বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬

স্বপ্নের সেই পতাকা

একটি জাতীয় পতাকা মানে একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়, একটি জাতির স্বীকৃতি। একটি জাতীয় পতাকা মানে একটি জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, ভাষা, সংস্কৃতি তথা তার সাংস্কৃতিক পরিচয়। জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক আর জাতীয় সংগীত সংস্কৃতির প্রতীক। জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীত নিয়েই রাষ্ট্র স্থিতি লাভ করে এগিয়ে যায়। বাঙালি জাতি তার প্রাণপ্রিয় পতাকা অর্জনে অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করেছে। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। 
জাতীয় পতাকা অর্জনে বাঙালি জাতির বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা তৈরির পর্বটি খুবই
আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাময়। এটি একটি টিম স্পিরিটের ফলাফল। এই পতাকাটি তত্কালীন ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের উর্বর মস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ। এই পতাকা তৈরিতে আমি সেদিন আদ্যোপান্ত জড়িত ছিলাম। তাই আমার স্মৃতিতে যতটুকু মনে আছে তা জাতির সামনে তুলে ধরছি। পতাকার ভাবনাটি হঠাৎ করে কারো মাথায় উদয় হয়নি। এটি অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘সিচুয়েশন ডিমান্ডস’। অর্থাৎ একটি পতাকা অতি জরুরি হয়ে পড়েছিল পরিস্থিতির কারণে। আর এটি তৈরি হয়েছিল এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে এক কর্মদিবসের প্রচেষ্টায়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই পতাকাটি প্রথমবারের মতো উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে। বাংলাদেশের পতাকা তৈরি ও উত্তোলনের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার বিষয়ে একটু বলে নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির সব আন্দোলনের সূতিকাগার। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি হলের কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই। এই হলটি হচ্ছে ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। এই হলটি ছিল ছাত্রলীগের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের তীক্ষ নজর ছিল এই হলের ওপর। পুলিশ, ইপিআর ও আর্মি সুযোগ পেলেই এ হলে রেইড দিত। ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতে ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে গঠিত হয় নিউক্লিয়াস বা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। এর সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলাম বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ মনি ও আমি। ১৯৬৪ সালে গঠিত হয় বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হন কাজী আরেফ আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টকে পুনর্বিন্যাস করে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’। সিরাজুল আলম খানের পাশাপাশি এ পর্যায়ে নেতৃত্বে আসেন কাজী আরেফ আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব, শেখ ফজলুল হক মনি, মার্শাল মনি প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতা। ১৯৭০ সালে গঠিত হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’। আমি ছিলাম এর ডেপুটি কমান্ডার। এর মধ্যে আলোচনায় চলে আসে বঙ্গবন্ধুকে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ কর্তৃক অভিবাদন প্রদানের বিষয়টি, কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন প্রদান কোথায় কবে করা হবে তা গোপন রাখা হয়। তবে ওই অভিবাদন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর হাতে একটি পতাকা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭০ সালের ৬ জুন। সন্ধ্যা হওয়ার পরপরই ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতাদের ভিড় লেগে যায়। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, মার্শাল মনি প্রমুখ। রুমের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন চিশতি হেলালুর রহমান, ইকরামুল হক, নজরুল, শিবনারায়ণ দাস, রেজা শাহজাহান প্রমুখ ছাত্রনেতা। প্রথমে একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। উপস্থিত সভার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে পতাকার জমিন হবে বাংলার চিরচেনা সবুজ রঙের। তার মাঝখানে থাকবে বৃত্তাকার লাল রঙের সূর্যের প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখানে থাকবে সোনালি রঙের বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ছবি। বিষয়টির ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই এর ট্রেসিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় ছাত্রলীগকর্মী শিবনারায়ণ দাসকে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই ট্রেসিংয়ের ওপর ড্রয়িং করে তা আরো নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার জন্য শিবনারায়ণ দাসকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমানে বুয়েটে) শেরে বাংলা হলের ৪১০ নম্বর কক্ষে পাঠানো হয়। সেখানে থাকতেন ছাত্রলীগ নেতা হাসানুল হক ইনু (তথ্যমন্ত্রী) ও সালাউদ্দিন আহম্মেদ। ইনু ভাই ও শাজাহান ভাই ট্রেসিংটি দেখে একটি সাদা কাগজের ওপর চমত্কারভাবে পতাকাটির ড্রয়িং করে দেন। শিবনারায়ণ দাস অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ড্রইংটি মধ্যরাতে এনে সিরাজ ভাইয়ের হাতে দেন। এখন প্রয়োজন দেখা দেয় দর্জি ও কাপড়ের। পতাকাটি তৈরি করে এনে দেওয়ার জন্য দরকার পড়ে অত্যন্ত সাহসী, দক্ষ ও বিচক্ষণ এক কর্মীর। সেদিন মধ্যরাতে আমাকে ডেকে আনা হয় ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে। আমি ও মোস্তফা মোহসীন মন্টু (গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক) তখন অপেক্ষা করছিলাম ১৫১ নম্বর কক্ষে। তখন রাত আনুমানিক ২টা। সিরাজ ভাই আমাকে কাপড় সংগ্রহ করে দর্জি দিয়ে সেলাই করে ড্রইং মতো পতাকা তৈরি করার গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন। আমি তখন মার্শাল ল কোর্ট কর্তৃক ১৪ বছরের দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে খুবই সাবধানতার সঙ্গে চলাফেরা করছি। এখানে বলে রাখি ১৯৬৯ সালে নেতৃত্বের ইঙ্গিতে আমি, মন্টু ও সেলিম নিউ মার্কেটের ভেতর চারজন পাকিস্তানি সেনাকে ঘায়েল করি। আমাদের অনুপস্থিতিতে মার্শাল ল কোর্ট ১৪ বছর কারাদণ্ড দেয়। সিরাজ ভাই আমাকে বললেন, ‘যেখান থেকে পারিস এই ড্রইং অনুযায়ী একটি পতাকা তৈরি করে নিয়ে আয় রাত ফুরানোর আগেই। আমার বিশ্বাস আছে এই কাজটি একমাত্র তুই পারবি।’ তখন নিউ মার্কেটের ভেতরে ছিল একটি মসজিদ এবং কাঁচা বাজারের পাশেও ছিল একটি টিনের তৈরি মসজিদ। এখন যেখানে নিউ সুপারমার্কেট। এই মসজিদের পাশে ছিল কয়েকটি দোকান ঘর, যার একটির মালিক ছিল এক অবাঙালি ব্যক্তি। সে দর্জির কাজ করত এবং রাতে দোকানেই ঘুমাত। আমি সেখানে গিয়ে তার ঘরের দরজায় নক করি। সে চিত্কার দিয়ে বলে, এত রাত্রে কে? আমি তখন নিজ পরিচয় দিয়ে বলি, ‘মুঝে এক ঝাণ্ডা (পতাকা) বানানা হায়, দরওয়াজা খোলো’ (আমার একটি পতাকা তৈরি করতে হবে, দরজা খোলো)। সে দরজা খুলে আমাকে দেখে বলে, খসরু ভাই আপ বহুত তাকলিফ মে হ্যায় (আপনি বড় বিচলিত আছেন)। আমি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বলি, জ্যায়সা জ্যায়সা ম্যায় চাহুঙ্গা ওয়াসা ওয়াসা ক্যারো। আমি তখন উত্তেজিত ও ঘর্মাক্ত। সামান্য সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। আমি তাকে ড্রইংটি বের করে খুলে দেখিয়ে বলি, ‘মুঝে এয়স্যা ঝাণ্ডা বানানা হায়, আভি চাইয়ে’ (আমার এমন একটি পতাকা তৈরি করে দিতে হবে, তাড়াতাড়ি চাই)। আমি তার দোকানে রাখা লাল-সবুজ রঙের কাপড়ের বান্ডিল খুঁজতে থাকি। কিন্তু লাল-সবুজ রঙের কাপড় খুঁজে পেলাম না। অবাঙালি দর্জি বলে, এই রঙের কাপড় পাওয়া যেতে পারে খালেক দর্জির দোকানে। খালেক দর্জির দোকানটি আবার বলাকা ভবনের তিন তলায় ছাত্রলীগের অফিসের পাশে অবস্থিত। সে দোকানের নাম ‘পাক ফ্যাশন টেইলার্স’। খালেকও দোকানেই রাত যাপন করত। আমি অবাঙালি দর্জিকে খালেকের দোকানে গিয়ে আমার কথা বলে ড্রইং মতো পতাকা তৈরি করে আনতে বলি। দর্জি শাটার টেনে সেখানে রওনা হয়। আমি তার দোকানের সামনে একটি টুলে বসে অপেক্ষা করার ভান করি। অবাঙালি দর্জি রওনা হওয়ার সামান্য পরই আমি চোখের নিমেষে নিউ মার্কেটের ছাদে উঠে মাথা নিচু করে দৌড়ে এসে অদূরে বলাকা ভবনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। আমি ভাবছিলাম ড্রইং হাতে নিয়ে দর্জি গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের আবার ডেকে না আনে। কারণ তখনকার পরিস্থিতি এমন ছিল যে কাউকে বিশ্বাস করা যেত না। আমি নিউ মার্কেটের ছাদে উঠে উপুড় হয়ে বসে দেখি পাক ফ্যাশন টেইলার্সের দোকানের লাইট জ্বলেছে। এর কয়েক মিনিট পর মেশিনে কাপড় সেলাই করার আওয়াজ ভেসে আসে। এরপর মেশিনের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়, লাইট নিভে যায়। আমি দ্রুত আবার আগের জায়গায় ফিরে এসে পতাকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দর্জি এসে বলে, ‘লিজিয়ে খসরু ভাই, খালেক কা পাছ কাপড়া মিলা, ওহি বানাকে দিয়া’ (নিন খসরু ভাই, খালেকের কাছে কাপড় ছিল ও বানিয়েও দিল)। আমি পতাকাটি খুলে এক ঝলকে দেখে ভাঁজ করে গেঞ্জির মধ্যে ঢুকিয়ে গন্তব্যে রওনা হই। আমি নিউ মার্কেটের পশ্চিম পাশ দিয়ে এসে আজিমপুর কবরস্থানের প্রাচীরের কাছাকাছি চলে আসি। দেখি নীলক্ষেত-নিউ মার্কেটের মোড় থেকে কয়েকটি গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে ইপিআর গেটের দিকে আসছে। প্রথমে গাড়িগুলোকে ইপিআরের ভেবেছিলাম। আমি টুক করে কবরস্থানের প্রাচীর টপকে ওপারে গিয়ে মাথা উঁচু করে দেখি, গাড়ি থেকে নেমে পাকিস্তানি সেনারা দ্রুত এলাকাটি ঘিরে ফেলছে। আমি বুঝতে পারি, তারা কোথাও থেকে ইনফরমেশন পেয়েছে। এভাবে দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে অসংখ্যবার প্রায় ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। রাত তখন শেষ প্রহর। আমি হলে প্রবেশ করে সিরাজ ভাইয়ের কাছে আসি। দেখি, ছাত্রলীগ নেতারা জড়ো হয়ে বসে ঊর্ধ্বশ্বাসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সিরাজ ভাইয়ের হাতে পতাকাটি তুলে দিলে তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমি জানতাম তুই পারবি।’ এরপর ছাত্রলীগ নেতারা পতাকাটি কবে কখন ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় বসেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলে ঢাকায় সর্বস্তরের জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিন বিকেলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত মতে পরদিন ২ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। ওই দিন বিকেলে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের এক প্রতিবাদ সভা কলা ভবনের সামনে বটতলায় অনুষ্ঠিত হয়। সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতা শেখ মো. জাহিদ হোসেন ওই পতাকাটি একটি বাঁশের আগায় বেঁধে ইকবাল হল থেকে মিছিল নিয়ে এসে বটতলায় জড়ো হন। জয় বাংলা বাহিনীর এই পতাকাটি হাতে নিয়ে রব ভাই তা কলা ভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদে উঠে উত্তোলন করেন এবং ডানে-বাঁয়ে বারবার নেড়ে সেখানে বেঁধে দেন। উপস্থিত হাজার হাজার ছাত্র-জনতা বিপুল করতালি দিয়ে পতাকাটিকে শুভেচ্ছা জানায়। তৈরি হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে প্রথম মাইলফলক। এভাবে আমরা একটির পর একটি মাইলফলক নির্মাণ করে এগিয়ে গেছি চূড়ান্ত বিজয়ের পথে।

কামরুল আলম খান খসরু

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা সিটি গেরিলা কমান্ডার এবং বিএলএফের অন্যতম সদস্য