মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭

নাজমুল করিম : একজন সমাজবিজ্ঞানী ও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি | সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রয়াত এ. কে. নাজমুল করিম সমাজবিজ্ঞানের অত্যন্ত সফল এবং পথপ্রদর্শক অধ্যাপক ছিলেন; কিন্তু অধ্যাপনার জীবন শুরু করার আগে থেকেই সমাজ বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল, যার প্রমাণ আছে ছাত্রজীবনে লেখা তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য তখন কোনো স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল না, তিনি ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু তিনি জানতেন যে রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রোথিত থাকে সমাজে, এবং রাষ্ট্রকে চিনতে হলে সমাজকে বোঝা অত্যাবশ্যক। তাঁর সমাজবিশ্লেষণ ভাববাদী ছিল না, ছিল বৈজ্ঞানিক।

সমাজবিশ্লেষণে আগ্রহকে তিনি তাঁর ছাত্র, সহকর্মী ও পাঠকদের ভেতর অনায়াসে ও ফলপ্রসূ রূপে সঞ্চারিত করেছেন। প্রভাবিতদের ভেতর আমি নিজেও একজন। আমার ক্ষেত্রে প্রভাবের সূত্রপাত ঘটে তাঁর ‘ভূগোল ও ভগবান’ প্রবন্ধটি পড়ার ভেতর দিয়ে। মনে পড়ে তখন আমি ক্লাস টেনের ছাত্র; পড়তে ভালোবাসতাম, পড়বার মতো রচনা খুঁজতাম এবং যা পেতাম গোগ্রাসে গিলতাম।
আবুল হাসনাত রোডের যে বাসায় নাজমুল করিম থাকতেন, আমাদের বাসা ছিল তার কাছেই। ও-বাসায় যাতায়াত ছিল আমার এক সমবয়সী বন্ধুর, তার হাতেই একদিন দেখি একটি পত্রিকা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী। পত্রিকায় অনেকগুলো লেখা ছিল, যেমনটা থাকে, থাকবার কথা; কিন্তু সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল আমাকে নাজমুল করিমের লেখাটি, সেই ‘ভূগোল ও ভগবান’ প্রবন্ধ। কালটি ছিল পাকিস্তানি ধুমধাড়াক্কার। তখন আমাদের নিয়মিত পাঠ্যের মধ্যে ছিল সরকারি মাহেনও পত্রিকা, আর ছিল দিলরুবা, মোহাম্মদী, তাহজীব, ইমরোজ ইত্যাদি। ধাঁচ সর্বত্রই এক রকমের, ইতরবিশেষ কেবল মাত্রার। সর্বত্র তখন আরো বেশি পাকিস্তানি হবার চেষ্টা, আর প্রতিযোগিতা ওইখানেই, ওই চেষ্টাতেই। তখন আমরা হাজার বছরের পাকিস্তানি ঐতিহ্য সম্বন্ধে শুনি, কায়েদে আজমকে মনে করি পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ নেতা, ইকবালকে জানি অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি হিসেবে। তারই মাঝে এই প্রবন্ধ- ‘ভূগোল ও ভগবান’।
লেখাটি আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। এ. কে. নাজমুল করিম স্মারক গ্রন্থে এটি আছে। হাতে পেয়ে দ্বিতীয়বার পড়লাম। ভয় ছিল হয়তো আগের মতো ভালো লাগবে না। কিন্তু এতদিন পরেও যতটা ভালো লাগলো তা সামান্য নয়। এর বক্তব্য এখন আর অভিনব শোনায় না; কিন্তু সেই সময়ে, ১৯৪৬-এ, যখন তিনি লেখেন ওই প্রবন্ধ (আমি পড়েছি পরে, ১৯৪৯-এ)- তখন তা কেবল নতুন ছিল না, ছিল অত্যন্ত সাহসী। তখন ওভাবে চিন্তা করবার মতো লোক খুব কম ছিল আমাদের সমাজে, আজও যে খুব বেশি আছে তা নয়। কিন্তু কেবল বক্তব্য নয়, প্রবন্ধটির ভাষাও আকর্ষণ করে। উত্তেজনা নেই, উত্তেজনার প্রয়োজনও নেই, যুক্তি নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট।
এক ধরনের প্রসন্নতা আছে তার লেখায়, যা লেখার আবেদন বৃদ্ধি করে। কিন্তু সবচেয়ে প্রধান সত্য লেখকের দৃষ্টির স্বচ্ছতা। তাঁর বাল্যবন্ধু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু উপন্যাসে সামন্তবাদী সমাজ ও চিন্তাধারাকে আঘাত করেছেন, তিনিও ভিন্নভাবে সেই কাজটিই যেন করতে চেয়েছিলেন।
এই লেখা পড়ার পর আগ্রহী হয়ে পড়েছিলাম আমি তাঁর অন্য লেখার ব্যাপারেও। বয়সটা ছিল বীর-সৃষ্টির, সেই আমার কাছাকাছি বাসার অধ্যাপক ভদ্রলোক বীর হয়ে উঠেছিলেন আমার চোখে। না, তাঁর অনেক লেখা আমি পাইনি। কোনো কোনো ঈদ সংখ্যায় বুঝি-বা লিখেছিলেন, পেলেই আমি পড়েছি। একটা লেখা আমার তখন পড়া হয়নি, এবারও পড়া হলো না, স্মারকগ্রন্থেও সেটি নেই বলে। এর সন্ধান দিয়েছেন সরদার ফজলুল করিম- তাঁর লেখা স্মৃতিচারণে, যেটি এই স্মারকগ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। যতদূর মনে পড়ে, সরদার ফজলুল করিমের লেখাও আমি সর্বপ্রথম ওই পত্রিকাতেই পড়ি, ওই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকীতে। ‘অবকাশ ও সভ্যতা’ নামে যে প্রবন্ধটির কথা সরদার ফজলুল করিম উল্লেখ করেছেন তাঁর স্মৃতিচারণে, স্মারকগ্রন্থের সম্পাদনা পরিষদ হয়তো সেটি সংগ্রহ করতে পারেননি, কিন্তু সরদার ভাইয়ের বিবরণ পড়ে মনে হলো এটাও একটি বাঁচিয়ে রাখার মতো লেখা বটে। ওই প্রবন্ধে নাজমুল করিম লিখেছিলেন, বুর্জোয়া বলবে, শোষণনীতি তুলে দিলে সবাইকে পেটের জন্য কাজ করতে হবে, তাই তার জ্ঞান সাধনার সুযোগ থাকবে না। ভবিষ্যতের সমাজকে এভাবে চিত্রিত করে বুর্জোয়া আমাদের ভীত করে তুলেছে। বিজ্ঞানের বর্তমানে যা উৎকর্ষ হয়েছে, তাতে মানুষ মানুষকে যদি শোষণ না করে, তার পরিবর্তে বিজ্ঞানের পূর্ণ প্রয়োগ করে প্রকৃতিকে যদি মানুষের দাসে পরিণত করা যায় এবং সমগ্র দুনিয়ার মানুষ যদি অবকাশভোগীতে পরিণত হয় তবুও দুনিয়ার বর্তমান লোকসংখ্যার আটগুণ বেশি লোক বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে আরো শত-গুণ এগিয়ে দিতে পারে।
এই রকমের আশার কথা কেবল তাঁর পক্ষেই ব্যক্ত করা সম্ভবপর যাঁর আছে বৈজ্ঞানিক ও বস্তুবাদী দৃষ্টিশক্তি। সেই অল্প বয়সে এবং বৈরী পরিবেশে এ দৃষ্টিশক্তি যে তাঁর আয়ত্তে এসে গিয়েছিল সেটা উপেক্ষা করার বিষয় নয়। স্মারকগ্রন্থে ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’ ও ‘ধর্মের বিবর্তন ও মার্কসবাদ’ নামে আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।
প্রবন্ধগুলো সেই সময়ে লেখা যখন পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন চলছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও অনেক প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, বাংলায় লিখেছেন, ইংরেজিতে লিখেছেন, ইংরেজিতে তাঁর মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ আছে। তাঁর এই লেখাগুলো উপকারী, এতে গবেষণা আছে প্রচুর, চিন্তাশক্তিটি স্বচ্ছ। তিনি ভাববাদী হয়ে পড়েননি, বস্তুবাদিতা ও বৈজ্ঞানিকতা পরিহার করেননি, উৎপাদন ব্যবস্থা ও ভৌগোলিক অবস্থানই সংস্কৃতির নিয়ামক বলে যে মতো একদা ব্যক্ত করেছিলেন তা থেকে সরে দাঁড়াননি, যেমনটা কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে। তবে যে-পরিমাণে লিখলে আমরা খুশি হতাম সে-পরিমাণে লেখেননি। আমাদের সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির জন্য তাঁর লেখা খুবই প্রয়োজন ছিল। কেননা একদিকে আছে আমাদের দুঃখজনক দার্শনিক দারিদ্র্য, অন্যদিকে রয়েছে লেখার মতো লোকের মর্মান্তিক অভাব। অর্থহীন লেখা প্রচুর পাওয়া যায়, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ লেখার ভীষণ দুর্ভিক্ষ। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা ছিল অনেক বড়।
এই যে প্রচুর পরিমাণে না-লেখা তার একটা কারণ অবশ্যই রচনার মান সম্পর্কে তাঁর আপসহীন মনোভাব। তিনি ভেবে চিন্তে লিখতেন। এ ব্যাপারেও তাঁর সঙ্গে মিল দেখি তাঁর বন্ধু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। তবে রাজনৈতিক ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞাও কম জোরদার ছিল না। চিন্তা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ইংরেজ আমলে যতটুকু ছিল পাকিস্তানি আমলে সে-টুকুতেও টান পড়েছিল। ইংরেজরা ছিল বুর্জোয়া, পাকিস্তানিরা সামন্তবাদী। তার চেয়েও বড় কথা ইংরেজরা কিছুটা দূরে ছিল, দূরে থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কী ঘটছে তা কিছুটা উপেক্ষা করতে পারতো, পাকিস্তানিরা ছিল একেবারে ঘাড়ের ওপর, তারা ভিন্ন মত দেখলেই লাফিয়ে পড়তে চাইতো। তদুপরি তাদের ছিল নিজেদের ওপর আস্থার অভাব, তাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে তারা ভয় করতো। এই যে নিশ্চুপীকরণ প্রক্রিয়া পাকিস্তানিদের, এর শিকার অনেকে হয়েছেন, কিছু পরিমাণে নাজমুল করিমও হয়ে থাকবেন।
কিন্তু তবু এরই মধ্যে তিনি তাঁর নিজের বিশেষ এলাকা যে সমাজবিজ্ঞান সেখানে সেইসব বস্তুর প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন যেগুলোর ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদীদের বিশেষ আগ্রহ থাকবার কথা। তাঁর ভয় ছিল পাছে সমাজবিজ্ঞান পাঠ ব্যবহৃত হয় কায়েমী স্বার্থকে আরো বেশি কায়েমী করে দিতে, মানুষকে বিভ্রান্ত, হয়তো উদ্ভ্রান্ত করে ছাড়তে। তিনি বলেছেন, সমাজবিজ্ঞান বিজ্ঞান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখনি যখন ইউরোপে সমাজ বিপ্লবের নানাবিধ লক্ষণ পরিস্ফূট হয়ে উঠছিল, কিন্তু তাই বলে সমাজবিজ্ঞান বৈপ্লবিক বিজ্ঞান নয়, বরঞ্চ রক্ষণশীলই সে, চরিত্রের দিক থেকে। সন্দেহ কী তিনি সমাজবিজ্ঞানের সেই ধারার সম্পর্কেই বলছিলেন যেটিকে পুঁজিবাদী জগতের বিশেষজ্ঞরা এদেশে প্রবর্তনে উৎসাহী ছিলেন। সমাজবিজ্ঞানের বৈপ্লবিক পাঠের বিষয়ে জানা ছিল তাঁর, কিন্তু সে-বিষয়ে বলবার অবকাশ ছিল না।
সমাজবিজ্ঞান নৃতাত্ত্বিক কৌশল, পরিসংখ্যান ও প্রয়োগবাদের নির্বিচার ব্যবহারের বিরুদ্ধে বলেছেন তিনি, কেননা তিনি জানতেন এই তিন বস্তু কেমন করে মানুষকে তার বস্তুগত অবস্থান থেকে সরিয়ে এনে তাকে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের বিষয়বস্তুতে পরিণত করতে পারে। মানুষ তো বস্তু নয়, তার চেতনা আছে, তার নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস আছে। মানুষ তো নিছক প্রাণী নয়, তার জীবন্ত সংস্কৃতি আছে, শ্রেণিগত অবস্থান রয়ে গেছে। পরিসংখ্যান সংখ্যা দেয়, কিন্তু ওজন দেয় না। ওজন করতে হলে দর্শন দরকার। দর্শন হচ্ছে ওজনের বাটখারা। প্রয়োগবাদ তথ্য দেয়, তত্ত্বকে ঢেকে দিয়ে। অধ্যাপক নাজমুল করিমকে তাই বারবার বলতে দেখি যে, সমাজবিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নয়, মানবিক বিজ্ঞান বটে। যাঁরা ভাবেন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো করে সমাজবিজ্ঞানের অনুশীলন করবেন তাঁরা অবশ্যই ভ্রান্তÑ তাঁর মতে। সমাজবিজ্ঞানের জন্য দর্শন চাই, দৃষ্টিভঙ্গি চাই। যদি স্পষ্ট করে বলে দিতেন যে, এই দৃষ্টিভঙ্গির হওয়া আবশ্যক বস্তুবাদী তা হলে আমাদের লাভ হতো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা বলা তো পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের যুগে সম্ভব ছিল না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ সোসিওলজি এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত ভাষণে একটি জরুরি প্রশ্ন তিনি তুলে ধরেন। সেটি হলো পশ্চিম যে এগিয়ে গেলো এবং পূর্ব পিছিয়ে রইলো তার কারণটা কী? অতীতে বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে ধর্মপ্রচারকে ও সন্তদের আবির্ভাব ঘটেছে, তাঁরা ধর্ম ও জগৎ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণী প্রচার করেছেন, কিন্তু তাঁদের চিন্তাধারা যে সমাজের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত ভিত তৈরি করতে পারলো না তার ব্যাখ্যাটা কী?
এ প্রশ্নের জবাবও তিনি দিয়েছেন। সেটি এই রকমের ¾ The concern of Greek philosophy was the examination of the relations between the individual and nature. The concern of Chinese philosophy was to find proper relation between the individual and his neighbour; while the concern of Indian philosophy was to examine the relationship between the individual and the self.
পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর এই পার্থক্যকরণের যথার্থতা বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। গ্রীক, চৈনিক ও ভারতীয় দর্শনের পার্থক্যের রূপরেখাটি এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট। গ্রীকদের সাধনা ছিল প্রকৃতিকে জানবার, চৈনিকরা জানতে চেয়েছে প্রতিবেশীকে, ভারতীয়তা নিজেকে। হ্যাঁ, এখানে সাধারণীকরণ আছে। যে কোনো দেশেই দর্শনের চর্চা যে একরৈখিক হয় না, সেখানে যে ব্যতিক্রম থাকে এটা নিশ্চয়ই সত্য। সকল গ্রীক দার্শনিকই যে এক ভাবে চিন্তা করেছেন তা নয়; চৈনিকদের চিন্তাধারাতেও নিশ্চয়ই বিভিন্নতা ছিল, এবং ভারতীয় দার্শনিকদের ভেতর কেবল যে আত্মনিমগ্ন ভাববাদীরাই ছিলেন তা নয়, বস্তুবাদীরাও ছিলেন বলে আমরা জানি। কিন্তু দর্শনচর্চার তিনটি মূল ধারার বৈশিষ্ট্য অধ্যাপক করিমের বক্তব্যে যে-ভাবে উঠে এসেছে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
তিনি দেখতে পেয়েছেন যে, গ্রীকদের দর্শনচর্চা পাশ্চাত্য চিন্তাধারার ভিত্তি তৈরিতে সাহায্য করেছে। বস্তুজগৎ সম্পর্কে গ্রীসের কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসাকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিম বিলক্ষণ এগিয়ে গেছে। অন্যদিকে চীন এবং ভারতবর্ষ মানবজীবনের জটিল সম্পর্ক সম্বন্ধে ভেবেছে ঠিকই, কিন্তু জাগতিক উন্নতির ব্যাপারে মনোযোগ দেয়নি। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, পশ্চিম এগিয়ে গেল, পূর্ব পারল না। তাঁর ব্যাখ্যাটা এই রকমের। ‘পশ্চিম আজ পূর্বের কাজে হাজির হয়েছে জাগতিক অগ্রগতির বাণী নিয়ে’Ñ তিনি মন্তব্য করেছেন। তাঁর নিজের পক্ষপাত যে পূর্বের প্রতি নয়, পশ্চিমের দার্শনিকতার প্রতিই সে-ইঙ্গিত ওই বিশ্লেষণের ভেতরেই রয়েছে।
এটাও অনুমান করা মোটেই অসঙ্গত নয় যে, দর্শনচর্চার তিন ধারার ব্যাপারে ভারতবর্ষের আত্মনিমগ্নতা তাঁর কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। চীন যে ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্ক নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছে, এর প্রতি তাঁর সমর্থন থাকবার কথা। কেননা নিজে তিনি সমাজবিজ্ঞানী, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কই তাঁর অধ্যয়নের বিষয়। ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে আত্মনিমগ্ন থাকবে, এবং নিজেকে জানা হলেই জগৎকে জানা হয়ে গেছে বলে ধরে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকবে, এই মনোভাব তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাঁর নিজের ভেতরও আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল না, থাকলে তিনি শিক্ষকতায় আসতেন না, হয়তো আমলা হতেন; সমাজবিজ্ঞানকে বেছে নিতেন না অধ্যয়নের বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে, এবং তাঁর অসংখ্য ছাত্র ও পাঠকের ওপর অমন প্রভাব রেখে যেতে পারতেন না যেমনটা তিনি রেখে গেছেন।
অধ্যাপক করিমের আমি সরাসরি ছাত্র ছিলাম না, যেমন আমার বন্ধুরা কেউ কেউ ছিল। তাদের কাছে শুনেছি সমাজ ও সংস্কৃতিকে তিনি যেভাবে বিশ্লেষণ করতেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িত অন্য কোনো শিক্ষক তাঁর কালে তা করেননি। সেই বিশ্লেষণ তিনি আরো স্পষ্ট, আরো ব্যাপকভাবে যে তাঁর লেখায় আনেননি, অন্য কথায় ‘ভূগোল ও ভগবান’ যে তিনি আরো বিস্তৃত করে লেখেননি, লালসালুর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ঔপন্যাসিক কাজটি তিনি যে প্রবন্ধের মধ্য আরো প্রবলভাবে সম্পন্ন করলেন না, এ নিয়ে দুঃখ করা অর্থহীন। তিনি যা করেছেন তা অসামান্য; তাঁকে আমরা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবো।
২.
অধ্যাপক নাজমুল করিম বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন সমাজের শ্রেণিবিভাজন সম্পর্কে। বলা যায় সমাজ বলতে যে অখণ্ড ও আভিজাত্য কোনো সত্তাকে বোঝায় না, সমাজ যে বিবদমান বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত সেই উপলব্ধিটা ছিল তাঁর বিবেচনায় কেন্দ্রীয় সত্য। আমরা দেখেছি তিনি বিশেষভাবে লক্ষ করেছেন অভিজাত ও মধ্যবিত্তের গঠন, অবস্থান ও বিবর্তনকে। তাঁর গবেষণায় মেহনতি মানুষের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য নয়। এর ব্যাখ্যা তাঁর নিজের লেখাতেই রয়েছে। নাজমুল করিমের প্রথম জীবনে লেখা একটি প্রবন্ধের নাম ‘মুসলিম অভিজাত ও মধ্যবিত্ত’। সেখানে তিনি বলছেন, প্রবন্ধটি কেবল জমিদার, মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ী শ্রেণির উত্থান পতনের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকবে, কারণ যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এদের হাতেই সমাজের নেতৃত্ব বর্তাচ্ছে। কৃষক, মজুর, তাঁতি, জোলা এ ধরনের অসংখ্য শ্রমিক মজুরই মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশ; কিন্তু সমাজের নেতৃত্ব তাদের হাতে নয়। সমাজের স্বরূপ বুঝতে হলে নেতৃশ্রেণির প্রকৃতি ও গঠন প্রথমে বোঝা প্রয়োজন, তাই এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধে নেতৃশ্রেণিদেরকে নিয়েই আলোচনা করব।
নেতৃত্ব রয়েছে কতিপয়ের হাতে, যারা ধনী, এবং ধনী বলেই নেতা। এই নেতারাই সমাজকে শাসন অর্থাৎ শোষণ করে, এবং ধনোপার্জনের ক্ষেত্রে তাদের যে আদর্শ সেটা মেহনতি মানুষের জন্য শিরোধার্য হয়ে পড়ে। সবার আগে তাই নেতাদেরকে দেখা দরকার। সেখানে কারা আছে, কী তাদের স্বভাব-চরিত্র, কেমন তাদের ন্যায়-অন্যায়ের বোধ সে-সব জানলেই তাদের হাতে পীড়িত মানুষদের অবস্থাটা বোঝা যাবে, মুখ দেখলেই যেমন শরীরের স্বাস্থ্য টের পাওয়া যায়।
প্রবন্ধটি যখন লেখা হয় তখন পাকিস্তানের সদ্য প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। চতুর্দিকে লম্ফঝম্ফ চলছে। রাষ্ট্র হবে ইসলামি, শাসন চলবে ইসলামসম্মত উপায়ে, এসব কথা তুমুল শব্দে শোনা যাচ্ছে। রাষ্ট্রনেতারা তো বলছেনই, বুদ্ধিজীবীরা আওয়াজ তুলছেন আরো জোরে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় অবস্থা। সেই রকমের একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে নাজমুল করিম তাঁর প্রবন্ধটির উপসংহারে পৌঁছেছেন এভাবে-
আমাদের সমাজের সংগঠন ও প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত বলতে পারি যে আমাদের সামাজিক আদর্শ মোটামুটি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র মুখীন। ইসলামের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ এ ধরনের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে সহায়তা করবে এতে আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে।
এখানে ইসলামের সাম্য মৈত্রীর আদর্শের উল্লেখ আছে, কেননা আশার একটা ভিত্তিভূমি প্রয়োজন ছিল। তদুপরি ইসলামের দোহাই না দিলে বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতো না। কিন্তু আসল ব্যাপার গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে লেখকের আস্থা। তখনকার দিনের বুদ্ধিজীবীদের মুখে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা কান পেতেও শোনা যেত না। অধিকাংশই ছিলেন এসব বিষয়ে হয় উদাসীন, নয়তো জ্ঞানপাপী। যাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে চিন্তা করতেন তাঁদের ভেতর অনেকেই ছিলেন রক্ষণশীল; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতর রক্ষণশীলরা সংখ্যায় ছিল বেশি। সরব ছিলেন তাঁরাই।
অধ্যাপক করিম যে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা একই সঙ্গে বলছেন সেটাও তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন, যাঁদেরকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, তাঁদের ভেতর কেউ যে সমাজতন্ত্রী ছিলেন এমনটা আমরা শুনিনি। উল্টো বরঞ্চ জানা আছে আমাদের যে তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন এপাশ ওপাশের জাতীয়তাবাদী। যাঁরা কিছুটা অগ্রসরমনস্ক ছিলেন, তাঁরা ছিলেন উদারনৈতিক। এঁরা গণতন্ত্র বলতে পুুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনস্থ সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বড়জোর নিপীড়নহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝতেন। সত্য এটাও যে সাম্প্রদায়িক বৈরিতার কারণে এমনকি উদারনীতিক অধ্যাপকেরাও পাকিস্তানে থাকা নিরাপদ মনে করেননি। দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তখনকার পত্রপত্রিকায় এবং বুদ্ধিজীবী মহলে জোর প্রচারণা ছিল এই রকমের যে, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র এক সঙ্গে যায় না, কেননা গণতন্ত্রের ভিত্তিই যেখানে ব্যক্তির অধিকার সেখানে সমাজতন্ত্র তো চায় ওই অধিকার কেড়ে নিয়ে সকল মানুষকে সমান করে দিতে। কী মারাত্মক কথা! সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বত্র জোর ধ্বনি উঠেছিল যে, সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার দাফনকাফন সুসম্পন্ন হয়েছে, দৈত্যরূপী সমাজতন্ত্র সকল স্বাধীনতাকে নির্মমভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। পুঁজিবাদের অধীনে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ যে মাৎস্যন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, যেখানে বড় মাছগুলো যে ছোট মাছগুলোকে নির্বিঘ্নে গিলে খাবে এবং সেই গিলে খাবার ন্যায়-নীতি অনুযায়ীই রাষ্ট্র ও সমাজ চলবে, এটা অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীরা হয় বুঝতেন না, নয়তো বুঝেও নিজেদের স্বার্থে স্বীকার করতে চাইতেন না। শ্বাসরুদ্ধকর সেই পরিবেশে তরুণ নাজমুল করিম বলছেন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ভেতর কোনো বিরোধ নেই।
না-বুঝে বলেননি, বুঝেই বলেছেন। বৈষম্যমূলক সমাজে গণতন্ত্র মানে যে অধিকাংশের সর্বনাশে কতিপয়ের পৌষ মাস এটা তিনি তাঁর অধ্যয়ন ও বিচারবুদ্ধি থেকে ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন, এবং তাঁর ওই প্রবন্ধের উপসংহারে তেমন গণতন্ত্রের কথাই বলেছেন যেটি সমাজতান্ত্রিক, এবং যার দৃষ্টান্ত সোভিয়েট ইউনিয়নে তখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। আরো স্পষ্ট করে এবং দৃঢ়তার সঙ্গেই হয়তো বলতেন যদি সমর্থন পেতেন অন্যদের কাছ থেকে। সমর্থনের তখন বড়ই আকাল ছিল। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা কলেজের বার্ষিকীতে, কলেজটি সরকারি এবং প্রবন্ধ লেখক কলেজের সদ্যনিযুক্ত একজন শিক্ষক, যিনি সরকারি কর্মচারী বটেন। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল পরিপূর্ণরূপে সরকার নিয়ন্ত্রিত।
সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত সম্পর্কে এই মানুষটির মনে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। ধর্মের বিবর্তন সম্পর্কে মার্কসবাদী ধারণার ওপর তিনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন; বোঝা যায় রাষ্ট্র ও সমাজের বিবর্তন সম্বন্ধে মার্কসবাদী ব্যাখ্যা তাঁর জন্য অধ্যয়নের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। স্মরণীয় যে, সেই বন্ধ্যা সময়ে তত্ত্ব হিসেবে মার্কসবাদের চর্চা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এবং ওই তত্ত্বে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ছিলেন হয় কারাগারে নয়তো আত্মগোপনে। নাজমুল করিমের ইশারা অনুসরণ করে বলা সম্ভব যে মার্কসবাদীদের দুর্দশা এবং তদবিপরীতে প্রতিপক্ষ পুঁজিবাদপন্থীদের উৎফুল্লতা অবলোকন করলে মেহনতি মানুষ কী অবস্থায় ছিল তা অনুধাবন করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হবার কথা নয়।
অধ্যাপক করিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠীদের একজন রবীন্দ্রনাথ গুহ। তিনিও সরকারি কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন, কিন্তু যেহেতু মার্কসবাদী ছিলেন, এবং তদুপরি হিন্দু, তাই টিকতে পারেননি, তাঁর চাকরি তো চলে গেছেই, তিনি দেশত্যাগ করতেও বাধ্য হয়েছেন। স্মারকগ্রন্থে তার একটি প্রবন্ধ আছে। তাতে তিনি স্মরণ করেছেন যে ১৯৫২ সালে বন্ধু নাজমুল করিম সুদূর নিউ ইয়র্ক থেকে তাঁর সঙ্গে পত্রে যোগাযোগ করতেন। একটি চিঠি রবি গুহের কাছে বিশেষ মূল্যবান বলে মনে হয়েছে, যেটিতে নাজমুল করিম তাঁর দু’টি প্রত্যয়ের কথা লিখেছেন। একটি ব্যক্তিগত, অপরটি সমষ্টিগত।
ব্যক্তিগত প্রত্যয়টি এই রকমের যে, তিনি যে গবেষণার পরিকল্পনা করেছেন তাঁর মূল উদ্দেশ্য ‘পা-িত্য ও ডিগ্রি লাভ নয়। সমষ্টির স্বার্থে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধনে কাজে লাগা।’ অপর প্রত্যয়টি সম্পর্কে রবি গুহ জানাচ্ছেন যে, নাজমুল করিম এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ ছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র। চিঠিতে এটাও বলা হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচার পথ নেই। মনে রাখা দরকার যে চিঠিটি তিনি লিখেছেন ১৯৫২ সালে, নিউ ইয়র্ক থেকে, যেখানকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়তে গেছেন ইস্ট পাকিস্তান স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে। পেছনে ফিরে তাকালে বুঝতে পারি কত আগে তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝে গেছেন যে পূর্ববঙ্গ ছিল পাকিস্তানের উপনিবেশ এবং ওই ঔপনিবেশিক শোষণব্যবস্থা থেকে বের হতে না-পারলে পূর্ববঙ্গবাসীর জন্য বাঁচার কোনো উপায় নেই।
এই বাস্তবটা তখন অনেকেই বোঝেননি, বুঝতে চানওনি। এমনকি কমিউনিস্ট আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও কেউ কেউ দ্বিধান্বিত ছিলেন সত্যটাকে মেনে নিতে। তাঁরা একটি তাত্ত্বিক নিষেধাজ্ঞার ভ্রান্তিতে পড়েছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল পাকিস্তান নিজেই একটি ঔপনিবেশ, আর তাই যদি হয় তা হলে পূর্ব পাকিস্তান কী করে তার উপনিবেশ হবে, উপনিবেশ কী করে উপনিবেশের মালিক হয়? বুঝতে চাননি যে উপনিবেশের অধীনে উপনিবেশ না-থাকুক, আধা-উপনিবেশ তো থাকতেই পারে। তাঁরা ভাবছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনেই শ্রেণিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। পূর্ববঙ্গের মানুষ যে পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকদেরকে শত্রু বলে মনে করছে সেই সত্যটা বরঞ্চ জাতীয়তাবাদীরা বুঝেছিলেন, এবং তাই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ পুঁজিবাদে দীক্ষিত জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হলো, সমাজতন্ত্রীরা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলেন।
নাজমুল করিম যে সত্যটিকে বুঝতে পেরেছিলেন সেটিকে যে তিনি প্রকাশ্যে তুলে ধরবেন পরিস্থিতি তখন এমন ছিল না। এই যে তিনি তাঁর উপলব্ধিকে গবেষণা ও লেখার মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ ও ধারাবাহিকরূপে তুলে ধরতে ব্যর্থ হলেন সে মর্মবেদনা তাঁকে পীড়িত করেনি এটা কেমন করে বিশ্বাস করি? পীড়া নিশ্চয়ই ছিল, এবং শারীরিক স্বাস্থ্যহানি ও অকাল মৃত্যুর জন্য ওই মানসিক পীড়া কতটা দায়ী কে বলবে। সংবেদনশীল মানুষ মাত্রেই মানসিক যন্ত্রণায় কাতর হন, তাঁরও হবার কথা বৈকি।

৩.
অধ্যাপক করিমের শ্রেণিবিশ্লেষণে পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজে যে দু’টি শ্রেণি কেন্দ্রীয় বিবেচনায় ছিল তাদের মধ্যে তখনকার অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে মধ্যবিত্তের দূরত্বটা তিনি পরিষ্কারভাবে দেখতে পেয়েছেন। বিবর্তনের ধারায় অভিজাতরা সমাজে নিজেদের প্রভাব হারাচ্ছিল, উঠে আসছিল মধ্যবিত্ত। এই মধ্যবিত্তের ভিত্তি ও ভরসা ছিল চাকরি ও শিক্ষার ওপরে। যুদ্ধ ও দেশবিভাগের ফলে একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও গড়ে উঠছিল, মধ্যবিত্তের সঙ্গে যার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল।
এই দৃশ্যটা পাকিস্তান আমলের। নাজমুল করিম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সমাজে যে পরিবর্তন ঘটছিল তার বিষয়ে লিখবার সময় ও সুযোগ তেমন একটা পাননি। অসুস্থ ছিলেন। তারপর তো চলেই গেলেন ১৯৮২তে। আজ যদি তিনি থাকতেন তা হলে অনেক ভাঙা-গড়া দেখতে পেতেন। তাঁর সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এটা মোটেই অস্পষ্ট থাকতো না যে, সমস্ত ভাঙা-গড়া ও উত্থান-পতনের ভেতর অবিচলিত রয়েছে একটি বস্তু, তা হলো সমাজের মূল কাঠামো। সেটা বদলায়নি। অল্পসংখ্যক মানুষ সমাজের অধিকাংশ মানুষের ওপর শোষণ-নিপীড়ন চালাচ্ছে, এটা যেমন সত্য ছিল পরাধীনতার কালে- অর্থাৎ ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলে- তেমনি সত্য হয়ে রয়েছে এখনো। ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য কমেনি, বরঞ্চ প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎকট ও দৃশ্যমানরূপে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। হ্যাঁ, ধনবৈষম্য আগেও ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রাম ও অনেক পরিবর্তনের পরেও এবং বহু ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনো যে সেটা বদলায়নি, অধিকন্তু বেড়ে গেছে সেই ঘটনা এখন বঞ্চিত মানুষের কাছে দুঃসহ মনে হচ্ছে।
নাজমুল করিম যে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আচার-আচরণ ও গতিবিধি লক্ষ করছিলেন সেই দুটি শ্রেণির গঠন ও আচরণে পরিবর্তন এসেছে। আগের অভিজাতরা ছিল অনেকটা বংশপরিচয়নির্ভর। তারা নিজেদেরকে স্থানীয় বলে ভাবতে চাইতো না। পারলে ফারসি-উর্দু ভাষা ব্যবহার করতো। ওই মানুষগুলো এখন আর নেই। এখনকার অভিজাতরা নতুন। আনকোরা। তারা খুবই স্পর্শকাতর, এবং মাতৃভাষার ব্যবহারে তাদের ভেতরও আগের অভিজাতদের মতোই বিস্তর অনীহা রয়েছে। উর্দু-ফার্সি বিদায় হয়েছে, রাজত্ব ইংরেজির। পারলে এরা ইংরেজিই ব্যবহার করে। আমরা জানি যে, বাঙালির সংস্কৃতিতে ভাষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নব্য-অভিজাতরা ইংরেজি ব্যবহার করে নিজেদের আভিজাত্যকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর করে তুলতে চায়। তারা যে সাধারণ নয়, ভুঁইফোড়ও নয়, ইংরেজি জানে, এক পুরুষ নয় কয়েক পুরুষ ধরেই ওই ভাষা ব্যবহার করে আসছে, এটা প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকে। সাধারণ মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া, তাদেরকে নত করে রাখা, তাদের কাছ থেকে নানা বিষয়ে সম্মতি ও আনুগত্য আদায় করে নেওয়ার অভিপ্রায়টা অনুক্ষণ কাজ করে। এ ব্যাপারে তারা খুবই আত্মসচেতন। তারা জানে যে জনগণের কাছ থেকে দূরত্বটাই তাদের আভিজাত্যের মূল পরিচয়। ওই দূরত্ব তারা মুখের ভাষা, গায়ের জামাকাপড়, নিত্যদিনের চালচলন, যাতায়াত সবকিছুর মধ্য দিয়েই বিজ্ঞাপিত করে। বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে ধমকও দেয়। যেমন নীরবে তেমনি সরবে।
এদের অবস্থানটা আসলেই জনগণের কাছ থেকে অনেক দূরে, যদিও বস্তুগত ও ব্যবহারিক কারণে তারা জনগণের আশপাশেই থাকতে বাধ্য হয়। আশপাশে থাকে বলেই সাধারণ মানুষকে আরো বেশি ঘৃণা করে। পারলে তাদেরকে দূরে ঠেলে দিতো, বিত্তনির্ভর বর্ণভেদ প্রথা চালু করতো; সেটা করতে পারে না বলে খুবই অসন্তুষ্ট থাকে, এবং সুযোগ পেলে ও সুযোগ সৃষ্টি করে অসন্তোষটা প্রকাশ করে তৃপ্তি পায়। ধরা যাক, তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাপারটা। এ শিল্পের মালিকেরা নব্য-অভিজাত, মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই তারা উঠে এসেছে। শ্রমিকদের সঙ্গে তাদেরকে এক ধরনের সম্পর্ক রাখতে হয়, কারণ সস্তা শ্রমের ওপরেই এই শিল্পের রাজপ্রাসাদ অতিদ্রুত গড়ে উঠেছে, এবং বাংলাদেশে শ্রম অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা বলেই অন্যদেশের পোশাক তৈরিওয়ালারা বাংলাদেশিদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। পোশাক কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের থেকে যতটা দূরে থাকা সম্ভব থাকতে চায়। সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার। কিন্তু শোষণের ব্যাপারে এই রাজারা আগের যে কোনো রাজার তুলনায় নিষ্ঠুর। তবে আগের দিনের রাজাদের মতোই এরা ভিন্ন এক জগতের মানুষ। বিলাসিতা ও জীবনযাপনের ব্যাপারে প্রজাদের সঙ্গে এদের কোনো ধরনের মিল নেই।
সম্প্রতি রানা প্লাজায় ভবনধসের কারণে এগার শত চৌত্রিশজন শ্রমিক নিহত হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছে অনেকে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। বিশ্বের শিল্পকারখানার ইতিহাসে এতোবড় হত্যাকা- এর আগে কখনো ঘটেনি। আমরা জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকা-ের কথা জানি, সেটি ঘটেছিল আজ থেকে পঁচানব্বই বছর আগে। সে-ঘটনা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে হৈ চৈ হয়েছে। উপমহাদেশের মানুষ সেটিকে ভোলেনি, কখনো ভুলবে না। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগেও এতো মানুষ প্রাণ হারায়নি, সত্য এই যে সেই হত্যাকা-ে নিহতের সংখ্যা ছিল চার শত, আহত দেড় হাজার। রানা প্লাজার সঙ্গে বিরাট তফাৎ। বলা যাবে যে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকা- ঘটিয়েছিল সরকারি লোকেরা; রানা প্লাজা বেসরকারি। কিন্তু রানা প্লাজার মালিক যারা তারা এ দেশের শাসকশ্রেণিরই সদস্য। এরা হচ্ছে ওই নতুন অভিজাত যারা ব্যবসা-বাণিজ্য তো বটেই, রাষ্ট্রকেও নিয়ন্ত্রণ করে। হত্যাকা-টি এদের হাতেই ঘটেছে। মূল তফাৎটা তাই গুণগত নয়, পরিমাণগত। পরিমাণের দিক থেকে রানা প্লাজা জালিয়ানওয়ালাবাগকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আরো একটি বিবেচনার দিক রয়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগকে দেশের মানুষ মেনে নেয়নি। ওই ঘটনার পর থেকে ব্রিটিশ-বিরোধিতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিল। মানুষ মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে। ফলে সাতচল্লিশে স্বাধীনতা এলো। সেই স্বাধীনতা যথার্থ নয় বুঝতে পেরে পূর্ববঙ্গের মানুষ নতুনভাবে সংগ্রাম করেছে। ভেবেছে মুক্তি আদায় করে ছাড়বে। একাত্তরে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলো। কাজটা সাধারণ মানুষই সম্পন্ন করলো, যুদ্ধ করে। কিন্তু কই মুক্তি তো এলো না। আসেনি যে তার প্রমাণ অসংখ্য : জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও নিষ্ঠুর যে হত্যাকা- রানা প্লাজার সেটি ওই প্রমাণগুলোরই একটি বটে।
রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি উঠেছে। উঠবেই। মালিকপক্ষ টালবাহানা করছে। এক বছর পার হয়ে গেছে ক্ষতিপূরণের দেখা নেই। জানা গেল বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মালিকপক্ষ নিহতদের আত্মার মাগফেরাতের জন্য একটি দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছিল। যেন নিহতরা পাপ করেছে, আর যারা হত্যাকা-ের জন্য দায়ী তারা নিষ্কলুষ পুণ্যবান। ভূমিহারা উপেনের কথা মনে পড়ে, সে বেচারা নিজের গাছের পড়ে-পাওয়া দু’টি আম হাতে নেওয়ার অপরাধে জমিদারের মালির হাতে প্রহৃত হয়ে অশ্র“সজল কণ্ঠে তবু বলতে পেরেছিল, ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে।’ রানা প্লাজার নিহত মানুষরা তো অতটুকুও বলতে পারবে না, তারা তো বেঁচেই নেই।
নব্য-অভিজাতরা যে কতটা আত্মসচেতন ও জনগণের কাছ থেকে দূরে থাকতে সচেষ্ট তার নিদর্শন যত্রতত্র পাওয়া যাবে। যেমনি বড় ঘটনাতে, তেমনি ছোট ঘটনাতেও। ধরা যাক, ধানমন্ডি খেলার মাঠ। এতকাল দেখে এসেছি যে এটা সকলের জন্য খোলা মাঠ, শহরের অন্যসব পার্কের মতোই। হঠাৎ শোনা গেল এটি ব্যক্তি মালিকানায় চলে গেছে এবং সেখানে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্লাবের যারা মালিক তারাই মাঠের মালিক। আশঙ্কা তৈরি হলো যে এই পার্কও ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাব প্রভৃতির মতো একটি অভিজাত ক্লাবের আবাসিক ভূমিতে পরিণত হবে। জনসাধারণের সেখানে প্রবেশ-অধিকার থাকবে না। মালিকানার দাবিদাররা বলেছে ওটা নাকি আইয়ুব খান ‘এলিট’দেরকে দিয়ে গেছে প্রয়োজনমতো ব্যবহারের জন্য, সেখানে ‘টোকাইরা’ কেন আসা-যাওয়া করবে? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। দেশের মালিক হচ্ছে এলিটরা, দেশে টোকাইরা আছে, থাকুক, খাটাখাটনি করুক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখুক, চাকর-বাকর হিসেবে কাজ করুক, তাদের আবার পার্কে ঘোরাঘুরির সখ কেন? ঘর নেই তবু দুয়ার চায়। কেমন ধৃষ্টতা। সম্প্রতি নতুন ট্যাক্সি এসেছে ঢাকায়। এই ট্যাক্সিতে চড়ে ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যেতে খরচ পড়বে ছয় শ’ টাকা। ইচ্ছা করলে ওই টাকায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসা সম্ভব। তবু ভরসা করি যে ওই ট্যাক্সি সার্ভিস সফলভাবেই সচল থাকবে, অভিজাতদের ভোগ ও বিলাসের আয়োজনের সঙ্গে যদি কোনোমতে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। ট্যাক্সিগুলো টোকাইমার্কা হলে ঘাড়ধাক্কা খেত, যেমনটা তাদের স্বজনেরা খেয়েছে, এবং বিদায় হয়ে গেছে। নতুন ট্যাক্সি নাকি বিলাসবহুল। তাদের পক্ষে তাই চলমান থাকবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। মধ্যবিত্ত আশা করেছিল কালেভদ্রে ট্যাক্সিতে চড়বে, অন্য দেশের মধ্যবিত্ত যেমনটা চড়ে থাকে। সে গুড়ে বালি! এদেশে ভোগ-বিলাসিতার যতটুকু যেখানে আছে তা অভিজাতদের জন্যই নির্দিষ্ট।
অধ্যাপক করিম যে মধ্যবিত্তকে দেখেছেন উদীয়মান সেই শ্রেণিটি এখন আর টিকে নেই। ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ উঠে গেছে ওপরে, আরেক ভাগ নেমে গেছে নিচে। ওপরের যাত্রীদের সংখ্যা অল্প; অধিকাংশই নিম্নগামী। যারা ওপরে উঠেছে তারাই এখন অভিজাত। বঙ্কিমচন্দ্রের কালে উঠতি মধ্যবিত্তের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল জমিদারদের সঙ্গে; তাঁর প্রথম জীবনে নাজমুল করিম দেখেছেন মধ্যবিত্তের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটা বিরোধ চলছে। একালের বিত্তসংগ্রহকারী মধ্যবিত্ত কিন্তু ব্যবসায়ীদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে না, কেননা কোনো না কোনোভাবে নিজেই সে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। বাণিজ্যে যে লক্ষ্মীর বসবাস তার প্রমাণ দিতে আজকের বাংলাদেশের কোনো গাফিলতি নেই। বাণিজ্যের জন্য জাহাজ ভাসানোর দরকার নেই, দেশের ভেতরেই বিস্তর নদীনালা রয়েছে। মধ্যবিত্তের যে অংশ নিম্নমধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছে তার অবস্থান মেহনতি মানুষদের কাছাকাছি; অথচ অভ্যাস, শিক্ষা, অভিমান ইত্যাদির কারণে মেহনতিতে রূপান্তরিত হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। সে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলে। করুণা আশা করে, পায় না। তার নিজের ভবিষ্যৎ যে মেহনতি মানুষের সঙ্গে একত্র হয়ে সংগ্রাম করার ভেতরেই নিহিত এই সত্যটিকে মেনে নেওয়া তার সাধ্যের বাইরে।
৪.
ভরসার জায়গাটা আসলে মেহনতি মানুষই। নাজমুল করিম যাদেরকে একদা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তা হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন, তারা এখন সেখানে নেই বটে, তবে নব্য-অভিজাতরাই এখন ক্ষমতায়, এবং আগের দিনের অবিভক্ত মধ্যবিত্ত ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত। অভিজাতদের অধীনে দেশের মুক্তি নেই।
তবে আশার কথা এটা যে, চেতনার দিক থেকে শ্রমজীবী মানুষও এখন আর আগের অবস্থায় নেই। সুকঠিন বস্তু জগতে বসবাসের এবং মুক্তির ধারাবাহিক সংগ্রামে অংশগ্রহণের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তাদেরকে সজাগ করে তুলেছে। তাদের ক্ষোভ ও বিক্ষোভ আজ অপরিমেয়।
পরিস্থিতি বিস্ফোরণমুখী। প্রয়োজন নেতৃত্বের। সেই নেতৃত্ব অভিজাত শ্রেণি দেবে না, দিতে হবে মেহনতি মানুষকেই। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা ভূমিকা থাকবে আভিজাত্যের ভেতরে বসবাস করেও যারা বোঝে যে ‘ভদ্রতা’-বিবর্জিত পরস্ব-অপহরণকারী অভিজাতরা শ্রেণিগতভাবে যা করছে তাতে মঙ্গল নেই, ধ্বংস আছে, এবং জানে যে বাঁচতে ও বাঁচাতে হলে যেতে হবে শ্রমজীবীদের কাছে সেই ক্ষুদ্র অংশের। নিম্নমধ্যবিত্তের ভূমিকা হতে পারে আরো বড় মাপের, যদি তারা বোঝে যে শ্রমজীবীদের সঙ্গে একাত্ম না হলে দুর্বৃত্ত অভিজাততন্ত্রকে ভাঙার কোনো উপায় নেই। আর বিদ্যমান ব্যবস্থাটা যদি কার্যকর থাকে তা হলে মুক্তি দূরের কথা, ক্রমবর্ধমান দুর্দশাই হবে ভাগ্যলিপি। অতীতে মেহনতি মানুষ সংগ্রাম করেছে, কিন্তু নেতৃত্ব দিতে পারেনি, যে জন্য মুক্তি আসেনি। আগামী দিনের নেতৃত্ব দিতে হবে তাদেরকে এবং তাদেরই পক্ষের মানুষদেরকেই।
প্রশ্নটা তাই স্পষ্টতই দাঁড়াচ্ছে যে আমরা কে কোন পক্ষে। সংরক্ষণের নাকি পরিবর্তনের? দেশ প্রতীক্ষা করছে একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের, বলা চলে সামাজিক বিপ্লবের। অভিজাত ও তাদের অনুসারীরা এর বিরোধিতা করবে তাদের নিজেদের স্বার্থে। বড়লোক ও ছোটলোকের ভেতর ব্যবধানটা বাড়তে থাকবে, এবং ছোটলোকরা বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত হবে। এব্যবস্থার কোনো বৈধতা নেই। দেশের মঙ্গলাকাক্সক্ষীদের জন্য কর্তব্য একটাই- পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করা।
নাজমুল করিম নিজে যে সংরক্ষণের নয়, পরিবর্তনের দিকের মানুষ ছিলেন সেটা তিনি জানিয়ে দিয়েছেন একেবারে শুরুতেই, যখন তিনি মন্তব্য করেছেন যে তাঁর দৃষ্টিতে সমাজ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রমুখী। তিনি আমাদের জন্য একটি শ্রদ্ধেয় দৃষ্টান্ত, তাঁর কাজের জন্য; যে কাজে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানোর দিশা রয়েছে। অধ্যাপক নাজমুল করিম আমাদের অগ্রযাত্রার বিচক্ষণ সহযাত্রী ছিলেন, এবং থাকবেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী