রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৬

পেনসিল দিয়ে লেখা বিদ্রোহী কবিতা

কবি কাজী নজরুল ইসলাম দোয়াত-কলমে কবিতা লিখতেন। দোয়াতের কালিতে বার বার কলমের নিব চুবিয়ে তিনি কবিতা, গল্প, গান লিখেছেন। কিন্তু কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতা লিখেছেন পেনসিল দিয়ে। ‘বল বীর বল চির উন্নত মম শির’ এমন লাইন একটানে কাঠ
পেনসিল দিয়ে লিখে নিজে তো ইতিহাস হয়েছেন, বিদ্রোহী কবিতাও ইতিহাস হয়ে গেছে। এক বসাতেই তিনি কবিতাটি লিখেছেন।

দিনে নয়, লেখা হয়েছে রাতে। কবে লেখা হয়েছে? সুনির্দিষ্টভাবে সেই তারিখ জানা না গেলেও কবিতাটি লেখা হয়েছে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের ভাড়া বাড়িতে বসে নজরুল কবিতাটি লেখেন। কবিতার প্রথম পাঠক ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। কবিতা লেখার জোশ একেবারে পরিপূর্ণ রাখার জন্যই নজরুল পেনসিল ব্যবহার করেছিলেন।

বার বার দোয়াতে কলম চুবিয়ে লিখলে জোশ হারিয়ে যাবে, কবিতার সুর-তাল কেটে যাবে সম্ভবত এই আশঙ্কা থেকেই নজরুল পেনসিল দিয়ে কবিতাটি লেখেন। মাত্রাবৃত্ত মুক্তক ছন্দে কবিতাটি লিখে নজরুল দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। কবিরা বলে থাকেন, ‘কবিতার প্রথম লাইন স্বর্গ থেকে আসে। এরপর কবি স্বর্গের সেই লাইন সাজিয়ে কবিতাকে পূর্ণপ্রাণ করেন।’ এক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি, নজরুল তাঁর বিদ্রোহী কবিতার প্রথম স্তবক মহাকাশ থেকে নিয়ে সাজিয়েছেন, ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ভ্যুলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন আরশ ছেদিয়া/উঠিয়াছি চির বিস্ময়, আমি বিশ্ব বিধাত্রীর।’

নজরুল মহাবিশ্বের মহাকাশ, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, ভ্যুলোক, দ্যুলোক ভেদ করে খোদার আসন ‘আরশ’ অতিক্রম করে বিদ্রোহী হয়েছেন। নজরুলের আগে পৃথিবীতে এমন বিদ্রোহীর কোনো উত্থান ঘটেনি। কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে নজরুল তালতলা লেনের ভাড়া বাড়িতে একসঙ্গে বসবাস করতেন। মুজফ্ফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বিদ্রোহী কবিতা সম্ভবত শেষ রাতেই লেখা হয়েছিল।’ নজরুল কবিতাটি লিখে ভোরে মুজফ্ফর আহমদকে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন।

বিদ্রোহী কবিতা প্রথম ছাপা হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ধূমকেতু (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। এ সময় বিদ্রোহী কবিতাটি মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। নজরুলের বন্ধুবান্ধবসহ সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকরা বিদ্রোহী কবিতার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু বিদ্রোহী কবিতা জ্বালা ধরিয়েছে নজরুলবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের মনে।

এই চক্রটি নজরুলকে তো বটেই, বিদ্রোহী কবিতাকেও কাটাছেঁড়া করেছে। ওই সময় ‘শনিবারের চিঠি’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় নজরুলকে ব্যঙ্গ করে বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি লেখেন এবং সেগুলো ছাপেন। সজনীকান্ত দাসের বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি এমন, ‘আমি ব্যাঙ/লম্বা আমার ঠ্যাং/আমি ব্যাঙ/আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই/আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।’ যোগানন্দ দাস লেখেন, ‘আমি বীর!/আমি দুর্জন, দুর্ধর্ষ, রুদ্র দীপ্ত শির/আমি বীর!’ অশোক চট্টোপাধ্যায় লেখেন, ‘ভাবী শ্বশুরের হিসাব খতিয়া/তরুণ বাঙ্গালী সাগর মথিয়া/উঠেছি যে আমি নিছক শুদ্ধক্ষীর/আমি বীর!’ আরও অনেকে এভাবেই বিদ্রোহী কবিতার সমালোচনা করেছেন। এমনকি কবি গোলাম মোস্তফাও তাঁর ‘নিয়ন্ত্রিত’ শিরোনামের কবিতায় কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতাকে আঘাত হানার চেষ্টা করেছেন এভাবে, ‘ওগো ‘বিদ্রোহী’ বীর!/ সংযত কর, সংহত কর উন্নত তব শির/ তুই যদি ভাই বলিস চেচিয়ে- উন্নত মম শির,/ আমি বিদ্রোহী বীর,/ সে যে শুধুই প্রলাপ, শুধুই খেয়ায়, নাই নাই/ তার কোন গুণ,/ শুনি স্তম্ভিত হবে ‘নমরুদ’ আর ‘ফেরাউন’!’ কিন্তু সজনীকান্ত, গোলাম মোস্তফারা নজরুলের বিদ্রোহ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি।

নজরুলের কাঠ পেনসিলে লেখা কালজয়ী সেই বিদ্রোহী কবিতা আজও চির উন্নত মম শির হয়ে আছে। পৃথিবীতে যত দিন মানুষ থাকবে তত দিন বিদ্রোহ থাকবে। তত দিন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ থাকবে।

ফখরে আলম,

 alam_jess61@yahoo.com