যুদ্ধ অথবা গণহত্যায় মানুষের শরীর এক প্রকার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। মানুষের শরীরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আদর্শ অঙ্কিত হয়, একটি আদর্শের ওপর অন্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের সময় একটি দেশের ভূখন্ডের মতো সেখানে বসবাসকারী মানুষের শরীরের ওপরও যুদ্ধ চলে। ভূখন্ডের মতো সেই মানুষগুলোর শরীরও বিজিত হয় কিংবা আত্মসমর্পণ করে। নারীদের ক্ষেত্রে
ধর্ষণের মাধ্যমে তাদের শরীর এক প্রকার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ২-৪ লক্ষ বাংলাদেশী নারী ধর্ষিত হয়। ১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডায় ৩ মাসের গণহত্যায় ধর্ষিত হয় ১-১.৫ লক্ষ নারী। এভাবে গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যায় সিয়েরা লিওনের ৬০ হাজার (১৯৯১-২০০২), লাইবেরিয়ার ৪০ হাজার (১৯৮৯-২০০৩), সাবেক যুগোশ্লোভিয়ায় ৬০ হাজার (১৯৯২-৯৬) এবং কঙ্গোতে ১৯৯৮ সাল থেকে অন্তত ২ লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছে।
ধর্ষণের মাধ্যমে তাদের শরীর এক প্রকার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ২-৪ লক্ষ বাংলাদেশী নারী ধর্ষিত হয়। ১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডায় ৩ মাসের গণহত্যায় ধর্ষিত হয় ১-১.৫ লক্ষ নারী। এভাবে গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যায় সিয়েরা লিওনের ৬০ হাজার (১৯৯১-২০০২), লাইবেরিয়ার ৪০ হাজার (১৯৮৯-২০০৩), সাবেক যুগোশ্লোভিয়ায় ৬০ হাজার (১৯৯২-৯৬) এবং কঙ্গোতে ১৯৯৮ সাল থেকে অন্তত ২ লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছে।
সময়ের শুরু থেকে সহিংস কিংবা সংঘাতপূর্ণ কোন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নারীদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। বিভিন্ন সাহিত্যেও নারীদেরকে পুরুষের জন্য় পুরস্কার হিসেবে দেখানোর একটি দৃষ্টিভঙ্গি বহুকাল ধরে চলে আসছে যা এখনো বিদ্যমান। একটি যুদ্ধে নানা কারণে সাধারণ মানুষ মারা যায়। কিন্তু একটি যুদ্ধকে গণহত্যা বলা হয় তখনি এর মূল লক্ষ্য যখন থাকে একটি নির্দিষ্ট বর্ণ, জাতি অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া। যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ গণহত্যার একটি অন্যতম হাতিয়ার।
মার্কিন নারীবাদী লেখিকা ও আইনজীবী ক্যাথরিন ম্যাককিনন তার বই ""Are Women Human?" এ গণহত্যাকে যুদ্ধ থেকে আলাদা করে এমন চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। প্রথমত, একটি গণহত্যায় হানাদারদের মূল লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে ধ্বংস করে ফেলা। এর অর্থ সে গোষ্ঠীর সবাইকে হত্যা করা নয়। হানাদাররা তাই ওই গোষ্ঠীর ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের পাশাপাশি এমন অবস্থা তৈরি করে যা সে গোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবনযাপনকে স্থবির করে ফেলে। দ্বিতীয়ত, একটি গণহত্যা সকল ক্ষেত্রে একপক্ষীয় হয়। যুদ্ধের ক্ষেত্রে যোদ্ধারা (সামরিক বা বেসামরিক) আক্রমণ অথবা পশ্চাদপসরণ করে যার মূল লক্ষ থাকে একটি অঞ্চলের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু গণহত্যায় সুসজ্জিত সামরিক যোদ্ধারা আক্রমণ করে নিরস্র সাধারণ মানুষের ওপর। তৃতীয়ত, যুদ্ধের সময় ধর্ষণের মূল লক্ষ্য ধর্ষকের পরিচয় সম্পর্কে ধর্ষিতা বা তার গোষ্ঠীকে অবগত করা নয়। কিন্তু গণহত্যায় একজন ধর্ষক ধর্ষণের মাধ্যমে ধর্ষিতা নারী ও তার গোষ্ঠীকে একটি বার্তা দিয়ে যায় যে কারা এবং কেন এটি করেছে। চতুর্থত, যুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। গণহত্যায় ধর্ষণ থাকে নিয়ন্ত্রিত যার মাত্রা প্রয়োজনে বাড়ানো কিংবা কমানো হয়। গণহত্যায় দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয় যা একটি নিয়মতান্ত্রিক সামরিক আদেশের অংশ হিসেবে বিবেচিত ও পালিত হয়। ধর্ষক পুরুষেরা এ সময় স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে নয় বরং একটি গোষ্ঠিী, ধর্ম, বর্ণ অথবা জাতীয়তার সদস্য হিসেবে ধর্ষণ করে।
গণহত্যার ক্ষেত্রে ধর্ষণের মূল লক্ষ্য শুধুমাত্র ভয় প্রদর্শন বা ধর্ষকের তৃপ্তিলাভ নয়। এর মূল লক্ষ্য হলো জাতিগত নিধন। গণহত্যায় ধর্ষণ তাই সবচেয়ে কার্যকরী অস্র। যুদ্ধের সাথে ধর্ষণের সম্পর্ক পরোক্ষ হলেও গণহত্যার অন্যতম একটি অংশই হলো ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা রোয়ান্ডার গণহত্যায় ধর্ষণ সেই ধ্বংসকরণের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। মায়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর হওয়ার পূর্বে ২০১১ সালে অং সান সুচি একটি ভিডিও বার্তায় ধর্ষণ সম্পর্কে বলেন, "এটি সেনাবাহিনীর একটি অস্র যা তারা একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে ভীতি প্রদর্শনে ও আমাদের দেশকে বিভক্ত করতে ব্যবহার করছে। আমি এটাকে এভাবেই দেখি।" কিন্তু রোহিঙ্গারা মায়ানমারের জাতিগত কোন গোষ্ঠী নয়, মায়ানমারে কোন গণহত্যা চলছে না, জাতিগত নিধন শব্দটি খুবই শক্তিশালী, আরাকানে কি হচ্ছে তা জানার জন্য আরো অনুসন্ধান প্রয়োজন ইত্যাদি নিয়ে বিশ্ববাসী যতোদিন ব্যস্ত থাকবে ততোদিন পর্যন্ত মায়ানমারে মানুষের শরীর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে থাকবে এবং বিপন্ন হয়ে হারতে থাকবে মানবতা।
ফাহিম আহমেদ, শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Find Nobin Kontho on Facebook