রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বুঝেছিলেন অন্ধবিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা জাগাতে বিজ্ঞানের চেতনার বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞানবোধের অভাবটি
বুঝতে পারেন না, কিন্তু এ নিদারূণ এক দৈন্য। এই দৈন্য কাজের ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে রেখেছে। এ দৈন্য মানুষকে নিরীহ করে রেখেছে যা তাকে নানা নির্যাতন ভোগে বাধ্য করে রাখে।
রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবনকর্মই মানুষের কল্যাণ সাধনের অভিপ্রায়ে ধাবিত। তবে এই কবি মনীষী কীভাবে এবং কোন ভাবনায় নিজের চেতনায় বিজ্ঞানের ভিত গড়েছিলেন? সেটা বুঝে নিতে আমাদের তাকাতে হবে তার শৈশব জীবনচর্চার দিকে। জীবন সাধক রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিলো না’।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) জীবনকাল উনিশ বিশ শতকে সমভাবে বিস্তৃত ছিল। উনিশের শেষ ভাগে এবং বিশ শতকের প্রথমভাগে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেই ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটে যায়। স্টিম ইঞ্জিন ব্যাপকভাবে চালু হলে পৃথিবীর দূরত্ব ঘুচতে শুরু করে, সভ্যতার বিকাশ দ্রুততর হয়।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের ঠিক আগেই ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ জীববিদ্যার ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে বসে। প্রায় একই সময়ে রসায়ন বিদ্যায় নানা আবিষ্কার, বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, জীবাণুতত্ত্বসহ নানা উদ্ভাবন মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক রূপান্তর ঘটাতে শুরু করে।
রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করার পর শৈশবেই সব নব উদ্ভাবনের কথা জানতে পারলেন। আমরা তো জানিই যে শিশু রবীন্দ্রনাথ নর্মাল স্কুলের মনোযোগী ছাত্র না হয়ে উঠতে পারলেও ঠাকুরবাড়ির পাঠশালায় গৃহশিক্ষকদের রুটিন পাঠের হাত থেকে নিস্তার ছিলো না তার। গণিত, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যায় পাঠ নিতে হতো ঠাকুরবাড়ির কিশোর বালকদের। আর সাহিত্যে পাঠ নিতে হতো মেঘনাদবধকাব্য থেকে।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘জীবনস্মৃতি’তে আমাদের জানিয়েছেন, কঙ্কাল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানবদেহের খুঁটিনাটি শেখাতেন এক পণ্ডিত। আর মানবদেহের বৈজ্ঞানিক পাঠ নিতে মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে লাশকাটার আদ্যোপান্তও দেখতে যেতে হতো ঠাকুরবাড়ির কিশোর বালকদের।
অল্প বয়সে বিজ্ঞানের এসব চর্চায় রবীন্দ্রনাথের কিশোর মন বিরূপ হয়ে ওঠেনি বরং সে সবে বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহের যোগ হয়েছিল তা আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের কথা থেকেই। কবি জানাচ্ছেন, সপ্তাহে একদিন রবিবার ‘সীতানাথ দত্ত (ঘোষ) মহাশয় আসিয়া যন্ত্রতন্ত্রযোগে প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন।… যে রবিবার সকালে তিনি না আসিতেন, সে রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।’ (জীবনস্মৃতি, পৃ-৪১)
আমরা আরো জানতে পারি, পিতার সঙ্গে যখন ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে যেতেন সেটা নিছক পাহাড় দর্শন পর্ব থাকতো না; পাহাড়ে বেড়ানোর প্রতিটি সন্ধ্যা অবলীলায় জ্যোতির্বিদ্যার প্র্যাক্টিকাল সেশন হয়ে উঠত। জ্যোতির্বিদ মহর্ষি দেবেন ঠাকুর পুত্রকে পাহাড়ের চূড়া থেকে সন্ধ্যাবেলায় দূরবীক্ষণ যন্ত্রযোগে নক্ষত্রমণ্ডলীর গ্রহ-নক্ষত্রদের চিনিয়ে দিতেন।
জ্যোতির্বিদ্যার পাশাপাশি পিতার কাছ থেকে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারগুলোর বিষয়েও পাঠ নিতেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। পিতার কাছ থেকে পাওয়া ধারণা নিয়েই তিনি লিখেছিলেন প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’ (১৮৭৩) বারো বছর বয়সে। এই লেখাই পরিবারে বিজ্ঞানের লেখক হিসাবে তাকে প্রতিষ্ঠা দেয়।
যে কারণে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ঠাকুরবাড়ি থেকে শিশু কিশোরদের জন্য ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ সে পত্রিকায় পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূ-বিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান বিষয়ে শিশু কিশোর উপযোগী লেখা দেবার জন্য নিয়মিত লেখক হিসাবে মনোনিত হন। ‘বালক’ পত্রিকায় বালক কবি প্রায় প্রতি সংখ্যায় লিখেছেন।
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাধনা’ নামে পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ সাধনায় প্রাণিবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে বেশ অনেকগুলো লেখা দিয়েছিলেন। নতুন ইংরেজি শিক্ষিতজনেরা তখন বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলায় কিছু কিছু লিখতে শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাদের সে সব রচনা পড়েও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কিছুকালের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের জোর্তিবিজ্ঞানের আগ্রহ প্রাণবিজ্ঞানে সঞ্চারিত হয়েছিল।
বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ক এক প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্রকে চমকে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহবশেই তিনি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের সাহচার্য পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের গবেষণার বিষয় নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’-এ রবীন্দ্রনাথ ‘জড় কি সজীব?’ এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন যেটি ১৯০১ ছাপা হয়েছিল। সেটি পড়ে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু বিস্মিত হয়েছিলেন আর তিনি তার সেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে ,‘তুমি যদি কবি না হইতে তো শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হইতে পারিতে।’
রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হতে চাননি বটে কিন্তু আজীবন বিজ্ঞানচর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানের লোকহিত প্রায়োগিক দিকটি মাথায় রেখেই। তিনি যর্থাথই মনে করতেন বিজ্ঞানের হাত ধরেই পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ক্রম অগ্রগতি তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতেন।
তিনি যখন ১৯২৬ সালে ইউরোপের পথে বেরুলেন, গেলেন জার্মানিতে আইনস্টাইনের সাথে দেখা করতে। আইনস্টাইন তখন তার আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব প্রকাশ করে বিজ্ঞানের জগতে আলোড়ন তুলেছেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের কাছে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা জানতে পারলেন। ফিরে এসে তিনি অনুজ সত্যেন বোসকে খুঁজে বের করলেন এবং তার সাথে বিজ্ঞানচর্চায় যুক্ত হলেন।
৪ বছর পর ১৯৩০ এ আবার তিনি জার্মানিতে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময়ই বেতারযন্ত্র, আকাশ বিজয়, তেজস্ক্রিয়তা, পরমাণুর গড়ন, ইলেকট্রন-প্রোটন, দু’ধরণের তড়িৎকণা, কোয়ান্টামবাদ, জ্যোতিষ্কলোকের রহস্য, জীবাণুতত্ত্ব, বংশগতিবিদ্যা – এসব বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন রবীন্দ্রনাথের মনেও প্রবলভাবে দোলা দিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ তার গোটা জীবনের বিজ্ঞান ভাবনাকে পরিণত বয়সে এসে গ্রন্থিত করার কথা ভাবেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো তিনি ১৯৩৭-এ ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে যে প্রবন্ধ সংকলনটি প্রকাশ করেন সেটি মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। তাহলে কি ভারতের বাইরের বিশ্বকে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের জগৎ বলেই জ্ঞান করেছিলেন? আজকের অধুনা বিশ্ব মানেই বিজ্ঞান সৃষ্ট সভ্যতা সে নিরিখেই সম্ভবত কিশোর রবির চিত্তে অমন প্রণোদনা।
‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের প্রবন্ধের সূচিটি দেখলেই হতবাক হতে হয়। পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, গ্রহলোক, ভূলোক – সহজ বাংলায় বিজ্ঞানের অমন কঠিন বিষয়গুলোর পরিচিতি দিয়েছেন ‘বিশ্বপরিচয়’ নামের গ্রন্থে। রবীন্দ্র অনুধ্যানে আরো বিস্ময় জাগে যে, জীবনের শেষ পর্বে কবি নাকি বৈজ্ঞানিক মায়াবাদ আর নবপ্রাকৃত তত্ত্বে অভিভূত ছিলেন।
কবি মনীষী রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নেয়া শিক্ষিতজনের অত্যাবশ্যক কর্তব্যকর্ম হিসেবেই মনে করতেন। প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাদপদ ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জোট বেঁধে আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য বড় অপশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে নানা উপলক্ষে, যে কোনো আয়োজনে এক বিজ্ঞানপ্রেমী রবীন্দ্রনাথকে উন্মোচন আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।
আফজাল রহমান,
বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ,
আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ