মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আমরা ধর্ষণ যেভাবে শিখলাম!

সমস্যার ট্রিগার না দেখে আমরা বুলেট নিয়ে খুব মাথা ঘামাই এটা নতুন কিছু না। পরবর্তী কথাগুলো আমার কাছে সম্পূর্ণ বাস্তব, কারো কল্পনার সঙ্গে মিলে গেলে তা কাকতালীয়।

বাংলা সিনেমার গানের দৃশ্য, নায়ক-নায়িকার প্রেম হওয়ার পরের দৃশ্যেই গান, যেখানে তারা নাচছে। গানের অন্তরার সময় নায়ক-নায়িকাকে পাপ্পি দিতে গেল, আর নায়িকা লজ্জায় তার মুখ ঘুরিয়ে নিল। একটা কাট মেরে পরিচালক নিয়ে গেল দুটো গোলাপ ফুলের দৃশ্যে যেখানে দুটো ফুল আলতো করে
বাড়ি খেল, অর্থাৎ পরিচালক এখানে পবিত্র ভালোবাসার দৃশ্য দেখাতে চান না।

এই সিনেমারই অন্য দৃশ্যে যাই, যেখানে নায়িকার বাবার লোক বা অন্য কোনো খলনায়ক নায়কের বোনকে ধাওয়া করে ধরে নিয়ে গেল গাজীপুর জঙ্গলের কোনো বাংলোতে। সেখানের দৃশ্যগুলো যেমনটা হয়ে থাকে, নায়কের বোনকে মাঝখানে রেখে সবাই হাততালি দিচ্ছে। প্রথমেই টান মেরে ওড়না সরিয়ে ফেলা হলো। এরপর তাকে দুর্বল করার জন্য শরীরে করা হলো আঘাত। এরপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো বিছানায়। সিনেমেটোগ্রাফার তখন এক্সট্রিম ক্লোজে নায়িকার বুকের বিন্দু বিন্দু ঘাম নিচ্ছে। এর পরের শটে দেখানো হলো নায়কের বোনের টান টান পা, মিশন শেষ।

এরপর সম্ভাব্য স্ক্রিপ্ট হচ্ছে, নায়কের বোন হাসপাতালে ভর্তির পর সুযোগ বুঝে পাচতলার কাচের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল এফডিসির চত্বরে। অথবা বাড়িতে ফেরার সময় হটাৎ ট্রাকের সামনে আত্মহত্যা, অথবা বাড়ি ফিরে লজ্জায় নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা।

এদিকে নায়ক-নায়িকার সঙ্গে পবিত্র প্রেম (যে পবিত্র প্রেমের দৃশ্য পরিচালক দেখাতে লজ্জা পেয়েছিলেন) করে বাড়ি ফিরে দেখে বোন ধর্ষণের অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। নায়ক তখন বোনের ওড়না কপালে বেঁধে নিয়ে প্রতিশোধের আগুনে পাগল হয়ে এক দৌড়ে চলে গেল আর একাই সবাইকে পুত করে দিল।

শুধু আমাদের দেশে না, এই উপমহাদেশের কিছু সিনেমা এভাবেই ধর্ষণের প্রচার ও বাজারজাত করে আসছে। একটু খেয়াল করুন ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ধারণার বীজ বপন করেছে এই সিনেমাগুলোই। এই উপমহাদেশের সিনেমায় প্রচুর ধর্ষণের দৃশ্য, একটু গুগল করে দেখুন তো ধর্ষণ কোন অঞ্চলে বেশি হয়। বাসে, গাড়িতে ধর্ষণ, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং ধর্ষণের পর হত্যা বা আত্মহত্যা এই সমস্ত ধারণা এই অঞ্চলে এলো কোথা থেকে। আমি বলছি না শতভাগ শিখিয়েছে এসব সিনেমা। একজন কিশোর এই ধরনের দৃশ্যে আসলে কী শেখে? আমার তো মনে হয় এখানেই হয় তার ধর্ষণের হাতেখড়ি।

পশ্চিমাদের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শেখানো হয় দুজনে রাজি তো হয়ে গেল প্রেম, বিছানার দৃশ্যও থাকল। কারো সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না, ওকে সুখে শান্তিতে আমরা আলাদা হয়ে যাই, নো ভায়োলেন্স। আমি বলছি না ওটাই অনুসরণ করতে হবে, তবে আমাদের যা শেখানো হয়েছে, তার থেকে ঢের ভালো ওই সব দৃশ্য।

এপ্রিল মাসের ২ তারিখ শনিবার রাতে পৌর এলাকার গুন্দইল পূর্বপাড়ায় নববধূর মুখে গামছা বেঁধে ধর্ষণ করে।

২০১৫ সালের জুন মাসে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে এক কিশোরীকে গণধর্ষণের পর গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ওই তরুণী সেবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছিল।

সেপ্টেম্বর ২০১৫, মা ও মেয়েদের পরস্পরের সামনে ধর্ষণ করে ১৪ জন দুর্বৃত্ত। আবার সেটির ভিডিও ধারণ করা হয়। সেটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে। এরপর জোর করে সম্পত্তি দখলের পাঁয়তারা চালিয়েছে।

সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে ঝালকাঠিতে সুন্দরবন-২ লঞ্চের কেবিনে আটকে রেখে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে বখাটে যুবকরা।

জুলাই ২০১৪, ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে এক ১৪ বছরের কিশোরীকে তার বড় ভাইয়ের কথিত অপরাধের শাস্তি হিসেবে ধর্ষণ করা হয়েছে।

এই রকম জানা-অজানা অগণিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এগুলো তুলে ধরলেও এগুলো চাপা পড়ে যায় নতুন কোনো ইস্যুতে বা অন্য কোনো ধর্ষণের খবরে। আবার অনেকেই ধর্ষিত হওয়ার পর মান-সম্মানের ভয়ে মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছেন।

যে উপমহাদেশের ছেলেমেয়েকে ছোটবেলাতেই শেখানো হয় তোমাদের এক সঙ্গে থাকা নিরাপদ নয়, স্কুলে ভাগ করা হয় প্রভাত শাখা ও দিবা শাখা, উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, বালক বিদ্যালয়, কো এডুকেশনে বসানো হয় ডান পাশ বাম পাশ করে, বাসে বসানো হয় শিশু ও প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে (উইথ ডিউ রেস্পেক্ট) এবং চলচ্চিত্রে প্রেমের বদলে শেখানো হয় ধর্ষণের ভিডিও টিউটোরিয়াল, সে দেশে ধর্ষণ বন্ধ হবে না কখনোই। নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অধিকাংশ মেয়েই দুনিয়া তো দূরের কথা, নিজের দেশটিও ঘুরে দেখতে পারে না। আমি জানি আমার মা, আমার বোন আমারই দেশের এক ভাগ না দেখে মরে যাবে। ওরা বেঁচে থেকে মরে যায় না, ওরা সারা জীবন নিশ্বাস নিয়ে ঘরে মরে থাকে।

শেষে একটা প্রশ্ন রেখে যাই, ধর্ষণ কীভাবে করা হয়, এটা আপনি কোথায় প্রথম দেখেছেন?

শেখ রাজিব

লেখক : ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক