বুধবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৬

সোভিয়েত ইউনিয়ন রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি

কমিউনিস্টরা মুসলমানদের ওপর যেসব গণহত্যা চালিয়েছে ইতিহাস তার যুগ-যুগান্তরে এর কোনো দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করেনি। বলশেভিক বিপ্লব সফল করার জন্য লেনিন ও স্ট্যালিন ১৯১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। তাদের আহ্বানের ভাষা ছিলো এমনÑ হে মুসলমানগণ! তোমাদের মসজিদ, তোমাদের নামাজ, তোমাদের ঈদ-উৎসব, তোমাদের আচার-অনুষ্ঠান সবকিছু হবে নিরাপদে; তোমরা এগিয়ে আসো এবং জারের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে সহায়তা করো। তোমাদের মুক্তির
সময় চলে এসেছে। [আল-বালাগ, কুয়েত, সংখ্যা ৪৭৮, নভেম্বর, ১৯৭৮]
তাদের আহ্বানে মুসলমানরাও ধারণা করলো, এখন তাদের মুক্তির সময় চলে এসেছে। তারা জার থেকে মুক্তি এবং তাদের উৎপীড়নের আগুন থেকে বাঁচার জন্য উড়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তারা দৈত্য ও ড্রাগনের দুই চোয়ালের মধ্যে পড়ে যায়, এবং ওরা তাদের আচ্ছামত চিবিয়ে খায়। বলশেভিক বিপ্লবের পদতলে ৬০-৬৫ মিলিয়ন (৬ কোটি-৬ কোটি ৫০ লাখ) মুসলমান প্রাণ হারায়। এই মুসলমানরা পৃথিবীর যে ভূখ-জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো, তার পরিমাণ ১৫ মিলিয়ন বর্গমাইল (আফ্রিকা মহাদেশের আয়তনের চেয়েও বেশি)।

মুসলিম ও কমিউনিস্ট
কমিউনিস্টরা মুসলমানদের সঙ্গে আসলে কী আচরণ করেছিলো এবং বর্তমানে কেমন আচরণ করছেÑ সেই ইতিহাস অনেক লম্বা এবং অনেক বেদনাবহ। আমরা পাঠকের সুবিধার্থে কেবল সেইসব অঞ্চলের অবস্থা অতি সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি, যেগুলোতে একসময় কমিউনিজমের মিথ্যা ফাঁকা বুলি আওড়িয়ে হামলে পড়েছিল সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্টরা। কমিউনিজমের দোহাই দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এসব অঞ্চলে মুসলমানদের চরমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, হরণ করা হয়েছে তাদের নাগরিক অধিকার, যখন তখন তাদের হত্যা করা হয়েছে খুব তুচ্ছ কারণে। কমিউনিজম যদিও আজ এক বিস্মৃত মতবাদের নাম, তবুও সেই মতবাদপুষ্ট লোকজন এখনও সোভিয়েত সংলগ্ন এলাকাগুলোতে নানা অজুহাতে অব্যাহত রেখেছে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক কর্মকা-। এমন অনেক রাষ্ট্র যেগুলো পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট রাশিয়ার কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে, সেসব রাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত কমিউনিজমের ভূত তাড়া করে ফেরে তাদেরকে। রাশিয়ার সংলগ্ন এসব রাষ্ট্রে রাশিয়া পুনরায় নিজের দখল পাকাপোক্ত করার চক্রান্ত করে আসছে অনেক দিন ধরেই। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবে এসব রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। এই চক্রান্তের পথ ধরেই ককেশাস এবং উত্তর-পূর্ব ইউরোপজুড়ে নিরবে নিভৃতে চলছে মুসলিম নিধন এবং অত্যাচার। যার শুরুটা হয়েছিল সেই কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই।
এখন আমরা দৃষ্টিপাত করবো সে সময়ের যখন কমিউনিজমের প্রেতাত্মা ভর করেছিল রাশিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি রাষ্ট্রকে এবং এই মতবাদের বিরোধিতা করায় যেসব অঞ্চলে মুসলমানদের ওপর নেমে এসেছিল নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা, সেইসব অঞ্চলের সামান্য খতিয়ান পাঠকের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।

পূর্ব তুর্কিস্তান : চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজের সহায়তায় ১৯৩৪ সালে তা দখল করে নেয়। তারা পূর্ব তুর্কিস্তানের ২ লাখ ৫০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক চিন্তাবিদ, আলেম-উলামা এবং যুবক শ্রেণি। ১৯২৫ সালে চীনবিপ্লব সংঘটিত হয়। তখন ২ লাখ একুশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়।
যুগোশ্লাভিয়া : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মার্শাল টিটো ২৪ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে।
ক্রিমিয়া : বেলা কোনের (ইল্কষধ কড়যহ)-এর শাসনামলে কমিউনিস্টরা ১৯২১ সালে ১ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে এবং ৫০ হাজার মুসলমানকে দেশান্তর করা হয়। ক্রিমিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন আধিপত্য বিস্তারের পূর্বে, দ্বিতীয় ক্যাটরিনার সময়ে মসজিদ ছিলো ১৫৫৪টি এবং মুসলমান ছিলো ৫ মিলিয়ন। কিন্তু কমিউনিস্টরা মুসলমাদের হত্যা করে, তাদের দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করে, সাইবেরিয়ায় বিতাড়িত করে এবং মসজিদ ধ্বংস করে। অবশেষে ওখানে মুসলমানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ মিলিয়ন এবং মসজিদ অবশিষ্ট থাকে ৭০০টি। ১৯২০ সালে বলশেভিকরা ক্ষমতায় এসে সমস্ত মসজিদ বন্ধ করে দেয় এবং মুসলমানদের ওপর এবং ক্রিমিয়ার অধিবাসীদের ওপর ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়।
১৯২২ সালের ১৫ জুলাই ইঝভেৎসিয়া (ওুাবংঃরধ, রাশিয়ার সংবাদপত্র) তার বন্ধুদের উদ্দেশে (যেমন লেনিন) ক্রিমিয়ার দুর্ভিক্ষ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেÑ এবছরের জানুয়ারি মাসে দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয় ৩,০২,০৯০ জন এবং তাদের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হয় ১৪,৪১৩ জন। মার্চ মাসে দুর্ভিক্ষ আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৭৯,০০০ জনে এবং তাদের মধ্য থেকে মৃত্যুবরণ করে ১২,৭৫৪ জন।
জুন মাসে দুর্ভিক্ষগ্রস্তদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯২০৬৩ জনে; কিন্তু তাদের মধ্যে কতোজন মারা গিয়েছিলো তা পত্রিকাটি উল্লেখ করেনি। [আল-ইসলাম ফি ওয়াজহিজ জাহাফিল আহমার, মুহাম্মদ আল-গাজালি, পৃষ্ঠা ১২৪] ১৯৪৬ সালে ক্রিমিয়ায় মাত্র অর্ধমিলিয়ন মুসলমান বেঁচে ছিলো। স্ট্যালিন তাদের সাইবেরিয়ায় দেশান্তর করেন। [আল-বালাগ, কুয়েত, সংখ্যা ৪৭৮, নভেম্বর, ১৯৭৮; আল-আফআল ইয়াহুদিয়্যা ফি মাআকিলিল ইসলাম, আবদুল্লাহ আত-তাল, পৃষ্ঠা ৪৮]
ককেশাস (চেচনিয়া এবং সারকাসিয়ান) : স্ট্যালিন ককেশাসের সমস্ত মুসলমানকে সাইবেরিয়া ও আজারবাইজানে দেশান্তর করেন। তাদের মধ্যে ৮ লাখ চেচেন মুসলমান, ৩ লাখ কারাশাই মুসলমান এবং ২ লাখ ৫০ হাজার কালমুক মুসলমান। গোটা চেচনিয়ায় এখন একটি মসজিদও পাওয়া যায় না।
চেচনিয়ার সব মসজিদ ধসিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলোকে পশুশালা, সিনেমাহল, বিভিন্ন সংগঠনের অফিস, বিনোদনকেন্দ্র এবং ক্লাবে পরিণত করা হয়েছে। অন্যান্য এলাকার অবশিষ্ট মসজিদগুলো সরকারকে শুল্ক প্রদান করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে মসজিদে লেনিনের কথা বলা যেতে পারে, মুসলমানরা এই মসজিদের জন্য প্রতিবছর ২৪ হাজার রুবল কর প্রদান করে থাকেন। তিনি অন্যান্য মসজিদকে পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণা করেছেন।
পশ্চিম তুর্কিস্তান : পশ্চিম তুর্কিস্তানে মোট ৬০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ১৯১৯ সালে পশ্চিম তুর্কিস্তান থেকে ২৫ লাখ মুসলমান পালিয়ে যান। ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্টরা ১ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ৫ লাখ মুসলমানকে হত্যা ও সাইবেরিয়ায় দেশান্তর করা হয়।
১৯৩৪ সালে ৯৩০০ হাজার মুসলমানকে দেশান্তর করা হয়।
১৯৫০ সালে ৭ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়।
১৯৩২ সাল থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও অনাহারে ৩০ লাখ মুসলমান মারা যান। তাদের সংখ্যা নিরুপণ করা হয় এবং তা চীনের কাছে পেশ করা হয়।
১৯৫১ সালে ১৩,৫৬৫ জন মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
[পশ্চিম তুর্কিস্তান সম্পর্কিত তথ্যগুলো জাতিসঙ্ঘে পেশকৃত প্রতিবেদন থেকে গৃহীত। আরো দেখুন : আল-আফআল ইয়াহুদিয়্যা ফি মাআকিলিল ইসলাম এবং আল-ইসলাম ফি ওয়াজহিজ জাহাফিল আহমার]
রাশিয়ার পারসংখ্যান থেকে এটা প্রমাণিত যে, স্ট্যালিন ১১ মিলিয়ন (১ কোটি ১০ লাখ) মুসলমানকে হত্যা করেছেন। বর্তমানে যেসব মুসলমানের আশঙ্কায় সোভিয়েত ইউনিয়নের উপলব্ধি ও সতর্কতা আরো বেড়েছে, তাদের সংখ্যা হবে প্রায় ৬০ মিলিয়ন। গত শতাব্দীর শেষের দিকে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০ মিলিয়নে। ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের বিস্তার ঘটছে।

ইসলামি শিক্ষা, মসজিদ এবং আলেম-উলামা
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। তবে ধর্ম-শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করার জন্য কেবল কিছু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব তাত্ত্বিকভাবে অনুমোদিত। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কেবল একটি মাদরাসার অনুমোদন দেয়া হয়েছিলো। এটি হলো বুখারার মিরি গারব মাদরাসা। বন্ধ করে দেয়ার পর পুনরায় এটি চালু করা হয়।
কেবল এক রাশিয়াতেই ১৯৩১ সালে মসজিদ ছিলো ২৬২৭৯টি। বুখারা ও খিভার অসংখ্য মসজিদ বাদ দিয়েই মসজিদের এই সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র ঝড়ারবঃ ডধৎহবংি-এর ভাষ্য অনুযায়ী পরে মুসল্লিদের জন্য উন্মুক্ত মসজিদ ছিলো মাত্র ১৩১২টি।
১৯৬৪ সালে ফরাসি ভাষায় তাশখন্দ সম্পর্কিত একটি বুলেটিন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় যে, কাজখস্তানসহ গোটা মধ্য-এশিয়ায় মসজিদের সংখ্যা মাত্র ২৫০টি।
আলেম-উলামা : ১৯১৭ সালে (বুখারা ও খিভা ব্যতীত) আলেম-উলামা ৪৫৩৩৯ জনের কম ছিলেন না। কিন্তু ১৯৫৫ সালে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮০৫২ জনে; কারণ তিরিশের দশকে অধিকাংশ আলেম-উলামাকে হত্যা করা হয়েছিলো।
জাকাত প্রদান ছিলো নিষিদ্ধ। হজ করাও ছিলো অসম্ভব। ১৯৪৫ সালের পর হজের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত, এমনকি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত হজ পালনকারী ব্যক্তির সংখ্যা একশোর বেশি ছিলো না। আর রমজান মাসের রোজা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ না হলেও কার্যত নিষিদ্ধ ছিলো। রোজা রাখা ছিলো অসম্ভব। অবশেষে কয়েকজন মুফতি মুসলমানদের এই ফতোয়া দিতে বাধ্য হন, তারা যেনো তিন দিন রোজা রাখে, যাতে তিন দিন ত্রিশ দিনের স্থলাভিষিক্ত হয়। এই তিন দিন হলো রমজানের ১ম, ১৫শ এবং ৩০শ দিন। [আল-মুসলিমুনা ফিল ইত্তিহাদিস সুফিয়াতি, পৃষ্ঠা ২৭৬ ও তার পরবর্তী]
ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা : কমিউনিস্টরা একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করে এবং এর নাম দেয় ¯্রষ্টাহীনদের সংঘ। যুদ্ধের পর রাজনৈতিক তথ্যপ্রচার সংস্থা গড়ে তোলা হয়। এর অধিকাংশ কর্মকা- ছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই।
কাজাখস্তান অঞ্চল : কাজাখস্তান অঞ্চলে সংস্থাটি ১৯৪৬-১৯৪৮ সালের মধ্যে ৩০৫২৮টি বক্তৃতার আয়োজন করে। এর মধ্যে ২৩০০০ টি বক্তৃতাই ছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে।
উজবেকিস্তান : ১৯৪১ সালে ইসলামের বিরুদ্ধে ১০ হাজারেরও বেশি বক্তৃতার আয়োজন করা হয়।
তুর্কমেনিস্তান : ১৯৬৩ সালে ইসলামের বিরুদ্ধে ৫ হাজারেরও বেশি বক্তৃতার আয়োজন করা হয়।
পুস্তক রচনা : ১৯৫৫-১৯৫৭ সালের মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ৮৪ টি পুস্তক রচনা করা হয় এবং সেগুলোর ৮ লাখ কপি মুদ্রণ করে বিতরণ করা হয়।
১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ২১৯টি পুস্তক ও বুলেটিন মুদ্রিত হয়।
ইসলামের পাঁচ স্তম্ভ
দুই কালেমায়ে শাহাদাত : মুসলমানদের কালিমা দুটি গোপনীয়ভাবে পড়তে হয়।
জাকাত : জাকাত প্রদান নিষিদ্ধ।
রোজা : কার্যত অসম্ভব।
হজ : প্রথমে নিষিদ্ধ ছিলো। পরে তাত্ত্বিকভাবে তার অনুমোদন দেয়া হয়।
পবিত্র কুরআন : রাষ্ট্রীয় কোনো কোনো কানুন আছে, যাতে বলা হয়েছে কারো কাছে পবিত্র কুরআন পাওয়া গেলে তাকে এক বছর কারাদ- দেয়া হবে।

আবদুস সাত্তার আল আইনি