রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭

সংসদীয় গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত ট্রেন | শান্তনু মজুমদার

দেড় দশকের সামরিক শাসন অবসানের পর ১৯৯১ সাল থেকে কখনো ঢিমেতেতালা, কখনো ঝমঝমিয়ে চলতে থাকা সংসদীয় গণতন্ত্রের ট্রেনখানি এক-এগারোতে লাইন থেকে ‘পিছলে যায়’ প্রায় দুই বছরের জন্য। আর এবারের নির্বাচন বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রকে ‘আলুর দম’ বানিয়ে দিয়েছে বলে মনে করে বিস্তর মানুষ। ২০১৪ সালের জানুয়ারির দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। এখন অবধি এবিষয়ক বেশির ভাগ আলোচনা দলমুখী। আবার কখনো কখনো পূর্বনির্ধারিতভাবে কোনো এক পক্ষকে দায়ী করার সীমাবদ্ধতাপীড়িত। এটা মারাত্মক।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকতে চায় এবং বিরোধী পক্ষও যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়। এবারের দুর্ঘটনার কারণ বুঝতে উভয় যেনতেন বুঝতে হবে। ব্যাপারটা এমন নয় যে ক্ষমতাসীনদের যেনতেনর প্রতিক্রিয়া বিরোধীরা পাল্টা-যেনতেন করে বা বিরোধীদের যেনতেনর জবাবে ক্ষমতাসীনেরা রাষ্ট্রযন্ত্রসহ যেনতেনতে নামে; বরং ব্যাপারটা এ রকম যে উভয় পক্ষই ক্ষমতাকে পাখির চক্ষু জ্ঞান করে যেনতেনতে লিপ্ত হয়। এবার, গতবার, তার আগেরবার, তারও আগের বার—সংসদীয় গণতন্ত্রের সেকেন্ড রাউন্ডের শুরু থেকে একই ব্যাপার! এ কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্রবিষয়ক আলোচনায় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী পক্ষের কোনো একটিকে এককভাবে জুলুমবাজ বা কোনো একটিকে এককভাবে জুলুমের শিকার জ্ঞান করার সুযোগ নেই। পারস্পরিক জুলুমের কথা বাদ দিয়ে, সাধারণ জনগণের কথা ধরলে প্রধান দুই পক্ষের কোন পক্ষ না জুলুম করে? বিচারবহির্ভূত হত্যা আর বাসে বোমা মেরে, আগুন দিয়ে হত্যা—এর কোনটি জুলুম নয়? মানে, এবারের দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উভয় পক্ষের দায় চিহ্নিত হওয়াটা জরুরি। 

দুই দলের যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা পাওয়ার উদগ্র বাসনা এবার আবর্তিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটা কী ঘটল? দেখুন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তত্ত্বাবধায়কবিষয়ক সুবিধাবাজিতে কোনো রাখঢাক নেই। ক্ষমতার বাইরে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা দরকার হয় তাদের। এই জিনিস সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস, বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে এতটুকু যায় কি না, তা নিয়ে তাদের তখন মাথাব্যথা থাকে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মানলে যে রাজনীতিকের মুখে ঝামা ঘষা হয়, তাও বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তাঁদের মনে থাকে না। বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগের আর আওয়ামী আমলে বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে অত্যাশ্চর্য যুক্তিসমৃদ্ধ আবেগঘন লেখালেখি প্রস্তুত করে থাকেন। এবারও তাই হয়েছে, ২০০৬ সালের মতো। বিরোধী দল, বিরোধী দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রভাবশালী অংশের প্রয়াসে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়কের দাবি নির্বাচন প্রশ্নে মূল আলোচ্য হয়ে পড়ে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণের বিষয়টি বিবেচনায় না রেখে, তত্ত্বাবধায়ককে সব সমস্যার সমাধান ধরে নেওয়ার সুযোগে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, পুলিশ ও প্রশাসনের দলীয়করণ, বেতার ও টেলিভিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান একচ্ছত্রভাবে সরকারি দলের হাতে থেকে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো বলতে গেলে আলোচনায়ই আসেনি। বিরোধী দলের আন্দোলন গণতান্ত্রিক হচ্ছে কি না, তা নিয়েও তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বস্তুত, এভাবেই নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই একটি বাজে নির্বাচনের আবহ তৈরি হয়ে ছিল। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে যে ক্ষমতাসীনেরা তাদের কাজ সেরে রেখেছিল অনেক দিন আগে, আদালতের রায় ব্যবহার করে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে। শেষাবধি কী হয়েছে? প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন দুটি পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থানে অটল থেকে সংঘাতের আশঙ্কা বহাল রেখেই আক্রোশভরে পরস্পরের দিকে ধাবিত হয়েছে। এক পক্ষ যেনতেনভাবে নির্বাচন, আরেক পক্ষ যেনতেনভাবে নির্বাচন বানচাল চেয়েছে। যেনতেন নির্বাচন পক্ষ যেনতেনভাবে জিতে যাওয়ার পর কিছুদিন পর্যন্ত মিনমিনে কণ্ঠ থাকলেও, এখন ‘আবার কিসের নির্বাচন’, ‘কাদের সাথে সংলাপ’ জাতীয় একনায়কী কথাবার্তা বলা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রাসঙ্গিক ওজর দেখানো শুরু করেছে।

দুর্ঘটনা তো ঘটেই গেছে। এখন করণীয় কী? হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো চেঁচানো? নিজের মর্জিমাফিক দায়ীপক্ষ চিহ্নিত করে তাদের ওপর গজব নাজিলের রোদন? হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে অহর্নিশি ‘এ দেশের কিছু হবে না’ বটিকা বিনা মূল্যে বিতরণ? এসব কিচ্ছু না। অতিদেশপ্রেমিক কিংবা দেশবিরাগী সন্ন্যাসীর ভূমিকা পালন করার কোনো দরকার আমাদের নেই। আজকের দিনে এ ধরনের ভূমিকা মানায় না। স্বাধীন দেশে দেশ নিয়ে যতটা সম্ভব আবেগ ও ব্যক্তিগত মর্জিবর্জিত কাজের কথা হওয়াটাই কাজের কথা। আরেকটা কথা, আলোচনার কেন্দ্রে দেশ নয়, মানুষ থাকলে ভালো হয়। 

গণতন্ত্রের ট্রেন এখন চলছে একবগগা। নির্বাচন ছাড়াই দেড় শতাধিক সরকারদলীয় এমপি! জনাকয় আলহাজ বামপন্থী শরিক ও অফিশিয়াল বিরোধী দল থেকে নেওয়া জনাকয় সদস্যসহযোগে গঠিত অপরূপ এক মন্ত্রিসভা! সংসদে সরকারি দলের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে ভীষণ মনোযোগী অত্যন্ত অনুগত একটি বিরোধী দল। এহেন অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি চর্চাকারীদের প্রথম কাজ হতে পারে সংসদীয় গণতন্ত্রের চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক নির্বাচন থেকে মুক্ত হওয়ার আলোচনায় শরিক হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ জারি রাখা। একই সঙ্গে বিরোধী দলকে দিয়েও এ কথা কবুল করানো যে হতাশাজনক নির্বাচনটিতে তাদের ভূমিকা এতটুকু কম নয়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে বড় দুই দলকে নিয়মিতভাবে ক্ষমতায় বসানো ও সরানো স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার অংশ হতে পারে না। 

আরেকটি বুদ্ধিবৃত্তিক করণীয় হচ্ছে ‘ব্যাক টু বেসিক’ বা মূলে ফিরে যাওয়ার কাজটি করা। অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্র কীভাবে ভিত্তি পায়, কীভাবে চালু থাকে, কীভাবে শক্তিশালী হয় সে-সম্পর্কিত বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা। এই মনোনিবেশ করার সময় বাংলাদেশকে পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম এবং বাংলাদেশি রাজনীতিকদের এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ধরে নিয়ে আলোচনা শুরু করার বালখিল্যতা বা মতলব একেবারেই বাদ থাকবে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ জারি রাখার পাশাপাশি সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষায় এখনকার কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। এর মধ্যে থাকবে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা—যে কমিশন প্রধানমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল, মিডিয়া, দাতাগোষ্ঠী কাউকে অযথা পরোয়া করে না, যে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনে যে কাউকে ডেকে সতর্ক করে দিতে পারে। 

এ ছাড়া দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, বিশেষ করে প্রতিটি কমিটি গঠনে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করায় দলগুলোর ওপর বিশেষ চাপ দেওয়া, এ ক্ষেত্রে দলগুলোর চালাকি নিয়মিতভাবে উন্মোচন করা দরকার। জনসাধারণের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নিয়েই বা সাম্প্রতিক অতীতে কোথায় তেমন কোন আলোচনা হয়েছে? আদর্শ-চেতনা ইত্যাদি জরুরি। কিন্তু সারাক্ষণ আদর্শ? সারাক্ষণ চেতনা? এতে হয় কী, দলের পলিসি নিয়ে সাধারণের মধ্যে তেমন কোনো চিন্তাভাবনার উন্মেষ হয় না। বাংলাদেশের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক একটি রাষ্ট্রে উদারনৈতিক গণতন্ত্র পেতে হলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের মতো সময়সাপেক্ষ কিন্তু অবশ্য প্রয়োজনীয় শর্তটি এড়িয়ে কেবল নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার ওপর আলোচনা কেন্দ্রীভূত করে ফায়দা হবে না। পরিবারতন্ত্র, দলের মধ্যে গণতন্ত্রহীনতা, আন্তদলীয় সম্পর্কে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিকতা, রাজনীতিক ও জনগণের মধ্যে মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্কের অবসানও ঘটবে না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী না হলে ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে বিরোধীদের চূড়ান্ত আস্থাহীনতা, ক্ষমতা হারালে পিঠের চামড়া চলে যাওয়ার মতো জেঁকে থাকা ভয়গুলোও কাটবে না। 

রাজনৈতিক সংস্কৃতির সার্বিক নিম্নমানের কারণে বড় দলগুলো জনগণকে ভয় পায় না এবং যেকোনো যেনতেন করেই পার পেয়ে যায়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবল থাকলে পরিস্থিতি এমন শোচনীয় হতো না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার এহেন মুখ থুবড়ে পড়া পরিস্থিতিতে স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির গুরুত্ব অপরিসীম। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নানা রকমের শক্তিমানদের চোখে চোখ রাখতে পারবে এমন স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির পুনরুত্থান একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। 

শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।