বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭

শিক্ষাভাবনা | ইশতিয়াক আহমেদ শালীন

আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির  বিকাশ এই চেতনাকে অবলম্বন করেই বিস্তার লাভ করার কথা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যা করা হল আমাদের জাতির জনক ও জাতীয়তাবাদের আইকন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দীর্ঘ দিনের জন্য দেশ পরিচালিত হয় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিদের হাতে যারা সুকৌশলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিদন্দী হিসেবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিষ্ঠিত করে মৌলবাদের বীজ বপন করে দিয়ে যায় এই দেশে। 
মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ বা ‘পরিচয় সংকট’ বলে এক ধরণের কথা আছে। এই অবস্থায় কোন ব্যক্তি বা সমাজ বুঝতে পারে না তার আসল পরিচয়  কি। তখন তারা তাদের বিভিন্ন পরিচয়ের মধ্যে যে কোন একটিকে কট্টরভাবে আঁকড়ে ধরতে চায়, মানতে চায় না যে একজন মানুষ বা সমাজের ভিন্ন মত বা পরিচয় থাকতে পারে, সৃষ্টি হয় মৌলবাদের। আর আমাদের দেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এই পথেই বাঙালীদের পথভ্রান্ত করেছে। তারা ধর্মভীরু বাঙালীদের মনে প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা বাঙালি নাকি মুসলমান! এভাবে তারা ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে ধর্মীয় মৌলবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত করে। এই মৌলবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ততদিনে আর শুদ্ধ থাকেনি। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ দিয়েছিলেন। 

তিনি ১৯৭৪ সালের ৩০  মে পেশ করা ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের সুপারিশক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সার্বজনীন ও একমুখী শিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।এই কমিশনের মতে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ হবে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মোট আট বছর এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মেয়াদ হবে নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মোট চার বছর। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি চার বছর মেয়াদী সম্মিলিত ডিগ্রি কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালু হবে। কমিশন প্রাথমিক স্তরে সর্বজনীন ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন, প্রচলিত অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা (১ম থেকে ৫ম শ্রেণী) ১৯৮০ সালের মধ্যে বাধ্যতামূলক করণ এবং ১৯৮৩ সাল নাগাদ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করে। প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়া ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় এনে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করে পনের বছর বয়স পর্যন্ত তাদের শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়।মাধ্যমিক পর্যায়ে নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বৃত্তিমূলক বিষয় বাধ্যতামূলক ছিল যাতে করে তারা কায়িক শ্রমের প্রতি মর্যাদাবোধ সম্পন্ন হয়। শিক্ষার্থীদের খেলাধূলা ও শরীরচর্চায় নিয়মিত এবং সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ডে বছরে ৬০ ঘন্টা বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দেওয়ার বিধান রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল এই কমিশনে। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি পাননি এবং এই শিক্ষা নীতি বাস্তবায়িতও হয়নি। শিক্ষার উপর নগ্ন আগ্রাসন আমরা দেখতে পাই স্বৈরাচার এরশাদের শাসন আমলে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে যা তৈরী হয়েছিল সাম্প্রদায়িক শিক্ষার প্রসার ও সরকারী শিক্ষা সংকোচন নীতি অবলম্বনে।

১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর প্রকাশিত এই রিপোর্টে বলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন খর্ব হবে এবং যারা উচ্চ শিক্ষার ৫০ শতাংশ ব্যয় বহন করতে পারবে রেজাল্ট খারাপ থাকলেও তারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকবে। এতে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্র সমাজ প্রাণ বিসর্জন দেয় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। অথচ অর্থনীতিবিদদের মতে শিক্ষায় বিনিয়োগ শুধু ব্যক্তির জন্যই নয় সমাজের জন্যও সমানভাবে লাভজনক। গবেষণায় দেখা গেছে শিল্পখাতে বিনিয়োগের তুলনায় শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ দশগুণ বেশি লাভজনক। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের জিডিপিতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ থাকে সুপারিশকৃত বরাদ্দের ৩০% এর মত।১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বেতার- টেলিভিশনে দেশবাসীর উদ্দ্যেশে দেয়া বঙ্গবন্ধুর  ভাষণের একটি অংশের শিরোনাম ছিল “শিক্ষাই শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ”। ঐ ভাষণে তিনি বলেন, “সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না”।দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্প সময়েই ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৪৪ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ ও চাকরি সরকারীকরণ, ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে বই প্রদান ও গরীব ছাত্রছাত্রীদের পোশাক প্রদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পাঁচটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মূল্যায়ন করলে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু প্রণীত ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা(১৯৭৩-৭৮)-তে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল সবচেয়ে বেশি ৭%। 

এর পরের পরিকল্পনা গুলোতে যা আস্তে আস্তে কমে আসে। ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশনের সুপারিশ ছিল সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করা। কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাই শিক্ষার তিনটি ধারা-বাংলা, ইংরেজি ও মাদ্রাসা। শিক্ষাক্রম গড়ে ওঠে জাতীয় চেতনা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সামাজিক ব্যবস্থা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে। আমাদের এই আমাদের ইংরেজি ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারার শিক্ষাক্রমে জাতীয় চেতনার প্রতিফলন খুব একটা দৃশ্যমান না। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ধারা প্রচলিত নয়। বাংলা মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই অভিযোগ না থাকলে সাম্প্রতিক শিক্ষাক্রম নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। উগ্র ধর্মীয়বাদে প্রভাবিত হয়ে এ ধারার বিভিন্ন বই থেকে অনেক বিষয় বাদ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যা অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।স্ব-পরিবারে নিহত হবার আগে শিক্ষা উন্নয়ন ও প্রসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেগুলোর দুই-একটির  বাস্তবায়ন আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় পর, আর বেশিরভাগই এখনো আলোর মুখ দেখেনি। যেখানে বঙ্গবন্ধু থাকলে ১৯৮০ সালে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়ে যাবার কথা ছিল, সেখানে তা হয় আরো এক দশকেরও পরে। 

আর ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আজও কার্যকর হয়নি। সর্বজনীন শিক্ষার বদলে আমরা আমি দেখি কয়েক ধারা শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা বিশেষ নজরের অভাবে আজও ততটা অগ্রসর হয়নি প্রগতিশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে। যদি বঙ্গবন্ধু গৃহীত ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়ন হতো তবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক সমস্যা অনেক আগেই সমাধান হয়ে যেত। এই শিক্ষা কমিশন দেশীয় ইতিহাস-কৃষ্টির সাথে বিশ্ব চাহিদার তাল মিলিয়ে স্বনির্ভর প্রগতিশীল সমাজে তৈরীর একটি নকশা আমাদের উপহার দিয়েছিল। অব্যাহত মৌলবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও জঙ্গিবাদের শিকড় উপরে ফেলে লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামে ড.কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশকৃত নীতিমালার আদলে গঠিত একটি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাই হতে পারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার।         

ইশতিয়াক আহমেদ শালীন,
শিক্ষার্থী, ৪র্থ বর্ষ, শিক্ষা ও‌‌ গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়