রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

শিরি-ফরহাদ :অমর প্রেমগাথা

প্রেম বলতে প্রথমত পৃথিবীতে বিচরণকারী নরনারীর একের প্রতি অন্যের রহস্যাতীত আকর্ষণবোধ এবং এর অপূরণজনিত কারণে জন্ম নেয়া অসুস্থতাকে বোঝায়। বিশ্বের প্রতিটি প্রেমকাহিনি অভিন্ন। প্রেমিক হূদয়মাত্র মথিত ব্যাখ্যাতীত বেদনায়। প্রেমের প্রাপ্তি ধারণ করা দুষ্কর। আগুনের আকর্ষণে ছুটে গিয়ে আগুনে আত্মাহুতি দেয়ার নামও তো প্রেম। যুগে যুগে মানুষের মন প্রেমে পড়েছে। 

না পাওয়ার যন্ত্রণায় কাতর হয়েছে বারবার। কিন্তু নিজেকে সে রুদ্ধ করে রাখতে পারেনি। আত্মা যার সন্ধান লাভ করে অসীমের, নিজেকে রুদ্ধ রাখা তার পক্ষে কীভাবে সম্ভব। স্বাধীন মানব তো চিরকাল সিন্ধুপ্রেমিক।

শিরিন আর খসরু। তেমনি এক অমর অজর প্রেমকাহিনি। গল্পের নায়ক পারসিক রাজকুমার আর নায়িকা আর্মেনীয় রাজকুমারী। এ দুজনকে ঘিরে রচিত হয়েছে পারস্যের চিরকালীন বিয়োগান্তক প্রেমগাথা। মহাকবি ফেরদৌসি তাঁর অমর কাব্য শাহনামা’য় বয়ান করেছেন এ কাহিনি। তবে তাঁর জনপ্রিয় সংস্করণটি কবি নেজামির অবদান।

একবার এক কৃষকের বাড়িতে ভুরিভোজের কারণে পিতা হরমুজের নিদারুণ ভর্ত্সনার শিকার হলেন তরুণ যুবা খসরু। অপরাধের জন্য বারবার ক্ষমা চাইলেন পিতার কাছে। কিন্তু পিতা হলেন দেশের রাজা। তিনি কি সহজে ক্ষমা করতে রাজি হন। অবশেষে প্রাথমিক ক্ষমা নিয়ে ঘুমোতে গেলেন রাতে। ওই রাতে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হলো তার। ওই রাতে তার স্বপ্নে এসে দেখা দিলেন তার দাদা আশিরবান। দাদু তাকে উপহার দিলেন বর, পরমাসুন্দরী এক স্ত্রী, যার নাম হবে শিরিন, যে রূপে হবে পৃথিবীর অদ্বিতীয়া। আর দিলেন শাবদিজ নামে দুরন্ত এক অশ্ব, যে ছুটতে পারে পবনকে পেছনে ফেলে। সেই সঙ্গে উপহার দিলেন বারবাদ নামে এক গায়ক, যে বীণার তারে সুর তুললে গান গাইতে জড়ো হয় রাজ্যের ফুল পতঙ্গ আর পাখপাখালিরা। আর সবশেষে দিলেন পারস্য নামে এক বিশাল রাজ্য।

সকালে উঠেই সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হলো তার। তবুও প্রাণের বন্ধু শাপুরকে সব খুলে বললেন তিনি। শাপুর ছবি আঁকে, চিত্রকর। তার শিল্পীমন। স্বপ্নই তার কাছে সৃষ্টির ডাকপিওন। বন্ধুর কথা শুনে সে তাকে জানাল আর্মেনিয়া রাজ্যের রানি মাহিন বানু আর তার ভাতিজি অপরূপা সুন্দরী শিরিনের নানা রকমের গল্প। শিরিন মানে মিষ্টি। শাপুরের মুখে শিরিনের নিখুঁত রূপের বিবরণ শুনে বিকারগ্রস্ত হলেন তরুণ খসরু। দিনরাত স্বপ্নে কেবল তাকেই দেখেন। কিন্তু তার তো প্রাসাদের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই, পিতার কঠিন নিষেধাজ্ঞা। কী আর করা, তেপান্তর পাড়ি দিয়ে শাপুর একাই ছুটল শিরিনের সন্ধানে। সঙ্গে তার ঝোলার ভেতর ফ্রেমে বাঁধানো যুবরাজ খসরুর এক প্রতিকৃতি।

কিন্তু চাইলেই কি আর যে কেউ গিয়ে দেখা করতে পারে দেশের রাজকুমারীর সঙ্গে। সুতরাং বিস্তর ফন্দি করতে হলো শাপুরকে। অনেক কীর্তিকাণ্ড করে অবশেষে শিরিনের দেখা পাওয়া গেল একসময়। তাকে জানালেন নিজের অভিপ্রায়ের কথা। বন্ধুর অসহনীয় বিরহের কথা। অলিন্দের আড়ালে নিয়ে তাকে দেখালেন খসরুর প্রতিকৃতি। আর কী আশ্চর্য, একবার মাত্র ছবিখানা দেখেই জীবনে না দেখা রূপবান যুবকের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করলেন রাজকন্যা শিরিন। আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল অজানা সুখের শিহরণে। জীবনের সব আনন্দ এক মুহূর্তে রূপ নিল বিষাদে। যুবরাজকে ছাড়া অর্থহীন হয়ে উঠল তার প্রতিটি ক্ষণ। সখীদের সান্নিধ্য বিষবত্ অনুভব হতে লাগল। প্রাসাদের অনুপম পাথরের দেয়াল তাকে পিষে ধরতে লাগল চারদিক থেকে। বিরহের জ্বালা সইতে না পেরে এক রাতে পালিয়ে গেলেন প্রাসাদ ছেড়ে। উদ্দেশ্য খসরুর রাজধানী মাদাইনে গিয়ে প্রিয়ের সঙ্গে মিলন।

এদিকে ততদিনে পারস্যের খসরুর বাবার রাগ পড়ে এসেছে। ছুটি মিলেছে খসরুর। খাঁচাভাঙা পাখির মতো উড়াল দিলেন তিনি। মুক্তি পাওয়া মাত্র একবস্ত্রে ছুটলেন আর্মেনিয়ার উদ্দেশে। সঙ্গে নিলেন না কাউকে। নিজের ভালোবাসা সম্বল করে বেরিয়ে পড়লেন পথে। শিরিনকে পেতে হবে যেকোনো প্রকারে এই তার পণ।

যেতে পথে শিরিনের সঙ্গেই কিন্তু দেখা হয়ে গেল তার। ঝরনার জলে ছায়া ফেলে সে তখন নিজের গা ধুয়ে নিচ্ছে। নির্জন প্রকৃতির মাঝে আলোর বিচ্ছুরণের মতো ফুটে বের হচ্ছে তার সৌন্দর্য। কিন্তু বিধির লিখন ভিন্ন, কে তারে খণ্ডাবে। খসরু নিজেও ছিলেন হতশ্রী কৃষকের বেশে। শিরিন তাকে দেখলেন কিন্তু চিনলেন না ওই দণ্ডে। হাতের কাছে পেয়েও এভাবে আবারও হারিয়ে ফেলল দুটি বিভ্রান্ত হূদয়। নিজেদের কাজ সমাপান্তে দুজনেই ফিরে গেলেন নিজেদের পথে। চলতে চলতে একসময় আর্মেনিয়া পৌঁছে গেলেন খসরু। সাধারণ বেশে প্রাসাদের ফটকে গিয়ে রানিমার সাক্ষাত্ চাইলেন। তাকে দেখা দিলেন রানি। নিজের পরিচয় দিলে ভিনদেশি রাজপুত্রকে স্বাগত জানালেন রানি সামিরা। অতিথি হিসেবে তাকে বরণ করে নিলেন প্রাসাদে। কিন্তু মনে শান্তি নেই খসরুর। দিনরাত হেথায় হোথায় খুঁজে বেড়ান, কিন্তু শিরিনকে তিনি পাচ্ছেন না কোথাও। কেউ জানে না সে কোথায়। অবশেষে একদিন জানা গেল তার খবর। সে পালিয়েছে প্রাসাদ ছেড়ে। অমনি ছুটলেন বন্ধু শাপুরের কাছে। যাও বন্ধু খুঁজে আনো তাকে। এদিকে, ততদিনে খসরুর রাজ্য থেকে ব্যর্থ হয়ে আবারও আর্মেনিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছে শিরিন। জানতে পেরেছে যুবরাজ তারই সন্ধানে ছুটে গেছে তারই রাজ্যে। মনে মনে প্রার্থনা করছে যেন পথেই সাক্ষাত্ হয়ে যায় দুজনার। হয়তো তেমনই ঘটত। কিন্তু আর্মেনিয়ায় খবর এল আকস্মিকভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে তার পিতা হরমুজ। পিতার মৃত্যুর সংবাদ শুনে সামিরার প্রাসাদ ছেড়ে প্রায় একই সময় নিজ রাজ্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন খসরুও। এভাবে বারবার ছোটাছুটি আর ব্যর্থ খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে খসরুকে বিদ্রোহের মাধ্যমে সিংহাসনচ্যুত করলেন সেনাপতি বাহরাম। ফিরে আসার শপথ নিয়ে আপাত কৌশল হিসেবে আবারও আর্মেনিয়া পাড়ি জামলেন খসরু।

এবার কিন্তু শিরিনের সঙ্গে মিলনে আর কোনো বাধা রইল না তার। দুজনেই কাছে পেলেন দুজনাকে। প্রতীক্ষিত হূদয়ের সবগুলো জানালা খুলে দিলেন। মিলনেবিরহে পার হয়ে গেল বেশকিছু দিন। সবাই জানল দুজনের ভালোবাসার কথা। বিয়ের প্রস্তাব দিলেন যুবরাজ। যদিও অমত নেই, চট করেই তাকে বিয়েতে রাজি হলেন না শিরিন। শর্ত দিলেন দুষ্ট বাহরামের নিকট থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে নিজ রাজ্য। হারানো গৌরবের স্থলে পুনরায় অভিষিক্ত করতে হবে তাকে। তবেই মিলন। রাজি হলেন খসরু। শিরিনকে পাওয়ার জন্য পৃথিবীটাকে হারাতে হলেও কোনো কষ্ট নেই তার। দূরে যেতে বুক ফেটে যায়, তবু তাকে প্রাসাদে রেখে শক্তি সঞ্চয় করতে গেলেন কনস্ট্যান্টিনোপল। সেখানকার সিজার তার উপরোধ শুনে রাজি হলেন তাকে সাহায্য করার। তবে তারও আছে শর্ত একটি। যা-ই হোক আমি রাজি, জানালেন খসরু। তার মনে তখন একটাই চিন্তা। সিজারের শক্তি নিয়ে লড়াইয়ে নামবেন বাহরামের বিরুদ্ধে। ফিরিয়ে নেবেন রাজ্য। সেখানে তিনি হবেন রাজা আর রানি করবেন প্রিয় শিরিনকে। এবার তাহলে শর্তটা শোনা যাক। কী সেটা? তেমন কিছু না, সিজারের এক মেয়ে আছে মরিয়ম। বিয়ের যোগ্য তবে উপযুক্ত পাত্রের অভাব। তাকে বিয়ে করতে হবে। শুধু কি তাই, যতদিন জীবিত থাকবেন মরিয়ম, ততদিন অন্য দার পরিগ্রহ করতে পারবেন না খসরু।

কবির বয়ানে এই সময় কাহিনির মধ্যে ঢুকে পড়লেন ফরহাদ নামে অশান্তহূদয় এক ভাস্কর। পাথর খোদাইকর। সৌন্দর্যপিয়াসী যুবক এক পলক দেখামাত্র তুমুল প্রেমে পড়লেন অনিন্দ্যসুন্দরী শিরিনের। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেমিকের গল্প কিছুই অজানা রইল না রাজা খসরুর। তাকে ডেকে পাঠালেন একদিন। জানলেন তার ভালোবাসার অদম্য স্ফুরণের কথা। কিন্তু তাকে বধ করতে পারেন না তিনি। বুদ্ধি করে অসম্ভব এক দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন দূর পাহাড়ে। সেখানে কঠিন পাথর কেটে সিঁড়ি গড়ে তুলতে হবে শীর্ষ অবধি। তবে গোটা কাজটি তাকে করতে হবে একক পরিশ্রমে। যদি সে কোনোক্রমে সফল হতে পারে তাহলে শিরিনের সঙ্গে তার বিয়ে হলেও হতে পারে। রাজার আশ্বাসে প্রবল বিশ্বাসে ভর দিয়ে কাজে নেমে গেলেন ফরহাদ। দিনরাত অমানুষিক শ্রম দিয়ে অনেক বছর পর একদিন ঠিকই সিঁড়ি তৈরি করে করে পৌঁছে গেলেন পাহাড় চূড়ায়। রাজার কাছে খবর গেল অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে ফরহাদ। এবার তো শিরিনের সঙ্গে তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে বাধ্য হবেন রাজা। খসরু দেখলেন মহাসংকট। প্রেম অজেয়। ফরহাদ তাকে দেখালো সেটা আরো একবার। কিন্তু শিরিন তো কেবলই তার! আর কারও হতে পারে না সে! কূটবুদ্ধি করে খবর পাঠালেন ফরহাদের কাছে, একদিনের জ্বরে ভুগে মারা গেছে শিরিন।

রাজদূতের মুখে এই খবর শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন ফরহাদ। তা কীভাবে হয়। গোটা জীবন বাজি রাখা হলো যার জন্য সে নিজেই নেই! নিজেকে সম্বরণ করতে পারলেন না ফরহাদ। ওই দণ্ডে পাহাড়চূড়া থেকে ঝাঁপ দিলেন অতল খাদের গহিনে। এভাবে নিজেকে ধ্বংস করে নিবিয়ে গেলেন প্রেমের অনির্বাণ হুতাশন। ফরহাদের দুঃখজনক মৃত্যুর খবর জানিয়ে শিরিনকে চিঠি দিলেন খসরু। এ ঘটনার কিছুদিন পরই মারা যান খসরুর শর্তসাপেক্ষে বিয়ে করা স্ত্রী মরিয়ম। সমবেদনা জানিয়ে খসরুকেও পাল্টা চিঠি পাঠালেন রাজকুমারী শিরিন।

এসব ঘটনার পর শিরিনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর কথা যখন ভাবছেন খসরু, ঠিক তখন ইস্পাহানের শিকারা নামে এক সুন্দরীর সঙ্গে আবারও অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন খসরু। ফলে আবারও অপেক্ষার ফেরে পড়ে গেলেন শিরিন। অবশেষে নিয়তি সদয় হলো তাদের ওপর। একদিন আবারও শিরিনের প্রাসাদে এসে পৌঁছালেন রাজা। কিন্তু হায়, এতদিন যার অপেক্ষায় বসে থেকে প্রহর গুনেছেন, শরাবের কারণে তার কাছেও যেতে পারলেন না তিনি। অশ্রু চেপে তুমুল মাতাল খসরুকে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন শিরিন। শিকারাকে জড়িয়ে কটু কথা বলতেও ছাড়লেন না। মাতাল খসরু বারবার চেষ্টা করলেন নিজেকে ব্যাখ্যা করতে। বোঝানোর চেষ্টা করলেন রাজাদের অনেক কিছু করতে হয় রাজনৈতিক কারণে। অনেক মানুষের সঙ্গ বজায় রাখতে হয় তাদের। কিন্তু যত নারী থাক এ জীবনে শিরিনই তার একমাত্র আরাধ্য। কোনো কথাই শুনতে রাজি হলেন না রাজকুমারী। ব্যর্থ প্রত্যাখ্যাত পরিত্যক্ত হয়ে নিজের ডেরায় ফিরে এলেন আহত খসরু।

এরপর কাহিনিতে নানা ধরনের উত্থান পতন। শিরিনের মন গলানোর জন্য পণ ধরলেন খসরু। একবার বনে গিয়ে বিপদে পড়লেন রানি শিরিন। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বনরাজ সিংহ। বাঁচার পথ নেই বুঝি আর। এমনি সময় দেবদূতের মতো কোথা থেকে উদয় হলেন খসরু। কিন্তু হাতে কোনো হাতিয়ার নেই। অসীম সাহসী খসরু খালি হাতে লড়াই করে সিংহের গ্রাস থেকে শিরিনকে উদ্ধার করে আনলেন। অভিভূত হলেন শিরিন। এরপর বিয়েতে রাজি না হয়ে কি আর উপায় থাকে। মত দিলেন তিনিও। শুরু হলো বিয়ের প্রস্তুতি। এমনি সময় ভিলেনের মতো রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন শিরোয়ে। মরিয়মের গর্ভে খসরুর ঔরসজাত পুত্র। ততদিনে যৌবনে পা দিয়েছে সেও। শিরিনের রূপের আগুনে এক মুহূর্তে পতঙ্গের মতো ঝলসে গেল শিরোয়ে। প্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞানে জন্মদাতা পিতাকে নির্বিকারে হত্যা করে ভয়ংকর বার্তা পাঠাল শিরিনের কাছে, এক সপ্তাহের ভেতর বিয়ে করতে হবে তাকে। দূতের মুখে বার্তা শুনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন শিরিন। খসরু ছিল তার প্রেম। তার ঔরসজাত সন্তানের সঙ্গে বিবাহ, জীবন থাকতে নয়! সুতীক্ষ ছুরিকা বুকে আমূল বিঁধিয়ে নিথর দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়লেন প্রাসাদের ঠাণ্ডা মেঝেতে। 

আজও এক কবরে একাত্মা সমাহিত হয়ে আছেন দুটি প্রাণ খসরু আর শিরিন।

অন্য সব মহত্ গাথার মতো কাব্যগাথার উপাদানসমৃদ্ধ এ কাহিনিতেও জড়িয়ে আছে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস। ক্ষমতার পালাবদল, কারাগারে নিক্ষেপ আর সাসানীয় রাজা হরমুজকে অন্ধ করে দেয়ার মতো ঘটনা। রাজকুমার খসরুর দুই মামার নেতৃত্বে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, পিতার অবর্তমানে পুত্র খসরুর সিংহাসনে আরোহণ। নতুন রাজার বিরুদ্ধে সেনাপতি বাহরাম শবিনের বিদ্রোহ এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে রাজা মরিসের নিকটে খসরুর পলায়ন ও আশ্রয় গ্রহণ। ফেরদৌসির শাহনামায় বিস্তারিত বয়ান করা হয়েছে এই সমস্ত কাহিনি। ফারোখি, কাতরান, মাসুদ ই সাদ ই সালমান, ওসমান মোখতারি, নাসের খসরু, আনওয়ারি এবং সানজাইসহ অসংখ্য পারসিক কবি তাদের কাব্যচর্চায় উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এ কাহিনি।

নিজামির কাহিনি অবশ্য ফেরদৌসির চাইতে একেবারেই ভিন্ন ধরনের। ইতিহাসকে অপসারণ করে তিনি মূলত জোর দিয়েছেন গল্পের মানবিক আবেদনের ওপর। সেলজুক সুলতান দ্বিতীয় তুগরুলের অনুরোধে কাব্যটি রচনা করেন তিনি। তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ বলা হয় এটাকে। গোটা লেখাটি শেষ হবার কিছুদিন পর মারা যান কবির প্রথম স্ত্রী আফাক। আসাদ ঘোরঘানির লেখা থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছেন তিনি। ইরানীয় বিশ্বকোষ অনুসারে, ফরহাদের কাহিনির আবেদন কেবল পারসিক সাহিত্যের মাঝেই সীমিত নয়, তা ব্যাপ্ত হয়ে আছে লোকগীতি আর শিল্পকলাসহ পারস্যের সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাত্র ২০১১ সালে সাড়ে আট শ বছর ধরে জনপ্রিয় এই লোকগীতির পুনঃমুদ্রণের ওপর অপ্রত্যাশিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরান সরকার। দেশটির সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনা বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে স্পষ্টত কোনো ব্যাখ্যা প্রদান না করলেও জানা গেছে, নরনারীর মিলনসম্বলিত আপত্তিকর বিবরণ থাকার অভিযোগেই তাদের এ শুদ্ধি পদক্ষেপ। ওরহান পামুকের ১৯৯৮ সালের উপন্যাস ‘মাই নেম ইজ রেড’-এর প্রধান চরিত্র শেকিউর আর ব্ল্যাক মূলত শিরিন আর খসরুরই বদলে নেয়া রূপ। গল্পে নায়কের নামটাও হুসরেভ, এটি খসরু নামের তুর্কি সংস্করণ।

অগণন সুফি কবির কবিতায় হাজার বার ধ্বনিত হয়ে এসেছে এ গল্প। পারস্যের বাইরে, যেমন পাকিস্তানে এটি মানুষের লোকগীতির অংশ হয়ে গিয়েছে। ইউরোপে এ বিষয়ে লিখেছেন হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক মোর জোকাই। পাঞ্জাবে কিসসার শীর্ষে অবস্থান শিরি-ফরহাদ-এর। অসংখ্য ছবি নির্মিত হয়েছে এ কাহিনি ঘিরে। ২০০৮ সালে আব্বাস কিয়ারোস্তামি এ গল্প অবলম্বনে তৈরি করেন ‘শিরিন’। এর কাহিনিটাও মজার। একদল মেয়ে একটা ঘরে বসে ছবিটা দেখার ফাঁকে ফাঁকে এ ব্যাপারে নিজেদের প্রতিক্রিয়া বলে যায়। ৬২৮ সালে মারা যান শিরিন।

ইতিহাস অনুসারে, খসরুর পিতা চতুর্থ হরমুজের মৃত্যুতে বিদ্রোহের মাধ্যমে সিংহাসন দখল করে নেন সেনাপতি বাহরাম। খসরুর সঙ্গে সিরিয়া পালিয়ে যান শিরিন। আশ্রয় নেন বাইজান্টাইন সম্রাট মরিসের প্রাসাদে। শক্তি সঞ্চয় করে ৫৯১ সালে আবারও ফিরে আসেন পারস্যে এবং পুনরুদ্ধার করেন সিংহাসন। এভাবেই পারস্যের রানির আসনে অধিষ্ঠিত হন রোমক বংশোদ্ভূত খ্রিস্টান ধর্মানুসারী আর্মেনীয় রাজকুমারী শিরিন। ধীরে ধীরে পারস্যের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সহায়তায় বিভিন্ন উপায়ে নিজের প্রভাব খাটাতে শুরু করেন তিনি। ৬১৪ সালে জেরুজালেম দখলের পর ক্রস অব জেসাস হস্তগত করে পারসিকরা। রাজধানী তেসিফনে নিয়ে আসা হয় এবং সেটি নিজের কাছে রেখে দেন রানি শিরিন।

মিলটন মোললা