ভারতরত্ন ড. বি আর আম্বেদকরের জন্মদিন আজ। ভারতীয় সংবিধানের মুখ্য রূপকার হিসেবে মানুষের কাছে তার প্রধান পরিচয় হলেও তিনি ছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। জীবনের সহস্র প্রতিকূলতা থাকলেও, জীবন যুদ্ধের সেই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্র অতিক্রম করেই তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য
(অর্থনীতি)-তে লাভ করেন মাস্টার ও পি এইচ ডি ডিগ্রি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার-অ্যাট ল ও ডি এস সি।
যাকে স্কুলে বেঞ্চিতে বসতে দেওয়া হয়নি, লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, সংস্কৃত পড়তে দেওয়া হয়নি। ভারতীয় সমাজের তথা হিন্দু ধর্মের এক তথাকথিত অস্পৃশ্য ঘরে জন্ম হয়েছে বলে জন্মের দায়ে অভিশপ্ত এই মহান মানুষটি কোথাও যথার্থ সম্মান পাননি, অধিকার পাননি কোনোদিন, তিনিই ছিলেন দর্শন, আইন, অর্থনীতি, বাণিজ্য, রাষ্ট্রনীতি, নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, ভারততত্ত্ব থেকে রাজনৈতিক ভাষাতত্ত্বের মহান পণ্ডিত। ভারতের ইতিহাসে তিনিই তার একমাত্র দৃষ্টান্ত, যার প্রতিরূপ আজও খুঁজে মেলা ভার।
ভারতের এই মহান সন্তান যদি ইচ্ছে করতেন তা হলে পৃথিবীর যে কোনো দেশে বিপুল বৈভবে জীবনযাপন করতে পারতেন। যদি কংগ্রেসে যোগ দিতেন তাহলে হয়তো প্রধানমন্ত্রীও হতে পারতেন। কিন্তু বৃহত্তর ভারত দলিত-দরিদ্রের ভারত মুক্তি যার স্বপ্ন, তিনি তো এসব প্রলোভনে পা দিতে পারেন না। আর সমাজের অন্যান্য বর্ণহিন্দু সমাজসেবীদের সঙ্গে তাঁর প্রধান পার্থক্য হলো এই যে তিনি পাড়ে দাঁড়িয়ে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের চেষ্টা করেননি — তিনি সেই অন্ধকার থেকেই উঠে এসেছেন। পঙ্ক থেকে পঙ্কজের মতো নিজের সংগ্রামে ও সাধনায় বিকশিত হয়েছেন। হয়ে ওঠেন প্রতিভার এক স্বর্ণশতদল।
আম্বেদকরের কিছু স্বপ্ন ও অবদান
যে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, নিপীড়ন ও নির্যাতন সহ্য করে আম্বেদকর তার জীবনকে সর্বোচ্চস্থানে তুলে এনেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা সেই বেদনাদীর্ণ বক্ষ নিয়েই তিনি দলিত-দরিদ্রের মুক্তির জন্য গড়ে তোলেন ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি বা স্বাধীন শ্রমিক দল (১৯৩৬)। যারা ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস প্রস্তাবিত শিল্পবিরোধ (সংশোধনী) বিল’র বিরোধিতা করেন কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে। ধর্মঘটের ডাক দেন যৌথভাবে। ৭ই নভেম্বর-এর ধর্মঘট সফল করার জন্য ৬ই নভেম্বর এক মঞ্চে ভাষণ দেন যমুনাদাস মেহতা, প্রধান, নিমকর, মিরাজকর, ডাঙ্গে, রণদিভে এবং আম্বেদকর।
এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা যদি ভারতবর্ষে তার শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামী ঐক্যের স্বর্ণসূত্র হতে পারতো তাহলে আমরা ভিন্নতর এক ভারতবর্ষ দেখতে পেতাম। আমাদের দুর্ভাগ্য তা পরে রক্ষা করা যায়নি।
অন্যদিকে ১৯৩৭ সালেই বম্বে অ্যাসেমব্লিতে সেখানকার কৃষকদের বিশেষ করে গরিব কৃষকদের ওপর চাপানো (খোটি প্রথা নামক) শোষণমূলক এক ধরনের ভয়ানক অবিচার রোধ করার জন্য খোটি প্রথা রদ বিল (১৭.৯.৩৭) পেশ করেন। কংগ্রেস তো জমিদার ও ধনীদের দল। তাই তাদের ভোটে সেটা প্রথমে খারিজ হয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে আম্বেদকর গ্রামে গ্রামে জনমত তৈরির কাজে লাগেন। লক্ষ লক্ষ জনতার অংশগ্রহণে এ আন্দোলন এমন রূপলাভ করে যে কংগ্রেস খোটি প্রথা রদ করতে বাধ্য হয়। তারই দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে মাহার বাতান (এক ধরনের অবৈধ কর যা মাহারদের দিতে হতো) উঠে যায়। তিনি ঐ সময়েই সর্বপ্রথমে উত্থাপন করেছিলেন ভূমিসংস্কারের দাবিও।
তিনি দলিতদের স্বার্থে গড়ে তোলেন তফসিলী ফেডারেশন। যে ফেডারেশনের নেতা ছিলেন বাংলার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলসহ আরো ভারত বিখ্যাত নেতৃবৃন্দ। এবং বিস্ময়ের কথা ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে বোম্বাই প্রাদেশিক আইনসভায় আম্বেদকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হলে এই তফসিলী ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের চেষ্টায় তিনি ঐ বছরের ১৮ই জুলাই গণপরিষদে নির্বাচিত হন। আম্বেদকরকে সেদিন ভোট দিয়েছিলেন মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল (বরিশাল) দ্বারিকানাথ কারুরি (ফরিদপুর) গয়ানাথ বিশ্বাস (কুমিল্লা) ক্ষেত্রনাথ সিংহ (রঙপুর) নগেন্দ্রনাথ রায় (রঙপুর) এবং মুকুন্দবিহারী মল্লিক (খুলনা)।
তিনি শেষ জীবনে গড়ে তোলেন রিপাবলিকান পার্টি। যার মুখ্য উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিলো ‘সমাজতন্ত্রে’র কথা। তার স্বপ্ন ছিলো ‘‘জাত-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মেহনতী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং মেহনতী মানুষকে তাদের সাচ্চা নেতা নির্বাচন করতে হবে। শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।’’ তার প্রামাণ্য জীবনীকার ধনঞ্জয় কীরের ভাষায় আম্বেদকর বলেছিলেন ‘‘ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করা এক আশু কর্তব্য ঠিকই; কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে এদেশের মানুষের রক্তশোষণ করে যে জমিদার, মিলমালিক ও সুদখোর মহাজনেরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই। শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব সংগঠন — সাম্রাজ্যবাদের মতোই তাঁদের পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে।’’
তিনি যখন শ্রমসচিব (মন্ত্রী) তখন ১)কয়লা শ্রমিকদের নানা ধরনের সহায়তা প্রদান, ২) মহিলা শ্রমিকদের প্রসবকালীন ৩২৯দিন ছুটি, ৩) কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্র, ৪) ৮ ঘণ্টা কাজের আইনী স্বীকৃতি, ৫) ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্প্রসারণ, ৬) ন্যূনতম বেতন —সহ নানা শ্রমিক কল্যাণ আইন পাস ও কার্যকর করেন।
নেহরু মন্ত্রিসভা থেকে তার পদত্যাগের অন্যান্য কারণের সঙ্গে মুখ্য কারণ ছিলো হিন্দুকোড বিল বা মহিলা অধিকার বিল পাস না করতে পারা। যার ফলে হিন্দু সমাজে নারীরা বঞ্চিত হন সম্মান ও তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।
আম্বেদকরের শিক্ষা ও সমকাল
পশ্চিমবঙ্গে দলিত আন্দোলনের খোঁজ যারা রাখেন অথবা যারা যুক্ত তারা জানেন কংগ্রেস আমলে (১৯৭৬) সংরক্ষণ আইন পাস হলেও বামফ্রন্ট সরকার আসার আগে চাকরি শিক্ষা কোনো ক্ষেত্রেই তা প্রয়োগ হয়নি। এমনকি ১৯৯০ সালে মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর সময়ই সংরক্ষণের হার তফসিলী জাতির জন্য ১৫ থেকে ২২ শতাংশ ও আদিবাসীদের জন্য ৫ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়। যাও ছিলো এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।
যদিও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে সর্বত্র সংরক্ষণ প্রযুক্ত হয়নি তবুও ভর্তি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ প্রয়োগ বামপন্থীদের সময়ই প্রথম এবং অনেকাংশে সফলভাবে প্রযুক্ত হচ্ছে। মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং-সহ জীবিকামুখী শিক্ষাক্রমেও তা অবশ্য মান্য।
আর আম্বেদকর যেমন বলেছিলেন কৃষিতে সমবায়ই মুক্তির অন্যতম পথ। বলেছিলেন ছোট ছোট খণ্ড খণ্ড জমি চাষের অপচয়ের কথা। বলেছিলেন কৃষকের অধিকারের কথা। যা পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে সফলভাবে এবং ভারতের মধ্যে ব্যতিক্রমীভাবে প্রযুক্ত হয়েছে যার কোনো দৃষ্টান্ত আর কোথাও নেই। ভূমিসংস্কারের ফলে বণ্টিত জমির প্রায় সবই পেয়েছেন দলিত (এস সি/এস টি, ও বি সি তথা গরিব সংখ্যালঘু) সম্প্রদায়ের মানুষেরা। যা পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গকে উজ্জ্বলভাবে স্থান করে দিয়েছে।
তিনি মন্দির প্রবেশ আন্দোলন করার পর সে পথ ত্যাগ করেন — বলেন, ‘রামচন্দ্রের চেয়ে দলিতের কাছে রুটিচন্দ্রে’র দাম বেশি। যদিও তিনি ভারতীয় সমাজের প্রগতির পথে মূল বাধা জাতপাত বা মনুর বর্ণব্যবস্থাকেই চিহ্নিত করেছিলেন এবং ১৯২৭ সালে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে ‘মনুস্মৃতি’ দাহন করেছিলেন। বর্ণাশ্রমকে ভারত প্রগতির অন্তরায় বলে উল্লেখ করেছিলেন কার্ল মার্কসও।
আম্বেদকর চেয়েছিলেন শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রচুর ছাত্রাবাস, স্টাডি সেন্টার, কৃষি বিদ্যালয়। এমনকি লাইব্রেরি গঠন। নারীর স্বয়ংভরতা ও অধিকার। আম্বেদকরের এই স্বপ্ন বর্তমানে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গকে দরিদ্রের উন্নয়নের এক স্বর্ণযুগের দিকে ধাবিত করতে চলেছে।
বড় প্রতিভাবানদের নানা চিন্তার বিবর্তন নানামুখী থাকে তা মনে রেখেই বলি তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ স্বর্ণ সিদ্ধান্তে এই বলে উপনীত হয়েছিলেন যে ‘‘The soviet system of agriculture is according to me. the best’’ (অর্থাৎ সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থাই আম্বেদকরের মতে ছিলো সর্বশ্রেষ্ঠ)। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যারা যুক্ত তাদের পথ তো সেই সমাজতন্ত্রের দিকেই। আর পশ্চিমবঙ্গে গত তিনদশক কিছু অপূর্ণতা, কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও আম্বেদকরের ভাবনা অনুসারে এই শ্রমিক-কৃষক তথা শ্রমজীবী মানুষের মহত্তম কল্যাণ সাধনে তো বামপন্থীরাই সদা তৎপর এবং সতত প্রয়াসী।
কৃষক শ্রমিকের সমস্যার পাশে ২০০৩ সাল থেকে আর একটি সমস্যা বাংলার উদ্বাস্তু দলিতদের কাছে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সে হলো নাগরিকত্বের সমস্যা। ১৯৭১-র পর আসা বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের বিতাড়নই এর প্রধান উদ্দেশ্য। পাকিস্তান থেকে এলে তারাও থাকবেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে নয় — এমনই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। এই আইন করেন এন ডি এ সরকার, মমতাদেবী তখন তাদের সঙ্গে। আর ঐ বিষয়ের যে কমিটি তার সভাপতি ছিলেন মাননীয় প্রণব মুখোপাধ্যায়। তারাই সেদিন এই আইনটি করেন। যার ফলে পশ্চিমবঙ্গে এক জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
দেশভাগের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আম্বেদকরের প্রস্তাব ছিলো লোকবিনিময়। কংগ্রেস তখন তাঁর একথায় কর্ণপাত করেনি। অন্তত বাংলার উদ্বাস্তুদের জন্য তো নয়ই। তাই সারা ভারতে আজ বাঙালী দলিত উদ্বাস্তুদের জীবনজীবিকা পদে পদে বিপদগ্রস্ত। এজন্য রাজ্যসভার সদস্য বৃন্দা কারাতের নেতৃত্বে সারা ভারতে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। হচ্ছে দলিতদের জাতিপত্রের জন্যও।
আর এবার বামফ্রন্ট তার বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে প্রকাশিত ইশ্তেহারে ‘‘১৯৭১-এর পর আসা বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে।’’ — উদ্বাস্তু আন্দোলনের ঐতিহ্য ধরে এ এক বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত।
আম্বেদকরের জন্মদিনের এ শুভমুহূর্তে আমাদের শ্রদ্ধা এই মহামনীষীর প্রতি আর আকাঙ্ক্ষা বাবাসাহেবের চিন্তাধারার বাস্তব ও শ্রেষ্ঠ প্রয়োগক্ষেত্র হয়ে উঠুক পশ্চিমবঙ্গ। বাবাসাহেবের সামাজিক ন্যায়ের ভুলুন্ঠিত পতাকা বামপন্থীরাই ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন।
নিখিলেশ বিশ্বাস
Find Nobin Kontho on Facebook