একুশে বইমেলার গোড়ার কথা | শামসুজ্জামান খান

বাংলাদেশে বইমেলার উদ্ভবের ইতিহাস খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। বইমেলার চিন্তাটি এ দেশে প্রথমে মাথায় আসে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি বাংলা একাডেমিতেও একসময় চাকরি করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন, তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই
সংগ্রহ করত। এর মধ্যে একটি বই ছিল ওয়ানডারফুল ওয়ার্ল্ড অব বুকস। এই বইটি পড়তে গিয়ে তিনি হঠাৎ দুটি শব্দ দেখে পুলকিত বোধ করেন। শব্দ দুটি হলো ‘Book’ ও ‘Fair’। কত কিছুর মেলা হয়। কিন্তু বইয়েরও যে মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার-প্রসারের কাজে এই বইমেলা কতটা প্রয়োজনীয়, সেটি তিনি এই বই পড়েই বুঝতে পারেন। ওই বই পড়ার কিছু পরেই তিনি ইউনিসেফের শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি ভাবছিলেন বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। তখন তাঁর মাথায় আসে, আরে প্রদর্শনী কেন? এগুলো নিয়ে তো একটি শিশু গ্রন্থমেলা করা যায়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলার ব্যবস্থা করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়। যতদূর জানা যায়, এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে।

শিশু গ্রন্থমেলা করে সরদার জয়েনউদদীন পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেননি। আরও বড় আয়োজনে গ্রন্থমেলা করার সুযোগ তিনি খুঁজতে থাকেন। সুযোগটি পেয়েও যান। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। সেসব আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম। এই মেলায় তিনি একটি মজার কাণ্ড করেছিলেন। মেলায় যে রকম বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন, উৎসুক দর্শকও এসেছিলেন প্রচুর, বইয়ের বেচাকেনাও মন্দ ছিল না কিন্তু তাদের জন্য ছিল একটি রঙ্গ-তামাশাময় ইঙ্গিতধর্মী বিষয়ও। মেলার ভেতরে একটি গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখা হয়েছিল, ‘আমি বই পড়ি না।’ সরদার জয়েনউদদীনের এই উদ্ভাবনা দর্শকদের শুধু কৌতুকের খোরাকই জোগায়নি, পাঠ-সচেতন ও গ্রন্থমনস্কও করে তুলেছিল বলে অনুমান করি।

এখানেই থেমে থাকেননি সরদার জয়েনউদদীন। ১৯৭২ সালে তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেসকো ওই বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। গ্রন্থমেলার উদ্যোগী সংগঠক সরদার জয়েনউদদীন এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। এই মেলার পেছনেও ইউনেসকোর পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা ছিল। মেলায় অংশ নিয়েছিল ইউনেসকো, ঢাকার কয়েকটি দূতাবাস, ভারতীয় কয়েকজন প্রকাশক এবং ফরাসি দূতাবাসের আমন্ত্রণে এসেছিলেন বিশিষ্ট লেখক, অনুবাদক লোকনাথ ভট্টাচার্য। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা।

১৯৭২ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। তবে বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তাঁর দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা ও বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও এভাবেই তাঁদের বই নিয়ে বসে যান। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন। সে উপলক্ষে নিজামী, চিত্তবাবু, বর্ণমিছিলসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পুব দিকের দেয়াল ঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান। সে বছরই প্রথম বাংলা একাডেমির বইয়েরও বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে একটি স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই বিচ্ছিন্ন বই বিক্রির উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমিতে একটি বইমেলা আয়োজনের জন্য গ্রন্থমনস্ক মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হন। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে। মেলা উপলক্ষে বিপুল বই প্রকাশিত হয়। বলা চলে এই মেলা উপলক্ষ করেই বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এখন অনেক নতুন প্রকাশক এই শিল্পে এসেছেন। পাঠকেরা সংখ্যাও প্রতিবছর বাড়ছে। এই মেলা এক মাস ধরে চলে। পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলাই এত দিন ধরে চলে না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এটি পৃথিবীর দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজিত একটি বইমেলা। এই মেলায় মানুষের আগ্রহ এতই বেশি যে শুধু প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকেও গ্রন্থপ্রেমী বাঙালিরা এতে অংশ নেন। কিন্তু বাংলা একাডেমির ভেতরে অনেক নতুন ভবন এবং অবকাঠামো তৈরি হওয়ার ফলে এখানে আর বইমেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বইমেলার পরিসর বাড়িয়ে এর একটি বড় অংশকে কয়েক বছর ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর ফলে অমর একুশের স্মৃতিবাহী এই মেলাটির ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটল। যে মেলা একুশের মহান ঐতিহ্যকে ধারণ করে এত বিশাল আকার ধারণ করেছে, তা এখন আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের মূল স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এই স্থান থেকেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। এখানেই রয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন। আরও আছে মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল ও স্বাধীনতা-জাদুঘর। তাই এখানে বইমেলা সম্প্রসারিত হওয়ায় বাংলাদেশের বাঙালির জাতিসত্তার উদ্বোধনের স্মৃতিবাহী একুশের ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বাধীনতাসংগ্রামের চেতনা যুক্ত হয়ে মেলাটি এখন নতুন আঙ্গিক, পরিসর ও মাত্রিকতায় স্থিত হলো।

এ বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আরও বিস্তৃত অংশে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও নান্দনিকতায় ঋদ্ধ হয়েছে। সেই সঙ্গে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি ‘সম্প্রীতির জন্য সাহিত্য’ মূল থিম নির্বাচিত করে এক বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এবারের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের মূল আকর্ষণ হলো দেশের ছয়জন বরেণ্য লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন সম্মাননা প্রদান। এতে সম্মাননা জানানো হবে জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, আহমদ রফিক, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে; যা মেলায় যোগ করেছে এক সাংস্কৃতিক নবমাত্রা।

শামসুজ্জামান খান

]