লি থেকে এসেছেন। এ শহর বিস্তৃতি, জনবসতি, জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় তখন দিল্লির অনুরূপ ছিল। বড় বড় ধনী ও সম্পদশালী লোকরা এ শহরে ছিলেন। যদিও পরবর্তীতে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ায় এ শহরে জনবসতি হ্রাস পেতে থাকে। তবুও যত লোক এখানে থেকে যান তারা সবাই দিল্লি থেকে আগত লোকদেরই বংশধর। ব্যবসা উপলক্ষে বিদেশিরা দিনে দিনে ঢাকায় আসে ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা আয় করে বিশাল জমিদারি ও ভূ-সম্পত্তি করে ফেলেছেন। মুঘল, গ্রিক, আর্মেনীয়, ইংরেজ, ফরাসি, পর্তুগিজ প্রভৃতি জাতি ঢাকায় বসবাস করে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হন।’

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৬০৮ সালে মতান্তরে ১৬১০ সালে মুঘল সুবাদার ইসলাম খাঁর ঢাকা আগমনের পর হতে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত যতবার সুবাদার ও নায়েব-ই-নাযিমগণ ঢাকা আগমন করেছেন, প্রতিবারই নিয়ে এসেছেন তাদের প্রয়োজনীয় লোকবল। কিন্তু বিদায়ের সময় আগত ঐ সকল লোকজন সকলে দিল্লি বা মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন না করে বিভিন্ন অনিবার্য কারণে ঢাকাতেই অবস্থান করে গেছেন। ফলে উর্দুভাষাভাষী সুখবাস সম্প্রদায় বিস্তৃত ও প্রসারিত হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ে এদের আবাসস্থল ছিল ফুলবাড়িয়া, নাজিরাবাজার, বংশাল, নয়াবাজার, মাহুতটুলি, দেওয়ানবাজার, চকবাজার, বেগমবাজার, সাতরওজা, মৌলভীবাজার, মুঘলটুলি, ইসলামপুর, কলতাবাজার, কসাইটুলি, উর্দু রোড, খাজে দেওয়ান, লালবাগ, নবাবগঞ্জ। এরা মুসলমান। এদের নিজস্ব বিভিন্ন সামাজিক রীতি-নীতি রয়েছে। এসব রীতি-নীতি জাঁকালোভাবে পালিত হয়। বর্তমানে অনেকে ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বসবাস করছে।

মনে রাখা দরকার, সুখবাস ভাষা উর্দুপ্রধান হলেও বিশুদ্ধ উর্দু ভাষা থেকে আলাদা, অন্য রকম। ‘কুট্টি’ বা ‘সুখবাস’ উপভাষা দুটি যেভাবেই গড়ে উঠুক না কেন, দুটি ভাষাই নির্মিত হয়েছে বাংলা এবং উর্দু ভাষাকে কেন্দ্র করে। এই যে একটি শহরকে কেন্দ্র করে ভাষার জন্ম, বিকাশ ও প্রকাশ, সভ্যতার মাপকাঠিতে নতুন
কোনো ঘটনা নয়। 

মোশাররফ হোসেন ভূঞা





Find us on Facebook Nobin Kontho