জুড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গণমানুষের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজকের আয়োজন।
রুটির দোকান থেকে মানুষের অন্তরে
কাজী নজরুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি ও সংগীতজ্ঞ। তার জন্ম ১৮৯৯ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে। তিনি স্থানীয় মক্তবে কোরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে নজরুলের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে তাকে নামতে হয় জীবিকা অর্জনে। স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন। কিছুদিন আসানসোল রুটির দোকানে কাজ করেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্যজীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ সালে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। এ বছরের শেষ দিকে মাধ্যমিক পরীক্ষা না দিয়ে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। প্রায় আড়াই বছর ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক করপোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার হয়েছিলেন। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচিত হন। তার সঙ্গেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সঙ্গে। যার সঙ্গে তার পরিণয় হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লায় ফিরে যান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল। এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন—‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী’। তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতি লাভ করে। ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রায় চার হাজার গান, বহু কবিতা রচনা করেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এ সময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। দীর্ঘকাল অসুস্থ থাকার পর ১৯৭৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সেনা জীবন
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক করপোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। ওই রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে তিনি ফারসি ভাষা শেখেন। এ ছাড়া সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সংগীতচর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সঙ্গে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে— বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প : হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা : সমাধি ইত্যাদি। করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফারসি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। এ সূত্রে বলা যায়, নজরুলের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
নজরুল যখন কয়েদি
কাজী নজরুলের লেখা ‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’, ‘প্রলয় শিখা’ ও ‘চন্দ্রবিন্দু’সহ মোট ৫টি বই ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বলাবাহুল্য বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। নজরুলের প্রতিবাদ আর তার লেখনীর অন্যতম দিক হলো নজরুলই ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেন। নানা সৃষ্টিতে বৈচিত্র্যমণ্ডিত নজরুলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় পত্রিকা সম্পাদনাও। ১৯২২ সালে নজরুল ‘ধূমকেতু’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশ পেত। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতুর দ্বাদশ সংখ্যায় ‘আনন্দময়ীর আগমন’ নামক একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে ওই মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরের দিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আগে থেকেই নজরুলের কাব্য চেতনা আর সৃষ্টিশীল দ্রোহের সঙ্গে পরিচিত ছিল সাধারণ মানুষ। এবার কারাবরণ করে নজরুল সমগ্র দেশবাসীর কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার ‘বসন্ত’ নাটকটি কবির নামে উৎসর্গ করেন। তাকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন। শরীরের ওজন প্রায় ১৩ কেজি কমে যায়। এভাবে নজরুল একটানা অনশন করে যান ৩৯ দিন। ওই সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং নজরুলকে চিঠি লিখে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে এ বিষয়ে তাকে টেলিগ্রাম পাঠান। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘রোব ঁঢ় যঁহমবৎ ংঃত্রশব. ঙঁৎ খরঃবত্ধঃঁত্ব পষধরসং ুড়ঁ.’ কিন্তু টেলিগ্রামটি নজরুলের হাতে পৌঁছায়নি। জেল কর্তৃপক্ষ ‘অফফত্বংং রং হড়ঃ ভড়ঁহফ’ লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। জেল কর্তৃপক্ষ প্রকৃত ঠিকানা জানলেও ইচ্ছা করেই টেলিগ্রামটি নজরুলের কাছে না পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফেরত পাঠায়। রবীন্দ্রনাথ এ ঘটনায় দারুণ মর্মাহত হন। শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নজরুলের অনশনে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ৩৯ দিন পর কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে তারই হাতে লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন।
সাংবাদিক কবি
পাক-ভারত যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কমরেড মোজাফফর আহমদের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। তখনই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আফজালুল হক প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ের ১২ তারিখ নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচিত হন। তার সঙ্গেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সঙ্গে।
আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন দিল ওহি মেরা ফাস গেয়ি
সবার কাছে তিনি বিদ্রোহী কবি। কিন্তু তার জীবনে দ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে যে প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে তাও কিন্তু আর কারও ক্ষেত্রে ঘটেনি। একজন সত্যিকারের প্রেমিক বলতে যা বোঝায়, এর পুরোটাই রয়েছে নজরুলের ব্যক্তিজীবন, কাব্য কিংবা সংগীতে। তার প্রেমের সংগীত-সুধা পানের জন্য মনোযোগী শ্রোতা হওয়ার দরকার নেই। এমনিতেই হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন দিল ওহি মেরা ফাস গেয়ি’ চরণের গূঢ় ব্যঞ্জনা সহজেই পৌঁছে যায় যে কোনো মানুষের অন্তরে। ব্যক্তিগত জীবনেও প্রেমের ব্যাপারে কাজী নজরুল ছিলেন একেবারেই আপসহীন। নজরুলের জীবনে নারীর প্রতি প্রেম মূলত তিনবার এসেছিল। প্রথম নার্গিস আসার খানম, দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং তৃতীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসা। এর মাঝে ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ কিংবদন্তিতুল্য। এ ছাড়াও রানী সোমসহ আরও দু-একজনের নাম এলেও সেগুলো উল্লেখ করার মতো নয়। কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছুটা সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে। মোট পাঁচবারে সেখানে প্রায় ১১ মাসেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন কবি। তরুণ কবি নজরুল ১৯২১ সালের এপ্রিলে কুমিল্লার দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন। সেখানে বাড়ির পাশের কামরাঙা গাছতলায় বাঁশিতে সুর তুলে, আর পুকুরঘাটে বসে কবিতা লিখে লিখে সময় কেটেছে তার। নজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফারসি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকালে নার্গিসের মামা ক্যাপ্টেন আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে নজরুলের। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। নজরুল তখন মুসলিম সাহিত্য সমিতির (কলকাতা) অফিসে আফজালুল হকের সঙ্গে থাকতেন। ওই সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আকবর খান নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে কলকাতা থেকে ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেইলে নজরুল কুমিল্লা এসে পৌঁছান। ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়ার পর এটিই ছিল নজরুলের প্রথম পূর্ববঙ্গ যাত্রা। যাওয়ার পথে তিনি ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটি লেখেন। ট্রেনে কুমিল্লা পৌঁছে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় ওঠেন। চার-পাঁচ দিন সেখানে কাটিয়ে কবি রওনা দেন দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির উদ্দেশে। তবে সেই চার-পাঁচ দিনেই সেনবাড়ির সবাই বিশেষ করে বিরজা দেবীর সঙ্গে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নজরুল তাকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন। দৌলতপুরে নজরুলের জন্য আলী আকবর খানের নির্দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়ির জ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে নজরুলের। কবিতা শুনিয়ে, গান গেয়ে তাদের তো বটেই, দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন ছুটে আসত কবির নৈকট্য লাভের আশায়। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় আসমাতুন্নেসা তার ভাইয়ের বাড়িতে তেমন সমাদর পেতেন না। আসমাতুন্নেসার স্বামী মুনশী আবদুল খালেক একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। আর সেই মেয়েটিই কবি নজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খাতুন। নজরুল যাকে ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন নার্গিস। নার্গিসের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছিল কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দিঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। খাঁ বাড়ির মুরব্বিরা নার্গিসের বর হিসেবে নজরুলকে তেমন পছন্দ করতেন না। নজরুলকে তারা ছিন্নমূল বাউণ্ডুলে হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু গ্র্যাজুয়েট আলী আকবর খানের চাপে তারা প্রতিবাদ করতেন না। এক পর্যায়ে খোদ নজরুলই বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। কিন্তু ঘটল বিচিত্র এক ঘটনা। কবির বিয়ে হলো ঠিকই, বাসর আর হলো না। কোনো এক অজানা অভিমানে বাসররাতেই নজরুল বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। দৌলতপুর থেকে চলে আসেন কুমিল্লায়। কিন্তু সেই অভিমানের কারণ কবি কোনো দিন কাউকে মুখ ফুটে বলেননি। ইতিহাসও তা স্পষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারেনি। তবে আরেকটি সূত্রমতে, নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়েই হয়নি। আলী আকবর খান নজরুল-নার্গিসের বিয়ের আয়োজন করলেন জাঁকজমকের সঙ্গে। তার অতি আগ্রহ ও নার্গিসের কিছু আচরণ নজরুলকে এই বিয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা করে তোলে। ঘটনার আরও অবনতি হয় যখন কাবিননামায় আলী আকবর খান একটি শর্ত রাখতে চাইলেন— ‘বিয়ের পরে নজরুল নার্গিসকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন না, দৌলতপুরেই তার সঙ্গে বাস করবে।’ এ অপমানজনক শর্ত মেনে না নিয়ে নজরুল ইসলাম বিয়ের মজলিশ থেকে উঠে গিয়েছিল। তার মানে, সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের সঙ্গে নজরুল ইসলামের ‘আকদ’ বা বিয়ে একেবারেই হয়নি। (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা— মোজাফফর আহমদ পৃষ্ঠা-৬৭)। সৈয়দা ইসলাম নার্গিসের পরই আসে ফজিলাতুন্নেসার নাম। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলিম নারী। ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কবির পরিচয় হয় ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কবি তখন মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন ঢাকায়। কবি একটু-আধটু জ্যোতিষবিদ্যা জানতেন। কাজী মোতাহার হোসেন সে কারণে কবিকে নিয়ে যান ফজিলাতুন্নেসার বাসায়। তখনই শুরু হয় হাত দেখা। প্রথমে হাতে হাত, পরে চোখে চোখ। কবির মন প্রেমে টালমাটাল হয়ে উঠল। কবি ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেও ফজিলাতুন্নেসা থেকে গেলেন তার মনজুড়ে। তারপর থেকে নজরুল লিখে চললেন একটার পর একটা প্রেমপত্র। তবে এই প্রেম একতরফা ছিল। শুধু কাজী নজরুল ইসলামের দিক থেকেই প্রেম ছিল। ফজিলাতুন্নেসা নজরুলের আকুতিতে তেমন একটা সাড়া দেননি। কিন্তু নজরুলের কবি মনে ঠিকই তিনি ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বেশ কিছু চিঠি পাঠিয়েছিলেন ফজিলাতুন্নেসাকে। নজরুল সেসব চিঠি দিতেন তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে। ফজিলাতুন্নেসা মোতাহার হোসেনকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতেন। কাজী মোতাহার বন্ধু হয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে পৌঁছে দিতেন কবির প্রেমের চিঠি। সরাসরি কেন চিঠি পাঠাতেন না, তার কারণও উল্লেখ করেছেন কবি, ‘ঐ এক চিঠি পেয়েই যত দূর বুঝেছি- আমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না।’ তবে শেষ পর্যন্ত নজরুলের জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা। প্রমীলার ডাকনাম ছিল দুলি। তাদের এই বিয়ে প্রেম থেকে নয়, বরং পারিবারিক সম্মতিতে স্থির হয়েছিল। তবে জানা যায়, নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালে প্রমীলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। প্রমীলার সঙ্গে তার আলাপ-পরিচয় ছিল। তার এই প্রেমের কথা তার ‘বিজয়িনী’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাদের বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে। বিয়েতে বাধা ছিল একটাই, ধর্ম। বিবাহ-আইনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই। তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩।
এক নজরে নজরুল
► বিদ্রোহী কবির পুরো নাম- কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ► জন্ম- ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ (বাংলা), ২৪ মে ১৮৯৯ (ইংরেজি)। ► জন্মস্থান- ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রাম। ► পিতার নাম- কাজী ফকীর আহম্মদ। ► মাতার নাম- মোসাম্মাৎ জাহেদা খাতুন। ► শিক্ষাকাল- প্রথমে গ্রামের মক্তব, পরে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল হাইস্কুল, মাথরুন ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়, দরিরামপুর উচ্চবিদ্যালয় (ত্রিশাল)। ► আশ্রয়দাতা- কাজী রফিজউল্লাহ (তৎকালীন পুলিশ ইন্সপেক্টর)। ► কর্মস্থল- এস রকসের চা-রুটির দোকান, প্রসাদপুর গার্ড সাহেবের বাসা, ৪৯ বাঙ্গালি পল্টন। ► বিয়ে- ২৫ এপ্রিল, ১৯২৪ ইংরেজি। ► স্ত্রীর নাম- প্রমীলা সেনগুপ্তা, ডাকনাম- দুলী। ► কাজী নজরুল ইসলামের ডাকনাম- দুখু মিয়া। ► প্রমীলার জন্ম- ২৭ বৈশাখ, ১৩১৫ বাংলা। ► কাজী নজরুল ইসলামের শ্বশুর- শ্রী বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত। ► কাজী নজরুল ইসলামের শাশুড়ি- শ্রীমতি গিরিবালা দেবী। ► কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম সন্তান- অরিন্দম খালিদ, ডাকনাম- বুলবুল। ► কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্র- কাজী অনিরুদ্ধ, ডাকনাম- লেনিন বা নিনি। ► সাহিত্য চর্চাকাল- ১৩২৬ হতে ১৩৪৯ বাংলা। ► কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কবিতা- মুক্তি। ► প্রথম গল্প- বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী। ► প্রথম প্রবন্ধ- তুর্কি মহিলার ঘোমটা খোলা। ► প্রথম উপন্যাস- বাঁধন হারা। ► সর্বশ্রেষ্ঠ (সাধারণ মানুষের বিবেচনায়) কবিতা- বিদ্রোহী। ► কাজী নজরুল ইসলামের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ভাঙার গান, অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, চক্রবাক, রিক্তের বেদন, ব্যথার দান, প্রলয় শিখা, আলেয়া প্রভৃতি। ► বাল্য রচনা- মেঘনাদ বধ, চাষার সঙ, শুকনী বধ, দাতাকর্ণ রাজপুত্র, কবি কালিদাস, আকবর বাদশাহ প্রভৃতি। ► কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা- ধূমকেতু। ► ধূমকেতুর প্রথম প্রকাশ- ১৭ মে, ১৯২৩ ইংরেজি। ► কাজী নজরুল ইসলাম অভিনীত প্রথম ছায়াছবি- ধ্রুব। ► নজরুলগীতির সংখ্যা- তিন হাজারের উপরে। ► জাতীয় খেতাব- ‘জগত্তারিণী’ ও ‘পদ্মভূষণ’। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জগত্তারিণী’ এবং ১৯৬০ সালে ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ স্বর্ণপদকে সম্মানিত করে। ► মৃত্যু- ২৯ আগস্ট, ১৯৭৬ ইংরেজি তারিখে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।