মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬

চলতি সময় ও আমাদের অন্ধকারে ছুটাছুটি | সিন্ধু দাস

চলতি সময়ে বেশ কয়েকটি ইস্যু মিডিয়া থেকে শুরু করে সোসাল মিডিয়া, বুদ্ধিজীবি থেকে শুরু করে সুইডো বুদ্ধিজীবি, বাকজীবি সবার মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আম জনতা হিসেবে আমরাও পিছিয়ে নেই। যেখানে যখন পারছি, করছি মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন। কখনো বা তনুকে নিয়ে, কখনো বা সুজন, তারপর জবি এর সেই ছেলে, ধুমপান মুক্ত ক্যাম্পাস, ইলিশের দাম ইত্যাদি
ইত্যাদি। জাতি হিসেবে আমরা খুব ভাল গতর খাটতে পারি। শারিরীক পরিশ্রমের দিক থেকে কেউ আমাদের হারাতে পারবে না। কিন্তু যখন আমাদের একটু ভাবতে বলা হয় তখনই শুধু বলি, এত ভাবার কি আছে? ছাগল আর গরু দেখেই চেনা যায়। এতো ভেবে কি হবে? কিন্তু আমরা ভুলে যাই, যে শাসক শ্রেনী আমাদের মাথায় লবণ রেখে বরই খাচ্ছে সে গরুও না আবার ছাগল ও না।

তনু, আমাদের তনু

তনুর জন্য আমাদের দেশের সবার চোখে আজ জল। তনু হত্যার বিচার আমরা সবাই চাই। আমার তো মনে হয় যে হত্যা করেছে সে ও চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো তনুর আগে ও পরে তো আরো অনেক মানুষ হত্যা হয়েছে। তাদের নিয়ে আমাদের দু:খ নাই কেন। কারণ টা কি, তনু মেয়ে বলে? দেখতে সুন্দর বলে? ক্যান্টনমেন্টে খুন হয়েছে বলে? সে আমাদের ছাত্র সমাজের সদস্য বলে? সংস্কৃতিমনা মেয়ে ছিল বলে? মাথায় হিজাব পড়তো বলে? সে কোন গার্মেন্টস কর্মি ছিল না বলে? সে নাস্তিক ছিল না বলে? সে আস্তিক ছিল বলে? নাকি সে আমাদের সবার আপনজন ছিল? চলতি বাসে ধর্ষণ, গৃহবধুকে, গার্মেন্টস কর্মিকে, ছোট শিশুকে ইত্যাদি। ওরা কোথায় হারিয়ে গেল? তারপর আবার সুন্দরী মেয়ের লাশ রাস্তায় পরে থাকলেই আমরা ধরে নেই যে খুনি খুন করার আগে অবশ্যই ধর্ষণ করেছে।

আন্দোনলের সাতরং

কোথা থেকে শুরু হচ্ছে এই আন্দোলন গুলো। সাধারন জনগণ হিসেবে আমাদের মাথায় তা কখনই আসেনা। ক্ষমতাসীন দল তথা বৃহত্তম আসনহীন দল চুপ কেন তা আমরা জানি ও বুঝি। বাকি থাকলো বামদল গুলা। কিন্তু জানতে ও মানতে কষ্ট হলেও এ কথা সত্য যে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে যেকোন আন্দোলনের নামে নিজ পার্টির জন্য সদস্য সংগ্রহ করা। আন্দোলন সফল করা নয়। আর যদি সফল হয়ে যায় তাহলে তো ভাল ই।
বাকি যেসব অরাজনৈতিক সংগঠন, গোষ্টী, বা ব্যক্তি তাদের কাছে এই সব আন্দোলন একটা ফেশন। কেউ আবার ভাবেন বিবেকবান মানুষ হিসেবে এটা তার ফরজ কাজ। কেই ভাবেন আ হা রে মানুষটা মারা গেল। যাই তার জন্য একটু (একটু মানে একটু) কষ্ট করে আসি। কেই আবার ভাবেন যে, এত বড় একটা বড় ঘটনা, আমার কিছু একটা না বললে বা না করলে জাত থাকবে না।

নাই, দেশে নিরাপত্তা নাই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে যখন খুন হয়, তখন কোথায় ছিলাম আমরা বিবেকবান ছাত্র শিক্ষকরা? ঘরে বসে শুধু বলেছি যে ব্যাপার টা ঠিক হয় নি। অন্তত খুন করা ঠিক হয়নি? অনেকে তো আবার মনে করেন যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। কোথায় গিয়েছিল আমাদের নিরাপত্তার চিন্তা। তাছারাও দেশের বিভিন্ন জায়গায় মারা গেল আরো অনেক ব্লগার।
বাস্তব কথা হচ্ছে এই আমি একদিক থেকে হত্যাকারিকে মৌন সমর্থন দিচ্ছি আবার আরেক দিকে আরেক হত্যাকারির বিচার চাচ্ছি।

নতুন ইস্যু ও সরকার

আমাদের সবার ধারনা সরকার সব সময় একটা ইস্যু ঢাকতে আরেকটা ইস্যু নিয়ে আসে। এটা ঠিক এটা শাসকের একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার। কিন্তু আরো অনেক ছুপা রুস্তম আছে। পুলিশ যখন সুজন কে গুলি করল তখন সে দেখে মারে নি যে ছেলেটা কোথায় পড়াশুনা করে। বা এটাও ভাবে নাই যে একে মারলে সরকার কে একটা নতুন ইস্যু উপহার দেওয়া যাবে। নতুন ইস্যুকে সামনে আনতে মিডিয়ার কারসাজিও কম না। তনুর দু:খে যতই আপনার রাতে ঘুম না আসুক, পত্রিকা বা টেলিভিশন ওয়ালারা জানে আপনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তনুর ছবি দেখতে চান না। তাই তারা, সুজন, ইলিশমাছ ধূমপান মুক্ত ক্যাম্পাস নামে নতুন নতুন আইটেম হাজির করে আপনার সামনে। ভিন্ন রকম টেস্ট আমাদেরও ভালো লাগছে। ওদের দোষ দিয়ে লাভ কি?? দিনশেষে তো আমাদেরই সেবায় নিয়োজিত তারা। তাই আওয়ামী লীগকে দুইটা, বি এন পি কে চারটা সবশেষে জামাত কে ছয়টা গালি দিয়ে না পারবেন কিছু বদলাতে, না নিজে পারবেন বেশিদূর এগোতে। ঘরের ভেতরের বিভীষণকেও খোজতে জানতে হবে। প্রতিদিন সকালের প্রথম আলোকেই যেন আমরা শেষ আলো হিসেবে বিবেচনা না করি।

সব কথার শেষ কথা,

খুন হয়েছে, তদন্ত করবে পুলিশ। বিচার করবে বিচারবিভাগ। আমরা আম জনতাদের কেন ছোট থেকে বড় সব বিষয়ে রাস্তায় নামতে হয়? কি করলে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে না? খুনি, ধর্ষক, ডাকাত, দুর্নীতিবাজরা কোথা থেকে ঘনঘন এত সাহস পায়? আজ যাকে গালি দিচ্ছি কাল তাকেই বা কেন আমরা আমাদের মাথায় তুলে বসাই বা বসাতে বাধ্য। সমস্যার গভীরে যেতে আমাদের শিখতে হবে। দশজন হাউমাউ করছে, আমিও না করলে জাত থাকবে না এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে, সমস্যার দীর্ঘ স্থায়ী সমাধান নিয়ে ভাবতে হবে।
প্রয়োজনে আন্দোলনও করবো তবে লোক দেখানো, বিবেকবান পরিচয় দেওয়া বা শুধু জাত রক্ষার জন্য নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়