মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদঃ একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা | শান্তনু মজুমদার

পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানের ব্যাপক ভূমিকা থাকার ব্যাপারটি যেমন অস্বীকার করা যাবেনা ঠিক একইভাবে এটাও অনস্বীকার্য যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবার আগেই আগেই এর ঝুঁকিগুলো বুঝতে শুরু করেছিলেন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে উদারনীতিক-গণতন্ত্রকামী অংশটি। পাকিস্তান আন্দোলনের শেষের দিকে এসে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন মুসলিম লীগের ভেতরে বাঙালি মুসলমানদের প্রাগসর অংশটিকে বিনাশ করে দেয়ার সর্বতো চেষ্টা
চালানো হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর চেষ্টা আরো প্রকট হয়, যার পরিনতিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের উপরের দিকের পদ কমিটিগুলো শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিংবা আবুল হাশিমের মত উদারনীতিবাদীদের পরিবর্তে প্রধান নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুগত লোকজনে পূর্ণ হয়ে যায় (নায়ার ১৯৯০, আহমাদ ১৯৬৩) 
মুসলিমলীগের কায়েমি স্বার্থবাদী অংশটির প্রচন্ড চাপের মুখে টিকে থাকার অনিবার্য প্রয়োজনে মুসলিম লীগের মধ্যেকার উদারপন্থী ধারাটি ১৯৪৯ সালের মাঝামাঝিতে এসে আওয়ামী মুসলিম গঠণ করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে মুসলিম লীগের কায়েমি স্বার্থবাদীদের কর্মকান্ড বাংলার মুসলিম তরুন সমাজের অগ্রসর অংশটির মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার করে। বিশেষ করে অর্থনীতিক সাংস্কৃতিক ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করতে পারার কারণে সমাজের এই অংশটি বাংলা ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের সুচনা লগ্ন থেকে শক্ত অবস্থান গ্রহনে সক্ষম হয়। 

অগ্রসর চিন্তার মুসলিম এই তরুনদের তালিকার একেবারে উপরের দিকেই রাখা যায় তাজউদ্দিন আহমদের নাম।  শুরুতেই উল্লেখ করে নেয়া যায় যে ভাষা আন্দোলনে তাজউদ্দিন আহমদের অংশগ্রহন একেবারেই আচমকা কোন ঘটনা নয়। ১৯৪০ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলার চরিত্রে ব্রিটিশদের দেয়া কলঙ্কমোচনের লক্ষ্যে সুভাষ চন্দ্র বসুর আন্দোলন কিংবা এরও আগে গ্রামের বাড়ী গাজীপুরের কাপাসিয়া এম জুনিয়র স্কুলে ছাত্র থাকা অবস্থাতে উপনিবেশিক শাসন বিরোধী শিক্ষকদের সাথে দেখা-সাক্ষাত হবার মত ঘটনাগুলি কিশোর তাজউদ্দিন আহমদের মনন গঠনে সহায়তা করে বলে মনে করা যায়। কৈশোর থেকেই তাজউদ্দিন আহমেদ যে ধরণের রাজনীতি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সংস্পর্শে এসেছিলেন তাতে করে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিক সংগ্রামে তাঁর যুক্ত না থাকাটাই হত অস্বাভাবিক ঘটনা। উল্লেখ্য, ১৯৪১ সালের দিকে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরজ স্কুলে নবম শ্রেনী ছাত্র থাকা অবস্থাতেই রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। আর ১৯৪৪ সালের দিক ঢাকা কলেজের ছাত্র হবার পরে পরিনত হন সক্রিয়  রাজনীতিক কর্মীতে (আহমেদ ২০০৮) বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রথম পর্ব থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যুক্ততার বিষয়টি নবগঠিত রাষ্ট্র সম্পর্কে তাজউদ্দিন আহমদের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিক অবস্থানের সহজাত প্রতিফলন। 

উর্দুকে প্রধান ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বিপদ বুঝে ফেলে, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র তিন মাসের মাথাতেই অর্থ্যাৎ নভেম্বর মাস নাগাদ, অগ্রসর বাঙালিরা বলতে শুরু করেন যে, ‘‘ইহাতে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বনাশ ঘটিবে। …. উর্দু বাহিয়া আসিবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণ, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক মৃত্যু’’ (হক ১৯৪৭) এই দুর্ভাবনাটি পাকিস্তান জন্ম নেয়ার ঠিক আগে আগে পাকিস্তানপন্থার উগ্র জোশের মধ্যেও তাজউদ্দিন আহমদরা বুঝতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে মুসলিম লীগের নেতৃত্বের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে যে একদল তরুন কর্মী গণ আজাদী লীগ নামে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করেন তাঁদের মধ্যে তাদের মধ্যে তাজউদ্দিন আহমদ অন্যতম (হেলাল ১৯৮৫) গণ আজাদী লীগের ঘোষণা পত্রে, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, বাংলাকে মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করা এবং এই ভাষাকে দেশের জন্য যথোপযোগী করার কথা বলা হয় (উমর ১৯৭৯) গণ আজাদী লীগের ধারাবাহিকতাতে গঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগ কর্তৃক ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্থাপিত ১২ দফাগণদাবীর সনদএর ৫ম দফাতে ‘‘ভাষার ভিত্তিতে স্বয়ং শাসন অধিকারসম্পন্ন প্রদেশ গড়িবার এবং আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার মানিয়া লইতে হইবে’’ মর্মে দাবী জানানো হয় (রহমান ১৯৮২) 

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসেই ভাষা প্রশ্নে তাজউদ্দিন আহমদের অবস্থানের আরেকটি প্রমান পাওয়া যায়। এসময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য : জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করলে সংগঠন হিসাবে তমুদ্দিন মজলিশ এর বিরোধীতা করে; : মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এসময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। তাজউদ্দিন আহমদ দাবীর সাথে একমত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে শরীক হয়ে যান(আহমেদ ২০১০) একই বছরে সম্ভবত নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠণের আলোচনাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অনুষ্ঠিত সভাতে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সূচণালগ্নের আলোচনাতে বহুল উচ্চারিত তমুদ্দিন মজলিস এবং এর প্রধান আবুল কাশেম সম্পর্কে খুব একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না তিনি। আবুল কাশেমকে হিন্দু এবং কমিউনিস্ট বিরোধী একজন মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। এছাড়াও তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ভাষা আন্দোলনের সূচণালগ্নে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা নয় বরং কেবলমাত্র আদালতের ভাষা করার দাবী করেছিল তমুদ্দিন মজলিস (উমর ১৯৮৫) উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনের প্রধানতম সংগঠকদের একজন কমরুদ্দীন আহমদও তমুদ্দিন সম্পর্কে একই মত পোষণ করেন। বস্তুতঃ তমুদ্দিনকে এভাবে দেখতে সক্ষম হওয়ার মধ্যে উদারনীতিক-প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের আজীবনের সংলগ্নতার প্রমান পাওয়া যায় (হেলাল ১৯৮৫)

১৯৪৮ সালের শুরুতেই তাজউদ্দীন আহমদ ব্যাপকতরভাবে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে নেন নিজেকে। বছরের শুরুতেই ( জানুয়ারি) পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারীদের কিছু কাগজপত্র ঢাকার বলিয়াদি প্রেস থেকে বাজেয়াফত করে। এছাড়াও ব্যাপারে কয়েকজনের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যুর গুজব বের হয়। এসব নিয়ে কথা বলার জন্য যেসব ছাত্র প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ খানের সাথে দেখা করেন তাঁদের মধ্যে তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন অন্যতম (আহমেদ ২০১০) একই বছরের মার্চ মাসের শুরু থেকেই গতি পেতে থাকা রাষ্ট্রভাষার দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সামনের সারির সংগঠকদের একজন হিসাবেও তাঁকে পাওয়া যায়। ২রা মার্চের সাংস্কৃতিক রাজনীতিক সংগঠনের আয়োজনে কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নেতা-কর্মী সভাতে অন্যতম অংশগ্রহনকারী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এই সভা থেকেই শামসুল হককে আহবায়ক করে সর্বদলীয়রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদগঠিত হয় (হেলাল ১৯৮৫) তাজউদ্দিন আহমদ এই পরিষদের অন্যতম সদস্য হন। 

আন্দোলনের অংশ নিয়ে খ্যাতি কুড়ানোর বাসনা বাঙালির ইতিহাসের অন্যতম প্রধান এই রাজনৈতিক চরিত্রটিকে তরুন বয়সেও আক্রান্ত করতে পারেনি। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার ঐতিহাসিক ধর্মঘটে কিভাবে তিনি সস্তা নাম কেনার প্রক্রিয়া থেকে দূরে থেকে থেকেছেন তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন বদরুদ্দীন উমর (১৯৮৫) ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভাতে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করলে শিক্ষিত সচেতন বাঙ্গালিদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি বিবেচনাতে নিয়ে জিন্নাহ মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে গঠিতরাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সাথে আলাপের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কমরুদ্দীন আহমাদের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের যে টিমটি জিন্নাহের সাথে দেখা করেন এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে বিতন্ডায় লিপ্ত হন তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অন্যতম; অন্য সদস্যরা ছিলেন শামছুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, লিলি খান (উমর ১৯৮৫)

১৯৪৮ সালের শুরুতেই ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠলেও তা কোন পরিনতি পায়নি। বরং,  সরকারপক্ষের নানামুখী চক্রান্ত, আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর মতাদর্শিক অনৈক্য, কোন কোন সংগঠনের পিছুটানের পরিনতিতে মার্চ মাসের আন্দোলনটি একপর্যায়ে স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের স্মরণে ১৯৪৯ এবং ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চে দুএকটি উদ্যোগ নেয়া হলেও তা তেমন কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি। তবে বাংলা ভাষার মধ্যে উর্দুয়ানি প্রবেশ করানোর সরকারী চেষ্টা, সরকারের গঠিতমূলনীতি কমিটিকর্তৃক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার সুপারিশের মত বিষয়গুলো ১৯৫০ সালে শেষের দিকে এসে ভাষা আন্দোলনে নতুন করে গতির সঞ্চার করে  (রফিক ২০০৯) তাজউদ্দিন আহমেদ এদিকে নজর রাখছিলেন বলে ধরে নেয়া যায়। কেননা  তাঁর ১৯৫০ সালের ৩১ অক্টোবরের দিনলিপিতেমূলনীতি কমিটি বিরুদ্ধে ‘‘পুরো দেশময় উত্তপ্ত অসন্তোষ’’ ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হয়েছে। ১৬ নভেম্বরের দিনলিপিতেমূলনীতি কমিটিবিরোধী ছাত্র ধর্মঘটের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি (আহমদ ২০০০) প্রগতিশীলতার রাজনীতির সাথে নিবিড় সম্পৃক্ততাজনিত দূরদৃষ্টির কারণেই ভাষা প্রশ্নটিকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে অগ্রসর হবার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সমস্যা হয়নি তাজউদ্দীন আহমদের। আর এক্ষেত্রে নেতৃপর্যায়ে আসীন ব্যক্তিত্বদেরকে খতিয়ে দেখতে দ্বিধা করেননি তিনি। ১৯৫১ সালের  ৫ই জানুয়ারি তারিখের দিনলিপি পড়লে বোঝা যায় যে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুর প্রতি সে সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থনের ব্যাপারটি তাঁর মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন, “রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুর প্রতি তাঁর আকাঙ্ক্ষা বোঝা গেল” (আহমদ ২০০৮) 

লক্ষ্য করার মত ব্যাপার এই যে আলোচ্য সময়কালে তাজউদ্দীন আহমদ একজন সক্রিয় রাজনীতিক কর্মী। তাঁর দিনলিপিগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ সাংস্কৃতিক শিক্ষামূলক কর্মকান্ডেও তিনি সমানভাবে সক্রিয়। এছাড়াও এসময় তিনি নিজ-এলাকাতে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। কিন্তু লক্ষ্য করার মত ব্যাপার এই যে এতসব যুক্ততা স্বত্তেওমূলনীতি কমিটি সুপারিশ ঘিরে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গটি পুনরায় আলোচনায় চলে আসার পর থেকে তাজউদ্দীন আহমদের কাছে তা আর প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। রাষ্ট্রভাষা দাবীকে ঘিরে শাসকচক্রের বিরোধী বড় একটা অবস্থান গড়ে তোলার সম্ভাবনা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়।

১৯৫১ সালের দিনলিপিতে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক নানাবিধ কর্মকান্ডে তাঁর যুক্ত থাকার প্রমান বারবার পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরুপ, ১৬ই ফেব্রুয়ারির দিনলিপিতে উল্লেখ আছে যে সেদিন বেলা ১১টায় মুখলেসুর রহমান নামের একজন ব্যক্তি ‘‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তার নিজের ভূমিকা সম্পর্কে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে’’ তাজউদ্দিন আহমদের কাছে ব্যাখ্যা দেন এবং স্বীকার করেন যে তিনি ‘‘দলিলুর রহমানের ভুল প্রভাবে পড়েছিলেন’’  বুঝতে সমস্যা হয়না যে ভাষা আন্দোলনের সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ কেবলমাত্র একজন সাধারণ কর্মীর ভূমিকাতে ছিলেন না। তা যদি হত তাহলে অন্যরা নিজের অবস্থানের ব্যাখ্যা দেয়া কিংবা ভুল স্বীকার করার জন্য তাঁর কাছে আসার কথা ছিল না। ১৩ই মার্চ তারিখে দুপুরে অনুষ্ঠিতরাষ্ট্রভাষা কর্মপরিকল্পনা কমিটি সভায় যোগ দেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১২ই এপ্রিল তারিখেরভাষা সংগ্রাম কমিটি’, ১৭ই এপ্রিলরাষ্ট্রভাষা কমিটি সভাতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ৩রা মে তারিখে প্রথম বর্ষ ছাত্রদের আয়োজিত বর্ষ সমাপনী অনুষ্ঠানে ‘‘আরবি হরফে বাংলা, আরবি সুরে বাংলা পড়া এবং বাংলা ভাষাকে আরবিতে রুপান্তর’’ এর অপচেষ্টাকে বিদ্রুপ করে গাজীউল হকের পরিবেশিত কৌতুকগুলোকে ‘‘সবচাইতে আকর্ষণীয়’’ ‘‘বোদ্ধা ব্যক্তির অবাস্তব চিন্তাধারার প্রতি ব্যাঙ্গাত্মক ইঙ্গিতবহ’’ হিসাবে চিহ্নিত করেন তাজউদ্দীন আহমদ। বোঝা যায় যে সেসময়ে শাসকচক্রের মদতে কতিপয় বাঙালি বুদ্ধিজীবী বাংলা ভাষার আরবীকরণ বিষয়ক যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিলেন তার শিকারে পরিনত হননি তিনি। ১৯৫১ সালের শেষদিকে, ৫ই ডিসেম্বর, বিশ্ববিদ্যালয় হলের বার্ষিক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেয়ার কথা দিনলিপিতে লিখেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেবার বার্ষিক সম্মেলনের বিষয় ছিল বাংলা কবিতা। বোঝা যাচ্ছে যে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের রাজনৈতিক অঙ্গনের উত্তাপ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেখা যেতে শুরু করে দিয়েছে তখন; আর রাজনীতিতে নিবিষ্ট তাজউদ্দীন আহমদ নিজেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন করে রাখছেন না। 

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাজউদ্দিন আহমদের যুক্ততা নিয়ে তাঁর দিনলিপিগুলো পড়লে এটা স্পষ্ট হয় যে তিনি আবেগকে যুক্তির উপরে স্থান দেননি। ভাবাবেগ তাঁর করনীয়গুলোকে বিলম্বিত করে দেয়নি কিংবা আবেগের প্রাবল্যে তিনি দায়িত্বহীনভাবে দায়িত্ব ভুলে যাননি। বায়ান্ন সালে একুশে ফেব্রুয়ারিতে লেখা দিনলিপিতেও ভাবাবেগ, আকূলতা, শোকাচ্ছন্নতার পরিবর্তে সে সময়কার করণীয় সংক্রান্ত ভাবনাই তাঁর কাছে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। একুশ তারিখের দিনলিপি এক জায়গায় ভাবাবেগের কোন প্রকাশ না করে তাজউদ্দিন আহমেদ লেখেন, ‘‘পুলিশের গুলিতে আহত নিহতদের মৃতদেহ দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না’’ একই দিন তিনি আরও লেখেন, ‘‘বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট চলছে। গতকাল থেকে এক মাসের জন্য সিআর, পিসি, ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আজ বিকেলে অ্যাসেম্বলি বসেছে। ধর্মঘট পালনকারী ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অ্যাসেম্বলি হাউসের কাছে জড়ো হয়; যাতে তাদের কন্ঠে অধিবেশনে উপস্থিত এমএলএরা শুনতে পান’’ (আহমদ ২০১০) 

যা ঘটেছে তা বিনা-আড়ম্বরে লিখেছেন তাজউদ্দীন আহমদ কিন্তু তিনি যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন তা বোঝা যায়। কেননা একুশ তারিখ রাতেই তাঁর বাসস্থানে পুলিশী অভিযান চলে। বাইশ তারিখেও তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালায় পুলিশ। এর পরের কয়েকদিনের কর্মকান্ডগুলোর প্রত্যেকটিতে তাজউদ্দীন আহমদের গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বার্তা নিজ-মুখে ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারেও মনোযোগী ছিলেন তিনি। ঢাকার ঘটনার এক সপ্তাহের মাথাতেই, পহেলা মার্চ, নিজ এলাকায় যান তাজউদ্দীন আহমদ। ঢাকা থেকে ট্রেনে যাবার সময় রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত সহযাত্রী হওয়া পাবুরের নেওয়াজ আলীর সাথেরাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং সরকারের জঘন্য ভূমিকানিয়ে কথা বলেন। ভাষা প্রশ্নটি কিভাবে সর্বসাধারণ্যে এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেদের মধ্যেও আবেদন তৈরি করেছিল তাও লক্ষ্য করেন তাজউদ্দীন আহমদ। ট্রেনে বসে নেওয়াজ আলীর সাথে কথা বলার সময়একজন হাবিলদারের নেতৃত্বে সশস্ত্র পুলিশের একটি দলকেতাঁর কথাবার্তামনোযোগ দিয়েশুনতে দেখেন। সময় পরোক্ষ শ্রোতা হাবিলদার কর্তৃকএক গ্লাস খেজুরের রসসাধার মধ্যে আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি আভাষ দেখতে সমর্থ হন তাজউদ্দীন আহমদ। 
পরের দিন কর্মস্থল শ্রীপুরে জনৈক মোবারক ভূঁইয়ার দোকানে বসে ‘‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মুসলিম লীগ সরকারের কার্যক্রম’’ সম্পর্কে উপস্থিত লোকজনকে অবহিত করেন। বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার গুরুত্ব অনুধাবনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে কোন ভুল করেননি তিনি। পরের মাসে, ১৯ শে মার্চ নিজ-সংগঠন যুবলীগের ওয়ার্কিং কমিটির ‘‘সাম্প্রতিক রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি ওপর পর্যালোচনা’’ সভাতে উপস্থিতি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১২ এপ্রিল রাষ্ট্রভাষা কমিটির সভাতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন।


রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদের যুক্ততার ধরণ তাঁর প্রগতিশীল-উদারনীতিক রাজনীতিক ভাবনা, আবেগসর্বস্ব চিত্ত-চাঞ্চল্য মুক্ত থেকে কাজ করতে পারার সক্ষমতার প্রকাশ। দিনলিপিগুলো থেকে তাঁর চারিত্রিক ঋজুতার এধরণটি ভালোভাবে ফুটে উঠে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাজউদ্দীনের ভূমিকাকে মনে হয় এক ধরণের প্রস্তুতিপর্ব - যা থেকে ভবিষ্যতে নতুন একটি জাতির জন্মকালে স্বাধীনতার প্রধান স্থপতির শারীরিক অনুপস্থিতিতে যাবতীয় সহিংসা-চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের জটাজালের মধ্যে থেকেও মুক্তির তরিটিকে তীরে ভিড়ানোর মত গুরুত্বপূর্ণতম দায়িত্ব পালনের জন্য নিজের অজান্তেই প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। 


: শান্তনু মজুমদার, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 



গ্রন্থপঞ্জীঃ 

আকাশ, এম এম, ভাষা আন্দোলনঃ শ্রেনীভিত্তি রাজনৈতিক প্রবনতাসমূহ, ঢাকাঃ ইউপিএল, ১৯৯০

আহমদ, তাজউদ্দিন, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, ১৯৪৯-৫০, ঢাকাঃ প্রতিভাস, ২০১০, পৃষ্ঠা ২১৯, ২৩১ 

আহমদ, তাজউদ্দিন, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, ১৯৫২, চতুর্থ খন্ড, ঢাকাঃ প্রতিভাস, ২০১০, পৃষ্ঠা ৪৬-৬০, ৭৩, ৯০ 

আহমদ, তাজউদ্দিন, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, তৃতীয় খন্ড, ঢাকাঃ প্রতিভাস, ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৯
আহমেদ, সিরাজ উদদীন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, বরিশালঃ ভাস্কর প্রকাশনী, ২০২০, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২০-২২, ৯৩-১০০

আহমাদ, মুশতাক, গর্ভমেন্ট অ্যান্ড পলিটিকস ইন পাকিস্তান, ২য় সংষ্করণ, করাচিঃ পাকিস্তান পাবলিশিং হাউস, ১৯৬৩, পৃষ্ঠা ১৩৫-১৪০  

উমর, বদরুদ্দীন, পূর্ব বাঙলার ভাষা-আন্দোলন তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, ২য় পরবর্তিত সংষ্করণ, ঢাকাঃ বাংলা একাডেমি, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৭-১৯

উমর, বদরুদ্দীন, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গঃ কতিপয় দলিল, ২য় খন্ড, ঢাকাঃ বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ১৮৩, ৩২৮-৩৩৪

নায়ার এম বি, পলিটিক্স ইন বাংলাদেশঃ স্টাডি অফ আওয়ামীলীগ, ১৯৪৯-৫৮, নয়াদিল্লীঃ নর্দান বুকস সেন্টার, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৩০-৭৫ ১০৮-১৬৫ 

হক, এনামুল (সম্পাদিত), কৃষ্টি, নারায়ণগঞ্জ, নভেম্বর ১৯৪৭ [উদ্ধৃতঃ আকাশ ১৯৯০: ৩৮]

হেলাল, বশীর আল, ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস, ঢাকাঃ বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫, ২২০-২২১

রফিক, আহমদ, ভাষা আন্দোলন, ঢাকাঃ প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩, পৃষ্ঠা ২৯-৩১ 

রহমান, হাসান হাফিজুর (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খন্ড), ঢাকাঃ তথ্য মন্ত্রনালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১০২