সোমবার, ১১ জুলাই, ২০১৬

নোয়াম চমস্কিঃ মার্কিন ভূমে এক মার্কিন বিরোধীর উত্থান

বিশ্বে হাতেগোনা যে ক’জন সুপ্রসিদ্ধ এবং সর্বজন স্বীকৃত বুদ্ধিজীবী প্রথম সারিতে রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম নোয়াম চমস্কি। তিনি একাধারে একজন ভাষাবিদ, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, লেখক, যুক্তিবিদ, সামাজ কর্মী, দার্শনিক এবং অধ্যাপক। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি একজন ভাষাতত্ত্ববিদ এবং সমালোচক। এই বিশেষ
কারণেই বিশ্ববাসীর কাছে সামদৃত এবং নন্দিত চমস্কি। ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের তোয়াক্কা না করে স্থান কাল পাত্রের সঠিক অবস্থানকে যিনি তীক্ষ্ণ সমালোচনামূলক বাক্যবাণে জর্জরিত করতে পারেন তিনি হলেন নোয়াম চমস্কি। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য নীতির কঠোর সমালোচনামূলক লেখনীতে তিনি যে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তাতেই জ্ঞানপিপাসু মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন প্রবীণ এই অধ্যাপক।

নোয়াম চমস্কি ১৯২৮ সালের ৭ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। আজ অবদি অধ্যাপনায় নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে। পাশাপাশি চলছে লেখালেখিও।

পঞ্চাশের দশকে ভাষাবিদ্যার ওপর ব্যাপক পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে আসেন চমস্কি। ইউনিভার্সাল গ্রামার থিওরি তারই অবদান। পরবর্তীতে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এর কয়েকবছর পর ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করেন। শুধু তাই নয় যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবিত নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদ এবং মূলধারার গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও চমস্কির অবস্থান ছিল একেবারে কট্টর সমালোচনামূলক। বিশ্ববাসীর চোখের সামনে উদীয়মান এই নয়া পুঁজিবাদের হা করা মুখের সামনে তিনি বিতর্কিতও হয়েছেন বহুবার। কিন্তু তার লেখনীর স্বকীয়তা তাকে ঠিকই অনেক উঁচুতে পৌঁছে দিয়েছে।

ইহুদি ধর্ম ও সংস্কৃতির সাহিত্যে তার অগাধ জ্ঞানের জন্য তিনি ইহুদিবাদী যুব নেতা হিসেবেও যৌবনে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ছাত্রাবস্থায়ই হিব্রু ভাষার শিক্ষকতা করে সেই টাকায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালাতেন। তিনি আরবি ভাষা শিক্ষাতেও সমান আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ইংরেজি ভাষাতত্ত্বকেই প্রধান হিসেবে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেন।

একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত হয়েও তিনি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন তথা পরোক্ষ মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তার লেখা এবং জনসমক্ষে বক্তৃতার মাধ্যমেই তিনি তার সমালোচনামূলক প্রতিবাদী অবস্থানের জানান দিয়েছিলেন সেই আগ্রাসনের শুরুতেই। মার্কিন বেতারের এক কর্মকর্তা চমস্কি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘নোয়াম চমস্কি দ্বিতীয়ত একজন ইহুদি। কারণ ফিলিস্তিনিদের যদি কোনো মার্কিন পরম মিত্র থেকে থাকে তাহলে তিনি আর কেউ নন, তিনি নোয়াম চমস্কি।’ ২০১০ সালে তাকে ইসরায়েলে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

ইসরায়েল ফিলিস্তিন ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে তার লেখা ‘পিস ইন দ্য মিডল ইস্ট’ এবং ‘দ্য ফেইটফুল ট্রায়াঙ্গল’। এই বই দু’টি যথাক্রমে ১৯৭৪ এবং ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। বই দুটি ক্ল্যাসিক সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে।

একইভাবে ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রসনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে তাদের নয়া উপনিবেশবাদ কায়েম করতে চায়, এটা নিশ্চিত। আর এটা অনুধাবন করতে চাইলে কারো উঁচুমাপের জ্ঞান দরকার হয় না। পাশাপাশি ভিয়েতনামের বাস্তবতা বোঝার জন্যও কোনো বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু খানিকটা বিশ্লেষণী ক্ষমতা যা সব মানুষের ভেতরেই বিদ্যমান। শুধু তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করার চর্চা দরকার।’

চমস্কির লেখা প্রথম রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ ‘আমেরিকান পাওয়ার অ্যান্ড দ্য নিউ ম্যান্ডারিনস’, যা ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় এবং তাকে মার্কিন মতবিরোধীদের সারির সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

চমস্কির ‘ওয়াজ দেয়ার অ্যান অল্টারনেটিভ?’ বইতে তিনি বিশ্বের সর্বত্র মার্কিন হস্তক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেন অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ফলে বইটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বছরের সর্বাধিক বিক্রিত বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

অধ্যাপনার পাশাপাশি আশি বছর বয়সী চমস্কি এখনও তার কলম চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অমর বাণী, এটা আজীবন জারি থাকুক- এটি বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের পরম প্রত্যাশা।

নোয়াম চমস্কিকে যারা চেনেন, তারা জানেন লোকটি কতোটা ঠোঁট কাটা। মূলত একজন ভাষাতত্ত্ববিদ। মনোবিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি। বিচরণ করেছেন রাজনীতিতে। আমেরিকান রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচক। তার তীক্ষ্ণ সমালোচনার কারনে নিজে ইহুদী হলেও ইসরাইলে তার প্রবেশাধিকার এখনো নিষিদ্ধ। তার মতামত ধারন করে বাম ঘরানাকে। নিজেকে তিনি দাবি করেন- “এনার্কো সিন্ডিকালিস্ট” হিসেবে। সিন্ডিকালিজম, যার অর্থ দাঁড়ায়- সমবায় ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রচলিত পুজিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণীর “স্বব্যবস্থাপণা” এবং রাজনীতিতে “ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি” প্রবর্তনের পক্ষে এরা। এদের আদর্শ কমিউন ব্যাবস্থা হলো ১৮৭১ সালের প্যারি কমিউন, কিংবা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ১৯১৭ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত সেন্ট পিটার্সবার্গের ক্রন্সতাদ, হাল আমলে আর্জেন্টিনার শ্রমিক আন্দোলনের জোর সমর্থক এরা। লিবারেটারিয়ান সোসিয়ালিজম বলতে এরা বোঝেন শ্রম দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় কর্ত্রিত্তের বাইরে এক সমাজ ব্যাবস্থা। যেখানে কমিউন হবে সে সমাজের পরিপোষক। উনবিংশ শতকের মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের আদলে সিন্ডিকালিস্ট মতবাদ বর্তমানে জনপ্রিয় হতে চলেছে সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকায়। বাড়ছে এ মতবাদে অনুসারীর সংখ্যা। “অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের” পেছনে এবং প্রকাশ্যে এদের সাংগঠনিক ততপরতা রয়েছে বলে ধারণা। এরা মনে করে দেশে-দেশে ধনী ও শোষকের যে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, এর গালে থাপ্পড় মারার জন্যই “এনার্কো সিন্ডিকালিস্ট” মুভমেন্টের প্রয়োজন।

৮৩ বছর বয়সের চমস্কি গত ৫৫ বছর ধরে আমেরিকার সেরা ইউনিভার্সিটি এম আই টি (ম্যাসাচুসেট ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি) তে অধ্যাপনা করে আসছেন। ১৯২৮ সালের ৭ ডিসেম্বর ইনি ফিলাডেলফিয়ার পেনসিলভানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন ইহুদী স্কলার। তবে ঘরে তাদের প্রধান ভাষা ছিল ইদ্দিস। আইরিশ ক্যাথলিকদের ব্যাপারে ভীতি নিয়েই তার বাল্যকাল শুরু। ১৯৪৫ সাল থেকে দর্শনে তার লেখাপড়া শুরু। পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটিতে ওয়েস্ট চার্চম্যান, এবং নেলসন গুডম্যান ছিলেন তার দর্শনের অধ্যাপক। ১৯৪৯ সালে আরেক ভাষাতত্ত্ববিদ ক্যারল শ্যাতজ’কে বিয়ে করার পর তাদের দুটো মেয়ে ও একটি ছেলে। চমস্কি ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি এম আই টি’তে যোগ দেন এবং ১৯৬১ সালে অধ্যাপকে পদোন্নতি লাভ করেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে সমগ্র আমেরিকায় জনমত তৈরি করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে ১৯৬৭ সালে তিনি নিউইয়র্ক টাইমসে “বুদ্ধিজীবীদের দায়” নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। ভাষাতত্ত্ব এবং মনোবিজ্ঞানে তার অসামান্য অবদান সত্ত্বেও চমস্কি সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন একজন রাজনীতি তত্ত্ববিদ হিসেবে। দুনিয়ার প্রায় সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ডাক পড়ে বক্তৃতা দেবার জন্য। ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত হিউমানিটিস সাইটেশন ইনডেক্সে তিনি ছিলেন সবার শীষে। জীবিত কোন স্কলারের জন্য এ অর্জন বিরল। শতাধিক বইয়ের রচয়িতা চমস্কি সমসাময়িক বিষয়ের ওপর এখনো লিখে চলেছেন।

তিনি কোন প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস করেন না, তবে তার আগ্রহ পশ্চিমা দর্শনে। তার দার্শনিক গুরু ব্রিটিশ স্কলার বার্টারেন্ড রাসেল, এবং আমেরিকান দার্শনিক জন ডেওয়ী। লাদেন হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন- আমাদের কেমন লাগবে যদি ইরাকী কমাণ্ডোরা জর্জ বুশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে এবং তার মৃতদেহ আটলান্টিকে ডুবিয়ে দেয়?” জর্জ বুশের অপরাধকে তিনি বিন লাদেনের অপরাধের চেয়ে গুরুতর মনে করেন এবং বলেন- বুশের এই অপরাধ নাৎসি অপরাধের সমতূল্য। আমেরিকান মিডিয়াকে তিনি যুক্তরাস্ট্র সরকারের “কেনা গোলাম” বলে অভিহিত করেন। এটাকে তিনি অস্বাভাবিক বিবেচনা করেন না, কারন এ সব মিডিয়ার মালিকও কর্পোরেট হাউস; যাদের সার্থ দেখভাল করার দায়িত্ব যুক্তরাস্ট্র সরকারের। তারপরও তিনি মনে করেন আমেরিকাই দুনিয়ার সেরা দেশ, কারন স্বাধীনভাবে কথা বলা এবং পথ চলা একমাত্র আমেরিকাতেই সম্ভব।

ফজলে রাব্বী, জহিরুল চৌধুরী