রবিবার, ২১ মে, ২০১৭

নভেরা আহমেদ আড়াল থেকে চির আড়ালে

নভেরা আহমেদ—একজন অভিমানী শিল্পীর নাম।  ভাস্কর্য শিল্পের এক কিংবদন্তি তিনি। নিজের সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী শিল্পসাধনা ও অজ্ঞাতবাসের জীবন তাঁকে পরিণত করেছিল জীবন্ত কিংবদন্তিতে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার এই ভাস্কর স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন প্রবাসজীবন। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই নারী জীবনের ৪৫টি বছর নীরবে-নিভৃতে কাটিয়েছেন প্যারিসে।

বাবা সৈয়দ আহমেদ সুন্দরবন অঞ্চলে কর্মরত অবস্থায় ১৯৩০ সালে জন্ম হয় নভেরা আহমেদের। তবে নভেরার পৈতৃক নিবাস
চট্টগ্রামের আসকারদিঘির উত্তর পাড়। আইন বিষয়ে পড়তে ১৯৫১ সালে নভেরা আহমেদকে পরিবারের পক্ষ থেকে লন্ডনে পাঠানো হয়। ভাস্কর হওয়ার অদম্য স্পৃহায় নভেরা যোগ দেন সিটি অ্যাওয়ার্ড গিল্ড স্টোন কার্ভিং ক্লাসে। পাঁচ বছর পড়াশোনার পর ন্যাশনাল ডিপ্লোমা পেয়ে দুই বছরের জন্য তিনি ফ্লোরেন্সে যান। সেখানে  প্রাচীন কয়েকজন শিল্পীর কাজের সঙ্গে পরিচিত হন এবং কাজ শেখেন।

শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৬ সালের জুন মাসে নভেরা দেশে ফিরে আসেন। সেসময়ে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ চলছিল। ভাস্কর হামিদুর রহমানের সাথে নভেরা আহমেদ শহীদ মিনারের প্রাথমিক নকশা প্রণয়ণের কাজ শুরু করেন। ১৯৫৮ সালের সামরিক আইন জারি হলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে অজ্ঞাত কারণে শহীদ মিনারের নির্মাতা হিসেবে তাঁর নামটি সরকারি কাগজ থেকে বাদ পড়ে যায়। ওই বছর তিনি ঢাকায় প্রথম মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন।

শহীদ মিনারের মূল যে-স্তম্ভটি, যাকে মাতৃমূর্তির রূপক মনে করা হয় তার আনতভঙ্গি প্রথমে যেটি হামিদুর রাহমান ও নভেরা আহমেদের উপস্থিতিতে নির্মিত হয় সেটি বর্তমানের মাতৃমূর্তিটির মতো কৌণিক ছিল না। নভেরার Seated Woman নামে তিনটি কাজ আছে—কোমল ভঙ্গিতে মা দৃষ্টিনত করে রেখেছে কোলের সন্তানের প্রতি।

নভেরার বেশকিছু ভাস্কর্যে আবহমান বাংলার লোকজ আঙ্গিকের আভাস মেলে। লোকজ ফর্মের সাথে সেখানে সমন্বয় ঘটেছে পাশ্চাত্য শিক্ষার। লোকজ টেপা পুতুলের ফর্মকে সরলীকৃত করে তাকে দক্ষতার সাথে বিশেষায়িত করেছেন তিনি। ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্য শিক্ষার সার্থক উপস্থাপনের চেষ্টা তাঁর আধুনিক চিন্তার পরিচায়ক। তাঁর ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—তিন কোণা আদল, ছিদ্র চোখ, লম্বা গ্রীবা। তাঁর কাজের প্রধান দিক হচ্ছে—নারীদের প্রতিমূর্তি। সমসাময়িক পুরুষ শিল্পীদের নির্মিত নারীদেহের রোমান্টিক ইমেজের বিপরীতে তিনি নারীকে দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে। তাঁর কাজে নর-নারীর কম্পোজিশন একটি ঐক্য গঠন করে। তিনি তাঁর ফর্মগুলোকে সরল, অর্থপূর্ণ, স্বকীতায় সমৃদ্ধ করেছেন। উন্মোচন করেছেন সব ধরনের বিচলিত, আবেগমথিত, সত্যিকারের নারীর রূপকে। মা শক্তিদায়িনী, সংকল্পবদ্ধ, অকপট, মৌন আকর্ষণরূপে উদ্ভাসিত। তাঁর মায়েরা সুন্দরী নয়, কিন্তু শক্তিময়ী ও সংগ্রামী। কখনো কখনো তারা মানবিকতার প্রতীক।

সে সময় ভাস্কর হিসেবে নিজের একটা দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন নভেরা। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বেশ বড় আকারের; ৫ ফুট থেকে শুরু করে এমনকি ৭ ফুট ১১ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতাবিশিষ্ট। তাঁর হাতে গড়া উল্লেখ্যযোগ্য ভাস্কর্যগুলো হলো— ‘পরিবার’ (১৯৫৮), যুগল (১৯৬৯), ইকারুস (১৯৬৯), জেব্রা ক্রসিং (১৯৬৮), ‘লুনাটিক টোটেম বা মেডিটেশন’ (১৯৬৮) ইত্যাদি।

১৯৬১ সালে ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিং স্কাল্পচার অ্যান্ড গ্রাফিক আর্টস শিরোনমে এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া তাঁর ছয়টি ভাস্কর্যের মধ্যে ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ নামের একটি ভাস্কর্য বেস্ট স্কাল্পচারে পুরস্কৃত হয়। ১৯৯৭ সালে তিনি ভাস্কর্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। তাঁকে নিয়ে ‘নভেরা’ (১৯৯৫) শিরোনামে জীবনী উপন্যাস রচনা করেছেন হাসনাত আবদুল হাই এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন এন রাশেদ চৌধুরী (১৯৯৯)। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল’।

বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের ইতিহাসে আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পের পথিকৃত্ শিল্পী নভেরা আহমেদ। কে জানে কোন অজানা অভিমানে প্রিয় স্বদেশ থেকে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছানির্বাসন? এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একবারও তিনি দেশে আসেননি, চাননি তাঁর শিল্পকর্মের স্বীকৃতি। এমনকি একুশে পদক নিতেও আসেননি তিনি। নভেরা দেশে না থাকলেও, তাঁর অনেক অমূল্য শিল্পকর্ম বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রদর্শিত হচ্ছে। খানিকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবন। আশ্চর্য এক আড়াল তৈরি করেছিলেন নিজের চারপাশে। ৬ মে ২০১৫ প্যারিসের শঁন পামেল গ্রামে চিরদিনের মতো আড়ালে চলে গেলেন এই অভিমানী ভাস্কর। এই চির অন্তরাল তাঁকে বিস্মৃত করতে পারবে না কখনো। সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি সদাপ্রকাশ্য থাকবেন শিল্পপিপাসুদের মনে।

নভেরা আহমেদ (১৯৩০—৬ মে ২০১৫)

অতনু তিয়াস





Find Nobin Kontho on Facebook