মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৬

চমকপ্রদ কহিনূর হীরা

ইতিহাস সমৃদ্ধ এক রত্ন। হীরা। তার নাম কহিনূর। এটি ডিম্বাকৃতির শ্বেত হীরা। বর্তমান ওজন ১০৫ ক্যারেট (২১.৬ গ্রাম) বা ৩১৯ রতি। প্রাথমিকভাবে ওজন ছিল ৭৫৬ ক্যারেট। শাহজাহানের রাজদরবারে কোহিনূরের ওজন পরীক্ষা করা হয়। ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী তাভারনিয়ার যাচাই করে
দেখেন যে, তার ওজন ২৬৮ ক্যারেটের সামান্য বেশি। ভেনিসের হীরক কর্তনকারী হরটেনসিও জর্জিস প্রথম অদক্ষ হাতে এ হীরা কেটে ফেলেন। এত বড় সর্বনাশ করায় সম্রাট শাহজাহান তাকে ১০ হাজার রুপি জরিমানা করেন। কোহিনূর কখনো ক্রয়-বিক্রয় করা হয়নি। এতে ৩৩টি পার্শ্ব রয়েছে। বিভিন্ন সময় হীরাটি হিন্দু, পার্সি, মোগল, তুর্কি, আফগান, শিখ এবং ব্রিটিশ শাসকদের অধিকারে ছিল। স্যার ওলফের মতে, কোহিনূর মোগলদের অধিকারে ছিল ২১৩ বছর, আফগানদের অধিকারে ছিল ৬৬ বছর এবং ২০১১ সাল নাগাদ ব্রিটেনের অধিকারে ১২৭ বছর। এ হীরা দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার হিন্দু অধ্যুষিত সন্তোষনগর অঞ্চলে কল্লর গ্রামে কল্লুর খনি থেকে উত্তোলন করা হয়। একইসঙ্গে কোহিনূরের যমজ দরিয়া-ই-নূর-ও উত্তোলন করা হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, অর্জুনের বাহুতে এ হীরাটি শোভা পেত। তবে অন্যরা ঐতিহাসিক ভাষ্যকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশের কর্নুল ও অনন্তপুর জেলা হীরক খনির জন্য খ্যাতি লাভ করায় সেখানে এ ধরনের হীরা প্রাপ্তি অসম্ভব কিছু ছিল না। পরবর্তীতে মালবের রাজপরিবারের কাছে কয়েক প্রজন্ম হীরাটি সংরক্ষিত ছিল। তবে কহিনূর হীরা নিয়ে সবেচেয়ে বেশি আলোচিত মোগল সাম্রাজ্য। মোগল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য হিসেবে এটা উপমহাদেশের মানুষের কাছে একটি পরিচিত নাম। কোহিনূর শব্দটি মূলত ফার্সি শব্দ কোহ-ই-নুর থেকে এসেছে। যার অর্থ পর্বতের আলো। অনেকে বলেন, কোহিনূর, কাকাতিয়া রাজবংশের অধিষ্ঠিত দেবীমন্দিরে দেবীর চোখ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যখন যে হীরাটির মালিকের ওপর জয়ী হয়েছে, হীরা তার দখলে চলে গিয়েছে। বর্তমানে হীরাটি ব্রিটিশ রাজসম্পত্তির একটি অংশ হিসেবে গণ্য। এরপূর্বে মোগল সম্রাটদের গৌরবের বিষয় ছিল কোহিনুর। মোগলরাই এর নামকরণ কোহিনূর করে। ১৪ শতকের প্রথম দিকে তুর্কি রাজবংশের সেনারা অপহরণ ও লুটতরাজের জন্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। ১৩১০ সালে আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মালিক কফুর, ওয়ারঙ্গলে একটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন। কাকাতিয়া রাজ্য ও অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয় রাজপ্রাসাদ ও মন্দিরগুলো লুট করা হয়। যার মধ্যে কোহিনূরও ছিল। এরপর হীরাটি তুর্কি রাজবংশের কাছেই ছিল। এরপর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হতে হতে এটা দিল্লির সুলতানদের অধিকারে আসে। কিন্তু ১৫২৬ সালে তুর্কি-মোগল যুদ্ধে তুর্কিরা পরাজিত হয়। জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ভারতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় হীরাটি বাবরের দখলে চলে আসে। বাবর ও তার পুত্র সম্রাট হুমায়ুন দুজনেই এটিকে ‘বাবরের হীরা’ বলে পরিচিত করিয়েছেন। পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহানের হাতে আসার আগ পর্যন্ত হীরাটি মোগল তোষাখানায় পড়ে ছিল। সম্রাট শাহজাহান, তার সুসজ্জিত ময়ূর সিংহাসনে হীরাটি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিলে কোহিনূরসহ ময়ূর সিংহাসন তাদের দখলে চলে যায়। কোম্পানি হীরাটি রানীকে ভেট হিসেবে প্রদান করে।

ব্রিটিশরা যেভাবে কোহিনূর চুরি করেছিল
রত্নালঙ্কার চুরি নতুন নয়। তবে কহিনূর হীরা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অতিকায় এই হীরার দিকে নজর ছিল শাসকদের। তাই যুদ্ধজয় বা সিংহাসন পরিবর্তনের সঙ্গে কহিনূরের মালিকানা পরিবর্তন ছিল উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে চুরি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোহিনূর হীরা এখন ব্রিটিশ রাজপরিবারের অলঙ্কার ভাণ্ডারের অংশ। এই কোহিনূরের দাম প্রায় ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা। সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি ছিল তার ময়ূর সিংহাসনে। ময়ূর সিংহাসনে খোচিত থাকা কোহিনূর হীরাটি ব্রিটিশরা চুরি করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ দখল করে নেওয়ার পর সরিয়ে ফেলে কোহিনূর। ময়ূর সিংহাসন থেকে এটি চুরি করে ব্রিটিশরা। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে কোহিনূর চুরি করেছে এ নিয়ে বহু বছর ধরেই অভিযোগ রয়েছে। এই হীরার আসল মালিকানা শুধু ভারত নয়, আফগানিস্তান, ইরানও দাবি করেছে। তে ব্রিটিশদের চুরি করে নিয়ে যাওয়া সেই কোহিনূর ভারতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বারবার। তবে সববারেই সেটি ব্যর্থ হয়েছে। কোহিনূর শোভিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ‘হীরার মুকুট’ ফিরিয়ে আনতে ‘মাউন্টেন অব লাইট’ নামক একটি দল ইতিমধ্যেই লন্ডন হাইকোর্টে মামলা দায়েরের জন্য আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল। মাউন্টেন অব লাইটের পক্ষের আইনজীবী দলটির দাবি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১০৫ ক্যারেট হীরার ওই কোহিনূরটি চুরি করে নিয়ে যায় ব্রিটিশ শাসকরা। এ কারণে তারা যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে ওই কোহিনূরটি ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। তবে সেই দাবি ধোপে টেকেনি। যুক্তরাজ্য কোহিনূর হীরা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়নি।