শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

ওরিয়েন্টালিজম বিষয়ে ভাবনা

সিসিবি’তে বেশ কয়েকজনকে কথা দিয়েছিলাম যে, ওরিয়েন্টালিজম সম্পর্কে লিখবো। ফিলিস্তিনী বংশোদ্ভূত, আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাইদ ১৯৭৮ সালে এই বই প্রকাশ করেন। এটা আমার এ’ যাবতকালে পড়া অন্যতম আকর্ষনীয়+প্রভাববিস্তারকারী বই। আমার দৃষ্টিতে, মুক্তবুদ্ধির চর্চায়- বিশেষ করে জ্ঞানবিজ্ঞানের বর্তমান পাঠ্যসূচির ইউরোসেন্ট্রিক পরিমন্ডলে- এই বই বিশেষভাবে উপকারী।

মূল আলোচনায় যাবার আগে একটা বিষয় বলে নেই।- আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার কারনে এই লেখাটা তৈরীতে আমি খুব একটা সময় দিতে পারিনি। একারনে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি জটিল মনে হতে পারে। তাছাড়া, বিষয়ের ব্যাপ্তির কারনে সবগুলো যুক্তির পক্ষে উদাহরনও দিতে পারলাম না লেখার আকার আরো বেড়ে যাবার আশংকায়। তবে শেষ অংশে এই ধারায় বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে আমার নিজের একটা গবেষনার উল্লেখ করেছি যা
ওরিয়েন্টালিজমের মূল বক্তব্য বুঝতে সহায়ক হবে আশা করি। এই লেখার উদ্দেশ্য আগ্রহী পাঠকদের কাছে অল্পকথায় ওরিয়েন্টালিজমের মূল বক্তব্য তুলে ধরা। কেউ বিশেষভাবে আগ্রহী হলে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

-এই লেখার বিষয়বস্তু কারো ভাল লাগলে আমার এই পরিশ্রম সার্থক। আর এতে যদি কোন ভুল থাকে, বা এটা কাউকে কোনভাবে আঘাত দেয়, তার দায় স্বীকার করে আমি আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তাহলে আলোচনা শুরু করা যাক।-

এককথায়, ওরিয়েন্টালিজম হল পাশ্চাত্যের গবেষকদের প্রাচ্যকে জানার, আবিষ্কার করার, এবং এই বিষয়ক জ্ঞানচর্চা করার একটি বিশেষ ধারা (আলোচনার সুবিধার্থে আমি জ্ঞানচর্চা পদ্ধতি বলবো)। এটি সামাজিক বিজ্ঞানে সর্বাধিক পঠিত, আলোচিত, এবং অনুসৃত একটি চিন্তাধারা (মাত্র ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত, তারপরেও গুগল স্কোলারস এর হিসাব অনুযায়ী এর সাইটেশন ৩০০০ এর উপরে!)। এমনকি এটি বেশ কিছু একাডেমিক ডিসিপ্লিনেরও জন্মকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে, যেমন, পোষ্টকলোনিয়াল ষ্টাডিজ। এটি গবেষককে মুক্তবুদ্ধির পথ দেখায়, বিশেষ করে যখন কেউ তার পরিচিত গন্ডি ছেড়ে অন্য দল/সমাজকে পাঠ করতে যায়।

এই ওরিয়েন্টালিজম ধারনার প্রবক্তা হলেন এডওয়ার্ড সাইদ (Edward Said) (তার সম্পর্কে কিছু বললাম না, নেটে অনেককিছু সহজেই পাওয়া যাবে বলে)। তিনি পাশ্চাত্যের স্কলারদের (বিশেষ করে এনলাইটেনডমেন্ট যুগে) প্রাচ্য-বিষয়ক গবেষনা রীতির একটা ঐতিহাসিক পর্যালোচনার মাধ্যমে এই ধারনায় আসেন। তার মতে, পাশ্চাত্যের এই গবেষনা পদ্ধতি একটা বিশেষ ধারা অনুসরন করে, যা’র মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের যে ছবিটা আসে তা বাস্তব প্রাচ্য থেকে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু এরপরও সেই জ্ঞান, প্রাচ্যের সেই খন্ডিত/বিকৃত ছবিই গ্রহনযোগ্য হয়, কারন তা প্রাচ্য-বিষয়ে পাশ্চাত্যের পূর্ব-ধারনাগুলোকেই পুণর্ব্যক্ত করে। প্রাচ্য পাশ্চাত্য থেকে আলাদা, এবং তা পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতে ক্রমক্ষয়িষ্ণু, ধবংসের দিকে। (একারনে সাইদ পাশ্চাত্য আর প্রাচের মধ্যে এই যে পার্থক্য টানা হয়, তাকে বলেছেন Ontological and Epistemological)। প্রাচ্য, তথা ইউরোপের বাইরে যেকোন স্থান-অঞ্চল-দেশ সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মাঝে একটা রোমান্টিক ধারনা সর্বদা বিদ্যমান। সেই ধারনা অনুযায়ী তারা একটা কাল্পনিক ইমেজ নিয়ে প্রাচ্যে আসে। কিন্তু তা স্বভাবতই খুঁজে পায় না। আবার বাস্তবের প্রাচ্যকে অস্বীকারও করতে পারে না। এ অবস্থায় তারা একদিকে প্রাচ্যকে নিয়ে আরো কাল্পনিক কাহিনী তৈরী করে, অন্যদিকে তাদের পূর্ব-ধারনা+ইচ্ছা অনুযায়ী প্রাচ্যকে পরিবর্তনের প্রয়াস পায়। তাদের দৃষ্টিতে প্রাচ্যের সমগ্র অঞ্চল এক, অভিন্ন ও সমন্বিত (essentially homogeneous) যা তাদেরকে সমগ্র প্রাচ্য সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারনা দান করে যে, প্রাচ্যের সব মানুষ, সমস্ত গোষ্ঠি ও দল, সমাজ, সংস্কৃতি একই রকম। (কাজেই প্রাচ্যের যেকোন একটা বিশেষ স্থানের, বিশেষ সময়ের, বিশেষ কিছু সমগ্র প্রাচ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে)।

ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরন করে সাইদ ওরিয়েন্টালিজম এর উতপত্তি এবং বিকাশকে তিনটি পর্যায়ে দেখাতে পেরেছেন। এগুলো নিম্নরুপঃ
প্রথম পর্যায়– এটা মূলত শুরু হয় ১৮শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপীয়দের সমুদ্রপথে ও স্থলপথে ভিনদেশে যাত্রার সাথে (যাকে তারা বলে নতুন দেশ আবিষ্কার, যেমন, ভারতবর্ষ আবিষ্কার, আমেরিকা আবিষ্কার, ইত্যাদি)। এই পর্বের দুটো বৈশিষ্ট্যঃ এক, প্রাশ্চাত্যের কাছে প্রাচ্যের ভাষাতাত্ত্বিক গুরুত্ব এবং সেই কারনে প্রাচ্যের প্রতি পশ্চিমের একাডেমিক কম্যুনিটির একটা ইন্টারেষ্ট; দুই, প্রাচ্যকে স্থির-অপরিবর্তশীল-অনড় ধরে নিয়ে সাধারনীকরন এবং প্রাচ্যকে ক্রমাগত বিভাজন-উপবিভাজন। এখানে পাশ্চাত্যের বাইরে যেকোন দেশকেই একই রকম ধরে নেওয়া হয়। -এইপর্বের মূলসুর ছিল প্রাচ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, তা আলোচনা, পর্যালোচনা, প্রকাশনা, ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাচ্যকে “represent” করা। এই উপস্থাপনার উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যকে দেখানো যে প্রাচ্য “আসলে দেখতে কেমন”, আর এর অব্যক্ত+অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যের লোকজনকে দেখানো যে প্রাচ্য তাদের থেকে কতটা আলাদা, অধঃস্তন, পশ্চাতপদ। আর তথ্য সূত্র ছিলো মূলত অভিযাত্রী আর পরিব্রাজকদের ভ্রমনকাহিনী আর তার সাথে মিশিয়ে আজগুবি কল্পকাহিনী; যেমন- কায়রোর বাজারের মধ্যে প্রকাশ্যে বেশ্যাগমন, ভাব নেওয়ার লোভে স্বেচ্ছায় এক যুবকের প্রকাশ্য রাজপথে বানর-কর্তৃক ধর্ষিত হওয়া, মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত একজন দরবেশের অগণিত মুসলিম মহিলাকর্তৃক ক্রমাগত মাষ্টারবেইট করে দেবার ফলে আবার মৃত্যুবরন, ইত্যাদি।

দ্বিতীয় পর্যায়– এটি মোটামুটি ১৮৭০-৮০ থেকে শুরু হয়ে ১ম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত চলেছে। এই সময়কালে ইউরোপের কলোনিয়াল শক্তিগুলো, বিশেষকরে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স- বিশ্বের প্রায় ৮৫% এলাকা দখল করে ফেলে। এই পর্যায়ে ওরিয়েন্টালিজমে চারটি প্রবনতা দেখা যায়ঃ expansion, historical confrontation, sympathy and classification। এক, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপীয় কলোনিয়ালিজম বিশ্বের অন্যদিকেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। যেমন, আফ্রিকা, চীন, ভারত, জাপান ইত্যাদি। আর খ্রীষ্টান ও ইহুদীবাদের সাথে আরবী ও ইসলামের ধর্মের তুলনার পাশাপাশি চলে আসে সংস্কৃত, বৌদ্ধধর্ম, জোরাস্ট্রোবাদ ও মনু সংহিতার তুলনা। এই পর্যায়ে কল্পকাহিনী ও ভ্রমন-বৃত্তান্তের সাথে যোগ হয় কলোনিয়াল শাসকদের বিবরনী, মিশনারী প্রচারকবাহিনী আর কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক অভিযান (যেমন, নৃ-তাত্ত্বিক গবেষনা)। এভাবে ‘একাডেমিক ও মতাদর্শিক ইন্টারেষ্ট+রাজনৈতিক ক্ষমতা’ প্রাচ্যের পাঠে পাশ্চাত্যের ইউরোসেন্ট্রিক ধারাকে আরো শক্তিশালী করে। দুই, ইউরোপের ঐতিহাসিকেরা প্রাচ্যকে নতুন করে পাঠ শুরু করে এই উদ্দেশ্যে যে, প্রাচ্যের সাথে তুলনামূলক আলোচনায় তাদের পাশ্চাত্যকেই ভালো করে জানা হবে। যেমন, গীবন প্রাচ্যে ইসলামের উত্থান বিশ্লেষনের মাধ্যমে রোমের পতন ব্যাখ্যার প্রয়াস পেলেন। তিন, কিন্তু কিছু কিছু স্কলারের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনাকে ছাপিয়ে চীন থেকে পেরু পর্যন্ত সমস্ত মানবসমাজকে জানার আগ্রহও দেখা যায়। এদের মতে, সকল কালচারেই নিজ নিজ স্বকীয়তা বিদ্যমান, এবং একারনে তাদের পাঠ করতে হলে সিমপ্যাথি (empathy নয়) থাকতে হবে। চার, এসময় প্রাচ্য-গবেষকরা classify করা শুরু করে, -মানুষ এবং প্রকৃতি দুইই।এই প্রকৃয়ায় তারা প্রাচ্যের মানুষ ও সমাজ় সম্পর্কিত সবকিছুকেই একটি বিশেষ প্রপঞ্চের (ওরিয়েন্ট বা প্রাচ্য) “নম্বর, রুপ, বা অংশ” হিসেবে বিবেচনা শুরু করে। এই শ্রেনীবিভাজনে বাহ্যিক পার্থক্যের সাথে যুক্ত হয় মোর‌্যাল পার্থক্য; আর বলাই বাহুল্য যে, এই মোর‌্যাল পার্থক্য বিচারে ইউরোপীর মোরালকে মাপকাঠি ধরা হয়। যেমন, (নেটিভ) আমেরিকানরা হলো “red, choleric, erect”, এশিয়ানরা “yellow, rigid, melancholic”, আফ্রিকানরা “black, phlegmatic,lax”। -এই পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলোকে আবার ধরে নেওয়া হলো জেনেটিক!

– এই চারটি ধারার উপর ভিত্তি করেই ওরিয়েন্টালিজম দাড়িয়ে।

তৃতীয় পর্যায়– পূর্বের পর্যায়ে ওরিয়েন্টকে জানা+জানার প্রকৃয়া সম্পন্ন করা গেছে। তাই এই পর্যায়ে প্রাচ্যবিদরা কিভাবে প্রাচ্যকে ভালোভাবে ‘ম্যানেজ’ (কল্যানমূলক শাসন) করা যায় সেই প্রকল্প হাতে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় উদ্ভব হয় প্রাচ্য-বিষয়ক জ্ঞানের নানা বিশেষায়িত শাখা এবং বিশেষজ্ঞ (বিশেষ করে, সামাজিক বিজ্ঞানে)। এটাই ওরিয়েন্টালিজমের চুড়ান্ত রুপ।

প্রথম পর্যায়ে প্রাচ্যবিদের কাজ ছিলো তার গবেষনার মধ্য দিয়ে প্রাচ্যকে একটা একক অঞ্চল+সমাজ+সংস্কৃতি হিসেবে পাশ্চাত্যের কাছে তুলে ধরা এবং দেখিয়ে দেওয়া যে প্রাচ্য পাশ্চাত্য থেকে কতটা আলাদা (পতিত অর্থে)। দ্বিতীর পর্যায়ে তার কাজ হলো প্রাচ্যের উপর বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা, এবং এর মাধ্যমে প্রাচ্যের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা অর্জন করা। তৃতীয় পর্যায়ে ব্যক্তি-বিশেষজ্ঞের জায়গায় সরাসরি চলে আসে প্রতিষ্ঠান ও শাসকবর্গ, কারন প্রাচ্যকে (কলোনীয়াল সাম্রাজ্য) ম্যানেজ করতে প্রতিষ্ঠান ও সরকার ব্যক্তির তুলনায় বেশি দক্ষ (এফিসিয়েন্ট)।

সাইদের আলোচনায় ওরিয়েন্টালিজমের যে বৈশিষ্ট্য সমূহ পাওয়া যায়, তা’র সারাংশ নিচে উল্লেখ করা হলঃ

১। ওরিয়েন্টালিজম প্রকৃতপক্ষে একটা আধূনিক রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্প, যেখানে প্রাচ্যের থেকে পাশ্চাত্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর লক্ষ্য হল, প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যের কাছে পাশ্চাত্যের আকাংখা অনুযায়ী (পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতে) উপস্থাপন করা।

২। পাশ্চাত্যের চোখে প্রাচ্য সর্বদা প্রাশ্চাত্যের কিছু কিছু বিষয়ের মতো। যেমন, জার্মান রোমান্টিকদের কাছে ভারতবর্ষের ধর্ম আসলে জার্মানো-ক্রিশ্চিয়ান প্রকৃতিবাদ (pantheism) এর প্রাচ্য-রুপ (যা আসলে একধরনের বিকৃতি)। প্রাচ্যবিদরা এভাবে প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যের একেক বিষয়ের মতো করে তৈরী করেই চলে নিরন্তর। এই প্রকৃয়াটা আবার প্রাতিষ্ঠানিকঃ এটা ক্লাসে পড়ানো হয়, এই বিষয়ে গবেষনা সেন্টার আছে (যেমন, বিভিন্ন দেশের এশিয়াটিক সোসাইটি, লন্ডন ইউনিভারসিটির SOAS), গবেষনা পত্রিকা আছে, বিশেষ ভোকাব্যুলারী আছে – সবগুলো একত্রিত হয়ে একটা প্রাচ্য-বিষয়ক জ্ঞান (narrative) তৈরী করে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতবাদ অনুযায়ী।

৩। এই প্রাতিষ্ঠানিকীকরনের ফলে প্রাচ্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনকি যুগের সবথেকে সৃষ্টিশীল গবেষক/চিন্তাবিদের পক্ষেও প্রাচ্য-বিষয়ক নতুন কিছু আবিষ্কার করা বা বলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারন, তা ক্লাসে পড়ানো হবে না, পত্রিকায় প্রকাশ হবে না, সোসাইটি স্বীকৃতি দেবেনা। কাজেই তা জ্ঞান বলে গৃহীত হবে না। (যেমন, ভারতীয়দের দর্শন, চৈনিকদের নৌ-শিল্প)। আর যা কিছু প্রাচ্য সম্পর্কে পাশ্চাত্যের পুর্ব-মনোভাবের সাথে মিলে যাবে, তা কোন বাঁধা ছাড়াই সরাসরি জ্ঞান হিসেবে গৃহীত হবে (enters the discourse)। যেমন- ১৯শতকে ভারতবর্ষ সম্পর্কে সবথেকে বেশি স্বীকৃতীপ্রাপ্ত লেখক জেমস মিলস ‘ভারতে আসা+ভারতের কোন ভাষা শেখা’ ছাড়াই ভারতের সবথেকে গ্রহনযোগ্য ইতিহাস লিখে ফেললেন! প্রকৃতপক্ষে, ওরিয়েন্টালিজম হল একটা রাজনৈতিক প্রকল্প, যা’র মূল উদ্দেশ্যই হল প্রাচ্যকে (অপরিচিতকে) পাশ্চাত্য (পরিচিত) থেকে আলাদা করে উপস্থাপন করা।

৪। যেহেতু প্রাচ্য বিষয়ক জ্ঞানচর্চা শুরুতেই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মাঝে বিভেদ ধরে নিয়ে যাত্রা করে, তাই এই প্রকৃয়ার মধ্য দিয়ে যাবতীয় গবেষনা, বিশ্লেষন, নীতিনির্ধারন, ইত্যাদি আরো বিভাজনমূলক হয়, এবং তা প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিভাজনকে আরো বিস্তৃত করে। এভাবে এটি প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের ইন্টার-কালচারাল যোগাযোগকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। এই প্রকৃয়ায় যেহেতু পাশ্চাত্যের নর্মস+ভাল্যুজকে মাপকাঠি ধরে নিয়ে বিচার+বিশ্লেষন করা হয় শুধু প্রাচ্যকে, তাই প্রাচ্য-বিষয়ক সমস্ত জ্ঞান স্থির-বৈজ্ঞানিক সত্যের রুপ ধারন করে।

৫। প্রকৃতপক্ষে কলোনিয়াল ক্ষমতার আশ্রয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রাচ্যকে (প্রাচ্যবিষয়ক জ্ঞানকে) তৈরী করা হয়। আর তাই দেখা যায়, প্রাচ্যকে চিত্রিত করা হয় আদালতের বিচারের বিষয়ে, ক্লাসের পাঠ্যে, স্কুল বা জেলখানায় নিয়ন্ত্রনে, ম্যাপে চিহ্নিত স্থান হিসেবে।

৬। ওরিয়েন্টালিজম হল একটা সাংস্কৃতিক ক্ষমতা। একঅর্থে, ওরিয়েন্টালিজম একটা লাইব্রেরী যেখানে প্রাচ্য বিষয়ক সব তথ্য কোনপ্রকার ক্লাসিফিকেশন না করেই একটা সাধারন নামে সংগ্রহে রাখা হয়। যেমন- আরব, মিশর, ভারত, চীন সবই এক ক্যাটাগরীতে। কারন ধরেই নেওয়া হয় যে, প্রাচ্যের সব সমাজ ও মানুষ একই রকম (‘অদ্ভুত’, ‘অপরিচিত’, ‘যুক্তিহীন’, ‘রহস্যময়’, ইত্যাদি)। এই বৈশিষ্ট্য গুলোকে ধরে নেওয়া হয় ধ্রুব।

৭। ওরিয়েন্টালিজমের ফলে গবেষকদের মধ্যে আসে একটা ঐক্যমতঃ তাদের কাছে একটা নির্দিষ্ট ধরনের বিষয়, মন্তব্য, বিশ্লেষন যথার্থ হিসেবে গৃহীত হয়। একারনে এইসব রীতিকে মনে করা হয় প্রাচ্যকে জানার ও বোঝার সঠিক পদ্ধতি।

৮। প্রাচ্য সম্পর্কে যা কিছুই বলা বা লিখা হোক না কেন, তার মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয় যে, প্রাচ্যবিদ নিজে অবস্থান করে প্রাচ্যের বাইরে- শারীরিক ও নৈতিক উভয় দিক থেকেই। এর মাধ্যমে আরেকটা বিষয়ও বোঝানো হয় যে, প্রাচ্যের লোকদের আসলে নিজেদেরকে নিজেরাই প্রকাশ করার সামর্থ নেই। তাই পাশ্চাত্যের গবেষকদেরই দায়িত্ব হল প্রাচ্যকে উপস্থাপন করা।

ওরিয়েন্টালিজমে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য অসম ক্ষমতা নিয়ে অবস্থান করে, যেখানে পাশ্চাত্য সব সময় ক্ষমতাবান। একারনেই পাশ্চাত্য প্রাচ্যের হয়ে কথা বলে, কিন্তু তা’র শ্রোতা আবার পাশ্চাত্য। যেহেতু প্রাচ্যকে বিবেচনা করা হয় পুরোনো, পতনোম্মুখ এবং রাজনৈতিকভাবে স্থবির, পাশ্চত্যের কাছে একে উদ্ধার করা তাই একটা নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়ে। এই করতে গিয়ে তারা প্রাচ্য, প্রাচ্যের মানুষ, সংস্কৃত, সভ্যতা, ইত্যাদি সম্পর্কে তত্ত্ব তৈরী করে। শত বছরের পরিক্রমায় ওরিয়েন্টালিজমে পরিবর্তন আসে, কিন্তু তা কেবল তথ্যের উতসে; তথ্যের এবং সেই সাথে প্রাচ্যেরও প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যগুলো অটুট থেকে যায়। যেমন, ওরিয়েন্টালিজমের আগে+শুরুতে ইউরোপীয়দের ধারনা ছিল যে ‘আরব হচ্ছে খ্রীষ্টান দুনিয়ার পার্শ্ববর্তী বিধর্মীদের একটা অভয়াশ্রম এবং মুহাম্মদ একজন ধূর্ত ধর্মত্যাগী’; আর ২০ শতকে এসেও একজন প্রাচ্যবিদের চোখে ‘ইসলাম একটা সেকেন্ড-ক্লাস এরিয়ান হেরেসি’।

ধারাবাহিকভাবে ইউরোসেন্ট্রিক ধারনা ও অনুরুপ পদ্ধতিতে জ্ঞানচর্চার ফলে পাশ্চাত্যের স্কলারদের মধ্যে একটা অন্ধবিশ্বাস (dogma) জন্মে যা ওরিয়েন্টালিজমকে ক্রমশ একাডেমিক গ্রহনযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব দেয়। প্রাচ্য সম্পর্কে প্রাশ্চাত্যের প্রাথমিক রোমান্টিসিজম থেকে জন্ম নেয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্ডারষ্ট্যান্ডিং, তার থেকে আসে বিশেষজ্ঞ+প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডিসিপ্লিনারী কন্ট্রোল (সাম্রাজ্যবাদ)। এভাবে পতনোম্মুখ প্রাচ্যের অক্ষম, কিন্তু স্বেচ্ছাচারী মানুষদের রক্ষা, শাসন ও উন্নয়নের স্বাভাবিক (natural) সমাধান হিসেবেই আসে পাশ্চাত্যের সক্ষম, গনতন্ত্রমনা শাসকদের মানবতাবাদী শাসন (সাম্রাজ্যবাদ)। প্রকৃতপক্ষে, ওরিয়েন্টালিজমে প্রাচ্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন প্রাচ্য সর্বদা বাইরে থেকে সাহায্য ও পরিবর্তনের মুখাপেক্ষী; আর যেহেতু সভ্যতা, সংস্কৃতি আর জাতিগতভাবে পাশ্চাত্যই শ্রেষ্ঠ, তাই সেই দায়িত্ব (তথা প্রাচ্যকে উদ্ধারের দ্বায়িত্বটা) পড়ে পাশ্চাত্যের ঘাড়ে! যেহেতু প্রাচ্য নিজের উপর নির্ভর করে চলতে পারেনা, নিজেকে নিজে উপস্থাপন করতে পারেনা, নিজের পতন নিজে ঠেকাতে পারেনা, তাই পাশ্চাত্যের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়ে প্রাচ্যকে সাহায্য করার। এভাবে এই ধারনাকে স্বভাবিক করে ফেলা হয় যে, প্রাচ্যের উচিত সব সময় পাশ্চাত্যের সম্রাজ্যবাদের অধীনেই থাকা।

উপরের আলোচনা থেকে এমনটি মনে হতে পারে যে, ওরিয়েন্টালিজম অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু সাইদের মতে, এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিভাবে?-
১। ওরিয়েন্টালিজমের ব্যাপারে গবেষকের বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিগত সতর্কতা যে, মোটাদাগে প্রাচ্য/পাশ্চাত্য বিভাজন জ্ঞানচর্চায় পদ্ধতিগত ভাবে সংকীর্ণ,
২। উপরোক্ত কারনে গবেষকের গবেষনা/জ্ঞানচর্চায় এই অনিবার্য পদ্ধতিগত কুপমন্ডুকতা (straightjacket) এড়িয়ে চলা,
৩। গবেষনায় বিমূর্ত তত্ত্ব ও ধারনার বদলে মানুষের প্রকৃত+বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তথ্য সংগ্রহ ও বিচার-বিশ্লেষন করা।

ওরিয়েন্টালিজমে প্রাচ্য/পাশ্চাত্য সম্পর্ক মূল আলোচ্য বিষয় হলেও ভূমিকাতেই বলেছি যে, এই পদ্ধতি যেকোন ধরনের সামাজিক গবেষনায় প্রাসঙ্গিক যেখানে গবেষক নিজ সমাজ ছেড়ে অন্য দল/সমাজ/জাতির মধ্যে গবেষণা করতে যায়। আর তাই, এই পদ্ধতি এক দেশ/সমাজ/সংস্কৃতির গবেষক আরেক দেশ/সমাজ/সংস্কৃতি, পুরুষ হিসেবে নারীসমাজ, হেটেরোসেক্সুয়াল হিসেবে হোমোসেক্সুয়াল সমাজ, সামাজিক ব্যক্তি হিসেবে অসামাজিক দল, যেমন নেশাখোর, অপরাধী, মানসিক প্রতিবন্ধী, ইত্যাদি গবেষনায় নতুন দিগন্ত উম্মোচিত করেছে। আমারও ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতা আছে এমন একটা গবেষনা করার।

ঢাবি’তে মাষ্টার্স এর থিসিস হিসেবে আমি ২০০৩/০৪ এ বাংলাদেশে মাজারে গাঁজার ব্যবহার নিয়ে সেই গবেষনাটা করেছিলাম। আমি দেখেছি যে, আমাদের দেশে মাদকের ব্যবহারকে একটা সরল-সাধারন সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, যেখানে সব ধরনের মাদকদ্রব্য, তার ব্যবহারকারী, ব্যবহারের কারন, ফলাফল- সবই আশ্চার্যজনক ভাবে একই রকম। কোন পার্থক্য নাই। আর তাই, আইনও করা হয়েছে সেই ভাবে যে, যেকোন মাদকদ্রব্যই বেআইনী+শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেন সকল প্রকার মাদকদ্রব্য+ব্যবহারকারী একই রকম, এবং স্থান-কাল-পাত্রভেদে সব সময়ই তারা একই রকম। পাশাপাশি, কিছু কিছু মাদকের ক্ষতিকর ব্যবহারের শারীরিক+সামাজিক ক্ষতি দেখে ধরে নেওয়া হয় যে, সব ধরনের মাদকদ্রব্য ক্ষতিকর, এবং কিছু কিছু মাদকাসক্তের অসামাজিক কার্যকলাপ দেখে সকল মাদকসেবীকে অসামাজিক বলে ঘোষনা করা হয়। আর যেহেতু মাদকদ্রব্য ক্ষতিকর+মাদকসেবী ক্ষতিগ্রস্ত, ভালো মানুষদের (পড়ুন মানবিকতাবাদী সমাজপতি/শাসকদের) তাই নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়ে দেশ থেকে সমস্ত মাদক ও মাদকসেবন উচ্ছেদ করা; সেই সাথে মাদকসেবীদের আরোগ্য করা। তারা স্বেচ্ছায় না ফিরলে এমনকি মারধোর, জেল-জরিমানা করেও ফিরতে বাধ্য করা। এখানে ইনডিভিজ্যুয়ালী দেখা হয় না কোনকিছুই; মাদক হিসেবে সংজ্ঞায়িত যেকোন দ্রব্যই নিষিদ্ধ, আর যেকোন উদ্দেশ্যে যে কেউই তা গ্রহন করুক, তা’ শাস্তিযোগ্য।

আমি দেখলাম (এবং দেখালামও) যে, বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে সবথেকে বেশী দিন ধরে, সবথেকে বেশী পরিমানে, সবথেকে বেশী লোকে ব্যবহার করে গাঁজা, মাজারে মাজারে। তারপর এডওয়ার্ড সাইদের দেখানো পথে আগে থেকে তৈরী করে রাখা সব তত্ত্ব বাদ দিয়ে সরাসরি গেলাম মাজারে, “নিজের চোখে দেখে+নিজের কানে শুনে+নিজের বুদ্ধি দিয়ে বুঝে” তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানার জন্য। সেখানে গিয়ে দেখলাম, অনেক ধরনের মাদকসেবীদের একশ্রেণী এই গাঁজাসেবীদের মধ্যেও আছে আরো নানান প্রকার বিভাজন। তাদের গাঁজা সেবনের উদ্দেশ্যও ভিন্ন ভিন্ন। ঠিক যেরকম প্রাচ্যের মধ্যে নানান দেশ/সমাজ/সংস্কৃতি আছে, গাঁজাসেবীদের মধ্যেও আরো অনেক ভাগ আছে। কিন্তু প্রাচ্যবিদ যেমন প্রাচ্যের এই সকল পার্থক্যকে মুছে দিয়ে একটা কাল্পনিক ‘হোমোজেনাস প্রাচ্যে’র গল্প তৈরী করে, সেই ভাবে আমাদের দেশেও একটা গল্প তৈরী করা হয় যেখানে সকল মাদক+মাদকাশক্তি+মাদকসেবী একরকম। এর ফলে যা হয় তা হলো, কয়েকজনের দোষে আরো অনেক নির্দোষ মানুষ অযথাই নিবর্তনমূলক (repressive) শাসনের ভুক্তভোগী হয়। (আমার এই থিসিসটা আর্টিকেল হিসেবে Contemporary Justice Review, ভল্যুম ১১, নং ৪ (ডিসেম্বর, ২০০৮)- এ পাবলিশ হইছে  :) )।

একই ভাবে, আরবের বিকৃতমস্তিস্ক কোন এক শেখের হারেমে কয়েক গন্ডা বিবি দেখে প্রাচ্যবিদরা এই কাহিনী ফাঁদে যে সারা প্রাচ্যেই শাসক, তথা পুরুষেরা এইরকম বহুগামী। পারস্যের কোন এক স্থানে অগ্নিপুজা দেখে পুর্ব-অভিজ্ঞতার অভাবহেতু আসল ঘটনা বুঝতে না পেরে গল্প বানায় যে, প্রাচ্যের লোকেরা শয়তানের পুজা করে। ভারতবর্ষে মন্দিরের গায়ে শৃঙ্গারচিত্র দেখে আসল কাহিনী না বুঝেই বুঝে ফেলে যে প্রাচ্যের লোকেরা বড়ই রহস্যময়, যৌনকাতর। – বর্তমানেও একই প্রকৃয়া চলছেই। আর তাই প্রাচ্যবিদরা (এবং তাদের প্রভাবে সামগ্রিকভাবে পাশ্চাত্যের জনসাধারনও) আফগানিস্তানের একদল ধর্মোম্মাদ তালেবানের পাথর ছুড়ে মানুষ মারার ঘটনা পুরো মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য বলে ধরে নেয়, একজন লাদেন ও তার কয়েকশ সাঙ্গাতদের দেখে ধরে নেয় সমস্ত মুসলমানই সন্ত্রাসী। আর এই প্রকৃয়ার আবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ, প্রাচ্যের বিপন্ন মানবতাকে উদ্ধারের জন্য তাই Humanitarian Intervention হয়ে পড়ে পাশ্চাত্যের নৈতিক দায়িত্ব, কার্যতঃ যা’ কিছু মানুষের দোষে প্রাচ্যের সমস্ত মানুষের ভোগান্তি (গনহত্যা, ফোর্সড ডিসপ্লেসমেন্ট, অনাহারজনিত অপুষ্টি, সমাজকাঠামোর ক্ষয়, ইত্যাদি) ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি+পারেনা।

মাহমুদ হাসান,
সহকারী অধ্যাপক, নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতার শাখা