যুক্তরাষ্টের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কি নারী হতে যাচ্ছেন? প্রশ্নটি যেন সারা দুনিয়ার। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন যখন ডেমো্ক্রেট দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন পেলেন, তখন থেকে এ প্রশ্ন আরও তীব্র হতে থাকে। স্বভাবতই নারীরা এ বিষয়ে একটু বেশি সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্রে হিলারির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে নারীরা স্বতন্ত্রভাবে
তৈরি করছেন গ্রুপ, খুলছেন ফেসবুকে পেইজ। মনোনয়ন দৌড়ে বার্নি স্যান্ডার্স যখন ছিলেন, তরুণদের সঙ্গে সঙ্গে বহু তরুণীর কাছেও তিনি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। এখন হয়তো তারা হিলারির দিকে ঝুঁকবেন, তেমনটাই আভাস মিলছে।
ওদিকে, গোঁড়া শ্বেতাঙ্গ, বয়স্ক আমেরিকান আর কিছু সম্পদশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে। এছাড়া রিপাবলিকান দলের সমর্থকরা তো আছেনই যারা ট্রাম্পকে সমর্থন দেবেন দল থেকেই তিনি মনোনীত বলে।
নির্বাচনের ফল কী হবে তা তো নিশ্চিত করে কখনও বলা যায় না। কেবল জরিপের ফলগুলো কিছু ইঙ্গিত দেয়। সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, মোট ভোটারদের শতকরা ৪৩ জন হিলারিকে ভোট দেবেন না। তাঁর পরিবর্তে তারা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন কিনা তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না।
পর পর তিন বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্রেটরা নির্বাচিত হয়েছেন, এমন নজির তাদের ইতিহাসে নেই। জরিপের ফলও বলছে, তেতাল্লিশ ভাগ ভোটার হিলারিকে ভোট না দেবার পক্ষে। তারপরও তিনি নির্বাচিত হয়ে এলে কেবল প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাস গড়বেন তা নয়, ডেমোক্রেটদের অনেক ইতিহাসও লেখা হবে নতুন করে।
কী হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশের প্রধান যদি একজন নারী হন, তাহলে? আশাবাদী অনেকেই। পৃথিবীর বহু দেশে সরকারপ্রধান হিসেবে নারীরা কৃতিত্বের সঙ্গে দেশ শাসন করেছেন অতীতে, এখনও করে যাচ্ছেন। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে এখন দুটি প্রজন্ম সরকারপ্রধান হিসেবে নারীদের দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর কয়েকটা বছর অপেক্ষা করলে মিয়ানমারেও সরকারপ্রধান হিসেবে নারীকে দেখা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এদিকে এশিয়ার ইসরাইল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো না কোনো সময় সরকার চালিয়েছেন নারীরা। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশে নারীকে শাসনভার বইতে দেখা গিয়েছে নানা সময়। আশির দশকে ব্রিটেনের লৌহমানবী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তাঁর নামে ইউরোপে ‘থ্যাচারিজম’ নামে একটা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
এ সময়ে জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মেরকেল– কারও কারও মতে– শুধু নিজ দেশ নয়, পুরো ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন শাসন করছেন।
পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান পদে নানা সময়ে নারীকে পেয়েছে সে দেশের জনগণ। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও গভর্নর জেনারেল দুই পদেই নারীর দায়িত্ব নেওয়ার ইতিহাস আছে; নিউজিল্যান্ডেও তাই। অস্ট্রেলিয়াতে প্রধানমন্ত্রী পদে একজন নারীকে দেখা গেছে।
বাকি থাকল যুক্তরাষ্ট্র। ২৪০ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করা এই দেশ এখন পর্যন্ত একজন নারী সরকারপ্রধান পেল না! বিষয়টি নিয়ে খোদ মার্কিন মুল্লুকের অনেককেও আফসোস করতে দেখা যায়।
অনেকের ধারণা, মার্কিন মুল্লুকে নারীদের এত এত স্বাধীনতা, এত সুযোগ, তাহলে নারী সরকারপ্রধান হওয়া তো তেমন কোনো বিষয় ছিল না। অবশ্যই ধারণাটি ভুল। পাপুয়া নিউগিনি ছাড়া পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দেশ যেখানে কর্মস্থলে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। ইরান ও সুদানের মতো অল্পসংখ্যক দেশের সারিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যারা জাতিসংঘের সিডও সনদ (নারীর বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য বিলোপ সনদ) অনুমোদন করেনি!
শুধু কি তাই, যুক্তরাষ্ট্রে নারী-পুরুষের বেতন-বৈষম্য এমন যে, তা সমান করে আনতে গেলে ২০৫৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে! যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব ক্ষেত্রে পুরুষ যেখানে এক ডলার আয় করে, নারী পায় ৭৯ সেন্ট। যে প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর শ্রমকে ঠকাচ্ছে তাদের পণ্যের সিংহভাগ ক্রেতাই আবার নারী।
ইনস্টিটিউট অব উইমেন পলিসি রিসার্চের গবেষণায় দেখা গেছে যে, মার্কিন শ্রমবাজারে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ নারী আছেন এখন। কলেজ ডিগ্রিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার অর্ধেকই এখন নারী। তবু এই পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমিক কেবল নারী হওয়ার কারণে ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। শুধু কায়িক পেশাজীবীরা নন, ডাক্তার ও অ্যাটর্নিদের মতো অভিজাত পেশাজীবীরাও মজুরি-বৈষম্যের শিকার।
একবার বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকদের কয়েক জনের সুযোগ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের একজন মার্কিন নারী কর্মকর্তার (সম্ভবত আন্ডার সেক্রেটারি র্যাংকের) সঙ্গে ভিডিও চ্যাটে অংশ নেবার। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের একজন হিসেবে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাঁরা কেন সিডও সনদ অনুমোদন করেননি। ওই কর্মকর্তা জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক স্বাধীন ও শক্তিশালী। তাদের উপর সরকার ‘সহজে’ কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না!
সেটাই আসল কথা। হিলারি ক্লিনটনের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বে ও তিনি নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র তৈরি করার ব্যাপারে কতটা সফল হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। অবশ্য এ নিয়ে আশা করছেন এদেশের সংখ্যাগুরু কর্মজীবী নারীরা। একজন নারীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যিনি হিলারির পক্ষে প্রচারে অংশ নিচ্ছেন, তিনি প্রকাশ্যে বললেন:
‘‘আমি আশা করছি হিলারি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট হাউসগুলোতে মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে বাধ্য করে আইন প্রণয়ন করবেন।’’
পরে আবার আমার কানে কানে বললেন:
‘‘হিলারি তা পারবেন কি না সে ব্যাপারে ‘অনেস্টলি আই ডাউট’।’’
সমালোচকরা বলেন, হিলারি নিজেও তো কর্পোরেট সাম্রাজ্যের অংশ। তিনি ওয়ালমার্টের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য, যে প্রতিষ্ঠান তার শ্রমিকদের প্রতি অবিচার করার ব্যাপারে ‘সুখ্যাতি’ লাভ করেছে! অক্টোপাশের মতো সেদেশে কর্পোরেট। রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেপে রেখেছে মানুষকে। হিলারি কেন, কোনো সরকারপ্রধানের পক্ষে সে ফাঁস খোলা সম্ভব নয়।
তবে ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্রে হিলারির সদিচ্ছার প্রমাণ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র আইন সংস্কার করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেখানে হিলারির ভূমিকা ছিল। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী ১৮ বছর বয়সের উপরের নাগরিকদের নিজের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র রাখার অধিকার আছে। সংবিধানসম্মত সে অধিকারবলে, সেখানে প্রতি বছর ৩৩,০০০ আমেরিকান নাগরিক খুন হচ্ছেন!
বোঝা যায়, অস্ত্র ব্যবসায়ীদের প্রভাব কতটা সেখানে। এজন্য আন্তরিকভাবে চেয়েও আইনটি বদলাতে পারেননি ওবামা প্রশাসন। এমনকি খুব সাম্প্রতিক অরল্যান্ডো হামলার পরও ওবামা কংগ্রেসকে আহ্বান জানিয়েছেন আইনটি পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য এক প্রচারণায় হিলারি নিজেও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি আইনটি সংস্কারের উদ্যাগ নিবেন। কিন্তু এতটাই কি সহজ হবে তাঁর জন্য কাজটি করা? যেখানে ওবামা এত প্রভাবশালী হয়ে ও দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থেকেও এটি সম্ভব করতে পারেননি।
ক্লিনটন প্রশাসন মার্কিন নাগরিকদের জন্য সহজ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। সে উদ্যাগের পিছনের ভূমিকা কিন্তু হিলারির। পরবর্তীতে ওবামা প্রশাসন এ সংক্রান্ত এক বিল বহু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে পাশ করাতে পেরেছিলেন। তবু সম্পূর্ণটা পারেননি। সেই একই ইনস্যুরেন্স কর্পোরেটদের লবির কারণে।
বাংলাদেশেও হিলারির প্রচুর সমর্থক রয়েছে। তিনি নারী বলেই শুধু নয়, উন্নয়নশীল দেশের জনগণের মধ্যে ডেমোক্রেট প্রার্থীদের প্রতি দুর্বলতা থাকে সব সময়। তাছাড়া হিলারি শুধু প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নয়, তাঁর নাম প্রায় গত ২৫ বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। প্রথমে ফার্স্ট লেডি, এরপর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে। ২০০৯ সালেও তিনি ওবামার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পদে মনোয়ন পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তখনই কারও কারও ভবিষ্যদ্বাণী ছিল এ রকম যে, এখন কৃষ্ণাঙ্গ, পরবর্তীতে নারী হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সাবেক প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিসেবে তিনি আনুকুল্য পেয়েছেন, এ অভিযোগ কারও কারও। স্যান্ডার্সকে মনোনয়ন না দিয়ে তাঁকে দেওয়ার পিছনে অনেকে এ বিষয়টির দিকে আঙ্গুল তুলছেন। হিলারি ফার্স্ট লেডি থাকার সময়ই অনেকের ধারণা ছিল, এক সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন। ধীরে ধীরে সে পথ তৈরি করেই এগিয়েছেন তিনি। মনিকা-ক্লিনটনের সেই কেচ্ছার পরও স্বামীকে তাঁর ক্ষমা করে দেওয়া কতটা পতিপ্রেম আর কতটা ক্ষমতাপ্রেম তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকের।
তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প যদিও সে প্রসঙ্গ তুলেননি, কিন্তু নারী বলে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। ‘জেন্ডার কার্ড’ ব্যবহার করছেন হিলারি এমন অভিযোগ করেই কেবল ক্ষান্ত হননি ট্রাম্প, আরও অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন। হিলারি পুরুষ হলে শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট পেতেন, এমন হিসাবও কষেছেন সেই ভদ্রলোক। এছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত ইমেইল ব্যবহার, পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালে বেনগাজি ইস্যু ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচকদের উত্তর দিতে হয়েছে তাঁকে অহরহ। ইসরাইলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে মুসলমান ভোটারদের একাংশ তাঁর উপর নাখোশও বটে।
অনেকে ভাবছেন, হিলারি ক্লিনটনই বুঝি প্রথম নারী যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেলেন। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরও এক ডজন নারী বিভিন্ন সময় মনোনয়ন পেয়েছেন। তাদের কেউ সেভাবে আলোচিত হননি; কারণ তাঁরা রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেটের মতো মূলধারার রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ছিলেন না। ১৯৮৪ সালে প্রথমবারের মতো
আমেরিকার একটি প্রধান দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন জেরালডিন ফেরারো। তিনিই প্রথম আলোচনায় আসেন। সে সময় নারী বলে তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে সরস আলোচনা হত।
মনে পড়ছে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিকের সঙ্গে জেরালডিনের কথোপকথন। সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন:
‘‘আপনি কি পারমাণবিক বোমার বোতাম টিপতে পারবেন?’’
তাঁর উত্তর ছিল:
‘‘দেশের নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই পারব।”
এরপর প্রশ্ন ছিল:
‘‘আপনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোয়ন পেয়েছেন কেন? আপনার জেন্ডারের জন্য?’’
তখন জেরালডিনের উত্তর ছিল:
‘‘আমি জানি না, আমি জানি না। যদি পুরুষ হতাম এবং আমার যোগ্যতা একই থাকত, তাহলে এ প্রশ্ন আপনি করতে পারতেন না। পারমাণবিক বোমার বোতাম টিপতে পারব কিনা, এ প্রশ্নও করতেন না।’’
১৯৮৪ সাল থেকে ২০১৬। পরিবর্তন হয়েছে অনেক। এ ধরনের ‘বেকুব’ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা হিলারির নেই। তারপরও দুঃখের বিষয় এই যে, ১৯৮৪ থেকে ২০১৬ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়নি। বিষয়টি এখন নারীঅধিকার সমর্থকরা ফোকাসে আনতে চাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে হিলারি ছাড়া আর কে তাদের মুখপাত্র হতে পারবেন?
তবে শুধু সমান মজুরি বা মাতৃত্বকালীন ছুটি নয়, হিলারির নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর প্রজনন-স্বাস্থ্য, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে।
হিলারির প্রতি নারীদের এ সমর্থনের জোয়ারের কারণ তিনি নিজেও। বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৮ সালে তিনি বারাক ওবামার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে ভুল করেছিলেন তা হচ্ছে, ‘নারী’ ইস্যুগুলো তিনি এড়িয়ে গেছেন। বস্তুত একজন নারী হিসেবে নয়, তিনি শুধু প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন যাকে বলে ‘মেলনেস’ অনুসরণ করে। অনেকটা সে কারণে সে সময় হিলারি নারীদের মধ্যে ততটা জনপ্রিয়তা পাননি যা এখন পাচ্ছেন।
এমনকি সে সময় তিনি তরুণ ডেমোক্রেট নারীদেরও ভোট পাননি বলে মনে করা হয়। অথচ ফার্স্ট লেডি হিসেবে তিনি নারীদের জন্য কাজ করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। তখনও তিনি সে বিষয়গুলো অনায়াসে তাঁর প্রচারণায় ব্যবহার করতে পারতেন।
এখন যেমন তিনি ‘উইমেন পাওয়ার’ বিষয়টির উপর জোর দিচ্ছেন। ১৯৯৫ সালে বেইজিংএ নারী সম্মেলনে তিনিই দিয়েছিলেন সেই জনপ্রিয় শ্লোগান, ‘উইমেন রাইট ইজ হিউমেন রাইট’– বাংলায় বললে, ‘নারীঅধিকার মানবাধিকার।’
আগামী ৮ নবেম্বর আমেরিকানরা তাদের ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন জিতলে অবশ্যই ইতিহাস তৈরি হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কতটা সফলতা দেখাতে পারবেন তা সময় বলবে। এ প্রসঙ্গে ইলিনর রুজভেল্টর উদ্ধৃতি মনে পড়ছে:
‘‘নারীরা হচ্ছে টি-ব্যাগের মতো। গরম পানিতে ছাড়লে বোঝা যায় তারা কতটা শক্তিশালী।’’
হিলারির শক্তি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে পৃথিবী, যখন তিনি হোয়াইট হাউসে আবার প্রবেশ করবেন। ফার্স্ট লেডি হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
পারভীন সুলতানা ঝুমা
সাংবাদিক, কলামিস্ট
তৈরি করছেন গ্রুপ, খুলছেন ফেসবুকে পেইজ। মনোনয়ন দৌড়ে বার্নি স্যান্ডার্স যখন ছিলেন, তরুণদের সঙ্গে সঙ্গে বহু তরুণীর কাছেও তিনি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। এখন হয়তো তারা হিলারির দিকে ঝুঁকবেন, তেমনটাই আভাস মিলছে।
ওদিকে, গোঁড়া শ্বেতাঙ্গ, বয়স্ক আমেরিকান আর কিছু সম্পদশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে। এছাড়া রিপাবলিকান দলের সমর্থকরা তো আছেনই যারা ট্রাম্পকে সমর্থন দেবেন দল থেকেই তিনি মনোনীত বলে।
নির্বাচনের ফল কী হবে তা তো নিশ্চিত করে কখনও বলা যায় না। কেবল জরিপের ফলগুলো কিছু ইঙ্গিত দেয়। সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, মোট ভোটারদের শতকরা ৪৩ জন হিলারিকে ভোট দেবেন না। তাঁর পরিবর্তে তারা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন কিনা তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না।
পর পর তিন বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্রেটরা নির্বাচিত হয়েছেন, এমন নজির তাদের ইতিহাসে নেই। জরিপের ফলও বলছে, তেতাল্লিশ ভাগ ভোটার হিলারিকে ভোট না দেবার পক্ষে। তারপরও তিনি নির্বাচিত হয়ে এলে কেবল প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাস গড়বেন তা নয়, ডেমোক্রেটদের অনেক ইতিহাসও লেখা হবে নতুন করে।
কী হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশের প্রধান যদি একজন নারী হন, তাহলে? আশাবাদী অনেকেই। পৃথিবীর বহু দেশে সরকারপ্রধান হিসেবে নারীরা কৃতিত্বের সঙ্গে দেশ শাসন করেছেন অতীতে, এখনও করে যাচ্ছেন। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে এখন দুটি প্রজন্ম সরকারপ্রধান হিসেবে নারীদের দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর কয়েকটা বছর অপেক্ষা করলে মিয়ানমারেও সরকারপ্রধান হিসেবে নারীকে দেখা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এদিকে এশিয়ার ইসরাইল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো না কোনো সময় সরকার চালিয়েছেন নারীরা। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশে নারীকে শাসনভার বইতে দেখা গিয়েছে নানা সময়। আশির দশকে ব্রিটেনের লৌহমানবী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তাঁর নামে ইউরোপে ‘থ্যাচারিজম’ নামে একটা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
এ সময়ে জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মেরকেল– কারও কারও মতে– শুধু নিজ দেশ নয়, পুরো ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন শাসন করছেন।
পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান পদে নানা সময়ে নারীকে পেয়েছে সে দেশের জনগণ। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও গভর্নর জেনারেল দুই পদেই নারীর দায়িত্ব নেওয়ার ইতিহাস আছে; নিউজিল্যান্ডেও তাই। অস্ট্রেলিয়াতে প্রধানমন্ত্রী পদে একজন নারীকে দেখা গেছে।
বাকি থাকল যুক্তরাষ্ট্র। ২৪০ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করা এই দেশ এখন পর্যন্ত একজন নারী সরকারপ্রধান পেল না! বিষয়টি নিয়ে খোদ মার্কিন মুল্লুকের অনেককেও আফসোস করতে দেখা যায়।
অনেকের ধারণা, মার্কিন মুল্লুকে নারীদের এত এত স্বাধীনতা, এত সুযোগ, তাহলে নারী সরকারপ্রধান হওয়া তো তেমন কোনো বিষয় ছিল না। অবশ্যই ধারণাটি ভুল। পাপুয়া নিউগিনি ছাড়া পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দেশ যেখানে কর্মস্থলে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। ইরান ও সুদানের মতো অল্পসংখ্যক দেশের সারিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যারা জাতিসংঘের সিডও সনদ (নারীর বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য বিলোপ সনদ) অনুমোদন করেনি!
শুধু কি তাই, যুক্তরাষ্ট্রে নারী-পুরুষের বেতন-বৈষম্য এমন যে, তা সমান করে আনতে গেলে ২০৫৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে! যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব ক্ষেত্রে পুরুষ যেখানে এক ডলার আয় করে, নারী পায় ৭৯ সেন্ট। যে প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর শ্রমকে ঠকাচ্ছে তাদের পণ্যের সিংহভাগ ক্রেতাই আবার নারী।
ইনস্টিটিউট অব উইমেন পলিসি রিসার্চের গবেষণায় দেখা গেছে যে, মার্কিন শ্রমবাজারে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ নারী আছেন এখন। কলেজ ডিগ্রিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার অর্ধেকই এখন নারী। তবু এই পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমিক কেবল নারী হওয়ার কারণে ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। শুধু কায়িক পেশাজীবীরা নন, ডাক্তার ও অ্যাটর্নিদের মতো অভিজাত পেশাজীবীরাও মজুরি-বৈষম্যের শিকার।
একবার বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকদের কয়েক জনের সুযোগ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের একজন মার্কিন নারী কর্মকর্তার (সম্ভবত আন্ডার সেক্রেটারি র্যাংকের) সঙ্গে ভিডিও চ্যাটে অংশ নেবার। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের একজন হিসেবে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাঁরা কেন সিডও সনদ অনুমোদন করেননি। ওই কর্মকর্তা জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক স্বাধীন ও শক্তিশালী। তাদের উপর সরকার ‘সহজে’ কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না!
সেটাই আসল কথা। হিলারি ক্লিনটনের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বে ও তিনি নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র তৈরি করার ব্যাপারে কতটা সফল হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। অবশ্য এ নিয়ে আশা করছেন এদেশের সংখ্যাগুরু কর্মজীবী নারীরা। একজন নারীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যিনি হিলারির পক্ষে প্রচারে অংশ নিচ্ছেন, তিনি প্রকাশ্যে বললেন:
‘‘আমি আশা করছি হিলারি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট হাউসগুলোতে মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে বাধ্য করে আইন প্রণয়ন করবেন।’’
পরে আবার আমার কানে কানে বললেন:
‘‘হিলারি তা পারবেন কি না সে ব্যাপারে ‘অনেস্টলি আই ডাউট’।’’
সমালোচকরা বলেন, হিলারি নিজেও তো কর্পোরেট সাম্রাজ্যের অংশ। তিনি ওয়ালমার্টের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য, যে প্রতিষ্ঠান তার শ্রমিকদের প্রতি অবিচার করার ব্যাপারে ‘সুখ্যাতি’ লাভ করেছে! অক্টোপাশের মতো সেদেশে কর্পোরেট। রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেপে রেখেছে মানুষকে। হিলারি কেন, কোনো সরকারপ্রধানের পক্ষে সে ফাঁস খোলা সম্ভব নয়।
তবে ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্রে হিলারির সদিচ্ছার প্রমাণ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র আইন সংস্কার করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেখানে হিলারির ভূমিকা ছিল। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী ১৮ বছর বয়সের উপরের নাগরিকদের নিজের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র রাখার অধিকার আছে। সংবিধানসম্মত সে অধিকারবলে, সেখানে প্রতি বছর ৩৩,০০০ আমেরিকান নাগরিক খুন হচ্ছেন!
বোঝা যায়, অস্ত্র ব্যবসায়ীদের প্রভাব কতটা সেখানে। এজন্য আন্তরিকভাবে চেয়েও আইনটি বদলাতে পারেননি ওবামা প্রশাসন। এমনকি খুব সাম্প্রতিক অরল্যান্ডো হামলার পরও ওবামা কংগ্রেসকে আহ্বান জানিয়েছেন আইনটি পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য এক প্রচারণায় হিলারি নিজেও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি আইনটি সংস্কারের উদ্যাগ নিবেন। কিন্তু এতটাই কি সহজ হবে তাঁর জন্য কাজটি করা? যেখানে ওবামা এত প্রভাবশালী হয়ে ও দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থেকেও এটি সম্ভব করতে পারেননি।
ক্লিনটন প্রশাসন মার্কিন নাগরিকদের জন্য সহজ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। সে উদ্যাগের পিছনের ভূমিকা কিন্তু হিলারির। পরবর্তীতে ওবামা প্রশাসন এ সংক্রান্ত এক বিল বহু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে পাশ করাতে পেরেছিলেন। তবু সম্পূর্ণটা পারেননি। সেই একই ইনস্যুরেন্স কর্পোরেটদের লবির কারণে।
বাংলাদেশেও হিলারির প্রচুর সমর্থক রয়েছে। তিনি নারী বলেই শুধু নয়, উন্নয়নশীল দেশের জনগণের মধ্যে ডেমোক্রেট প্রার্থীদের প্রতি দুর্বলতা থাকে সব সময়। তাছাড়া হিলারি শুধু প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নয়, তাঁর নাম প্রায় গত ২৫ বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। প্রথমে ফার্স্ট লেডি, এরপর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে। ২০০৯ সালেও তিনি ওবামার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পদে মনোয়ন পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তখনই কারও কারও ভবিষ্যদ্বাণী ছিল এ রকম যে, এখন কৃষ্ণাঙ্গ, পরবর্তীতে নারী হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সাবেক প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিসেবে তিনি আনুকুল্য পেয়েছেন, এ অভিযোগ কারও কারও। স্যান্ডার্সকে মনোনয়ন না দিয়ে তাঁকে দেওয়ার পিছনে অনেকে এ বিষয়টির দিকে আঙ্গুল তুলছেন। হিলারি ফার্স্ট লেডি থাকার সময়ই অনেকের ধারণা ছিল, এক সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন। ধীরে ধীরে সে পথ তৈরি করেই এগিয়েছেন তিনি। মনিকা-ক্লিনটনের সেই কেচ্ছার পরও স্বামীকে তাঁর ক্ষমা করে দেওয়া কতটা পতিপ্রেম আর কতটা ক্ষমতাপ্রেম তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকের।
তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প যদিও সে প্রসঙ্গ তুলেননি, কিন্তু নারী বলে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। ‘জেন্ডার কার্ড’ ব্যবহার করছেন হিলারি এমন অভিযোগ করেই কেবল ক্ষান্ত হননি ট্রাম্প, আরও অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন। হিলারি পুরুষ হলে শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট পেতেন, এমন হিসাবও কষেছেন সেই ভদ্রলোক। এছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত ইমেইল ব্যবহার, পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালে বেনগাজি ইস্যু ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচকদের উত্তর দিতে হয়েছে তাঁকে অহরহ। ইসরাইলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে মুসলমান ভোটারদের একাংশ তাঁর উপর নাখোশও বটে।
অনেকে ভাবছেন, হিলারি ক্লিনটনই বুঝি প্রথম নারী যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেলেন। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরও এক ডজন নারী বিভিন্ন সময় মনোনয়ন পেয়েছেন। তাদের কেউ সেভাবে আলোচিত হননি; কারণ তাঁরা রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেটের মতো মূলধারার রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ছিলেন না। ১৯৮৪ সালে প্রথমবারের মতো
আমেরিকার একটি প্রধান দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন জেরালডিন ফেরারো। তিনিই প্রথম আলোচনায় আসেন। সে সময় নারী বলে তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে সরস আলোচনা হত।
মনে পড়ছে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিকের সঙ্গে জেরালডিনের কথোপকথন। সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন:
‘‘আপনি কি পারমাণবিক বোমার বোতাম টিপতে পারবেন?’’
তাঁর উত্তর ছিল:
‘‘দেশের নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই পারব।”
এরপর প্রশ্ন ছিল:
‘‘আপনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোয়ন পেয়েছেন কেন? আপনার জেন্ডারের জন্য?’’
তখন জেরালডিনের উত্তর ছিল:
‘‘আমি জানি না, আমি জানি না। যদি পুরুষ হতাম এবং আমার যোগ্যতা একই থাকত, তাহলে এ প্রশ্ন আপনি করতে পারতেন না। পারমাণবিক বোমার বোতাম টিপতে পারব কিনা, এ প্রশ্নও করতেন না।’’
১৯৮৪ সাল থেকে ২০১৬। পরিবর্তন হয়েছে অনেক। এ ধরনের ‘বেকুব’ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা হিলারির নেই। তারপরও দুঃখের বিষয় এই যে, ১৯৮৪ থেকে ২০১৬ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়নি। বিষয়টি এখন নারীঅধিকার সমর্থকরা ফোকাসে আনতে চাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে হিলারি ছাড়া আর কে তাদের মুখপাত্র হতে পারবেন?
তবে শুধু সমান মজুরি বা মাতৃত্বকালীন ছুটি নয়, হিলারির নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর প্রজনন-স্বাস্থ্য, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে।
হিলারির প্রতি নারীদের এ সমর্থনের জোয়ারের কারণ তিনি নিজেও। বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৮ সালে তিনি বারাক ওবামার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে ভুল করেছিলেন তা হচ্ছে, ‘নারী’ ইস্যুগুলো তিনি এড়িয়ে গেছেন। বস্তুত একজন নারী হিসেবে নয়, তিনি শুধু প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন যাকে বলে ‘মেলনেস’ অনুসরণ করে। অনেকটা সে কারণে সে সময় হিলারি নারীদের মধ্যে ততটা জনপ্রিয়তা পাননি যা এখন পাচ্ছেন।
এমনকি সে সময় তিনি তরুণ ডেমোক্রেট নারীদেরও ভোট পাননি বলে মনে করা হয়। অথচ ফার্স্ট লেডি হিসেবে তিনি নারীদের জন্য কাজ করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। তখনও তিনি সে বিষয়গুলো অনায়াসে তাঁর প্রচারণায় ব্যবহার করতে পারতেন।
এখন যেমন তিনি ‘উইমেন পাওয়ার’ বিষয়টির উপর জোর দিচ্ছেন। ১৯৯৫ সালে বেইজিংএ নারী সম্মেলনে তিনিই দিয়েছিলেন সেই জনপ্রিয় শ্লোগান, ‘উইমেন রাইট ইজ হিউমেন রাইট’– বাংলায় বললে, ‘নারীঅধিকার মানবাধিকার।’
আগামী ৮ নবেম্বর আমেরিকানরা তাদের ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন জিতলে অবশ্যই ইতিহাস তৈরি হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কতটা সফলতা দেখাতে পারবেন তা সময় বলবে। এ প্রসঙ্গে ইলিনর রুজভেল্টর উদ্ধৃতি মনে পড়ছে:
‘‘নারীরা হচ্ছে টি-ব্যাগের মতো। গরম পানিতে ছাড়লে বোঝা যায় তারা কতটা শক্তিশালী।’’
হিলারির শক্তি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে পৃথিবী, যখন তিনি হোয়াইট হাউসে আবার প্রবেশ করবেন। ফার্স্ট লেডি হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
পারভীন সুলতানা ঝুমা
সাংবাদিক, কলামিস্ট