পৃথিবীর বড় ও উন্নত দেশগুলিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে ধনী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত অনুদান একটা বড় প্রভাব ফেলে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বড় বড় হাসপাতাল বানিয়ে, কিংবা ক্যানসার গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে, অসংখ্য নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিশেষ গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে, কিংবা স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান
বানিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় প্রভূত অবদান রেখেছেন বিভিন্ন ধণাঢ্য ব্যক্তিবর্গ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই অন্তত হাফ-ডজন ধণাঢ্য ব্যক্তির নাম করা যায় যাঁরা তাঁদের নিজস্ব খাজাঞ্চিখানা থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করে গেছে শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্যই। যেমন ইয়ের্কস, হুকার, কার্নেগি, রকিফেলার, স্লোন এবং লিক। এইসব ধনী মানুষেরা যেসব একক দান করে গেছেন তা দিয়ে মার্কিন সায়েন্স বহুদূর উঠে গেছে। জেমস লিকের একক অনুদানে নির্মিত লিক মানমন্দিরের বানানোর গল্পটা শুনুন।
জেমস লিকের জন্ম ১৭৯৬ সালে পেনসিলভানিয়ায়। তখন জর্জ ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রপতিত্বের শেষ বছর চলছে। নানান জায়গা ঘুরে লিক সাহেব চলে যান দক্ষিণ আমেরিকায়। সেখানে বিভিন্ন শহর (বুয়েনাস এয়ারিস, ভালপেরেসো, লিমা) বিভিন্ন মেয়াদে তিনি কাজ করেছেন। এসব শহরে তাঁর মূল পরিচিতি ছিল একজন দক্ষ ও কুশলী পিয়ানো-কারিগর হিসেবে। ১৮৪৮ সালে পেরুতে দশ বছর কাটানোর পর ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে আসেন। এবারে তাঁর সমস্ত জমানো সম্পত্তি দিয়ে তিনি সানফ্রানসিস্কোয় জমির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। রিয়েল এস্টেটের এই ব্যবসাই তাঁকে ধনী করে তোলে। কুড়ি বছরের মধ্যেই তিনি ঐ এলাকার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন যাঁর তৎকালীন পুঁজি ছিল ৭,৫০,০০০ ডলার। তখন তিনি সপ্ততিপর বৃদ্ধ।
১৮৬০ সালে এক তরুন পর্তুগিজ-আমেরিকান জর্জ মেডেইরা ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূবিদ্যা নিয়ে বক্তৃতা করে আসছিলেন। সান হোসেতে এরকম একটি লেকচার শুনে মেডেইরাকে লিক সাহেব তাঁর র্যাঞ্চে নিয়ে কয়েকদিন আতিথেয়তা করেন। এই সবের ফাঁকে ফাঁকে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ চলছিল এবং তখনই কোনো এক আলাপচারিতার ফাঁকে জর্জ মেডেইরা লিক সাহেবকে কথাচ্ছলে বলেন, ‘আহ্, লিক সাহেব, আমার যদি আপনার মতো ধন-দৌলত থাকত, তবে আমি দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা টেলিস্কোপটি বানাতাম!’ অবশ্য এই কথিত গল্প সর্বতোভাবে সঠিক কি-না তা বলা যায় না। যাহোক, ১৮৭১ সালে ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমী অব সায়েন্সেসের সভাপতি যখন লিক সাহেবের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান, তখন লিক সাহেব তাঁর কাছে “দুনিয়ার সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী টেলিস্কোপ” বানানোর ইচ্ছাটা প্রকাশ করেন। উক্ত সভাপতি মশাই এরপর কোথায় কীভাবে টেলিস্কোপটি বসানো যায়, তাতে কত খরচ পড়তে পারে সে বিষয়ে লিক সাহেবের সাথে বিশদ আলাপ করেন। এইসব আলাপচারিতায় সাব্যস্ত হয় যে টেলিস্কোপটির জন্য ১২,০০,০০০ ডলার বরাদ্দ করা হবে এবং জেমস লিক এই পরিমাণ অর্থ উইল করে আলাদা করে রাখেন। এদিকে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের সচিব জোসেফ হেনরিও লিক সাহেবকে এই বিষয়ে অনেক পরামর্শ দিতে থাকেন। এমনকি সেই সময়ের প্রথিতযশা জ্যোতিঃপদার্থবিদ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং নেচার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা নরম্যান লকইয়ারের নামও প্রস্তাব করেন, প্রস্তাবিত মানমন্দিরের পরিচালক হিসেবে।
যাহোক, নানান আইনী জটিলতা ও বাধাবিপত্তি পেরিয়ে লিক সাহেব এই টেলিস্কোপটি বানানোর জন্য তৃতীয় ডিড অব ট্রাস্ট গঠন করেন। তৃতীয় ডিডে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। ১. লিক সাহেব মর্জিমাফিক ট্রাস্টিদের হায়ার-ফায়ার করতে পারবেন; ২. ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের পরিবর্তে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্টদের হাতে এর ভার ন্যস্ত করা হয়; ৩. টেলিস্কোপটির জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে মাউন্ট হ্যামিলটন নির্ধারিত হয়। এতো সব ঝুট-ঝামেলা মোকাবেলা করতে করতেই ১৮৭৬ সালের আগস্টে লিক সাহেব মারা যান। তবে তিনি মারা যাবার আগে ট্রাস্টের দায়িত্ব একজন যোগ্য লোকের হাতে অর্পণ করে যান। এই মানুষটির নাম ক্যাপ্টেন রিচার্ড ফ্লয়েড। ফ্লয়েড সাহেব কিছুদিন ওয়েস্ট কোষ্টে স্টিমার পরিচালনা করেছিলেন বলে তাঁর উপাধি ‘ক্যাপ্টেন’ হয়। শ্বশুরবাড়ি সূত্রে বিরাট সম্পত্তির মালিক হওয়ায় বিলাসী অবসর জীবন কাটাতে কাটাতে ঘটনাক্রমে তাঁর সাথে লিক সাহেবের দেখা হয়। মে ১৮৭৫-এর কথা। দেখামাত্র, ফ্লয়েডকে লিক সাহেবের পছন্দ হয়ে যায়। এই কর্মী পুরুষটির হাতে লিক সাহেব তাঁর স্বপ্নের টেলিস্কোপটি বানানোর দায়িত্ব অর্পন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, ফ্লয়েড দায়িত্ব না নিলে লিক অবজার্ভেটির মতো কিনা সন্দেহ।
ফ্লয়েডের সাথে আরো যে দুজন মানুষের নাম করতে হয়, যাঁরা লিক অবজার্ভেটরি নির্মাণে মূল ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হল ডিড অব ট্রার্স্টির সচিব হেনরি ম্যাথুস ও নির্মাণের তত্ত্বাবধায়ক টমাস ফ্রেজার। ম্যাথুসের কাজ ছিল টাকা পয়সার ব্যাপারটা সামলানো। লিক সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তি বিক্রয় করে লব্ধ অর্থ থেকে সকল পাওনা গন্ডা এবং কর পরিশোধ করে নির্মাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়াই তাঁর কাজ ছিল। অন্যদিকে নোভা স্কশিয়ার মানুষ ফ্রেজার ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত প্রকৌশলী। লিক অবজার্ভেটরি নির্মাণের সমুদয় দায়িত্ব তাঁর কাঁধে ন্যস্ত ছিল। নির্মাণকাজ শেষ হবার কিছুদিন আগে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং প্রায় ১ বছর পর মাত্র ৪১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। লিক অবজার্ভেটরির কিউরেটর ম্যারি শেন-এর জবানিতে,
“পুরোমাত্রায় কাজ শুরুর ৮ বছরের মাথায় সেই সময়ের সর্বোৎকৃষ্ট মানমন্দিরটি নির্মিত হয়, সকল যন্ত্রপাতিও বসে যায় এবং মানমন্দিরটি কাজও শুরু করে দেয়। এটি সম্ভব হয়েছিল তিনজন বিশিষ্ট মানুষের কল্যাণে: ফ্লয়েড, ম্যাথুস ও ফ্রেজার। এঁরা কেউই জ্যোতির্বিদ্যায় পারঙ্গম ছিলেন না, কিন্তু লিক মানমন্দিরকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এই ত্রয়ীর চেষ্টার শেষ ছিল না। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁদের স্বকীয়তা, অধ্যবসায় এবং কঠিন পরিশ্রমের কারণে, বলা যায় এই পরিশ্রমের ফলেই ফ্লয়েড ও ফ্রেজার অকাল প্রয়াত হন।”
এমন সব কৃতবিদ্য মানুষ থাকা সত্ত্বেও এবং জায়গা ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও মানমন্দির নির্মাণের কাজ চলছিল শ্লথগতিতে। মানমন্দিরের জন্য ৩৬ ইঞ্চি লেন্স বানানোর ঠিকাদারী পায় অ্যালভিন ক্লার্ক এন্ড সন্স যারা ইউএস নেভাল অবজার্ভেটরির ২৬-ইঞ্চি প্রতিসারক টেলিস্কোপটি বানিয়েছিল। লেন্স বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় গ্লাস-ডিস্ক বা কাঁচের পাতটি আসে প্যারিস থেকে। কিন্তু প্যাকিংয়ের সময়ে কাঁচটি ভেঙ্গে যায় এবং ১৯ বারের চেষ্টায় অবশেষে ঠিকমতো কাঁচখন্ডটি অ্যালভিন ক্লার্কের কাছে হস্তান্তরিত হয় অক্টোবর ১৮৮৫ সালে এবং অভিলক্ষ্য লেন্সটি মাউন্ট হ্যামিলটনে আসে ডিসেম্বর ১৮৮৬তে। প্রায় এক বছর ধরে সম্পূর্ণ টেলিস্কোপটি পরিপূর্ণ আকৃতি পায়। একইসাথে পাহাড়ের চূড়ায় কঠিন পরিস্থিতিতে মানমন্দিরের নির্মাণ কাজও চলতে থাকে। ১০০ বছরেরও বেশী আগে ঐ দুর্গম পাহাড়ে নির্মাণকাজ চালানো নিশ্চয়ই চাট্টিখানি কথা ছিল না।
লিক মানমন্দিরের প্রথম ডিরেক্টর নিয়োজিত হন এডোয়ার্ড হল্ডেন। হল্ডেন নেভাল অবজার্ভেটরির ২৬ ইঞ্চি টেলিস্কোপের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিদ সাইমন নিউকম্বের অধীনে। এই নিউকম্বই মাত্র ২৮ বছর বয়স্ক হল্ডেনকে লিক মানমন্দিরের ডিরেক্টর করার জন্য মনোনীত করেন। ১৮৮৮ সালের ১৯ জুন হল্ডেন পরিচালক পদে ভূষিত হন। হল্ডেন একজন উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন। পরিচালক পদে যোগদানের প্রথম পাঁচ হপ্তায় তিনি সর্বমোট ৫০৪টি চিঠি লিখেছেন সবকটিই হাতে লেখা। তাঁর চাকরিকালে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য নানাভাবে যোগাড় করতে পেরেছিলেন। এর একটি কারণ হলো এই যে, হল্ডেন একজন প্রথম শ্রেণীর পাবলিসিষ্ট ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক। পত্র-পত্রিকায় তিনি লেখালেখিও করতেন। হল্ডেনের গণসংযোগের একটি উদাহরণ দিই: ৩ ফুট ব্যাসের একটি দর্পণ দান হিসেবে যোগাড় হয়েছিল এক বিলেতী সৌখিন জ্যোতির্বিদের কাছ থেকে। এর মাউন্টিং ও ডোম সহ প্রতিফলক টেলিস্কোপটিকে ইংল্যান্ড থেকে মাউন্ট হ্যামিলটনে নিতে জাহাজ ও রেলভাড়াও অনুদান হিসেবে যথাক্রমিক কোম্পানিগুলো থেকে আদায় করতে পেরেছিলেন হল্ডেন। ১৮৯৭ সালে পদত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত হল্ডেনের অধীনে লিক মানমন্দিরের ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু কৃতবিদ্য স্টাফ-মেম্বার ও জ্যোতির্বিদ কাজ করেছেন। কিন্তু আগেই বলেছি, পাহাড়ের নিঃসঙ্গ ও দুর্গম পরিবেশে পরিবার নিয়ে বাস খুবই অস্বাচ্ছন্দ্যের। ফলে, এবং আরো কিছু গৌন কারণে, হল্ডেনের অজনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। কিন্তু তবু বলা যায়, প্রথম পরিচালক হিসেবে হল্ডেন সার্থকই ছিলেন।
এই হলো লিক মানমন্দিরের গল্প। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার অনেক বড় বড় আবিষ্কার এই মানমন্দিরে সম্পন্ন হয়েছে। একটি ধনাঢ্য অনুদান কীভাবে সুদীর্ঘকাল জ্ঞানচর্চার পরাকাষ্ঠা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে লিক মানমন্দির তাঁর উদাহরণ। জেমস লিক এই অনুদানটি না করলেও পারতেন। কিন্তু করেছেন বলেই তৃতীয় সহস্রাব্দের একজন বাঙালি পাঠক তাঁর নাম জানতে পারছেন।
আমাদের দেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় এরকম ধনাঢ্য অনুদান আমরা কি পেতে পারি না? আমাদের দেশে শত কোটি টাকার মালিক কি নেই? তাঁরা কি দিতে পারেন না তাঁদের সমুদয় সম্পদের মাত্র ১০ শতাংশ? এরকম দু’চারটি অনুদান পেয়েই তো গবেষণার কাজ এগোয়। এখন পর্যন্ত আমাদের অনুদানগুলো হলো অমুকের নামে স্মারক বক্তৃতা কিংবা তমুকের নামে লাখ-দশেকের ফিক্সড-ডিপোজিটের বিপরীতে কিছু মেধাবী ছাত্রের বৃত্তি। বর্তমানে এইসব অনুদানের বেশিরভাগই আসে কোনো প্রয়াত শিক্ষাবিদের অনুদান থেকে। কিন্তু বড় ফান্ডের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমাদের দেশে এই মুহুর্তে কোনো মানমন্দির নেই। আমরা কয়েজন জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহী মানুষজন দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি মানমন্দির স্থাপনের জন্য চেষ্টা করে আসছি। এর জন্য প্রফেসর এ. আর. খান টেকনাফ ও বান্দরবানে কয়েকটি স্থানও নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। আমরা হিসাব করে দেখেছি, একটি ১ মিটার প্রতিসরণ টেলিস্কোপ সহ একটি মানমন্দির বানাতে ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকার দরকার। এই সামান্য অর্থ আমাদের অনেক ধনীব্যক্তির কাছে কিছুই না। এই সামান্য টাকাটা যদি তাঁদের নামে একটি সারস্বত প্রতিষ্ঠান করে সেখানে দান করে যান, তো চমৎকার হয়। সব তো আর সরকার করে দেবে না, ব্যক্তিগত অনুদানও কম গুরুত্ব বহন করে না। একই কথা প্রযোজ্য আমাদের দেশের ক্যানসার চিকিৎসায়। সুলেখক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখনিতে জানিয়েছেন স্লোন ক্যানসার ইনস্টিটিউটে তাঁর চিকিৎসার গল্প, এবং বাংলাদেশে ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণে ধনাঢ্য অনুদানের প্রয়োজনীয়তার কথা। আমাদের সমাজের ধনী মানুষেরা কি পারে না এদেশ ও সমাজকে আলোকবর্তিকা হাতে পথ দেখানোর জন্য কিছু আলোকদায়ী প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সাহায্য করতে?
এ সমাজ তো তাঁদেরও সমাজ, তাঁদেরও দেশ। নয় কি?
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী : বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
বানিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় প্রভূত অবদান রেখেছেন বিভিন্ন ধণাঢ্য ব্যক্তিবর্গ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই অন্তত হাফ-ডজন ধণাঢ্য ব্যক্তির নাম করা যায় যাঁরা তাঁদের নিজস্ব খাজাঞ্চিখানা থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করে গেছে শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্যই। যেমন ইয়ের্কস, হুকার, কার্নেগি, রকিফেলার, স্লোন এবং লিক। এইসব ধনী মানুষেরা যেসব একক দান করে গেছেন তা দিয়ে মার্কিন সায়েন্স বহুদূর উঠে গেছে। জেমস লিকের একক অনুদানে নির্মিত লিক মানমন্দিরের বানানোর গল্পটা শুনুন।
জেমস লিকের জন্ম ১৭৯৬ সালে পেনসিলভানিয়ায়। তখন জর্জ ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রপতিত্বের শেষ বছর চলছে। নানান জায়গা ঘুরে লিক সাহেব চলে যান দক্ষিণ আমেরিকায়। সেখানে বিভিন্ন শহর (বুয়েনাস এয়ারিস, ভালপেরেসো, লিমা) বিভিন্ন মেয়াদে তিনি কাজ করেছেন। এসব শহরে তাঁর মূল পরিচিতি ছিল একজন দক্ষ ও কুশলী পিয়ানো-কারিগর হিসেবে। ১৮৪৮ সালে পেরুতে দশ বছর কাটানোর পর ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে আসেন। এবারে তাঁর সমস্ত জমানো সম্পত্তি দিয়ে তিনি সানফ্রানসিস্কোয় জমির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। রিয়েল এস্টেটের এই ব্যবসাই তাঁকে ধনী করে তোলে। কুড়ি বছরের মধ্যেই তিনি ঐ এলাকার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন যাঁর তৎকালীন পুঁজি ছিল ৭,৫০,০০০ ডলার। তখন তিনি সপ্ততিপর বৃদ্ধ।
১৮৬০ সালে এক তরুন পর্তুগিজ-আমেরিকান জর্জ মেডেইরা ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূবিদ্যা নিয়ে বক্তৃতা করে আসছিলেন। সান হোসেতে এরকম একটি লেকচার শুনে মেডেইরাকে লিক সাহেব তাঁর র্যাঞ্চে নিয়ে কয়েকদিন আতিথেয়তা করেন। এই সবের ফাঁকে ফাঁকে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ চলছিল এবং তখনই কোনো এক আলাপচারিতার ফাঁকে জর্জ মেডেইরা লিক সাহেবকে কথাচ্ছলে বলেন, ‘আহ্, লিক সাহেব, আমার যদি আপনার মতো ধন-দৌলত থাকত, তবে আমি দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা টেলিস্কোপটি বানাতাম!’ অবশ্য এই কথিত গল্প সর্বতোভাবে সঠিক কি-না তা বলা যায় না। যাহোক, ১৮৭১ সালে ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমী অব সায়েন্সেসের সভাপতি যখন লিক সাহেবের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান, তখন লিক সাহেব তাঁর কাছে “দুনিয়ার সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী টেলিস্কোপ” বানানোর ইচ্ছাটা প্রকাশ করেন। উক্ত সভাপতি মশাই এরপর কোথায় কীভাবে টেলিস্কোপটি বসানো যায়, তাতে কত খরচ পড়তে পারে সে বিষয়ে লিক সাহেবের সাথে বিশদ আলাপ করেন। এইসব আলাপচারিতায় সাব্যস্ত হয় যে টেলিস্কোপটির জন্য ১২,০০,০০০ ডলার বরাদ্দ করা হবে এবং জেমস লিক এই পরিমাণ অর্থ উইল করে আলাদা করে রাখেন। এদিকে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের সচিব জোসেফ হেনরিও লিক সাহেবকে এই বিষয়ে অনেক পরামর্শ দিতে থাকেন। এমনকি সেই সময়ের প্রথিতযশা জ্যোতিঃপদার্থবিদ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং নেচার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা নরম্যান লকইয়ারের নামও প্রস্তাব করেন, প্রস্তাবিত মানমন্দিরের পরিচালক হিসেবে।
যাহোক, নানান আইনী জটিলতা ও বাধাবিপত্তি পেরিয়ে লিক সাহেব এই টেলিস্কোপটি বানানোর জন্য তৃতীয় ডিড অব ট্রাস্ট গঠন করেন। তৃতীয় ডিডে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। ১. লিক সাহেব মর্জিমাফিক ট্রাস্টিদের হায়ার-ফায়ার করতে পারবেন; ২. ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের পরিবর্তে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্টদের হাতে এর ভার ন্যস্ত করা হয়; ৩. টেলিস্কোপটির জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে মাউন্ট হ্যামিলটন নির্ধারিত হয়। এতো সব ঝুট-ঝামেলা মোকাবেলা করতে করতেই ১৮৭৬ সালের আগস্টে লিক সাহেব মারা যান। তবে তিনি মারা যাবার আগে ট্রাস্টের দায়িত্ব একজন যোগ্য লোকের হাতে অর্পণ করে যান। এই মানুষটির নাম ক্যাপ্টেন রিচার্ড ফ্লয়েড। ফ্লয়েড সাহেব কিছুদিন ওয়েস্ট কোষ্টে স্টিমার পরিচালনা করেছিলেন বলে তাঁর উপাধি ‘ক্যাপ্টেন’ হয়। শ্বশুরবাড়ি সূত্রে বিরাট সম্পত্তির মালিক হওয়ায় বিলাসী অবসর জীবন কাটাতে কাটাতে ঘটনাক্রমে তাঁর সাথে লিক সাহেবের দেখা হয়। মে ১৮৭৫-এর কথা। দেখামাত্র, ফ্লয়েডকে লিক সাহেবের পছন্দ হয়ে যায়। এই কর্মী পুরুষটির হাতে লিক সাহেব তাঁর স্বপ্নের টেলিস্কোপটি বানানোর দায়িত্ব অর্পন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, ফ্লয়েড দায়িত্ব না নিলে লিক অবজার্ভেটির মতো কিনা সন্দেহ।
ফ্লয়েডের সাথে আরো যে দুজন মানুষের নাম করতে হয়, যাঁরা লিক অবজার্ভেটরি নির্মাণে মূল ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হল ডিড অব ট্রার্স্টির সচিব হেনরি ম্যাথুস ও নির্মাণের তত্ত্বাবধায়ক টমাস ফ্রেজার। ম্যাথুসের কাজ ছিল টাকা পয়সার ব্যাপারটা সামলানো। লিক সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তি বিক্রয় করে লব্ধ অর্থ থেকে সকল পাওনা গন্ডা এবং কর পরিশোধ করে নির্মাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়াই তাঁর কাজ ছিল। অন্যদিকে নোভা স্কশিয়ার মানুষ ফ্রেজার ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত প্রকৌশলী। লিক অবজার্ভেটরি নির্মাণের সমুদয় দায়িত্ব তাঁর কাঁধে ন্যস্ত ছিল। নির্মাণকাজ শেষ হবার কিছুদিন আগে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং প্রায় ১ বছর পর মাত্র ৪১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। লিক অবজার্ভেটরির কিউরেটর ম্যারি শেন-এর জবানিতে,
“পুরোমাত্রায় কাজ শুরুর ৮ বছরের মাথায় সেই সময়ের সর্বোৎকৃষ্ট মানমন্দিরটি নির্মিত হয়, সকল যন্ত্রপাতিও বসে যায় এবং মানমন্দিরটি কাজও শুরু করে দেয়। এটি সম্ভব হয়েছিল তিনজন বিশিষ্ট মানুষের কল্যাণে: ফ্লয়েড, ম্যাথুস ও ফ্রেজার। এঁরা কেউই জ্যোতির্বিদ্যায় পারঙ্গম ছিলেন না, কিন্তু লিক মানমন্দিরকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এই ত্রয়ীর চেষ্টার শেষ ছিল না। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁদের স্বকীয়তা, অধ্যবসায় এবং কঠিন পরিশ্রমের কারণে, বলা যায় এই পরিশ্রমের ফলেই ফ্লয়েড ও ফ্রেজার অকাল প্রয়াত হন।”
এমন সব কৃতবিদ্য মানুষ থাকা সত্ত্বেও এবং জায়গা ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও মানমন্দির নির্মাণের কাজ চলছিল শ্লথগতিতে। মানমন্দিরের জন্য ৩৬ ইঞ্চি লেন্স বানানোর ঠিকাদারী পায় অ্যালভিন ক্লার্ক এন্ড সন্স যারা ইউএস নেভাল অবজার্ভেটরির ২৬-ইঞ্চি প্রতিসারক টেলিস্কোপটি বানিয়েছিল। লেন্স বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় গ্লাস-ডিস্ক বা কাঁচের পাতটি আসে প্যারিস থেকে। কিন্তু প্যাকিংয়ের সময়ে কাঁচটি ভেঙ্গে যায় এবং ১৯ বারের চেষ্টায় অবশেষে ঠিকমতো কাঁচখন্ডটি অ্যালভিন ক্লার্কের কাছে হস্তান্তরিত হয় অক্টোবর ১৮৮৫ সালে এবং অভিলক্ষ্য লেন্সটি মাউন্ট হ্যামিলটনে আসে ডিসেম্বর ১৮৮৬তে। প্রায় এক বছর ধরে সম্পূর্ণ টেলিস্কোপটি পরিপূর্ণ আকৃতি পায়। একইসাথে পাহাড়ের চূড়ায় কঠিন পরিস্থিতিতে মানমন্দিরের নির্মাণ কাজও চলতে থাকে। ১০০ বছরেরও বেশী আগে ঐ দুর্গম পাহাড়ে নির্মাণকাজ চালানো নিশ্চয়ই চাট্টিখানি কথা ছিল না।
লিক মানমন্দিরের প্রথম ডিরেক্টর নিয়োজিত হন এডোয়ার্ড হল্ডেন। হল্ডেন নেভাল অবজার্ভেটরির ২৬ ইঞ্চি টেলিস্কোপের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিদ সাইমন নিউকম্বের অধীনে। এই নিউকম্বই মাত্র ২৮ বছর বয়স্ক হল্ডেনকে লিক মানমন্দিরের ডিরেক্টর করার জন্য মনোনীত করেন। ১৮৮৮ সালের ১৯ জুন হল্ডেন পরিচালক পদে ভূষিত হন। হল্ডেন একজন উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন। পরিচালক পদে যোগদানের প্রথম পাঁচ হপ্তায় তিনি সর্বমোট ৫০৪টি চিঠি লিখেছেন সবকটিই হাতে লেখা। তাঁর চাকরিকালে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য নানাভাবে যোগাড় করতে পেরেছিলেন। এর একটি কারণ হলো এই যে, হল্ডেন একজন প্রথম শ্রেণীর পাবলিসিষ্ট ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক। পত্র-পত্রিকায় তিনি লেখালেখিও করতেন। হল্ডেনের গণসংযোগের একটি উদাহরণ দিই: ৩ ফুট ব্যাসের একটি দর্পণ দান হিসেবে যোগাড় হয়েছিল এক বিলেতী সৌখিন জ্যোতির্বিদের কাছ থেকে। এর মাউন্টিং ও ডোম সহ প্রতিফলক টেলিস্কোপটিকে ইংল্যান্ড থেকে মাউন্ট হ্যামিলটনে নিতে জাহাজ ও রেলভাড়াও অনুদান হিসেবে যথাক্রমিক কোম্পানিগুলো থেকে আদায় করতে পেরেছিলেন হল্ডেন। ১৮৯৭ সালে পদত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত হল্ডেনের অধীনে লিক মানমন্দিরের ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু কৃতবিদ্য স্টাফ-মেম্বার ও জ্যোতির্বিদ কাজ করেছেন। কিন্তু আগেই বলেছি, পাহাড়ের নিঃসঙ্গ ও দুর্গম পরিবেশে পরিবার নিয়ে বাস খুবই অস্বাচ্ছন্দ্যের। ফলে, এবং আরো কিছু গৌন কারণে, হল্ডেনের অজনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। কিন্তু তবু বলা যায়, প্রথম পরিচালক হিসেবে হল্ডেন সার্থকই ছিলেন।
এই হলো লিক মানমন্দিরের গল্প। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার অনেক বড় বড় আবিষ্কার এই মানমন্দিরে সম্পন্ন হয়েছে। একটি ধনাঢ্য অনুদান কীভাবে সুদীর্ঘকাল জ্ঞানচর্চার পরাকাষ্ঠা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে লিক মানমন্দির তাঁর উদাহরণ। জেমস লিক এই অনুদানটি না করলেও পারতেন। কিন্তু করেছেন বলেই তৃতীয় সহস্রাব্দের একজন বাঙালি পাঠক তাঁর নাম জানতে পারছেন।
আমাদের দেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় এরকম ধনাঢ্য অনুদান আমরা কি পেতে পারি না? আমাদের দেশে শত কোটি টাকার মালিক কি নেই? তাঁরা কি দিতে পারেন না তাঁদের সমুদয় সম্পদের মাত্র ১০ শতাংশ? এরকম দু’চারটি অনুদান পেয়েই তো গবেষণার কাজ এগোয়। এখন পর্যন্ত আমাদের অনুদানগুলো হলো অমুকের নামে স্মারক বক্তৃতা কিংবা তমুকের নামে লাখ-দশেকের ফিক্সড-ডিপোজিটের বিপরীতে কিছু মেধাবী ছাত্রের বৃত্তি। বর্তমানে এইসব অনুদানের বেশিরভাগই আসে কোনো প্রয়াত শিক্ষাবিদের অনুদান থেকে। কিন্তু বড় ফান্ডের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমাদের দেশে এই মুহুর্তে কোনো মানমন্দির নেই। আমরা কয়েজন জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহী মানুষজন দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি মানমন্দির স্থাপনের জন্য চেষ্টা করে আসছি। এর জন্য প্রফেসর এ. আর. খান টেকনাফ ও বান্দরবানে কয়েকটি স্থানও নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। আমরা হিসাব করে দেখেছি, একটি ১ মিটার প্রতিসরণ টেলিস্কোপ সহ একটি মানমন্দির বানাতে ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকার দরকার। এই সামান্য অর্থ আমাদের অনেক ধনীব্যক্তির কাছে কিছুই না। এই সামান্য টাকাটা যদি তাঁদের নামে একটি সারস্বত প্রতিষ্ঠান করে সেখানে দান করে যান, তো চমৎকার হয়। সব তো আর সরকার করে দেবে না, ব্যক্তিগত অনুদানও কম গুরুত্ব বহন করে না। একই কথা প্রযোজ্য আমাদের দেশের ক্যানসার চিকিৎসায়। সুলেখক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখনিতে জানিয়েছেন স্লোন ক্যানসার ইনস্টিটিউটে তাঁর চিকিৎসার গল্প, এবং বাংলাদেশে ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণে ধনাঢ্য অনুদানের প্রয়োজনীয়তার কথা। আমাদের সমাজের ধনী মানুষেরা কি পারে না এদেশ ও সমাজকে আলোকবর্তিকা হাতে পথ দেখানোর জন্য কিছু আলোকদায়ী প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সাহায্য করতে?
এ সমাজ তো তাঁদেরও সমাজ, তাঁদেরও দেশ। নয় কি?
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী : বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।