রবিবার, ২৮ মে, ২০১৭

মৃত্যুক্ষুধা বাস্তবতার সাহিত্যায়ন

যদিও রবীন্দ্রনাথ হতাশ সুরে উচ্চারণ করেছেন—

‘আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে...

আপনার মনে বসিয়া একেলা/ অনল শিখরে যা করিনু খেলা

দিন শেষে দেখি ছাই হ’ল সব হুতাশে হুতাশে।’


তবুও সেই ‘ছাই’ থেকে ‘অমূল্য’ রতন খোঁজার নিরন্তর প্রচেষ্টা পাঠকের। কেননা, সাহিত্য যে জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আর তা যদি হয় বাস্তবঘেঁষা তবে তো কথাই নেই। বাকস্তবকে কল্পনার সোনার ছোঁয়ায় উপস্থাপন করে লেখক পাঠকের হূদয়াসনে বসেন রাজাধিরাজ রূপে। যে ‘মানস প্রতিমা ভাসিয়া বেড়ায় আকাশে’ তাকে কালি-কলম এবং মনের টানে নামিয়ে আনেন ধরার ধুলায়।

কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় তেমনটিই করেছিলেন তাঁর অন্যতম উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’য়। জীবনের একপর্যায়ে তাঁকে থামতে হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। প্রায় চার বছরের অধিককাল তিনি এখানে অতিবাহিত করেন। চাঁদ সড়কের গ্রেস কটেজের আশেপাশের বিচিত্র জীবন-যাপন এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট এবং চরিত্রগুলোও তাঁর স্বচক্ষে দেখা। উপন্যাস আরম্ভ হয় চাঁদ সড়কের চমত্কার বর্ণনায়—

‘পুতুল-খেলার কৃষ্ণনগর।

যেন কোন খেয়ালি-শিশুর খেলাশেষের ভাঙা খেলাঘর।

খোকার চলে যাওয়ার পথের পানে জননীর মত চেয়ে আছে,

খোকার খেলার পুতুল সামনে নিয়ে।

এরি একটেরে চাঁদসড়ক। একটা গোপন ব্যথার মত করে গাছ-পালার আড়াল টেনে রাখা।’

সাহিত্যিক আকবর উদ্দীন ‘চাঁদ সড়কে নজরুল’ স্মৃতিকথায় লিখেছেন—‘এ বোধহয় ১৯২৭ সালের শেষ অথবা ১৯২৮ সালের গোড়ার দিকের ঘটনা। একদিন বেলা আন্দাজ দশটার সময় গিয়ে দেখি নজরুল একটা চিঠি হাতে করে আমতলায় বেতের চেয়ারটায় বিষণ্নভাবে বসে আছেন। কারণ বিজ্ঞাসা করায় তিনি চিঠিটা আমাকে দিলেন। কোন এক অখ্যাত মওলবী এই চিঠিতে নজরুলকে কাফের বলেছেন ও অনেক কটুকথা লিখেছেন—এরমধ্যে কিছুটা পারিবারিক ব্যাপারও ছিল।

নজরুল বললেন, “আমাকে হাজারবার কাফের বলুক ক্ষতি নাই; কিন্তু আমার স্ত্রীকে এর মধ্যে জড়ানো কেন?’

বললাম, “আপনার বাড়ীর ঐ কোণের কলতলার ঝগড়া ত রোজাই শোনেন। লক্ষ করেননি কি যে, গালাগাল দিতে আসল কথার সঙ্গে অনেক সত্যি-মিথ্যে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কিছু আসে; আর তা না হলে গালাগাল জমে না।”

হেসে বললেন, “যাক্, মনটা হাল্কা হ’ল।”

কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর চা পান করতে করতে বললেন, “মন্দ বলেননি। চাঁদসড়ক, ‘ওমান কাথলি’ পাড়া আর এই কলতলা একটা অদ্ভুত দুনিয়া। এই নিয়েইত অনেক কিছু লেখা যায়।” 

বললাম, “লিখুন না কেন?”

বলা বাহুল্য এরই ফলশ্রুতি ‘মৃত্যু-ক্ষুধা’।

নজরুলেল ‘মৃত্যু-ক্ষুধা’ বইয়ে চাঁদসড়কের কতকগুলো সত্যিকার চরিত্র কেবল নাম বদলে ব্যবহার করা হয়েছে।

গজালের-মা’র আসল ডাকনাম ছিল হবির (হাবিবের) মা। তার তিন ছেলে—বড় নূর মোহাম্মদ, মেঝো হাবিব, ছোট করিম—যাকে বইতে প্যাঁকালে নাম দেওয়া হয়েছে। মেজ-বৌ ছিল হাবিবের স্ত্রী।... ‘ওমান-কাথলি’ পাড়ার হিড়িম্বার সত্যিকারের নাম ছিল কামিনী। দশাসই পুরুষালী চেহারা। ধাত্রী হিসেবে তার নাম-ডাক ছিল। তা ছাড়া ঝগড়া ও লোকের উপকার করা—উভয়তেই তার নাম-ডাক ছিল।’

মেজ-বৌ সম্বন্ধে আকবর উদ্দীন লিখেছেন—‘মেজ-বৌয়ের আচরণ ও চরিত্র ছিল বেশ একটু স্বতন্ত্র ধরনের। তার রং ছিল গৌর ও উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মাঝামাঝি। চোখ দুটো খুব আয়ত না হলেও চেহারার সঙ্গে বেশ মানানসই ছিল। দেহের গঠন ছিল যাকে বলা যায় শার্প। দর্শনীয় ছিল তার চুলের বোঝা—ঘন, নিতম্ব ছাড়িয়ে নিচে পড়তো। মোটের উপর তার রূপ ছিল বললে মিথ্যে বলা হয় না। মেয়েটি পাড়ার আর পাঁচটা মেয়ের মতো ঝগড়া করতো না। মিশতো সকলের সঙ্গে, অথচ যেন একটু আলাদা থাকতো। সামান্য কিছু লিখতে পড়তেও জানতো। আর সব চাইতে আকর্ষণীয় ছিল তার সদাপ্রফুল্ল ভাব; হাসতো খুব—এক এক সময় হেসে লুটিয়ে পড়তো।... মাঝে মাঝে নজরুলের বাড়ীতে যেতো দোলেনার সঙ্গে গল্প করতে। অনেক দিন নজরুল এই গরীব অথচ রূপসী মেয়েটির উজ্জ্বল হাসির শব্দ শুনে বিস্মিত হতেন। প্রায়ই বলতেন, “অদ্ভূত মেয়ে, অদ্ভূত হাসি!” আর একদিন বলেছিলেন, “চোখ আর মন থাকলে দিন মজুরের ঘরের এই রকম মেয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। আর তাদের নিয়ে বড় বড় বই লেখা যায়।”

মেজ-বৌয়ের ডাকনাম ছিল নসিরন। একদিন সে লেখক আকবর উদ্দীনের স্ত্রীকে জানালো গোয়াবীর এক বাবু তাকে বেল কিনবার নাম করে ধাওয়া করেছে। এবং কাল সন্ধ্যায় আসবে বলে খাম ফেলে গেছে।

নজরুল শোনার পর প্ল্যান করে বেল দিয়ে ঘায়েল করে বাবুকে নাস্তানাবুদ করেন এবং দু’টো লোক ‘হাঁড়োল’ ‘হাঁড়োল’ বলে চিত্কার করতে করতে তাকে স্টেশনের রাস্তা পর্যন্ত তাড়িয়ে দেয়। নজরুল হাসতে হাসতে বললেন, ‘হাঁড়োল শব্দটি অমর হোক! কী শব্দই না বের করেছে এ-পাড়ার লোকেরা’। ‘মৃত্যু ক্ষুধা’ বইতে ‘হাঁড়োল’ নজরুল ব্যবহার করেছেন।

এরপর মেজ-বৌ প্রায় প্রত্যেক দিন নজরুলের বাসায় যেতো। দোলেনার সঙ্গে গল্প করতো, তার স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছ্বসিত হাসি হাসতো। ফাঁকে ফাঁকে নজরুলের সঙ্গেও দু’একটা কথা বলতো। নজরুলের প্রসঙ্গে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো— মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে পড়তো। আকবর উদ্দীনের স্ত্রী লক্ষ্য করে বুঝে ছিলেন— হয়তো মেয়েটি নজরুলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তারা মেজ-বৌকে বিয়ে করতে বলেন। কিন্তু সে কিছুতেই রাজী হয় না। সে ভাবে তাকে এ-পাড়া থেকে তাড়িয়ে দেবার মতলব হচ্ছে। তাই স্বেচ্ছায় এসে বলে,— “বেশ, করিমের (প্যাঁকালের) সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিন, আমি রাজী আছি।”

শেষ পর্যন্ত তা-ই করা হলো।

নজরুল শুনে গম্ভীরভাবে বললেন, “কত বড় ত্যাগ করল বুঝলেন?” লেখক বললেন, “জানি, কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। আর দু’দিন পরে আপনাকে জড়িয়ে ওর নামে অন্যায় কলঙ্ক রটনা হত, সেটা কি ভাল?”

একটু চুপ করে থেকে আরো গম্ভীরভাবে বললেন, “কলঙ্কের ছাপ ত আমার সর্বাঙ্গে— যাক, ভালই হ’ল, তবে আমি ওকে অমর করে দেবো।”

[নজরুল একাডেমী পত্রিকা - ১ম বর্ষ,৬ষ্ঠ সংখ্যা, বসন্ত; ১৩৭৬]

একটা সময় এসেছিল ভারতবর্ষে, মূলত বাংলায়, যখন অসংখ্য হিন্দু-মুসলমান খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যাচ্ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই প্রবণতা চূড়ান্তে উঠেছিল। নজরুল ইসলাম ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে মুসলমান নারী মেজ-বৌয়ের খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তী জটিলতা, বেদনা ও কারুণ্য রূপায়িত করে সত্যি তাকে অমর করে গেছেন। বলতেই হয় ‘মেজ-বৌ’ নজরুলের এক অনবদ্য সৃষ্টি।

‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের পনেরো পরিচ্ছদে আনসারের আবির্ভাব। আনসার চরিত্রে নজরুলের আত্মপ্রতিফলন ঘটেছে। নজরুলের মতোই আনসার সাম্যবাদী—সমাজের নিচুতলার মানুষ—মেথর, মুচি, ঝাড়ুদার ইত্যাদি শ্রেণিকে সে সাম্যবাদের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছে। শাসন-শোষণহীন যে সমাজের স্বপ্ন আনসার দেখে তা কিন্তু বাস্তবায়িত হয় না—কেবল মাত্র কথা এবং বক্তৃতায় সমাজে পরিবর্তন আসে না।

একপর্যায়ে দেখা যায়, আদর্শবাদী আনসারের প্রতি মেজ-বৌয়ের দুর্বলতা। কারণ আনসার শুধু আদর্শবাদী, সাম্যবাদী নয়—সে রোমান্টিকও। নজরুলের মতো আনসারও ভাবুক, স্বপ্নাতুর, কল্পনাবিলাসী। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত আনসার জানে তার সময় শেষ তবুও সে তার প্রণয়িনী রুবিকে যেন ক্ষুধিত অজগরের মতো গ্রাস করতে চায়।

এই উপন্যাসের রুবি চরিত্রটিও চাঁদ সড়ক এলাকার একটি বাস্তব চরিত্র। লেখক মরমী রায় ‘নজরুল-সান্নিধ্য ধন্যা গোফুরুন্নেসার সান্নিধ্যে’ নামক স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন, কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) কৃষ্ণনগর শহরের চাঁদ সড়ক এলাকার ‘গ্রেস কটেজ’ বাড়িতে ১৯২৬-২৮ সাল বসবাস করেন, এই সময় নজরুলের সান্নিধ্যে এসেছিলেন এই এলাকারই এক কিশোরী, আজ তিনি অশীতিপরা বৃদ্ধা, গোফুরুন্নেসা বিবি। একপর্যায়ে লেখক তার কাছে জানতে চান, ‘‘নজরুল লিখেছেন চাঁদসড়ক এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত শ্রমজীবী জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’। এই উপন্যাসের নায়িকা রুবি নাকি আপনি?”

গোফুর হাসলেন। বললেন :লোকে বলাবলি করত—আমাকে দেখেই কাজীদা নাকি রুবির চরিত্র লিখেছিলেন। আমি বলে উঠি : উপন্যাসের রুবির সঙ্গে আপনার তো মিল নেই? গোফুর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন : না, তা ঠিক নয়। রুবির সঙ্গে আমার মিল আছে। রুবিরও ছোট বেলায় একবার বিয়ে হয়েছিল, স্বামী এক মাসের মধ্যে মারা যায়। আমারও ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল, আট মাসের মধ্যে আমিও বিধবা হয়েছিলাম। রুবিরও আর একবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছিল তার আপত্তি সত্ত্বেও। আমারও তখন বিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছিল আমার আপত্তি সত্ত্বেও। রুবির মত আমিও ছিলাম জেদি—একগুঁয়ে। রুবির মত আমারও বেপরোয়া ভাব ছিল।

প্রশ্ন করি : নজরুল কি এ ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন?

গোফুরের উত্তর : না, তা ঠিক বলেন নি। তবে তাঁর উপন্যাস লেখা শুরু হলে, তিনি আমাদের শোনাতেন আর পাণ্ডুলিপির রুবি প্রসঙ্গ পড়ে শোনাবার সময় বলতেন—ঠিক আমার নানীর মত ছিল রুবি।

এখানে উল্লেখ্য যে, গোফুরুনের মুখের সঙ্গে নজরুলের মা জাহেদা খাতুনের মায়ের মুখের নাকি মিল ছিল তাই নজরুল তাকে নানী বলতেন। গোফুরুন্নেসা স্মৃতিচারণে বলেছেন—‘এমন সময় ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুল এলেন ‘গ্রেস কজেট’ বাড়িতে। তাঁর সঙ্গে স্ত্রী প্রমীলা ও তাঁর মা গিরিবালা দেবী। এই বাড়িতে সপরিবারে বসবাসের প্রথম দিনেই গোফুর গিয়ে পরিচিত হলেন তাঁদের সঙ্গে। রূপসী কিশোরী গোফুরকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ দেখে নজরুল বলে উঠলেন : আজ থেকে তুমি আমার নানী। চাঁদ সড়ক, ওমান কাথলি পাড়া আর এই কলতলা একটা অদ্ভূত দুনিয়া—বলে নজরুলের মনে হয়েছে সেই কলতলার কথা এবং সেখানকার ‘বিখ্যাত’ ঝগড়ার কথাও স্মৃতিচারণ করেছেন গোফুরুন্নেসা। ‘একটা মাজার কথা বলি—কাজীদার বাসার দক্ষিণে রাস্তার পাশে ছিল পুরসভার জলকল। সেখানে আগে জল নেওয়া নিয়ে মেয়ে, বৌদের মধ্যে ঝগড়া হত—কেউ কেউ গালাগালিও দিত। কাজীদা দূর থেকে এই সব ঝগড়া শুনতেন। আর আমার কাছে জানতেন—কে  কোন বাড়ির বৌ—কে কোন বাড়ির মেয়ে। কাজীদা চাঁদ সড়কের রাজমিস্ত্রীদের খবরাখবর খুঁটিয়ে তলিয়ে জানতেন তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায়।

কলতলার ওই বিখ্যাত ঝগড়ার উল্লেখ না করলে প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সুতরাং পাঠক চলুন আমরা ঝগড়া শুনে আসি। ক্রিশ্চান এবং মুসলমানদের জলের কলসি ছোঁয়া নিয়ে ঝগড়া।

‘...ঝগড়া তখন অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং গজালের মা বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলেচ, “হারাম-খোর, খেরেস্তান কোথাকার’! হারাম খেয়ে খেয়ে তোদের গায়ে বন-শুয়োরের মত চর্বি হয়েছে না, লা?

গজালের মাকে আর বলবার অবসর না দিয়ে হিড়িম্বা তার পেতলের কলসিটা খং করে বাঁধানো কলতলায় সজোরে ঠুকে, অল্প দুলিয়ে, থ্যাবড়ানো গোবরের মত মুখ বিকৃত করে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে খিঁচিয়ে উঠলে, “ওলো আগ্-ধুম্সী (রাগ ধুম্সী)! ওলো ভাগলপুরে গাই! ওলো আমার ছেলে খেরেস্তানের ভাত রাঁধে নাই লো, আমার ছেলে জজ সায়েবের খানসামা ছিল— জজ সায়েবের লো, ইংরেজের!”

পুঁটের মাও খেরেস্তান, তার আর সইল না। সে তার ম্যালেরিয়া-জীর্ণ কণ্ঠটাকে যথাসম্ভব তীক্ষ্ম করে বলে উঠলে, “আ-সইরন সইতে নারি, সিকেয় ইয়ে দিয়ে ঝুলে মরি! বলি, অ’ গজালের মা! ঐ জজ সায়েবও আমাদেরই জাত। আমরা ‘আজার’ (রাজার) জাত, জানিস?”

দু-তিনটি ক্রীশ্চান মেয়ে পুঁটের মা’র এই মোক্ষম যুক্তিপূর্ণ জবাব মুনে খুশি হয়ে বলে উঠ্ল, “আচ্ছা বলেছিস মাসি!”

খাতুনের মা কাঁখে কলসি পেটে পিলে আর কাঁধে ছেলে নিয়ে এতক্ষণ শোনার দলে দাঁড়িয়েছিল। এবং মাঝে মাঝে মূল গায়েনের দোয়ারকি করার মত গজালের মার সুরে মিলিয়ে দু-একটা টিপ্পনি কাটছিল। কিন্তু এই বার আর তার সইল না। ছেলে পিলে আর কলসি সমেত সে একেবারে মূল গায়েনের গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়াল এবং ক্রীশ্চানদের বৌদের লক্ষ্য করে যে ভাষা প্রয়োগ করল তা লেখা যায়ই না, শোনাও যায় না। এইবার হিড়িম্বা ফস করে তার চুল খুলে দিয়ে একেবারে এলোকেশীবামা হয়ে দাঁড়াল এবং কোমরে আঁচল জড়াতে জড়াতে খাতুনের মার মুখের সামনে হাত দুটো বারকয়েক বিচিত্র ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “তুই আবার কেলো উঝেড়াখাগী! তবু যদি ভাতারের ধম্সুনি না খেতিস দুবেলা।’ তারপর তার অপভাষাটার উত্তর তার চেয়েও অপভাষায় দিয়ে সে গজালের মার পানে চেয়ে বললে, হ্যালা ভাতার পুত্খাগী। তিন বেটা খাগী। তোর ছেলে না হয় জজ সায়েবের বাবুর্চিগিরি করত, আর সে ছেলেকেও তো দিয়েছিস কবরে। আর তুই নিজে যে সেদিন আমফেসাদ বাবুর (রামপ্রসাদ বাবু) হাঁড়ি ঠেলে রুনুন (উনুন) কেড়ে এলি। ঐ আমফেসাদ বাবু তোদের মৌলবী সাবের নাকিলা? হাত শোঁক, এখনও খেরেস্তানের গন্ধ পাবি।”

এর চরম উত্তর দিল গজালের মা, বেশ একটু ছুরির মত ধারালো হাসি হেসে, “বলি ওলো হুতেমা চোখী, ঐ আমফেসাদ বাবু আমার তলপেটে চালের পোটলা পেয়ে মাথায় চটি ঝাড়েনি। ছেলের বেয়ারাম হয়ে লো (হয়েছিল), তাই ওর বাড়ি চাকরি করতে গিয়েলাম (গিয়েছিলাম), তাই বলে এক গেলাস পানি খেয়েছি ও বাড়িতে? বলুক দেখি কোন বাড়ই রাঁড়ি বলবে।”

শেষের কথাগুলো হিড়িম্বার কানে যায়নি। সে ‘ছিটেন পাড়ার’ (প্রোটেস্টান্ট পাড়ার) পাদরী সায়েব মিস্টার রামপ্রসাদ হাতির বাড়ি চাকরি করতে গিয়ে সত্যিই একবার চাল চুরির জন্য মার খেয়েছিল। কিন্তু সে কেলেঙ্কারীর কথাটা এতগুলো মেয়ের মধ্যে ঘোষণা করে দেওয়াতে সে এইবার যা কাণ্ড করতে লাগল—তা অবর্ণনীয়। চুলছিঁড়ে, আঙুল মটকে, চেঁচিয়ে, কেঁদে, নেচে, কুঁদে সে যেন একটা বিরাট ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে ফেললে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে গালির বিগলিত ধারা—অনর্গল গেরিকস াব।

যত গালি তার জানা ছিল ভব্য, অভব্য, শ্লীল, অশ্লীল, সবগুলো একবার, দু’বার, বারবার আবৃত্তি করেও তার যেন আর খেদ মেটে না।

‘লুইস্-গানার’ যেন মিনিটে সাতশ করে গুলী ছুঁড়ছে!

আঞ্চলিক বাংলার দক্ষ রূপকার নজরুল— ঝগড়ার এমন বর্ণনা উপস্থাপন করলেন যা বাংলা সাহিত্যে বিরল। চাঁদ সড়কের অনেক আঞ্চলিক শব্দের মধ্যে কবির পছন্দ হয়েছিল ‘হাঁড়োল’ শব্দটি। এটিকেও অমর করে রেখেছেন ‘মৃত্যুক্ষুধা’য়। প্যাঁকালেও তার প্রেমিক ‘ওমান কাতলি’ কুর্শি যখন প্রেমালাপের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন পেছন থেকে এক গরুর গাড়িওয়ালা হেঁড়ে গলায় গান ধরে সব ভণ্ডুল করে দিল। সেই ‘ঋষভ চিত্কার’কে রাজমিস্তিরি দলের জনাব নামের লোক বলে উঠল। “উঃ শালার গলা ত নয়, যেন হাঁড়োল। ও শালা কে রে?”

প্যাঁকালে কটু কণ্ঠে বলে উঠল, “ঐ শালা ন্যাড়া গয়লা— শালা গান করছে না ত, যেন হামলাচ্ছে।”

গোফুরুন্নেসা উল্লেখ করেছেন—চাঁদ সড়কের রাজমিস্ত্রীদের খবরা-খবর খুঁটিয়ে তলিয়ে জানতেন তাদের সঙ্গে আলাপ-চারিতায়। মৃত্যুক্ষুধায় তেমনি একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যার অর্থ বুঝা প্রায় অসাধ্য। যেমন—‘হঠাত্ ওদের একজন চেঁচিয়ে উঠল, “খড়গ পাচে।”

অমনি সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। যে ঐ ইঙ্গিত-বাণী উচ্চারণ করলে তার গা টিপে আর একজন আস্তে জিজ্ঞাসা করলে, “কোথায় রে?”

অদূরে সাইকেল রেখে এক ভদ্রলোক রাস্তার ধারে একটা অপকর্ম করতে বসে গেছিলেন। সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে প্যাঁকালে বললে, “উ-ই যে, নীল চোয়ায়।”

লেখকের বক্তব্য এরকম—‘এদেশের রাজমিস্তিরিদের অনেকগুলো ‘কোডওয়ার্ড’— সাংস্কৃতিক বাণী আছে— যার মানে এরা ছাড়া অন্য কেউ বোঝে না। ‘খড়গ্ প্যাঁচে’ বাবু বা সায়ের আসেছ বা দেখছে, আর ‘নীল চোঁয়ায়’ ব্যবহূত হয় ঐ অপকর্মটির গূঢ় অর্থে।

‘মৃত্যু ক্ষুধা’র উল্লেখযোগ্য-চরিত্র প্যাঁকালে। নজরুল তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—‘গজালের মা-র ছোট ছেলে প্যাঁকালে টাউনের থিয়েটার দলে নাচে, সখী সাজে, গান করে। কাজও করে রাজ মিস্তিরির কাজ।

বাবু-ঘেঁষা হয়ে সেও একটু বাবু-গোছ হয়ে গেছে। টেড়ি কাটে, ‘ছিকেরট’ টানে, পান খায়, চা খায়। পাড়ার মেয়ে মহলে তার মস্ত নাম। বলে— “যেমন গলা, তেমনি গান, তেমনি সৌখিন। ‘থিয়েটারে’ লাচে— বাবুদের থিয়েটরে, ঐ খেরেস্তান পাড়ার যাত্তার গান লয়। হুঁ, হুঁ।”

সে যখন ‘ফুট-গজ’ ‘কন্নিক’ আর ‘সুত্’ নিয়ে ‘ছিকরেট’ টানতে টানতে কাজে যায় আর যেতে যেতে গান ধরে, তখন পাড়ার বৌ-ঝিরা ঘোমটা বেশ একটু তুলেই তার দিকে চায়।

...আর অবিবাহিত মেয়ের মায়েরা আল্লামিঞাকে জোড়া মোরগের গোশতের লোভ দেখিয়ে বলে, “হেই আল্লাজি, আমার কুড়ুনীর সাথেই ওর জোড়া লিখো।”

প্যাঁকালে সৌখিন— চা খাওয়া তার সখ, চার আনা দামের আয়না দু’পয়সায় বিক্রি করে দোকানে বসে চা খায়।

চুলে টেড়ি কাটাও তার সখের একটি। অভাবের সংসারে আয়না কিনতে পারে না বলে থালায় জল রেখে ঝুঁলে পড়ে বেশ বাগিয়ে টেড়ি কাটে তেল-চিটে চুলে।

“বয়স তার এই আঠার-উনিশ। কাজেই চেয়ে না পাওয়ার দুঃখটা ভুলতে আজো তার বেশ একটু সময় লাগে। কিন্তু তার আয়নার জন্য তার পিতৃহীন ছোট ছোট ভাইপো ভাইঝিগুলি ক্ষুধিত থাকবে— এ যখন মনে হয় তখন তার নিজের অভাব আর অভাবই বোধ হয়না।”

বিধবা ভাইবৌদের জন্য হূদয়ে অসীম মমত্ব বোধ করে। “সেজ-ভাবী অসুস্থ তার জন্য ললিত ডাক্তারের বাড়ির খানিকটা পলস্তরা করে দিয়ে এই ওষুধ নিয়ে এসেছি সেজ-ভাবীর তরে। দাঁড়া, এক পুরিয়া খাইয়ে দিই আগে।”

সেজ-বৌ ওষুধ দেখে খুশি হয়ে বলে উঠল, “ই কোন্ ওষুধ ছোট-মিঁয়ে? এলোপাতাড়ি না হৈমুবাতিক?”

প্যাঁকালে বিজ্ঞতার হাসি হেসে বললে, “ই এলিওপাতি লয় সেজ-ভাবী, হোমিওবাতি। গুড়ের মত মিষ্টি। খেয়েই দেখ।”

‘হঠাত্ সেদিন সেজ-বৌর অবস্থা একেবারে যায়-যায় হয়ে উঠ্ল। ‘ছিটেন’ পাড়ার ন’কড়ি ডাক্তার তাঁর বৈঠকখানাটা বিনি পয়সায় চুনকাম করে দেবার চুক্তিতে দেখতে এলেন। বললেন, “গরীব লোক তোরা, ভিজিট আমি নেব না বাপু— আমার বৈঠকখানায় একটু গোলা দিয়ে দিবি, তা দিন তিনেক খাটলেই চলে যাবে, কি বলিস?”

প্যাঁকালে চোখের জল মুছে কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে ডাক্তার বাবুর দিকে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।’

মেজ-বৌয়ের নিষেধ সত্ত্বেও প্যাঁকালে এই লোভী ডাক্তারকে গোটা আটেক ডিম দেয় শুধুমাত্র সেজ-ভাবী ডাক্তারের পরামর্শে ভাল হবে সে— আশায়।

কুর্শির সঙ্গে তার প্রেম— সে গভীরভাবে ভালবাসে কুর্শিকে। কিন্তু যে দিন সে দেখলো কুর্শি রেতো কামারের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করছে তখন সে আর সহ্য করতে পারে না। কন্নিক ছুঁড়ে মারে— কন্নিক এসে লাগে কুর্শির বাম কানের ওপরে। ঠিক কপালের পাশে। যাবার বেলায় বলে যায়, “তোর বাপকে বলিস আমি মেরেছি তোকে।”

শেষ পর্যন্ত সে রানাঘাট চলে যায়।

মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন লিখেছেন, তিনি নজরুলকে রুমে তালাবদ্ধ করে লেখা আদায় করেছেন ‘মৃত্যু ক্ষুধা’র জন্য। আকবর উদ্দীনও বলেছেন— ‘বইটি তিনি একটানা লেখেন নি।’ অনেক সমালোচক মনে করেন একটানা না লেখার কারণে এর শিল্প সৌকর্য কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে। উনিশ পরিচ্ছেদে আছে, মেজ-বৌ দুই সন্তান নিয়ে খ্রিস্টান হয়েছে। কিন্তু বাইশ পরিচ্ছেদে দেখা যায়, তার ছেয়েমেয়েরা মুসলমান রয়ে গেছে। একটানা না লেখার কারণে এ অসংগতি হতে পারে। মোবাশ্বের আলী অবশ্য মনে করেন— ‘মৃত্যু ক্ষুধা’য় তিনি আত্মগত সংকীর্ণ গণ্ডির ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস পেয়েছেন এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবমুখী হয়ে উঠেছে। বীত-ত্রিশের এই রচনায় তিনি যে অহংসর্বস্বতার ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তবতাবোধ ও সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন তা যথার্থ বিস্ময়াবহ।

ড. গুলশান আরা






Find Nobin Kontho on Facebook