বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬

নারীর ‘সৌন্দর্য’ ধারণা ও ‘আদর্শ শরীর’

‘আদর্শ শরীর’ বলতে কী বোঝায়, সেটি কীভাবে তৈরি করা হয়, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ লিখেছেন বিয়ানকা সালাজার গিজ্জু। তিনি একজন ব্রাজিলিয়ান অধ্যাপক। তার প্রবন্ধের প্রেক্ষাপটও ব্রাজিল যদিও অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য তিনি তার লেখায় এনেছেন। গিজ্জু ‘বডি বিজনেস’ (‘body business’) বলে একটি ধারণার প্রতিও আলোকপাত করেছেন যেখানে শরীরকে এক
ধরণের ‘পুঁজি’ বা ‘ক্যাপিটাল’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।

ব্রাজিলিয়ান প্রেক্ষাপটে একজন মেয়েশিশুর ‘সৌন্দর্যের’ ধারণা নির্মাণে টেলিভিশনের প্রভাব অপরিসীম। টেলিভিশন তাদের শেখায়; তারা কারা এবং কেন ও কীভাবে তাদের ‘সুন্দর’ হতে হবে। ‘সুন্দর’ হবার চিন্তা ঐ শিশুদের খুব ছোটকাল থেকেই একটি বিষয় হিসেবে দাঁড়ায় এবং তারা এ জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

শারীরিক পরিচিতি-ছেলে না মেয়ে-এ বিষয়টিও একটি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তাদের চিন্তা-মননে। এ ব্যাপারে গিজ্জু বলছেন ‘শরীর’ ও ‘সৌন্দর্য’ জৈবিক বা শারীরিক পরিচিতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ‘সৌন্দর্য’ এক ধরনের ‘পুঁজি’ যেটি একজন মেয়ের ‘ভাল’ ক্যারিয়ার গড়তে সহায়তা করে।

অনেকে আবার বিখ্যাত মডেল হবারও স্বপ্ন দেখে। এসবের বাইরে কারও কারও জন্য সেটি আবার দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবার একটি কৌশলও। ব্রাজিলে প্রতিদিন ১২০০ টির মতো প্লাস্টিক সার্জারি হয়, দেশটিতে গত শতকের শুরু থেকেই ‘সৌন্দর্য’-এর পেছনে বেশ বিনিয়োগ শুরু হয় এবং গিজ্জু আলোচনায় উল্লেখ করেছেন যে এই বিনিয়োগের একটি প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো পুরুষদের সন্তুষ্ট করা।

শুধু ব্রাজিল নয়, পুরো দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায় এই ধরনের প্রবণতা বিদ্যমান। তবে ইউরোপ সেদিক থেকে বেশ আলাদা। সেখানে একজন নারীর সম্মান বা মর্যাদা নির্ভর করে তার উদ্ভাবনী শক্তি, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির ওপর।

যেমন জার্মানিতে কোন নারী যদি তার শরীরের ‘সৌন্দর্য’-এর প্রতি বেশি মনোযোগী হয়, তাহলে বিষয়টিকে খারাপ ভাবে দেখা হয়। মনে করা হয় সে তার নিজ কাজের প্রতি যত্নশীল নয়। শরীরের ‘সৌন্দর্য’-এর চাইতে পড়াশুনা বা কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়াকে সেখানে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।

ছেলে-মেয়ে ধারণা তথা জৈবিক পরিচিতির সঙ্গে শারীরিক ‘সৌন্দর্য’-এর সম্পর্ক বাংলাদেশেও গুরুত্বপূ্র্ণ মনে করা হয়। ছোটকাল থেকেই নির্দিষ্ট পোশাক-পরিচ্ছেদ বাদ দিলেও চিন্তা-মননশীলতার নির্মাণ এবং প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবহার সেই সম্পকর্কেই প্রতিষ্ঠিত করে।

আর ব্রাজিলের মতো এখানেও টেলিভিশনের একটি ভূমিকা দেখা যায়। প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপন বাংলাদেশে দর্শকদের অনেক ক্ষেত্রেই শেখায় এটি শুধু মেয়েদের ব্যবহার্য জিনিস যেটি কিনা তাদের ‘সুন্দর’ করে। ‘সৌন্দর্য’-এর ধারণাটি এখানে এতোই বিভাজিত যে একজন মেয়ে যতটা সাজ-গোজ করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা কর্মস্থলে যায়, একজন ছেলে ততটা প্রয়োজন মনে করে না। এটি এজন্যও যে পাছে আবার কেউ মেয়েটিকে বলে ফেলে তুমি ‘কালো’ কিংবা ‘পচা’।

সাংস্কৃতিক আধিপত্যের (hegemony) কারণে একজন মেয়ে চায় না কেউ তাকে ‘অসুন্দর’ বলুক। সেটি কোন ছেলেও চায় না তবে তার মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক বেশ কম। ‘সুন্দর’ শরীর ও ‘সৌন্দর্য’ এর সবচে শক্তিশালী প্রতিফলন দেখা যায় বিয়ের সময়।

সাধারণতঃ ছেলে মেয়ে দুজনকেই এ সময়ে সাজতে হয়। কিন্ত একটি মেয়ের ‘বউ সাজ’ আর একটি ছেলের ‘জামাই সাজ’ এর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। শহরের একজন নববধূকে খাওয়া-দাওয়া, বাথরুমের কাজ বন্ধ রেখে যেভাবে বিউটি পার্লারে আটকে রেখে তার ‘সৌন্দর্য’ বৃদ্ধি করা হয়, তা চরম অমানবিকও বটে। কিন্তু সে এটি করে অনেকটা হাসি মুখে। কারণ সে জানে তাকে ‘সুন্দর’ হতে হবে, এটি করলে তাকে ‘সুন্দর’ দেখাবে। ব্রাজিলের মতোই এটি হচ্ছে এক ধরনের বিনিয়োগ একজন পুরুষকে ‘সন্তুষ্ট’ রাখার জন্য।

রাজধানীসহ দেশের নানান জায়গায় দ্রুত বর্ধনশীল বিউটি পার্লারের দোকান এরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে একজন মেয়ের জীবনে ‘সৌন্দর্য’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনে যত নারী মডেল দেখানো হয় তাদের প্রায় সবাই ‘সুন্দর’। তাই কোন মেয়ে যদি মডেল হতে চায়, তাহলে তাকেও ‘সুন্দর’ হতে হবে, এমনকি তাকে তার ‘ফিগার’ সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে।

টেলিভিশনে একটি নাটকও হয়তো দেখা যাবে না যেখানে রিসিপসনিস্ট চরিত্রে কোন পুরুষ অভিনয় করেছে। শুধু তাই নয় যে নারীকে দেখানো হবে, তাকেও ‘সুন্দর’ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে। ব্রাজিলের মতো বাংলাদেশেও নারীর শরীর ও ‘সৌন্দর্য’ এক ধরনের ‘পুঁজি’ হিসেবে কাজ করে।

‘সুন্দরী’ হলে ‘ভালো’ জামাই পাওয়া যায় এ কথাটি সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা এক ধরনের শিল্প। এটি কারও যোগ্যতা। তবে তা শুধু শারীরিক ‘সৌন্দর্য’-এর বিযয় নয়।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে একজন মেয়ের ‘সৌন্দর্য’কে তার শরীরের সঙ্গে এক করে দেখার প্রবণতা কমেনি বরং বেড়েছে। সেটি এরকম ধারণারই পুনরুৎপাদন করছে মেয়েরা ‘ভোগের বস্তু’। পরিহাস হচ্ছে নারী শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতি সত্ত্বেও এ ধারণা খুব বেশি বদলাচ্ছে না।

একজন নারীকে যদি প্রথমেই তার শরীর ও সৌন্দর্য দিয়ে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সে নারীর জন্যও এ ধরনের বিবেচনা অপমানজনক। এটি নারী ও পুরুষ দু পক্ষকেই বুঝতে হবে।

মোহাম্মদ কামরুজ্জামান