শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কর্নেল গাদ্দাফিকে যেমন দেখেছি

১৯৬৯ সালের  ১লা সেপ্টেম্বর আধুনিক লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মর গাদ্দাফি উপনিবেশের তাবেদার রাজা ইদ্রিসকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। লিবিয়ার ইতিহাসে যা সেপ্টেম্বর বিপ্লব নামে পরিচিত। ৪ দশক লিবিয়া শাসনের পর ইসলামিক সোস্যালিজম আর প্যান-আফ্রিকানিজমের প্রভাবশালী এই নেতা
২০১১ সালে সেই উপনিবেশী অপশক্তির মদদপুষ্ট সিভিল ওয়ারে নিহত হন। গাদ্দাফির শাসনামলে দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপ্লব দিবস হিসেবে পালন করা হতো।
১.
আশির দশকের গোড়ার দিকে যখন বেড়ে উঠছি, তখনই বুঝতে শিখেছি দেশটি আমার না, কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির। টিভি যতক্ষণ খোলা থাকতো, তাকেই দেখা যেতো। বাঙালি কমিউনিটিতে তাকে বলা হতো বড় ভাই অথবা গেদু মিয়া। প্রকাশ্যে তার নাম নিয়ে পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চাইতো না কেউ। সাদা পোশাকের পুলিশতো আর বাংলা বোঝে না। একটা মাত্র টিভি চ্যানেল। অবিরাম গাদ্দাফির মুখ। ছাদে উঠে ঠিকমতো অ্যান্টেনা ঘুরাতে পারলে অবশ্য ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালিয়ান টিভিও আনা যেতো। টিভি সারাদিন দেখতাম, একটা জাতি কিভাবে সামরিক হয়ে উঠছে। ছানি পড়া চোখে রাইফেলের লেন্সে চোখ রেখে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বুড়িরাও। আরও দেখতাম, মরুভূমি থেকে দলে দলে বেদুইন ধরে কলোনিতে উঠিয়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনী। স্কুলের মেয়েরা বেদুইনদের বাথরুমের ফ্লাশ টানা শেখাচ্ছে। ওই কলোনিগুলোতে বেড়ে ওঠা প্রজন্মই ফ্রি ইন্টারনেটের বদৌলতে জানতে পারলো, তাদের দেশে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র উদ্ধারে গাদ্দাফি হটালো তারা। হারালো স্বাস্থ্য, চিকিৎসা বা শিক্ষার মতো মৌলমানবিক চাহিদাগুলো। যেগুলো নিশ্চিত করেছিল গাদ্দাফি প্রশাসন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকেই লিবীয়রা জানে না লোডশেডিং কি? গাদ্দাফি পরিবারের দুর্নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, জনগণকে তিনি দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পেরেছিলেন।

২.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সাম্রাজ্যবাদের একটা আদর্শ উদাহরণ, বিশ্বজুড়ে নানা সমস্যার মূল উৎস শৈশবে টেলিভিশনে গাদ্দাফির ভাষণ দেখেই তা জেনেছিলাম আমি। লোকটা ভীষণ স্ট্যান্টবাজ। একবার কাবা শরিফের গিলাফ ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে আল্লাহ! হজরত মুহাম্মদের স্মৃতিধন্য এই প্রিয় ভূমিকে আমেরিকার দালালদের হাত থেকে রক্ষা করো। এরপর লিবীয়দের হজ যাওয়ার ব্যাপারে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছিল সৌদি সরকার। ৮৬ সালে যখন লিবিয়ায় বিমান হামলা চালালো যুক্তরাষ্ট্র, তখন টিভি দেখতাম, প্রেসিডেন্ট রিগ্যান পিস্তল হাতে পৃথিবীর ওপর বসে আছেন। মজার মজার সব স্টিল কার্টুন অনএয়ার হতো টেলিভিশনে। আমেরিকানরা কাফের। ওরা মুসলিমদের ভালো কখনোই মেনে নেবে না এমন জ্বালাময়ী ভাষণের পর গাদ্দাফিকে দেখতাম, আরেক কাফের রাশিয়ার সঙ্গে সেকি দহরম মহরম। হোক ইসলামী সোস্যালিজম! এই বিপ্লবী নেতার কারণে শৈশবেই আমার সোস্যালিজমের সঙ্গে পরিচয়।

৩.
গাদ্দাফির গাড়িতে বোমা পুঁতে রেখেছে সিআইএ। কিন্তু প্রেসিডেন্টের বাসভবন বাব-আল-আজিজিয়া থেকে তিনি অন্য একটি গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। টাইমবোমায় তার প্রাসাদসম গাড়িটি উড়ে গেলেও, তিনি বেঁচে গেলেন। এ ধরনের গল্প আরো অনেক আছে। সত্য-মিথ্যা জানি না, মিথ্যের মতোই গিলতাম গল্পগুলো। যে সির্তে গাদ্দাফির মৃত্যু হয়, শুনেছিলাম, সির্তের কাছাকাছি সেবা মরুদ্যানে থাকতো গাদ্দাফা কওম। ওই গোষ্ঠীরই এক প্রভাবশালী নেতা ছিলেন গাদ্দাফির বাবা। ভীষণ অসুস্থ হওয়ার পর, তাকে নেয়া হলো সির্ত সেন্টাল হাসপাতালে। প্রেসিডেন্টর বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঘাম ঝরছিল এক বাংলাদেশি ডাক্তারের। পাছে ভুল চিকিৎসার দায়ে তার আবার প্রাণ দিতে না হয়। উপায় না দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফোন করল গাদ্দাফিকে। বলল, উন্নত চিকিৎসার জন্য আপনার বাবাকে ত্রিপলি নিয়ে যান। গাদ্দাফি তখন জিজ্ঞাসা করলেন, গত ৫ বছরে এই রোগের জন্য কয়জনকে ত্রিপলি আনা হয়েছে? হাসপাতালের পরিচালক বললেন, কাউকে নয়। গাদ্দাফি তখন বললেন, অন্য সবার ক্ষেত্রে যা হয়েছে, আমার বাবার ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। সির্তেই মারা গেলেন গাদ্দাফির বাবা। এ ধরনের আরো অনেক চমক, চটকদারি গল্প আছে গাদ্দাফিকে নিয়ে। সিকিউরিটিকে না জানিয়ে গোপনে দেশের পরিস্থিতি দেখতে বের হতেন গাদ্দাফি। আরব্য রজনীর সেই খলিফা হারুনার রশিদের ইমেজ। একবার গভীর রাতে ত্রিপোলির এক হাসপাতালে আচমকা পরিদর্শনে যান গাদ্দাফি। দেখলেন, ডিউটি ডাক্তারের রূমে টেবিলে মাথা রেখে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন এক ভারতীয় ডাক্তার। তাকে বিরক্ত না করে প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেন, কাল সকালেই তাকে ইন্ডিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা কর, যাতে বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে।

৪.
১৯৭৮ সালে ইসরাইলের সঙ্গে মিশরের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির কড়া বিরোধিতা করেছিলেন গাদ্দাফি। তার মদতেই আরব লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল মিশরকে। যে জামাল আবদেল নাসেরকে গুরু মানতেন গাদ্দাফি, তার সঙ্গে সব সম্পর্কও ছিন্ন করলেন তিনি। আশির দশকে আরো একবার মিশরের সঙ্গে ঝামেলা হয় লিবিয়ার। মিসরাতায় সন্ধ্যার পরই নেমে গেল সেনাবাহিনী। সিনেমা হল, শপিংমল, হাসপাতাল থেকে শুরু করে অফিস আদালত যেখানেই মিশরীয়দের পেয়েছে, দলে দলে ট্রাকে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে দেশে। আমাদের বাসার নিচতলায় এক মিশরীয় মহিলা থাকতেন। দৈত্যের মতো লম্বা, ইউরোপীয়ানদের মতো ফর্সা নাম ছিল জামালাত। গোটা দশেক ছেলে-মেয়ে ছিল তার। স্বামী ছিলেন ফিলিস্তিনি। আর এ কারণেই সেই দফা বহিষ্কারের মুখে পড়েননি তিনি।

৫.
প্রায়ই দেখতাম, কোনো বাড়িতে কান্নার রোল। বুঝতাম, পুলিশ এসেছে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে কাউকে। অপরাধগুলো খুবই হালকা ধাঁচের। হয়তো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এক বন্ধু অপর বন্ধুকে বলল, গাদ্দাফি আইতাসে তোরে ধরতে। আর অমনি, সিভিল ড্রেসে কেউ এসে বলল, আপনাকে এ্যারেস্ট করা হলো। আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে একটা লিবীয় পরিবার থাকতো। ভদ্রলোককে আমি কখনোই দেখিনি। শুনেছি, তাকে গুম করেছে সরকারি বাহিনী। ভদ্রলোকের স্ত্রী ইতালিয়ান বংশোদ্ভুত হলেও তুখোড় আরবি বলতে পারতেন। তিনিই আমার মাকে আরবি শিখিয়েছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ৫ বছর ধরে কারাগারে তার এক ছেলে। অপর এক ছেলে মোহাম্মদ ছিলেন পুলিশের বড় কর্তা। চাকরি আর জীবন বাঁচাতে পরিবারের বাইরে আলাদা থাকতেন তিনি। মেয়ে মরিয়ম থাকতেন মায়ের সঙ্গে। সারাদিন গাদ্দাফিকে অভিশাপ দিতেন মা-মেয়ে। গভীর রাতে লুকিয়ে মাকে একবার দেখতে আসার অপরাধে তাকে দক্ষিণের প্রত্যন্ত এক মরুভূমিতে বদলি করা হয়েছিল। 

পরে খবর নিয়ে জেনেছি, এই মোহাম্মদই ছিল মিসরাতার প্রথম সারির বিদ্রোহী নেতা। গাদ্দাফির লাশ ৩ দিন হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে রাখার ষড়যন্ত্রও নাকি উনারই। ১৯৮৬ সালে মার্কিন হামলার পর আরো মজার একটা দৃশ্য দেখতাম। আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যেতো, ইউনিফর্ম পরে সশস্ত্র অবস্থায় গাদ্দাফির পক্ষে মিছিল করছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীও যে স্লোগান দিতে পারে, এটা দেখেছি তখন। সন্ধ্যার পর শুরু হতো ব্ল্যাকআউট পর্ব। ঘরের সব বাতি নিভিয়ে রাখার কঠোর নির্দেশ। রাজপথে সেনাবাহিনী। ট্যাংক পাহাড়া দিচ্ছে পাড়া-মহল্লা। মাথার ওপর দিয়ে সাই সাই করে উড়ে যেতো জঙ্গিবিমান!

৬.
ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ছিমছাম মিসরাতা শহরটিই লিবিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী। এমন একটা অদ্ভুত সময়ে আমার ওই শহরে বেড়ে ওঠা, যখন মোড়ে মোড়ে ইতালিয়ানদের গির্জার চূড়া বদলে মিনার করা হচ্ছে ধর্মান্তরিত হচ্ছে উপসনালয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কেবল লাগছে শহরটিতে। কৃত্রিম ঝর্নায় যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠছে পার্ক। সবুজায়নের আগ্রাসনে মরুভূমি, অদ্ভুত সব দৃশ্য। মাইলের পর মাইল ভূমধ্যসাগরীয় ফলের আবাদ। এখানে যেমন গরুর দাপট, ওখানে তেমন উট আর ঘোড়ার দৌরাত্ম। ভূমধ্যসাগর দেখেই সমুদ্রের বিশালতায় মুগ্ধ আমি তখনো জানতাম না, হতভাগা সাগরটার চারদিকই ঘিরে আছে স্থল। মরুভূমির সিংহ ওমর মুক্তারের দেশ বলে কথা, সবুজ বিপ্লবের ছোঁয়ায় তা আমূল বদলে গেলো সেখানে। আর শৈশবে আমার সবচেয়ে প্রিয় সেই টেলিভিশনে প্রায়ই দেখতাম ওমর মুক্তারের সিনেমাটি।

শিখেছি স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে হয়, উপনিবেশের শোষণমুখী চরিত্র; দেখেছি প্রকাশ্য ফাঁসির দৃশ্যও। অন্তত বাংলা সিনেমা দেখার আগ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, ফাঁসিটা দিনে-দুপুরেই হয়। অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে, নিঃশ্বাস ফেলে। আর একটা টুলের ওপর দন্ডিতকে দাঁড় করা হয়। টুলটা ফেলে দিলে দড়িতে ঝুলানো রুই-কাতলার মতো কাতরাতে থাকে দেশপ্রেমিক আসামি, করুণ মৃত্যু হয় তার। যেমন হয়েছিল ওমর মুক্তারের। সিনেমা দেখার ফাঁকে ফাঁকে বাবা শেখাতেন এটা হচ্ছে ওমর মুক্তার বাহিনীর কাউন্টার অ্যাটাক, আর ওইটা ছিল এ্যাম্বুশ।

৭.
গাদ্দাফি দেশটার জন্য সবই করেছেন, তবে জাতিকে রাজনীতি সচেতন করতে পারেননি। ইরাক-আফগানিস্তানের মতো জ্বলন্ত উদাহরণের পরও পশ্চিমাদের ফাঁদেই পা দিল লিবীয়রা। নৃতাত্ত্বিকভাবে খণ্ড খণ্ড সত্ত্বা নিয়ে বেড়ে ওঠা একটা বেদুইন জাতিরাষ্ট্র লিবিয়া। এর ওপরই সেকুল্যার আরব ন্যাশনালিজম চাপিয়ে দিলেন গাদ্দাফি। সঙ্গে আধখানা কমিউনিজম। সব মিলিয়ে গ্রিনবুক। আক্ষরিক অথবা আন্তরিক, দুদিক দিয়েই ত্রিপোলি ও বেনগাজির হাজার মাইলের দূরত্ব।

৪ দশকের লৌহ শাসনে গ্রিনবুক নিঃসন্দেহে কাজে দিয়েছে। গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়া সম্ভবত ৫ বছরেই তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। লিবীয়রা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, গণতন্ত্র কিনে বেহেস্তকে কিভাবে দোজখ বানিয়ে ফেলল। সরকারি আবাসন, রেশন, ফ্রি বিদ্যুৎ আর জ্বালানি সব বিক্রি করে গণতন্ত্র কিনেছে লিবিয়া।

সাঈফ ইবনে রফিক

সাংবাদিক এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট