বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৭

সামাজিক মূল্যবোধ ও তরুণ সমাজ। | আবুল কালাম

মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় মূল্যবোধকে। মূল্যবোধ মানে হচ্ছে বোধের মূল্য দেয়া। ভালকে ভাল আর খারাপকে খারাপ জানা। ভাল মন্দ বিচার করে অর্জিত জ্ঞানই হচ্ছে মূল্যবোধ। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মাঝে দেয়া হয়েছে বিবেক। যে বিবেক দিয়ে মানুষ ভাল মন্দ বুঝতে পারে । মূল্যবোধ যখন ব্যক্তি পর্যায়
অতিক্রম করে সামাজিক পর্যায়ে চলে আসে তখন তাকে বলা হয় সামাজিক মূল্যবোধ। মানুষ পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন রকম আচরণ করে যে আচরণগুলোর মাধ্যমে তার সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। আর সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে এসব আচরণের সমষ্টি। সামাজিক মূল্যবোধ সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মনে করা হয়। মানব জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হল সামাজিক মূল্যবোধ। কারণ যার মধ্যে মূল্যবোধ নাই, ভাল মন্দের তফাৎ করে ভাল কিছু করার সামর্থ নাই, শুধু অর্থের পরিমাপ দিয়ে তার সামাজিক স্তরবিন্যাস যাচাই করা সম্ভব নয়। সমাজকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য প্রয়োজন সামাজিক মূলবোধের সঠিক চর্চা।
সামাজিকীকরণ হল মূল্যবোধ চর্চা ও শিক্ষার প্রধান মাধ্যম। বিশেষ করে পরিবারের থেকে মানুষ সবচেয়ে বেশি মূল্যবোধ শিখে। পরিবারের বড়দের আচার-আচরণের প্রভাবে ছোটদের মূল্যবোধ নির্ধারিত হয়। পরিবার যদি সঠিক মূল্যবোধের চর্চা করে তবে ছোটরাও তা শিখবে। স্কুল জীবনে প্রবেশ করে মূল্যবোধ শিখার আগেই মানুষ পরিবার থেকে অনেক করনীয় বা বর্জনীয় বিষয় শিখে নিয়ে থাকে। খেলার সাথী বা সহপাঠীও মূল্যবোধের চর্চায় বেশ সহায়তা করে। প্রত্যেক খেলার সাথী বা সহপাঠী যদি নিজের পরিবার থেকে মূল্যবোধের সঠিক শিক্ষা পেয়ে থাকে তবে তার বন্ধুদেরও উৎকৃষ্ট জীবন গঠনে সহায়তা করে। আর যদি এর ব্যতিক্রম তবে ফলাফলও মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে থাকে।
সামাজিক মূল্যবোধ চর্চায় শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরসীম। সুশিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। জ্ঞানের প্রসার ঘটায়। মানুষের মাঝে যখন জ্ঞানের আলো থাকে তখন তার মাঝে থাকে একটি যুক্তিশীল বিবেক এবং সে বিবেকের দ্বারা সঠিক মূল্যবোধকে নিজের মূল্যবোধ প্রসারিত করাই হল শিক্ষার উদ্দেশ্য। টাকা উপার্জনই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। তাই যদি হত তবে তার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন হত না। অনেকে অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত হয়েও প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। বর্তমান শিক্ষা সামাজিক মূল্যবোধকে কতটা  প্রভাবিত করে তা নিয়ে বিস্তর যুক্তিতর্ক আছে তবে শিক্ষা ব্যবস্থা যতটা পুঁথিগত শিক্ষা দিতে সক্ষম সে হিসেবে মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারন ২০-৩০ বছর পূর্বে পাঠ্যসূচিতে সিংহ ভাগ বিষয় ছিল নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্বলিত যা একজন শিক্ষার্থীর বিবেককে ছাত্রাবস্থায়ই নাড়াতে সক্ষম ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের পাঠ্যসূচি ব্যাপক পরির্বতনে পুঁথিগত শিক্ষার প্রসার হলেও মূল্যবোধ তেমন শিক্ষা তেমনটা হয় না। একটা সময় ছিল যখন ছেলেমেয়েরা বাবা-মা, শিক্ষক তো বটেই, প্রতিবেশির শাসনও মানত। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা প্রতিবেশির তো দূরের কথা বাবা-মাকেও মানতে চায় না। বড়দের সম্মান করতে চায় না, ছোটদের স্নেহ করতে চায় না। সভ্যতার ব্যাপক উন্নয়ন সংস্কৃতিকে শুধু উন্নতই করে না, ধংসও করে। আর কুশিক্ষার প্রভাব তো আরও ভয়ংকর!  
তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উৎকর্ষতা মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারটাই বেশি করছে। এর কারন হচ্ছে মানুষ স্বাভবতই নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। বিশেষ করে তরুণ সমাজ। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নামের ফেইসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমই অসামাজিক জীবই বেশি সৃষ্টি করছে। আত্মীয়তার সম্পর্কও দূরে সরে যাচ্ছে। পূর্বে কোন একটা বিশেষ ছুটি হলে পরিবারের সকল সদস্য মিলে আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে যেত। সরাসরি একসাথে বসে আড্ডা দিত, গল্প করত, পারিবারিক পরিবেশে খাওয়া দাওয়া করত। সম্পর্ক থাকত সুদৃঢ়। কিন্তু এখন ফেইসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের দরুন তরুন প্রজন্ম তো দূরের কথা পরিবারের বড়রাও আত্মীয়দের থেকে বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। এসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এমন কিছু আচার-আচরণ, ভাষা বা দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করছে যা শুধু দেখতেই অশোভনীয় নয় তা মাতৃভাষারও ব্যাপক ক্ষতি করে চলছে। 
মূল্যবোধের চর্চার জন্য সঠিক ধর্মীয় শিক্ষাও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সকলে যদি যার যার ধর্মীয় আচার-আচরণগুলো চর্চা করে তবে মানব জীবনে মূল্যবোধে উৎকর্ষতা আসবেই, বিশেষ করে তরুন প্রজন্মকে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা ধারণ করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার কল্যানমুখী করতে হবে। বড়দেরকে সম্মান করকে হবে। ছোটদের স্নেহ করার মানসিকতা থাকতে হবে। যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠান বা কার্যক্রমে সবাইকে কাধে কাধ মিলিয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। বাবা-মারও সন্তানদের গতিবিধি লক্ষ রেখে সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।  শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। ছাত্র শিক্ষকের সুসম্পর্ক নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সামজিক মূল্যবোধ্যও সঠিক চর্চা সম্ভব হবে। সমাজ, দেশ ও জাতির সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভব হবে।

আবুল কালাম, শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়







Find Nobin Kontho on Facebook