মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০১৭

নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে ড্যু বয়েজ হেনরি গেটস এবং কর্নেল ওয়েস্ট

দাসপ্রথা, বর্ণবাদ, আফ্রিকার কালো নির্যাতিত মানুষদের সংগ্রামের প্রতি আমার অকুণ্ঠ সমর্থনের একটি মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস আছে। আমার ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, সবকিছুর সঙ্গের সঙ্গে তা যুক্ত। যতটা সংক্ষেপে পারা যায় তার একটি খতিয়ান দিয়ে হয়তো বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করতে পারি এবং হার্ভার্ডে শিক্ষার সঙ্গে তার যোগসূত্রটা তুলে ধরতে পারি। না হলে মনে হতে পারে যে হার্ভার্ড ছিল এক সময়ের সাদা, অভিজাতদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হয়তো এখনও সেই রকমই রয়ে গেছে। আমার ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ার সময় পুরনো খাতাপত্র বিক্রি করতে গিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিল। ক্রেতা লোকটির কাছে ছিল এক ঝুড়ি বই। তাদের কাছে বইয়ের চেয়ে লম্বা খাতাগুলোর দাম বেশি। তাই যখন বললাম,
আমার খাতাগুলোর বিনিময়ে এক ঝুড়ি বই দিয়ে দিতে তখন সে সানন্দে রাজি হয়েছিল। সেই এক ঝুড়ি বই আমার জীবনকে পালটে দিয়েছিল বলা যায়। কারণ সেই ঝুড়িতে ছিল মাক্সিম গোর্কির মা, জন রিডের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, আরো ছিল চালর্স ডিকেন্সের আ টেল অব টু সিটিস এবং আঙ্কল টমস কেবিন।

এই আঙ্কল টমস কেবিন পড়েই বলা যায় আমেরিকার দাসপ্রথা নিয়ে প্রথম জানতে পারা, তারপর ঢাকায় এসে টেলিভিশনে রুটস সিরিজ দেখা এবং জানা আরো গভীর হয়েছিল। অনেকেই জানেন যে আঙ্কল টমস কেবিন বইটিকে আমেরিকার সিভিল রাইটস আন্দোলনের অগ্নস্ফুিলিঙ্গ মনে করা হয়। আমি পড়েছিলাম বাংলা অনুবাদ, কার অনুবাদ মনে নেই। কিন্তু সেই কেন্টাকির এক কৃষক ঋণের কারণে তার সব হারাতে বসলে বাধ্য হয়ে তার দুটি ক্রীতদাসকে বিক্রি করে দিতে মনস্থির করে। এই ক্রীতদাসের একজন ছিল আঙ্কল টম। বাইবেলের পরে এই বই বিক্রির দিক থেকে এক নম্বরে ছিল। এর প্রভাব এতটাই বেশি হয়েছিল যে দাসপ্রথার পক্ষের লোকেরা এই উপন্যাসের বিরুদ্ধে কয়েকটা উপন্যাস ছেপেছিল। যেমন আন্ট ফিলিসেস কেবিন। আমরা যেমন বাংলা সাহিত্যেও এ রকম পালটাপালটি দেখতে পাই ধর্মীয় দ্বন্দ্ব থেকে, যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীর বিপরীতে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী লেখেন রায়নন্দিনী।

যদিও সাহিত্যের মূল্য বিচারে অনেক তাত্ত্বিক আঙ্কল টমস কেবিনকে ঊনবিংশ শতকের টিপিক্যাল সেন্টিমেন্টাল উপন্যাস বলবেন, আমি নিজেও তা-ই মনে করি; কিন্তু এই গ্রন্থের ব্যাপক প্রভাবকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর সেই ছোটবেলায় পড়া সেন্টিমেন্টাল উপন্যাস বলেই এই উপন্যাস আমার আজকের জোরালো কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে অবস্থানের মানসপ্রতিমাকে আকৃতি দিয়েছে বলা যায়। আঙ্কল টমস কেবিনের লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টৌর ছোটবেলা যেখানে কেটেছিল বা যেখানে বসে এই উপন্যাস রচনা করেছিলেন তা দেখেছি অনেক পরে। সেই জায়গাটি হলো কেন্টাকি, ইন্ডিয়ানা আর ওহাইও স্টেটের মিলনস্থল যে জায়গাটিকে ট্রাই স্টেট বলা হয়। পাশেই ওহাইও নদী। যে নদীর রূপ বর্ণনা পড়েছিলাম আঙ্কল টমস কেবিন উপন্যাসে যখন মিসিসিপি নদী দিয়ে দাসদের নিউ অরলিয়েন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সেই বাড়ি, যেখানে এই লেখক জন্মেছিলেন, ছোটবেলা কাটিয়েছিলেন। বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় তাদের অবস্থা বেশ সচ্ছল ছিল। কিন্তু সেই সচ্ছলতার মধ্যে থেকেও হয়তো দেখেতে পেরেছিলেন দাসদের অমানবিক যন্ত্রণা। একজন সত্যিকারের লেখকের চোখ তো তা-ই; সকলের চোখের সীমানা যেখানে শেষ, সেখানেই তার শুরু হয়। এ রকম ঐতিহাসিক জায়গায় এলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এই যে এক ব্যাখ্যাতীত গ্রন্থি, মায়া, এই বুঝি জীবনের অন্য নাম, মানবজীবনের অপার সার্থকতা!

এই গ্রন্থের প্রভাব সেই ছোটবেলা থেকে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই যখন একটু বড় হয়ে ঢাকায় পড়তে এলাম তখন জানলাম দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে পৃথিবীর আরো অনেকের মতো আমারও একধরনের অবসেশন আছে। এই অসাধারণ মানুষটির আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব আমাকে শুধু মুগ্ধই করে না, জীবনের অনেক ক্ষেত্রে প্রেরণাও জোগায়। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম এমন এক সমাজব্যবস্থার মধ্যে, যেখানে নিজ দেশে কালো মানুষেরা ক্রীতদাসের মতো নিগৃহীত, অত্যাচারিত ছিল। স্কুলবয়সেই ছাত্র-নেতৃত্বে অংশগ্রহণের দায়ে বরখাস্ত হন তিনি। তারপর থেকে ক্রমাগত সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় নেতা, তথা সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় নেতায় পরিণত হন তিনি। ১৯৬২ সালে বর্ণবাদী সাদাদের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার বিনা অনুমতিতে দেশত্যাগের দায়ে তাকে অভিযুক্ত করে। সেই মামলায় নিজের পক্ষে নিজেই আইনজীবীর ভূমিকা পালন করেন নেলসেন ম্যান্ডেলা। প্রহসনের সেই মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে কালো মানুষদের মুক্তির আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল বর্ণবাদী শাসকেরা। দীর্ঘ প্রায় আটাশ বছর কারাবন্দী ছিলেন তিনি। বহুবার নানা শর্ত দিয়ে মুক্তির লোভ দেখিয়েছে শাসকের দল। নিজের অপরিসীম দুর্ভোগের মধ্যেও মাথা নত করেননি তিনি, বরং বিপ্লবী স্পর্ধায় উত্তরে বলেছেন অসাধারণ সেই উক্তি, ‘অনলি আ ফ্রি ম্যান ক্যান নেগোশিয়েট।’ ১৯৮৮ সাল। পৃথিবীব্যাপী নেলসন ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ চলছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আমি তখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সারাদেশ থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে এক লক্ষ সাক্ষর সংগ্রহের কাজ করছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। সেই আন্দোলনের সঙ্গে আমিও জড়িয়ে গেলাম। এই উপলক্ষে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। আমার ইচ্ছা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে লেখা কোনো গান শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো। কিন্তু কোথাও কোনো গান খুঁজে না পেয়ে নিজেই দুটো গান লিখে ফেললাম। তখন আমি সবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে গান লেখা শুরু করেছি। সেই সূত্র ধরে বেশ কয়েকজন কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। সামিনা চৌধুরী আমার প্রিয় শিল্পীদের একজন এবং ভালো বন্ধুও বটে। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে গাইবার সম্মতি দিলেন। সামিনার গাওয়া ‘নেলসন ম্যান্ডেলা, তুমি সবল দুটি হাতে লোহার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছো’ সেই গানটির সুর করলেন নকিব খান। দ্বিতীয় গানটি গাইবার জন্য বললাম গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীরকে। তিনিও এক কথায় রাজি হলেন। কিন্তু তাঁর জন্য লেখা ‘কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটির তখনও সুর দেয়া হয়নি, এদিকে সময়ও কম। আমি নিজেই গানটিতে সুর দিয়ে একটি ক্যাসেটে রেকর্ড করে পৌঁছে দিলাম তাঁর কাছে। সেদিন মিটফোর্ডের হলভর্তি মানুষকে মুগ্ধ করলেন এই শিল্পীদ্বয় আর নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে সংগৃহীত হলো অসংখ্য স্বাক্ষর। সামিনা যদিও তাঁর গানটি আর অন্য কোনো মাধ্যমে গাননি, কিন্তু ফকির আলমগীর মিটফোর্ডের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলা একাডেমি বইমেলা, জনতার মঞ্চ ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে বাংলাভাষীদের মধ্যে পৌছে দিলেন গানটিকে। এমনকি গানটির একটি ক্যাসেট খোদ নেলসন ম্যান্ডেলাকেও পৌঁছে দেয়া হয়েছিল।

সেই নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা যাবার সুযোগ এল এই ঘটনার ঠিক বার বছর পর, ২০০০ সালে। সেখানে আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। সেবার আমি আমেরিকা থেকে গেলাম পেপার প্রেজেন্ট করতে। আর আমার স্ত্রী তৃষ্ণা এল বাংলাদেশ থেকে ইউএনডিপির স্কলারশিপ নিয়ে। ও তখন কেয়ার ইন্টারন্যাশনালে এইডস নিয়ে কাজ করত। দুজনের প্রায় এক বছর পরে দেখা হবে। সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট থেকে ও ইমেইল করেছে যে যদি আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপার না থাকত ও ফিরে চলে যেত। কারণ, ভীষণ জ্বর! যখন সাউথ আফ্রিকার এয়ারপোর্টে থেকে ওকে নিয়ে গেলাম তখন আমি সমানে বকে যাচ্ছি, এত ফ্যাকাসে হয়ে গেছ কেন? দেশে গিয়ে ঠিকমতো নিজের যত্ন নাও নাই, খাও নাই, এনিমিক হয়ে গেছ। ও আমার হাত ধরে শুধু বসেছিল। দেখি মুখের মাড়ি থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। আবার বকা, উহ! দেশে গিয়ে একটু ডেন্টিস্টের কাছে যাও নাই। এরপর যখন উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হলো, নেলসল ম্যান্ডেলা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তখন ও বমি শুরু করল। আমি কোনোমতে উদ্বোধন শেষ করে ওকে নিয়ে গেলাম কনফারেন্সের ফার্স্ট-এইড সেন্টারে। সেখানে একটি আফ্রিকান কালো জুনিয়র ডাক্তার। বললাম, জাস্ট স্যালেইন দিয়ে দাও। বেচারা আমরা দুজনই ডাক্তার শুনে একটু নার্ভার্স হয়ে গেল মনে হয়। ভেইন খুঁজে পায় না। তারপর বলে, কিচ্ছু চিন্তা করো না, আমি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে দিচ্ছি। একটা ক্লিনিকে নিয়ে স্যালাইন দেবে। তোমাদের টাকা-পয়সা দিতে হবে না। কিন্তু তখন জানতাম না এই নতুন ডাক্তারটি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে না দিলে আমরা স্যালাইন দিয়েই হোটেলে ফেরত যেতাম এবং তৃষ্ণাকে আর হয়তো বাঁচানোই যেত না! ক্লিনিকে সব ইংল্যান্ড থেকে পাশ করা শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার। ওরাও ভেইন খুঁজে পায় না। ডাকা হলো সিনিয়র প্রফসরকে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করালেন। পরবর্তী দশ দিন যমে-মানুষে টানাটানি। কিন্তু কেউ ডায়াগনোসিস করতে পারছে না কী হয়েছে। চিকিত্সা হলো ভীষণ ভালো, কিন্তু সিম্পটোমেটিক। রক্ত দেয়া হলো, স্যালাইন তো চলছেই। সব টেস্ট নেগেটিভ। দশ দিন পরে একটু ভালো হলো ও। বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকা ফেরত যেতেই হলো। গিয়েই এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বারডেম হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গে ডায়াগনোসিস হলো, ডেঙ্গেহেমোরিজিক ফিভার, যা সেবারই প্রথম বাংলাদেশে এপিডেমিক আকারে দেখা দিয়েছিল। এই রোগে শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে রক্ত বের হতে হতে শকে মারা যায় মানুষ। সেদিন ঐ তরুণ ডাক্তারটি এ জন্যেই ভেইন খুঁজে পায়নি, আর যদি সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শকের চিকিত্সা না পেত, হয়তো আর কিছুই করার থাকত না। সেদিন সেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে খুব বুঝেছিলাম কতখানি ভালোবাসি। ভালোবাসা তো এ রকমই, বাতাসের মতো; সব সময় এর মধ্যে থাকলে বোঝা যায় না, যখন তা চলে যেতে থাকে তখন মানুষ বুঝতে পারে তা কী অনিবার্য বেঁচে থাকার জন্যে। সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞবোধ করেছিলাম আফ্রিকান সেই ডাক্তারদের প্রতি।

দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে বিশ্বএইড সম্মেলন, নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে গান লেখা এবং সুর করার নানান গল্প লিখেছি পত্রপত্রিকায় এবং আমার কলাম সমগ্র ‘পথ হারানোর পথ’-এ। নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে লেখা আমার পুরো গানটির কথা তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না, কারণ এই গানের বাণীও আমার কালোদের প্রতি, তথা বর্ণবাদ বিরোধিতা এবং সংগ্রামি মানুষের মুক্তির প্রতি সমর্থনের বড় রকমের সাক্ষ্য বহন করে :‘কালো কালো মানুষের দেশে, ঐ কালো মাটিতে/ রক্তের স্রোতের শামিল/ নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্তমিল/ তোমার চোখেতে দেখি স্বপ্ন-মিছিল/ অগুনতি মানুষের হূদয়ের মিল/ শৃঙ্খল শিখিয়েছে শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিতে আজ/ রক্তের উষ্ণতা, মুক্তির মন্ত্রণা বিপ্লবী শ্রমিকের হাতুড়ির দৃঢ় কারুকাজ/ কারাগার ভেঙ্গে আসে প্রতিবাদী এক গাংচিল/ মৃত্যুর দরজায় করাঘাত করে আসে যুদ্ধ/ বিপ্লব আসবেই আফ্রিকা হাসবেই, অগণিত কালো হাত পৃথিবীকে করবেই শুদ্ধ/ মেঘের আকাশ হবে পতাকায় শোভিত সুনীল/ শুভ হোক তোমার জন্মদিন/ শুভ হোক তোমার মুক্তির দিন’

এই গানের অনেক কিছুই সত্যি হয়েছে। এই গান লেখার দু বছর পরেই নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পেয়েছিলেন কারাগার থেকে। আফ্রিকা হয়েছে শৃঙ্খলমুক্ত। কিন্তু বর্ণবাদের প্রভাব শেষ হয়নি। এমনকি আমেরিকার বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থায়ও বর্ণবাদ ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে।

স্বভাবতই আমি যখন হার্ভার্ডে পড়তে এলাম, জানলাম এটা পৃথিবীর সেরা ইউনিভার্সিটি, মুক্তচিন্তার সূতিকাগার, তখন মাথায় ঘুরতে থাকে কারা কারা এই ক্যাম্পাসে এই বিষয়গুলো নিয়ে বড় মাপের কাজ করছেন। শুরুতেই ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গিয়ে বোস্টন পুলিশ, যেখানে আইরিশ-আমেরিকান সাদাদের প্রাধান্য আছে, আমার একটা বাজে অভিজ্ঞতা হলো। আমি ঘণ্টা হিসেবে একটা গাড়ি ভাড়া করে লাইসেন্স নেবার পরীক্ষা দিতে গেলাম সকাল দশটায়। সেটাই আমার অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময়। কিন্তু একজন পুলিশ অফিসার আমাকে না নিয়েই টেস্ট নিতে বাইরে চলে গেলেন। এদিকে আমার তো ঘণ্টায় টাকা গুনতে হচ্ছে ভাড়া করা গাড়ির জন্যে। ফিরে এলে যখন তাকে বললাম, পুলিশ অফিসার বলে, বিকেল তিনটায় আসো, ইউ মিসড ইউর অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আমার মহা রাগ হয়, কারণ এটা অন্যায়। তাঁকে বুঝিয়ে বললাম যে আমি তো দশটাতেই এসেছি। কথাবার্তার একপর্যায়ে অনেকটা মুখ ফসকে আমি বলে ফেলি, ‘হোয়াই আর ইউ হ্যারেসিং মি?’ আমি তো আর জানি না আমেরিকায় ‘হ্যারেসমেন্ট’ একটা বিরাট অপরাধ। আমি তাঁকে সেই বিরাট অপরাধে অভিযুক্ত করছি। তাই পুলিশ অফিসার রেগে গিয়ে তার হ্যান্ডকাফে হাত দিলেন। হার্ভার্ডে যখন ছাত্রদের অরিয়েন্টেশন হয় তখন অনেক কিছুই শিখিয়ে দেয়া হয়। কখন কী করা উচিত, কার স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত ইত্যাদি। সেখানে শিখেছিলাম, কোনো পুলিশ অফিসার যদি হ্যান্ডকাফ বের করে তোমাকে অ্যারেস্ট না করে (কারণ অ্যারেস্ট করতে যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে হবে পুলিশকে), তখন সেই পুলিশ তোমাকে ভয় দেখল যা আইনসঙ্গত না। আমার এইবার সব শেখানো বিষয় মনে পড়ে গেল। আমি আমার হার্ভার্ডের ছাত্রের আইডি বের করে দিয়ে বললাম, ‘তোমার সুপারভাইজারকে ডাকো। আর আমি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির লিগ্যাল অফিসকে জানাচ্ছি’। হার্ভার্ডের স্টুডেন্ট’স লিগ্যাল অফিসের কথা শুনে মুহূর্তে পুলিশের আচরণ পাল্টে গেল। বলল, ‘তুমি চলে যাও। আমরা বিনা ফি-তে তোমার টেস্ট নেব আরেক দিন।’ বাসায় ফিরতে না ফিরতে পুলিশ শেরিফের ফোন এল। পারলে বাসায় লাইসেন্স দিয়ে দেয় আরকি। বলল, ‘তুমি যেখানে যে শহরে টেস্ট দিতে চাও আমরা সেখানেই বিনা খরচে টেস্ট নেব।’ আমি আবার গাড়ি ভাড়া করতে চাইনি। তাই এন্ডোভার নামের শহর, যেখানে ইকবাল হোসেন এবং মঞ্জু বিশ্বাস থাকতেন, তাদের ওখানে পরীক্ষা দিলাম ওনাদের গাড়ি দিয়ে। কিন্তু এই ঘটনা আমার মনের মধ্যে বিশাল একটা দাগ কাটল। আজকে আমি হার্ভার্ডের ছাত্র না হলে আমার কী হতো? আমি কি অন্য বর্ণের বলেই এই আচরণ, ইত্যাদি ভাবনা আমাকে পেয়ে বসে।

এখনকার মতো ইন্টারনেট তখন অবাধ ছিল না। তবু চেষ্টা করি সবকিছুর খোঁজখবর রাখতে। ১৯৯৭ সালে হেনরি লুইস গেইট এবং কর্নেল ওয়েস্ট নামের দুজন কালো লেখক, গবেষক, শিক্ষক, দার্শনিকের একটি বই বের হয়, দ্য ফিউচার অব দ্য রেস। বইটি পড়তে পড়তে জানতে পারি, প্রায় শতবর্ষ আগে আরেকজন আফ্রিকান আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং মানুষের অধিকার আদায়ের কর্মী উইলিয়াম ড্যু বয়েজ আফ্রিকান আমেরিকানদের নিয়ে অনেক আগেই একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ড্যু বয়েজ বোস্টনের কাছেই বার্লিংটনে জন্মগ্রহণ করেন এবং পড়ালেখা করেছিলেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে, যিনি ছিলেন প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান ডক্টরেট ডিগ্রিধারী। ড্যু বয়েজ ধারণা করতেন যে কালোদের মধ্যে একটি নেতৃত্ব দেয়ার মতো শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, অভিজাত শ্রেণি তৈরি হবে যারা আফ্রিকান আমেরিকানদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করবে। আমেরিকা যেহেতু ধনবাদী দেশ, এখানে উচ্চশ্রেণি বা অভিজাত শ্রেণিকে মূল্য দিয়েই এদের স্বাধীনতা এবং অন্যান্য সামাজিক উন্নতির কথা ভেবেছে এরা। কালোদের বিরুদ্ধে যেসব অন্যায় এবং অমানবিক সামাজিক নিয়ন-কানুন প্রচলিত ছিল তার বিরুদ্ধে ড্যু বয়েজ এবং তাঁর সঙ্গীরা একটি আন্দোলন তৈরি করেন। এই আন্দোলনকে নায়েগ্রা আন্দোলন বলা হয়। প্রথমত নায়েগ্রা জলপ্রপাতের তীব্র শক্তি এবং প্রবহমানতা প্রতীক হিসেবে নিয়ে এই নামকরণ, অন্যদিকে এই দলটির প্রথম বৈঠক হয়েছিল নায়েগ্রা জলপ্রপাতের কানাডিয়ান অংশে। এই দু কারণেই এটাকে নায়েগ্রা আন্দোলন নাম দেয়া হয়েছিল। ড্যু বয়েজ শুধু আফ্রিকান আমেরিকানদের অধিকার নিয়েই সোচ্চার ছিলেন না, আফ্রিকাসহ এশিয়ার দেশগুলোতে ইউরোপীয় উপনিবেশ এবং আধিপত্যের তীব্র সমালোচক ছিলেন। এই সময় আমেরিকার দক্ষিণের স্টেটগুলোতে জিম ক্রো আইন বলে একটি কুখ্যাত আইন ছিল। যে আইনের মাধ্যমে কালোদেরকে সবকিছু থেকে আলাদা করে রাখা হতো। যেমন সরকারি বাস, স্কুল, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কালোদের জন্যে আলাদা ঘর, বসার জায়গা, বাথরুম, এমনকি কালোদের জন্যে আলাদা বার এবং রেস্টুরেন্ট ছিল। এই সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে করতে ড্যু বয়েজ শুধু একজন আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে নয়, একজন বিশ্ব মানবতার কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি প্যান আফ্রিকান আন্দোলন সৃষ্টি এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। এ জন্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা পৃথিবী। একসময় রাশিয়া সফরে গিয়ে কমিউনিজমের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি নিজে মার্ক্স বা লেলিনের মতবাদ নিয়ে তেমন পড়ালেখা না করলেও একসময় মনে করেন যে সোশ্যালিজম বা কমিউনিজম হয়তো কালোদের মুক্তি এনে দিতে পারে। স্বভাবতই তিনি আমেরিকান সরকারের রোষানলে পড়েন এবং বহুবার তাঁর পাসপোর্ট সরকারিভাবে আটকে দেয়া হয়। ড্যু বয়েজের মায়ের দিকের পরিবার পশ্চিম আফ্রিকার ক্রীতদাস ছিল। সে কারণেই আরো বেশি আফ্রিকা নিয়ে তাঁর কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়েছিল। ড্যু বয়েজ আটাশটির বেশি গ্রন্থের প্রণেতা। উপন্যাস লিখেছেন, লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ এই বর্ণবাদ এবং সিভিল রাইট নিয়ে। একবার ১৯৫৭ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানার বিজয় দিবস স্মরণের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন কিন্তু আমেরিকান সরকার তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করে নেয়। এর পরের বছর পাসপোর্ট ফেরত এলেও ঘানার সরকারের অনুরোধে একটি প্রবাসী আফ্রিকানদের এনসাইক্লোপিডিয়ার কাজ করতে গিয়ে তিনি ঘানার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময় তিনি ঘানার রাজধানী আক্রাতে একটি বাড়ি নিয়ে সস্ত্রীক থাকা শুরু করেন। কিন্তু এ সময় তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে এবং অগাস্ট ২৭, ১৯৬৩ সালে ৯৫ বছর বয়সে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

আমি আমার গবেষণার কাজে পশ্চিম আফ্রিকায় বিশেষ করে ঘানা গিয়েছি বেশ কয়েকবার। ঘানার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব মেডিসিনের স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার, নার্সদের শিক্ষা দিয়ে রোগ এবং সামাজিক সমস্যার সমাধান করা ছিল সেই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য। যতবার ঘানা গিয়েছি ততবার আক্রায় ড্যু বয়েজের বাড়ি, যা এখন একটি মিউজিয়াম হিসেবে রাখা হয়েছে, সেখানে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছি।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির হাটচিন্স সেন্টার ফর আফ্রিকান অ্যান্ড আফ্রিকান আমেরিকান রিসার্চ ঘিরে এই আফ্রিকান আমেরিকান পণ্ডিত বা বুদ্ধিবীজীদের কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়েছে। এই সেন্টারের পরিচালক তখন দ্য ফিউচার অব রেস গ্রন্থের সহ-প্রণেতা হেনরি লুইস গেটস। হেনরি লুইস গেইটস একাধারে হার্ভার্ডের প্রফেসর, চলচ্চিত্রকার, সাহিত্য সমালোচক, সাংবাদিক এবং কালোদের অধিকার আদায়ের অ্যাক্টিভিস্ট। ১৯৯৭ সালে তিনি আমেরিকার ২৫ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে নির্বাচিত হন। আমেরিকান পাবলিক ব্রডকাস্টিং যা পিবিএস নামে পরিচিত সেখানে আফ্রিকান আমেরিকানদের ইতিহাস নিয়ে পঁচিশেরও অধিক ডকুমেন্টারি ফিল্ম বা তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। গ্রন্থ লিখেছেন কুড়িটিরও বেশি। অন্যদিকে কর্নেল ওয়েস্ট একজন দার্শনিক, একাডেমিক, বুদ্ধিজীবী, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট গ্রুপের সক্রিয় সদস্য এবং অ্যাক্টিভিস্ট। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা করে সেখানেই শিক্ষকতা করেছেন। তবে হার্ভার্ডের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা সেই ড্যু বয়েজ ফেলোশিপের মধ্য দিয়ে। এখন পর্যন্ত কুড়িটির ওপরে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং এখনও লিখছেন। এই শিক্ষক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দলের লেখা, কাজ এবং বক্তৃতামালা শুনে আমার নিজের মানসেও দীর্ঘদিনের জমে থাকা অবদমিত মানুষের প্রতি পক্ষপাত একটি যৌক্তিক রূপ পেয়েছিল।

আমেরিকায় দাসপ্রথা, বর্ণবাদ, আফ্রিকান আমেরিকানদের নিয়ে কাজ করার স্পৃহা— সবকিছুর মূলে সেই অবদমিত জনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন থেকেই এসেছে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরাও তো দীর্ঘদিনের নির্যাতন, অবদমনের শিকার; কিন্তু তা কোনোভাবেই আফ্রিকানদের দাসত্বের সঙ্গে তুলনীয় নয়। দাসপ্রথা এমন একটি আদিপ্রথা যা বিভিন্ন সমাজে, দেশে প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টের জন্মের ১৭৬০ বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া ব্যবিলনের আইনের যে নির্দেশনাগুলো পাওয়া যায়, যাকে কোড অব হামুরাবি বলে, তাতে দাসপ্রথার উল্লেখ ছিল। দাসপ্রথা আদি শিকারি সমাজে ছিল না এটা বুঝতে পারা যায়। কারণ সামাজিক শ্রেণিকরণের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রথার উত্পত্তি হয়েছে। দাসপ্রথা পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন সভ্যতায় যেমন, গ্রিস, মিশর, পারস্য এবং মুসলমান খলিফাদের সময়েও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু মানুষের রং বা আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিভাজন আমাকে সব সময় আকৃষ্ট করেছে চিকিত্সা-নৃবিদ্যার কারণে।

মানুষের আঙ্গিক-বৈশিষ্ট দিয়ে মানুষকে গোষ্ঠীতে বিভাজন কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ আধুনিক। পুরনো সভ্যতায়, যেমন গ্রিক সমাজে মানুষকে সমপ্রদায়ে ভাগ করা হতো ধর্ম, অর্থনৈতিক শ্রেণি ইত্যাদির ভিত্তিতে, যেমন ভারতে হিন্দুধর্মের ভিত্তিতে কৌলিন্য ভাগ করা হতো বা এখনও হয়। ইংরেজি ভাষায় রেস শব্দটির প্রকৃতপক্ষে কোনো অস্তিত্ব ছিল না এবং এটি প্রথম পাওয়া যায় ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে কবি উইলিয়াম ডানবারের একটি কবিতায়। এরপর মানুষকে আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য দিয়ে ককেশিয়ান, মঙ্গোলয়েড, নিগ্রয়েড ইত্যাদি গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়েছে। এরপরে আবারো মানুষের মূল চারটি পিতৃ-শাখা হিসেবে বলা হয়েছে আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান, ইস্ট এশিয়ান এবং নেটিভ আমেরিকান। সুতরাং বলা যায় যে দাসপ্রথার মতো রেস ততটা প্রচীন ধারণা নয়। মানুষকে বর্ণ দিয়ে বিভক্ত করে তাদের দাসের মতো পণ্য হিসেবে ব্যবহারের এই ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন। এমনকি পশ্চিমা বিশ্ব দাস-ব্যবসা শুরু করার আগে উত্তর-আফ্রিকার জলদস্যুরা ব্রাইটন এবং অন্য ইউরোপিয়ানদের পাচার করে নিয়ে যেত আফ্রিকায়। ধারণা করা হয়, এ রকম প্রায় ১.২৫ মিলিয়ন বা সাড়ে বার লাখ ইউরোপীয় সাদাকে দাস বাণিজ্যে আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ১৫০০-১৮০০ সালে।

আমেরিকাতে আফ্রিকার কালোদের দাস হিসেবে নিয়ে আসা শুরু হয় ১৬০৭ সালের দিকে। তারও আগে ১৫২৮ সালে নর্থ ক্যারোলাইনাতে ইউরোপের ঔপনিবেশিক দল আফ্রিকা থেকে দাস নিয়ে এসে আস্তানা গাড়তে ব্যর্থ হয়। এভাবে কয়েক দফা ব্যর্থতার পরে একজন ডাচ সৈনিক ১৯১৬ সালে কুড়িজন দাসের একটি দলকে নিয়ে আসে ভার্জিনিয়ার জেমস টাউন শহরে।

এই কুড়ি জনের মধ্যে একজনকে তার মালিক মুক্ত করে দেয়। মজার ব্যাপার হলো, প্রথম সেই মুক্ত কালো আফ্রিকান ছিলেন এন্থোনি জনসন, যিনি নিজে একজন আফ্রিকান চাকরকে নিজের করে রাখতে গিয়ে এই দাসপ্রথাকে প্রায় আইনসিদ্ধ করে ফেলেন। এন্থোনি জনসনকে আফ্রিকা থেকে ইন্ডেঞ্চারড সার্ভেন্ট হিসেবে নিয়ে আসা হয়। যার অর্থ হলো তার কিছু দেনা ছিল বা শর্ত ছিল যে পাওনা টাকা কাজ করে শোধ করবে। এন্থোনি জনসন পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন এবং টাকা শোধ করার পরে টাকা বাঁচিয়ে আফ্রিকা থেকে দাস নিয়ে আসা শুরু করে। সে-ই প্রথম একটি ভার্জিনিয়া কোর্টকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে তার চাকরদের একজন তার আজীবন দাস। এন্থোনি জনসন আফ্রিকা থেকে দাস নিয়ে আসার জন্য প্রতি দাসের জন্যে ৫০ একর করে জায়গা পেয়েছিলেন। তার এই প্রথাই এক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, পরবর্তীকালে তার জমিজমা সব কেড়ে নিয়ে সাদাদের দিয়ে দেয়া হলো এই বলে যে সে নিজেও নিগ্রো, সুতরাং তার অধিকার নাই জমির মালিক হবার। এই ঘটনার অর্থ এই নয় যে কালোরাই মূলত দাসপ্রথা চালু করেছে। রবং এই ঘটনাকে অজুহাত করে এই ভার্জিনিয়ার জেমসটাউন শহরে দাসপ্রথাকে আইনসিদ্ধ করে নেয়।

এভাবে ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ১২ মিলিয়ন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ দাস নিয়ে আসা হয় দক্ষিণ আমেরিকায়। এরা আমেরিকার ১৫টি অঙ্গরাজ্যে সাদাদের অধীনে ছিল। কালোদের ওপর দাসপ্রথা তথা বর্ণবাদের অত্যাচারের করুণ ইতিহাস কে না জানে। দিন-রাত প্রাণান্ত, অমানুষিক খাটুনি, চাবুকের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত পিঠের চামড়া, পশুদের সঙ্গে থাকা থেকে শুরু করে কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে এই দাসদের চলাফেরা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল।

আমি নিজে যখন পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে গিয়েছি তখন স্বচক্ষে দেখেছি সেই সব জায়গায় ইউরোপিয়ান বণিকদের অমানবিক দাস ব্যবসার নিদর্শন। যেমন ঘানার দক্ষিণ প্রান্তে গালফ অব গিনি সাগরের তীরে কেপ কোস্ট শহরের কাছে অনেকগুলো এ রকম পুরনো দুর্গ দেখতে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে অন্যতম কুখ্যাত দুর্গটির নাম এলমিনা ক্যাসল। এখানে সমুদ্রের তীরের আশেপাশের এলাকা থেকে কালোদের ধরে এনে আটকে রাখা হতো। তারপর জাহাজে করে পাঠিয়ে দেয়া হতো ক্যারিবিয়ান দেশগুলোতে এবং উত্তর আমেরিকায়। এই দুর্গের ভেতরে নানান প্রকোষ্ঠে অত্যাচার করা হতো কালোদের। ধর্ষণ, নির্যাতন, বশ মানানোর সব রকমের প্রচেষ্টা। কথা না শুনলে মৃত্যুকূপে আটকে রাখা হতো তাদের। আমি এ রকম একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিজেকে আটকে রেখে ওখানকার গাইডকে বলেছিলাম দরজা বন্ধ করে দিতে, শুধু অনুভব করতে চেয়েছিলাম এই রকম অন্ধকার, ভীতিকর একটি কোঠায় কিভাবে দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করেছে ওরা। আমি দুই মিনিটও টিকতে পারিনি। যাহোক, দাসপ্রথা টিকিয়ে রেখে অনেক অর্থনৈতিক ফায়দা লুটেছে বহুজন। সেই সঙ্গে ধর্মগ্রন্থের নানান উপাদান দিয়ে দাসপ্রথাকে আরো জায়েজ করে নিয়েছে কেউ কেউ। কারণ, ধর্মগ্রন্থগুলো বিশেষ করে বাইবেলে দাসপ্রথা স্বীকার করে নেয়া হয় এমনকি তাদের ওপরে শাস্তির অধিকারও দেয়া আছে।

কিন্তু এই দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সেই শুরু থেকেই প্রতিবাদ হতে থাকে মানবিক কারণে, প্রতিবাদ হয়েছে ১৬৬৩ সালে ভার্জিনিয়াতে, ১৬৮৮ সালে ফিলাডেলফিয়াতে। তবে আমেরিকার অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ভারমন্ট সর্বপ্রথম দাসপ্রথা রোহিত করে দেয় সেই ১৭৭৭ সালে। তারপরও প্রায় এক শতাব্দী পার হয়ে যায় দাসপ্রথা পুরোপুরি রোহিত করতে; প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে আইন স্বাক্ষর করেন এবং ১৮৬৫ সাল থেকে সংবিধানে ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে আমেরিকাতে দাসপ্রথার অবলুপ্তি ঘটে।

আইনগতভাবে দাসপ্রথার অবলুপ্তি ঘটলেও কালোদের মানুষ হিসেবে পূর্ণাঙ্গ অধিকার পেতে কিন্তু আরো এক শতাব্দী পার হয়ে গেছে। আমেরিকাতে দাসপ্রথার অবলুপ্তি ঘটলেও সেগ্রিগেশন বা বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে সাদারা কালোদেরকে সামাজিকভাবে আলাদা করে রেখেছিল। মাত্র ১৪৩ বছর আগেও দাসপ্রথা ছিল আইনসিদ্ধ, মাত্র ৪৩ বছর আগেও কালোদের ছিল না কোনো ভোটাধিকার, মাত্র ৪৪ বছর আগেও কালোরা পারত না সাদাদের সঙ্গে এক স্কুলে যেতে, বা একবাসে একসঙ্গে বসতে, বা এক রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে। এই সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় এবং মারটিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে সিভিল রাইট আন্দোলন শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে। এই সেদিন, ১৯৬৪ সালে সিভিল রাইট অ্যাক্ট এবং ১৯৬৫ সালে আফ্রিকান আমেরিকান ভোটার অ্যাক্ট পাশ করানো হয়।

এখন সঙ্গত প্রশ্ন, মানুষকে আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য দিয়ে শ্রেণিভুক্ত করার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি? বা এর সামাজিক প্রভাবই বা কী? বিশেষ করে আমেরিকার মতো দেশে? গত এক দশকে চিকিত্সাবিজ্ঞানের একটি শাখা জেনেটিক বা বংশগতিবিদ্যায় বিপ্লব ঘটে গেছে। এটা এতটাই জটিল যে মেডিকেল স্কুলের ছাত্রদের জন্যেও কঠিন বিষয়। তারপরও আমি যতটা সম্ভব সাধারণ পাঠকের জন্য উপযোগী করে বলার চেষ্টা করব। এই বিষয়গুলো বোঝা অত্যন্ত জরুরি বর্ণবাদ, বর্ণবাদের ভবিষ্যত্ এবং মানুষের প্রত্যাশাকে বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করার জন্য। আগে মনে করা হতো যে ককেশিয়ান, মঙ্গোলিয়ান বা নিগ্রয়েডদের মধ্যে বিরাট জেনেটিক পার্থক্য আছে। আজকাল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে মানুষের ভেতরে কত ভাগ আফ্রিকান বৈশিষ্ট্য, কত ভাগ ইউরোপিয়ান বা ককেশিয়ান বা এশিয়ান বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তা একেবারে শতকরা হিসেবে বের করে ফেলা যায়। মানুষের সমস্ত বৈশিষ্ট্যের ধারক এই জিন যা বাবা এবং মায়ের ক্রমোসমের মাধ্যমে আসে, তাকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেকখানি উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে, যা থেকে বহু পূর্ববর্তী ভুল ধারণা সংশোধন করা সম্ভব।



এক.

মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রেস বা গোত্র বলে কিছু নেই। পৃথিবীর যেকোনো দুজন মানুষের মধ্যে জেনেটিক বা বংশগতির পার্থক্য মাত্র শতকরা এক ভাগেরও কম। শুধু তাই নয়, একই গোত্রের লোকদের মধ্য এই জেনেটিক পার্থক্য অন্য গোত্রের লোকদের চেয়ে বেশি। ব্যাপারটা কেমন একটু উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। ধরা যাক, বাংলাদেশের একজন তথাকথিত সম্ভ্রান্ত বংশের লোক, যিনি গৌর বর্ণ, দীর্ঘদেহের অধিকারী, এবং দাবি করেন যে তাঁর শরীরে উচ্চবংশের রক্ত প্রবহমান। অন্যদিকে একজন তথাকথিত নিম্নবংশীয়, খর্বকায়, কালো সাধারণ মানুষ যার কোনো উচ্চবংশের দাবি নেই। এই দুই জনের ডিএনএ বিশ্লেষণ করলে তাদের মধ্য পার্থক্য পাওয়া যেতে পারে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, যদি এদের দুজনকে আফিকার কোনো কালো মানুষের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তার চেয়ে। এর মানে হলো, বাংলাদেশের এই অপেক্ষাকৃত সাদা লোকটির জেনেটিক বা বংশগত বৈশিষ্ট্য আর আফ্রিকার কালো লোকটির বংশগত বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম, পার্থক্য থাকলেও মাত্র এক শতাংশের পার্থক্য। তাহলে গায়ের রং আর গোত্র থেকে কোনো মানুষকেই বৈজ্ঞানিকভাবে শ্রেয় বা শ্রেয়তর বলা যায় না। অথচ হিটলারের বুদ্ধিদাতাদের ধারণা ছিল, তাদের শরীরে উচ্চবংশের নীলরক্ত প্রবহমান, সুতরাং তারাই রাজার শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। যেমন আমেরিকার সাদারা ওই ধারণা থেকে দীর্ঘদিন কালোদের ওপর বর্ণবাদী অত্যাচার চালিয়েছিল। পৃথিবীর সব সমাজেই কমবেশি এই ধারণা বিদ্যমান।



দুই.

বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে মানুষের পূর্বপুরুষদের সন্ধান করা সম্ভব হয়েছে। এই গবেষণার নাম অ্যানসেসটর স্টাডি। পৃথিবীর সব ধরনের গোত্রের মানুষ যেমন আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান, দক্ষিণ এশিয়ান, মঙ্গোলিয়ান ইত্যাদির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, মানুষের পূর্বপূরুষ বা আদিপুরুষ এসেছে আফ্রিকা থেকে। কিভাবে এটা জানা যায়? মানুষের শরীরে এক ধরনের ডিএনএ থাকে যাকে বলা হয় মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ যা শুধু মায়ের কাছ থেকে আসে। এটা অনুসরণ করে মানুষের আদি মাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে, যিনি আফ্রিকাতে ছিলেন। যেমন আফ্রিকা থেকেই মানুষ প্রথম পৃথিবীর অন্যদিকে পা বাড়িয়েছিল। এই মানুষ প্রথমে আসে দক্ষিণ এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায়। সে কারণেই মালয়েশিয়ার অধিবাসীদের মধ্য আফ্রিকানদের সঙ্গে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই আবিষ্কার আরো একটি বড় জোরালো প্রমাণ আনে নারীবাদী আন্দোলনের পক্ষে।



তিন.

দাসপ্রথার পক্ষে অনেক যুক্তি খাড়া করেছিল মানুষ। তার মধ্য একটি হলো, কিছু মানুষ বংশগতির দিক থেকে নিম্নমানের, যেমন আফ্রিকানরা। তাই তাদের দিয়ে দাসের কাজ করিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করা কোনো অনৈতিক কাজ নয়। বলাই বাহুল্য, খোদ আমেরিকাতে সেই সময়ের সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ হয়েছে দাসপ্রথার যুগে। এই ধারণার আরেক সংস্করণ আধুনিক যুগেও অন্যভাবে দেখা গেছে। যেমন, বলা হতো বা হয় যে কিছু কিছু জাতি, যেমন আফ্রিকান আমেরিকানরা জেনেটিক কারণে বেশি রোগে আক্রান্ত হয়, তাই তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য-বৈষম্য থাকাটা অসমীচীন নয়। আজ প্রমাণিত হয়েছে যে এসবের কোনো কিছুই ঠিক নয়, বিজ্ঞানসম্মত নয়। তাই এই বৈষম্য দূর করার একটা নৈতিক দায়িত্বও এ যুগের উন্নত মানুষের কাঁধে এসে বর্তায়।

দাসপ্রথার অবলুপ্তি ঘটলেও অনেক মানুষের দাসত্ব এখনও শেষ হয়নি। আধুনিক কালে নারী এবং শিশুদের অনেক ক্ষেত্রেই দাসদের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। অন্যদিকে আমেরিকাতে দাসপ্রথা না থাকলেও বর্ণবাদের থাবা আড়ালে-অন্তরালে এমনকি মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে সমাজে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। রেসিজম বা বর্ণবাদ শব্দটি এখন তাই অনেক ভিন্নমাত্রায় ব্যবহূত হয়ে থাকে। রেসিজম শব্দটি এখন আর বর্ণবাদে সীমাবদ্ধ নয় বলা যায়। বরং নিজ সমপ্রদায়ে শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী যে কাউকে বা সামপ্রদায়িক ভেদনীতিতে বিশ্বাসী যে কাউকে রেসিস্ট বলা যেতে পারে। এই শ্রেষ্ঠত্ব বা এক জাতি অপেক্ষা অন্য জাতি উত্কৃষ্ট এবং সে কারণে অন্যের ওপরে কর্তৃত্ব করার অধিকার ফলানো শোষণের একধরনের কৌশলমাত্র। শ্রেণিগত কৌশলের পাশাপাশি এর সামাজিক একটি দিকও আছে। এ জন্য আমরা খুব দৃশ্যমান রেসিজম বা বর্ণবাদ না দেখলেও বাংলাদেশে এর অন্য রকম সামাজিক প্রতিফলন দেখি। যেমন, আমরা বিয়ে করতে সাদা চামড়া খুঁজি, আমাদের কাছে এখনও ফর্সা পরীর মতো সুন্দরের সংজ্ঞা, এখনও আমরা কালোদের কাল্লু নামে ডাকি আর দেশের সংখ্যালঘুদের ডাকি মালাউন। এর সবই বর্ণবাদের বিবিধ রূপ। আমেরিকায় সাদা কর্তৃক রেড ইন্ডিয়ানদের ওপরে, আফ্রিকান কালোদের ওপরে, এশিয়ান বা ল্যাটিনোদের ওপরে আক্রমণ, এছাড়া এখন নানা ধর্মভিত্তিক রেসিজমের যে কালো থাবা তার বিস্তারিত খতিয়ান দেখলে শিউরে উঠতে হয়। একটি সভ্য মানবসমাজের ভবিষ্যত্ বিনির্মাণে এই রেসিজম থেকে মুক্তির কোনো বিকল্প নেই।

আমেরিকার সামাজিক ব্যবস্থায় এই বর্ণবাদ কতটুকু জায়গা দখল করে আছে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। এখানে এই বিশাল একটি দেশ (যাকে মহাদেশ বলাই ভালো), সেখানে দ্বিমুখী বৈশিষ্ট্যের মানুষের, কিংবা বলা যায় বহুমুখী বৈশিষ্ট্যের মানুষের সমারোহ। তাই খারাপ দিকগুলোর পাশাপাশি অনেক ভালো বিষয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি হালকাভাবে একটা বিশ্লেষণ করি এভাবে যে এখানে যেহেতু ইউরোপিয়ান জলদস্যুরা এসেছিল, অপরাধীদের নিয়ে আসা হয়েছিল, এরা জানত মানুষ প্রকৃতপক্ষে আরেকটি পশু। তাই তার পাশবিক দোষকে যেমন আমলে রেখেছে তেমনি ভালো দিকগুলোকে সামনে রেখেই আইন করতে হয়েছে সবকিছুর ভারসাম্য রাখতে। আসলেও কিন্তু তাই, আমেরিকার আইন আর ফাইন সবকিছু ঠিক রেখেছে। এ কারণেই, কেউ কাউকে বর্ণ, ধর্ম বা অন্য কোনো ভিত্তিতে অপমান করলে বা ভেদাভেদ করলে আইনে কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে।

এখানে আমি আমার একটি ব্যক্তিগত গল্প বলি। আমার জীবনের অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে আমি অনেকটা জুয়া খেলেছি। যেমন, সেল মলিকিউলার বায়োলজিতে পিএইচডিতে ভর্তির সুযোগ ও স্কলারশিপ থাকা সত্ত্বেও আমি বারডেমে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনের হেলথ এডুকেশন অফিসারের কাজ নিয়েছিলাম ১৯৯৪ সালে। বন্ধুদের মন্তব্য ছিল, আমি একটা গাধা, মানুষকে গান দিয়ে চিকিত্সা দিতে চাই।

তেমনি আমেরিকার হার্ভার্ড ও ইউএবি থেকে উচশিক্ষা করার পর আমার অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরির অফার আসে যা উচ্চাকাঙ্ক্ষী যে কারো জন্য অত্যন্ত লোভনীয় ছিল। এর মধ্যে খোদ হার্ভার্ডের জসলিন ডায়াবেটিস সেন্টারের চাকরিও ছিল। আমি ২০০৪ সালে গ্রহণ করলাম একটা মধ্যম সারির ইউনিভার্সিটির কাজ। কারণ এটা অন্যতম, প্রাচীন, ঐতিহাসিক কৃষাঙ্গদের বিশ্ববিদ্যালয়। আমার বন্ধুরা আবারও আমাকে গাধা ছাড়া আর কিছু বলতে পারল না। বিশ্বের যেকোনো অবদমিত জাতির বা গোত্রের প্রতি আমি অকুণ্ঠ সমর্থন অনুভব করি। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে নির্যাতিত নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে গান লিখেছি, ‘কালো কালো মানুষের দেশে’, লিখেছি ইরাকের যুদ্ধের বিরুদ্ধে, লিখেছি মুখতারান বিবির পক্ষে, সে রকম আজকে আমার কাছে বারাক ওবামাও ছিল প্রতীকী প্রার্থী। তাঁকে সেই প্রাথমিক নির্বাচন থেকেই সমর্থন করেছি। ক্ষুদ্র ডোনেশন দিয়ে, প্রকাশ্যে স্বেচ্ছাসেবকের সময় দিয়ে, অন্তরের গভীর কামনা দিয়ে। আর এটা করতে হয়েছে নিজের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে। আমি কাজ করি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যে স্টেটের গভর্নর রিপাবলিকান, সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক রিপাবলিকান, শিক্ষা বিভাগের হর্তাকর্তারা রিপাবলিকান, অন্যদিকে আমি তখনও নন-টেনিউর, তারপর মুসলমান নামধারী এক ক্ষুদ্র শিক্ষক। গত আট বছরের আমেরিকার ইতিহাস যারা ভালো করে জানেন তাঁরা জানেন এখানে ঝুঁকিটা কোথায় ছিল।

সে যাই হোক, ফিরে আসি আসল প্রসঙ্গে। বারাক ওবামার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার অর্থ আবার এই না যে এখানে বর্ণবাদ একদম চলে গেছে, বরং বলা যায় যে মানুষের মধ্যে ন্যূনতমপক্ষে বর্ণ নিয়ে বিভেদের প্রাথমিক দেয়ালটা উঠে গেছে। তার পরও ওবামাকে ঠিকমতো অনেক কাজ করতে দেয়া হয়নি বা হচ্ছে না। তার পেছনে বর্ণের একটি ভূমিকা আছে বলে অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন। আমেরিকা সেই ১৯৩০ সালের বিশাল অর্থনৈতিক মন্দার পর এই প্রথম আবার অর্থনৈতিক মহা সংকটে পড়েছে। প্রথমে এ থেকে বাঁচতে হবে। ইরাক যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। তা যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার যে পুলিশি সমরনীতি তাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আমেরিকার ভেতরে যে বৈষম্য তা দূর করতে হবে। বর্ণবাদ, তা শুধু গায়ের রঙের ভিত্তিতেই নয়, অন্য যেকোনো ভিত্তিতে, সে বৈষম্য তাকে পরাস্ত করতে হবে। এই কাজগুলো কি সহজ কাজ? মোটেও নয়। আরো মনে রাখা দরকার যে আমেরিকার যারা তাকে ভোট দেয়নি সেই ৪৬ শতাংশ লোকও থাকবে এই দেশেরই মধ্যেই। এদের কেউ কেউ এতটাই গোড়া যে অতিরিক্ত সাম্যের কথা বলার কারণে তাকে সোশ্যালিস্ট বা বিদেশিদের চর বলতেও দ্বিধা করেনি। আমরা আশা করব, শুধু ওবামার মধ্য দিয়ে নয়, যেকোনোভাবেই হোক না কেন, বর্ণবাদের অবসান হবে, সামাজিক বৈষম্য দূর হবে, ধর্মীয় সহনশীলতা বাড়বে আর মানুষের দারিদ্র্য দূর হবে এই বিশ্ব থেকে। এ থেকে বাংলাদেশের জনগণও যেন শিক্ষা নিতে পারে যে বর্ণবাদের থাবা আমাদের সমাজেও বিদ্যমান। আমরা বিয়ে করতে সাদা চামড়া খুঁজি, আমাদের কাছে এখনও ‘ফর্সা পরীর মতো’ সুন্দরের সংজ্ঞা, এখনও আমরা কালোদের কাল্লু নামে ডাকি আর দেশের সংখ্যালঘুদের ডাকি মালাউন। এর সবই বর্ণবাদের বিবিধ রূপ। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে, আমাদের নির্বাচনে আমরা যেন যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করি, অসাধু-লুটেরা আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকদের বর্জন করি।

১৯৭১ সাল ছিল বাঙালি জাতির ওপর নির্যাতনের চূড়ান্ত রূপ। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের যেন কোনোভাবেই ক্ষমতায় পুনর্বাসিত না করি। আমাদের প্রত্যাশা, মানুষ যেন এক নতুন পৃথিবীর জন্ম দিতে পারে যেখানে গায়ের রং নয়, সামাজিক প্রতিপত্তি নয়, কুল-কৌলিন্য নয়, বরং মানুষের মানবিক গুণাবলি আর মানবিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সৌকর্য হবে বিচারের মানদণ্ড। এই চাওয়া তো অন্যায় কোনো চাওয়া নয়। এই চাওয়ার প্রতি সমর্থন জানাতে যেমন নিজে কাজ করছি কালো মানুষদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কালোদের অধ্যুষিত এলাকায়, এমনকি আফ্রিকায়, তেমনি চাই পৃথিবীর প্রতিটি দেশ এবং সমাজ থেকে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র থেকে শুরু করে সব রকমের বৈষম্য দূর হয়ে যাক। মানুষের বর্ণিল রূপ আর বহুবিধ মন-মননের জন্যেই তো আমরা মানুষ। আমরা যেন সত্যিকারের মানুষই হয়ে উঠিতে পারি, থাকতে পারি সব সময়।

সেজান মাহমুদ