বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭

ফেরাউনের কবর

নীলনদের পূর্ব-পশ্চিমে দুই ধরনের জিনিস বানিয়েছিল প্রাচীন যুগের মিশর-রাজেরা। পূর্বদিকে ছিল তাদের প্রাসাদ, ঘরবাড়ি আর মন্দির। পশ্চিম দিকে কতকগুলো পাথুরে পাহাড় ছিল। ওই পাহাড়ের তলায় লুকিয়ে রাখত তাদের মমি করা মৃতদেহ। সেই মৃতদেহগুলোর কোনো সন্ধান যাতে কেউ না পায়, তার জন্য কঠিন
গোপনীয়তা রক্ষা করত তারা। আছে ওখানে ‘ভ্যালি অব কিংস’, ‘ভ্যালি অব কুইনস’। এসব রাজা-রানির উপত্যকাসমূহ আজ আমাদের দেখতে যাওয়ার কথা।

ফারাও রানি হাচেপসুতের মন্দিরে

প্রাচীন মিশরের আঠারোতম রাজবংশের রাজা প্রথম থুতমোসিস আর তার প্রধান রাজরানি আহমোজ-এর কন্যার নাম হাচেপসুত। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০৮ সালে তার জন্ম হয়। রাজরানির গর্ভে জন্ম নেওয়া রাজার কোনো পুত্রসন্তান বেঁচে না থাকার কারণে বুদ্ধিমতী এই কন্যাকেই রাজ্যভার দিতে চাইলেন রাজা। কিন্তু সে আমলের মিশরে নারীদের ক্ষেত্রে কঠিন নিয়ম। কোনো নারী এককভাবে সিংহাসনে বসবেন, এমন হবে না। ফলে রাজা প্রথম থুতমোসিস তার রাজত্বের প্রায় শেষদিকে এসে তার রক্ষিতা মুতনেফার্তের গর্ভজাত একুশ বছর বয়সী পুত্র দ্বিতীয় থুতমোসিসের সঙ্গে চব্বিশ বছর বয়সী কন্যা হাচেপসুতের বিয়ে দেন। এর ফলে কন্যা হাচেপসুতের রানি হওয়া যেমন নিশ্চিত হলো সেইসঙ্গে নীলরক্তবিহীন দ্বিতীয় থুতমোসিসও সিংহাসনে বসার অধিকারী হলো। এর দশ সপ্তাহ পরে রাজা মারা গেলে দ্বিতীয় থুতমোসিস তার স্ত্রী কাম সেবানের সঙ্গে যৌথভাবে মিশরের সিংহাসনে আরোহন করেন।

রানি হাচেপসুত আর দ্বিতীয় থুতমোসিসের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। বয়সে ছোট এবং শারীরিক গড়নে দুর্বল তার সহশাসক দ্বিতীয় থুতমোসিসের সঙ্গে রানির সম্পর্ক যথেষ্ট শীতলই ছিল। তার ওপর রাজ স্থপতি সেনমাত-এর সঙ্গে এই রানির প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক ছিল বলেও কিছু নমুনা পাওয়া যায়।

ক্ষমতা গ্রহণের সতের বছর পর এক উত্সবে শীতল সম্পর্কের এই স্বামী-স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন যে, তাদেরই পুত্রসন্তান হবে পরবর্তী ফারাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের ঘরে পুত্রসন্তানের বদলে দুটি কন্যাসন্তান জন্ম লাভ করে। একটি মেয়ের নাম ছিল নেফেরুরে যার অর্থ সৌন্দর্যময় সূর্যদেবতা। দ্বিতীয় থুতমোসিসসের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেয় এক পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় মেনখেপর। এই মেনখেপরকে পরবর্তী ফারাও করার জন্য তাকে বানানো হয় কর্নক মন্দিরের পুরোহিত। এর মধ্যে ত্রিশ বছর বয়সে দ্বিতীয় থুতমোসিস মারা যান। কথা রটে যে, এই মৃত্যুর পেছনে তার স্ত্রীর হাত ছিল। নিজ পুত্রকে মন্দিরের পুরোহিত করাটাই তার জন্য কাল হয়েছিল। সত্ভাই কাম স্বামীর মৃত্যুর পর হাচেপসুত নতুন ফন্দি আটেন। নিজের আসন পাকাপোক্ত রাখার জন্য নিজ কন্যা নেফেরুরের বিয়ে দেন সত্পুত্র মেনখেপরের সঙ্গে।

বালক মেনখেপর তৃতীয় থুতমোসিস নাম নিয়ে তার সত্মা এবং ফুফু তথা শাশুড়ির সঙ্গে যৌথভাবে রাজ্য পরিচালনায় সহভাগী হলেন। রানি হাচেপসুত চাতুর্যের সঙ্গে নয় বছর বয়সী তৃতীয় থুতমোসিসকে জনগণের সামনে রেখে নিজে আড়ালে থেকে শক্ত হাতে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন। হাচেপসুত তার কিশোর জামাতা কাম ভাইপোকে মুকুট পরিয়ে ঘরে রেখে নিজেই পাবলিক মোকাবিলা করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যান। পুরুষতান্ত্রিক ওই সমাজে নারীর বশ্যতা স্বীকার করা কষ্টের হবে, এটা জেনে তিনি পুরুষের মতো পোশাক পরা শুরু করেন। এই হাচসেপসুতই একমাত্র নারী ফারাও, যিনি পুরুষের মতো নকল দাড়ি তার থুতনিতে লাগাতেন।

প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে আমরা আরও কয়েকজন রানির কথা জেনেছি। নেফারতেরি, নেফারতিতি, তারা সবাই রানি ছিলেন। রাজার স্ত্রী বলেই তারা ছিলেন রানি। কিন্তু হাচসেপসুত ছিলেন মহিলা রাজা, ফারাও রানি।

হাচেপসুত শব্দের অর্থ ‘অগ্রপথিক রাজকীয় মহিলা’। এই মহিলা দীর্ঘকাল মিশর শাসনের কলকাঠি নেড়েছেন। তবে চব্বিশ বছর রাজত্বকালে কখনোই তিনি এককভাবে রাজ্য পরিচালনা করার সুযোগ পাননি । তিন-তিনবারই তাকে প্রথমে তার বাবা, পরে স্বামী এবং সবশেষে ভাইপো তথা সেছলের সঙ্গে যৌথভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে হয়েছে।

রানি হাচেপসুত স্বয়ং নুবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সোমালিয়া থেকে তিনি আটটি জাহাজ ভর্তি করে মূল্যবান হাতির দাঁত, মসলা, সোনাসহ মূল্যবান ধাতু সুগন্ধি গাছ এসব নিয়ে এসেছিলেন। এই অগাধ সমপদের বেশির ভাগই রানি হাচসেপসুত ব্যবহার করেন তার রাজত্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সৌধ নির্মাণে। তার মতো এত সৌধ অন্য কোনো রানির আমলে দেখা যায়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নীলনদের অপর তীরে থিবসের এক পাহাড়ের ঢালে ওই মন্দির।

সায়মার গল্প বলা থামাই। আমি বলি, এটা বীরত্বের গল্প, না ডাকাতির?

হাসে সায়মা। বলে, যারা জয়ী হয়, ইতিহাস তাদের পক্ষে লেখে। রানি যুদ্ধ জয় করে সম্পদ নিয়ে এসেছেন, সুতরাং তিনি মিশরীয়দের কাছে বীর, আর সোমালিয়দের কাছে ডাকাত। সেই যুদ্ধজয়ের সম্পদ দিয়ে তার বয়ফ্রেন্ড আর্কিটেক্টকে দিয়ে যে চমত্কার মন্দির বানিয়েছিলেন, সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে এটা বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষ দেখছে। তোমরাও আজ এটা দেখতে এসেছ। এটাই মিশরের সবচেয়ে সুরক্ষিত সুন্দর মন্দির।

পাথুরে পাহাড়সারির মাঝ বরাবর তৈরি হয়েছে প্রশস্ত সড়ক। ডানে বামে লোকালয় বলে কিছু নেই। মাঝে মাঝে কিছু ঘরবাড়ি। প্রাণহীন স্থাপনা। ইটের স্লাব একের পর এক উঠিয়ে তৈরি করা হয়েছে একতলা-দোতলা বাড়ি। কোথাও সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। লোকবসতিও তেমন নেই। রাস্তাঘাট বলতে এই যে সড়কপথটুকু করা হয়েছে তা কেবল এই পুরাকীর্তিগুলো দেখার জন্য। যেহেতু বৃষ্টিবাদলার বিষয় এখানে নেই, পানির সরবরাহ নেই, নদী নেই, খাল নেই, হাওড়-বাঁওড়ের আশা করাও নির্বুদ্ধিতা, কৃষিকাজের কোনো সুযোগ নেই এখানে। যেদিকেই চোখ যায়, ধূসর বালিয়াড়ির মতো সারি সারি পাথুরে পাহাড়। তাদের একটির কোনায় বেশ সুন্দর একটা ঘর। তার সামনে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হলো। এখানেই টিকিট কাউন্টার। টিকিট কাটলে ওরা নিয়ে যাবে সেই ঐতিহাসিক মন্দিরে। মন্দিরে যাওয়ার জন্য আছে বিশেষ রকমের গাড়ি। অনেকটা টয়ট্রেনের মতো। চারদিক খোলা, ছোট ছোট কতকগুলো কেবিন। ওগুলোই টেনে নিয়ে যায় আধা কিলোমিটার দূরের মন্দিরটির সামনে।

দূর থেকে দেখলে এই তেতলা টেরাসের মন্দিরটিকে গ্রিসের পার্থেননের মতো মনে হয়। পার্থেনন বানানো হয়েছিল এই মন্দির বানানোর হাজার বছর পরে। তবে কি এদের কাছ থেকেই এথেন্সের বাস্তুকারেরা নির্মাণের কৌশল শিখেছিল? হতে পারে।

আমরা ধীরে ধীরে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াই। এই মন্দিরের প্রধান স্থপতির নাম সেনমাত। এই স্থপতির সঙ্গে রানির সুসম্পর্কের কথা সুবিদিত। আগের আমলে রাজস্থপতিদের অনেক কদর ছিল। ইস্তাম্বুলেও এই কদরের কথা শুনে এসেছি। সুলতান সুলেমানের রাজস্থপতির মন কেড়েছিল তার কন্যা মিহরিমা। স্বামীকে ছেড়ে এই স্থপতির জন্য প্রাণপাত করেছিলেন তিনি। এখানে এই ঘটনা ঘটেছিল আরও তিন হাজার বছর আগে।

সেনমাতকে দিয়ে মহিলা রাজা হাচেপসুত যে মন্দির বানিয়েছেন তা উত্সর্গ করেছিলেন দেবতা আমুনরা’কে। এই আমুনরা নাকি তার জন্মদাতা ছিলেন, এমন কথাও তিনি বলে বেড়াতেন। তিনি দাবি করতেন, গোপনে আমুনরা পিতা থুতমিসের বেশে তার মা আহোমোজের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন বলেই তার জন্ম হয়েছিল। মন্দিরের দেয়ালে আমুনরা, হাথোর-এর পাশে পুরুষের বেশে রানি হাচেপসুতের অনেকগুলো চিত্র। এই মহিলা রাজার প্রাচীন লেখচিত্রে এমন কাহিনি তিনি লিখিয়েছিলেন। দেয়ালে নানা রকমের যুদ্ধজয়ের চিত্রও আছে।

একটি চিত্র বেশ মজার। সোমালিয়া থেকে ডাকাতি করে নিয়ে আসা সুগন্ধি গাছের গুড়ি, প্রচুর জিনিসপত্র এবং কিছু বেবুনের পাল নৌকায় তোলা হচ্ছে। তৃতীয় থুতমোসিস যৌবনে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর সত্মায়ের অভিভাবকত্ব কর্তৃত্ব অসহনীয় হয়ে উঠল। তার সত্মার প্রধান উপদেষ্টা স্থপতি সেনমাতও তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। কারণ সত্মার কল্যাণে এই মহা প্রজ্ঞাবান লোকটি কেন তার সেবান রাজকন্যা নেফেরুরের শিক্ষক, কর্নক মন্দিরের রক্ষক এবং আমুনের প্রধান স্থপতি, রাজকীয় সীলমোহর বহনকারী হবে, এসব তিনি মানতে পারেননি।

এ সময় সিরিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দিলে রানি হাচেপসুত তৃতীয় থুতমোসিসকে এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫৮-এ তৃতীয় থুতমোসিস যখন সিরিয়া অভিযানে ব্যস্ত সেই সময় মিশরের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই রানির মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৫০ বছর। রানির মৃত্যুর খবর পেয়ে তৃতীয় থুতমোসিস দ্রুত রাজধানীতে ফিরে আসেন। অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিনি রানির স্মৃতিতে গভীর সম্মান দেখান এবং তার নির্মিত সমাধিসৌধে তাকে সমাহিত করেন। এর একদিন পরেই তিনি নিজেকে মিশরের সার্বভৌম রাজা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি মৃত রানির প্রতি সম্মান দেখালেও তার প্রিয়ভাজনদের ক্ষমা করেননি। কিছুসংখ্যক পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বেশির ভাগই তার হাতে মৃত্যুবরণ করেন। সিংহাসনে বসে তিনি প্রথমেই রানির প্রিয় অমাত্যদের নাম বিভিন্ন শিলালিপি থেকে মুছে দেওয়ার নির্দেশ দেন। বিশেষ করে রানির প্রিয়ভাজন সেনমাতের। সেনমাতের জন্য যে শবাধার তৈরি হয়েছিল সেটি ১,২০০ টুকরায় ছিন্নভিন্ন করেন তিনি। একসময় তিনি তার মৃত সত্মা ও তার সহভাগী রানির ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। তার ধ্বংসলীলায় ভেঙে পড়ে স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন কার্নাকের মন্দির, অবেলিস্ক, বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত রানি হাচেপসুতের মূর্তিগুলোকে ভেঙেচুরে বিকৃত করা হয় তার নির্দেশে। এমনকি তার এই বিলম্বিত প্রতিহিংসার হাত থেকে রেহাই পায়নি পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্যময় এই দেইর-আল-বাহ্রী মন্দিরটিও। এই মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হাচেপসুতের নাম মুছে সেখানে তার এবং তার বাবা দ্বিতীয় থুতমোসিসের নাম লেখার নির্দেশ দেন। তৃতীয় থুতমোসিসের প্রতিহিংসার হাত থেকে এমনকি রেহাই পায়নি রানি হাচেপসুতসের সমাধিসৌধ পর্যন্ত। রানির ইচ্ছে ছিল রাজকীয় উপত্যকার ২০ নম্বর সৌধে তার পিতার যে সমাধি আছে সেখানেই হবে তার শেষ আশ্রয়স্থল। এ উদ্দেশ্যে তিনি এই সমাধিসৌধের আয়তন কিছুটা বড় করেন যাতে দুটি শবাধার রাখা যায়। তৃতীয় থুতমোসিস প্রথম তাকে সেখানে সমাহিত করলেও তার পিতার শবাধার সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে রাখেন ৩৮ নম্বর সৌধে। ক্ষুব্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ তৃতীয় থুতমোসিস যখন সবকিছু থেকে রানির নাম মুছে দিচ্ছিলেন সেসময় তিনি ২০ নম্বর সৌধ থেকে হাচেপসুতসের মমিটিও সরিয়ে ফেলেন।

তৃতীয় থুতমোসিস সফল হয়েছিলেন ইতিহাসের পাতা থেকে হাচেপসুতসের নাম মুছে দিতে। মাত্র ১৭০ বছর আগে এক ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ মিশরীয় পুরোনো চিত্রলিপি উদ্ধার করে এই রানির নামটি আবিষ্কার করে তাকে আবার ইতিহাসের আলোকিত অধ্যায়ে নিয়ে আসেন। এ কারণেই অনেকে তার সমপর্কে বলেন ‘দ্য লস্ট কুইন অফ ইজিপ্ট’।

আমাদের গাইড বলে, ওখানেও একসময় আরেকটা মন্দির ছিল, প্রাসাদ ছিল। কিন্তু এখন তার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা নেমে আসি মন্দির থেকে। আবার শাটল ট্রেনে করে আধামাইল দূরের টিকিট কাউন্টারে গিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠি।

সায়মাকে বলি, একটু দূরে থেকে এই মন্দিরটির ছবি তুলব, সে রকম একটি জায়গায় নিয়ে যাও। আমাদের গাড়ি মাইলখানেক দূরে এক জায়গায় এসে থামে। দেখি, বাম পাশে একটা পুরোনো পাইলন, মাঝখানে একটা দরোজা। এক দারোয়ান বসে আছে দরোজায়।

সায়মা বলে, এটা আরেকটা মন্দির। এখন এটার রিনোভেশনের কাজ হচ্ছে, তাই ভেতরে যাওয়া যাবে না।

মন্দির থেকে বেশ দূরে জনমানবহীন একটা জায়গা থেকে আমরা এই পাহাড়ি লোকালয় দেখি। কোনো কোনো পাহাড়ের ওপর জিন্সের প্যান্টপরা কিছু ভদ্রলোককে দেখি, সঙ্গে জোব্বাপরা আরও কিছু লোক। কোথাও কিছু খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে। সায়মা বলে, এই পুরো অঞ্চলটিই ‘ভ্যালি অব কিংস’। ফারাও রাজাদের কবর ছিল এখানকার পাহাড়গুলোর তলায়। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০টি কবরের খোঁজ পাওয়া গেছে। ধারণা করা যাচ্ছে, খোঁড়াখুঁড়ি করলে আরও কিছু কবর পাওয়া যেতে পারে। এক-একটা কবরে যে পরিমাণ সম্পদ পাওয়া যায়, ছোটখাটো একটা রাজ্য কেনা যায় সেই অর্থে।

আমাদের এ যাত্রায় সেসব কবরের একটি দেখার কথা। প্রবল প্রজ্ঞাবান সেইসব মানুষের নির্বুদ্ধিতার নজির দেখব বলে আমরা আমাদের গাড়িতে আবার উঠে পড়ি।



আমেনহোতেপের সত্যগ্রামে

লুক্সরের এই অঞ্চলটি যথার্থই ফাঁকা। পর্যটক ছাড়া স্থানীয় তেমন কোনো লোকজন বা লোকালয় চোখে পড়ে না। ডানে-বামে পাথরের পাহাড়। হঠাত্ করে এক জায়গায় কতকগুলো একতলা-দোতলা বাড়ি দেখা গেল। কিছু মানুষেরও আনাগোনা এখানে।

আমাদের গাইড সায়মাকে বলি, ‘ভ্যালি অব কিংস’-এ পরে যাব। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। আমরা এই গ্রামে নামব, ওই দোকান থেকে কিছু কিনব।

সায়মা বলে, এ জায়গাটির নাম ‘দেইর আল-মদিনা’। এটা একটা ঐতিহাসিক গ্রাম। এখানেই আমাদের দেখার অনেক কিছু আছে। চলো নামি।

ছোট টিমে ট্রাভেল করার মজাই আলাদা। ২০-২৫ জনের দল নিয়ে যারা লুক্সর থেকে এখানে এসেছে, তাদের সুযোগ নেই গাইডের কথার অবাধ্য হওয়ার। আমাদের আছে। আমরা গাইডকে গাইড করি।

মেয়েটি যথেষ্ট নরম। চারটে পুরুষকে সে কোনোভাবেই ক্ষেপাতে চায় না। বলে, তোমরা কি এলাবাস্টার-এর কিছু কিনবে এখান থেকে? অনেকগুলো এলাবাস্টার ফ্যাক্টরি আছে এখানে।

মাসুদ ভাই বলেন, না, আমরা কেনাকাটার মধ্যে নেই। ব্যাগে আমাদের জায়গা নেই। আছি দৌড়াদৌড়ির মধ্যে। আমি ওই ঘোড়ায় চড়ব। ব্যবস্থা করে দাও।

এই গ্রামটিতে কয়েকটা বাড়িও আছে। নিশ্চয়ই এই ফ্যাক্টরিতে যারা কাজ করেন, তারাই এখানে থাকেন। কিন্তু গ্রামের অবস্থা দেখে খুবই বিরক্তি লাগল। নামেই শুধু গ্রাম। না আছে কোনো পুকুর, না আছে গাছপালা। এই যদি হয় ২০০৯ সালের অবস্থা, তবে কেমন ছিল এই গ্রাম খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে, যখন ফারাও রাজেরা এই অঞ্চলটি ব্যবহার করত তাদের মন্দির বা প্রাসাদ বা কবরস্থান বানানোর সময়?

সায়মা মিশরতত্ত্ব নিয়ে পড়েছে। মিশরের আদিকালের মানুষজন, তাদের ঘরবাড়ি নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা তার। তদুপরি সে থাকেও এই অঞ্চলে। আমরা একটা এলাবাস্টার ফ্যাক্টরির সামনের বেঞ্চে বসে গল্পে মাতোয়ারা হয়ে যাই। মিশরের আদিকালের গল্প শুনি।

মিশরের আদিম অধিবাসীদের বসতি ছিল কেবলমাত্র এই নীলনদের তীর ঘেঁষেই। নীলনদের তীরে জন্মানো নলখাগড়া ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। নলখাগড়া সমানভাবে সাজিয়ে সাজিয়ে তার ওপর দিত কাদামাটির প্রলেপ। এটাই ছিল সুপরিচিত কাঠামো। কোথাও চারপাশে নলখাগড়ার ঝোপের মধ্যে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে মাথার ওপর নলখাগড়ার পাটি বিছিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিত। এর কিছুকাল পর মিশরীয়রা ইট তৈরির পদ্ধতি শেখে। কাদামাটির সঙ্গে খড়কুটো মিশিয়ে চাপ দিয়ে ইট তৈরি হতো। পরে শুকানো হতো রোদে।

এই অঞ্চলের মন্দিরের গায়ে কিছু চিত্র আছে। মাটির পাতিল, লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ, এসব চিত্রিত সেখানে। তার মানে লতা আর নলখাগড়ার তৈরি ঝুড়ির ওপর মাটির প্রলেপ লাগিয়ে পাত্র বানানো হতো। কখনো ঝুড়িগুলো পোড়ানো হতো আগুনে। হাতের কাজে দক্ষ ছিল আদিম যুগের মিশরীয়রা। একসময় সেখানে যুক্ত হয় তাদের শিল্পবোধ। চাষাবাদের জন্য তখন তারা বৃষ্টির ওপর নির্ভর করত না। নদী থেকে পানি নিয়ে শস্যের পরিচর্যা করত। কারিগররা হস্তশিল্প তৈরির বিনিময়ে পেত খাবার। যবের রুটি। ধনী লোকেরা দাসদের বিভিন্ন শ্রমের কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করত। দাসদের তখন আখ্যায়িত করা হতো ‘জীবন্ত নিহত’ হিসেবে। দাসেরা পরিশ্রম করত ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। কপিকলে তুলত পানি। কাটত খাল। বাঁধ বাঁধত। পাথর ভাঙত। ভয়ানক নির্যাতিত ছিল এই দাসশ্রেণি। জমিতে পানি দিত কপিকল করে। এই কপিকলকে তারা বলত শাদুফে। নির্মাণ কাজের জন্য দূর থেকে নৌকায় বোঝাই করে আনা বড় পাথরের চাঁইকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে হতো। দাসদের তখন নিজস্ব সম্পদ বলতে কোনো কিছুই ছিল না। প্রভুরা তাদের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করত। দাসদের অমানুষিক হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে, অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে যা কিছু পাওয়া যেত তার সবই মালিকের সম্পদ হিসেবে গণ্য হতো। দাসদের দেওয়া হতো সামান্য পরিমাণে খাদ্য। তাদের বাসস্থান ছিল অস্বাস্থ্যকর। তাদের ঘরগুলোতে ছিল পাতা বা ঘরের ছাউনি। তাদের পোশাক ছিল কোমরে ঝোলানো এক টুকরো কাপড়।

গোষ্ঠী চাষিরা কৃষিযোগ্য জমিতে চাষাবাদ করত। চাষিদের লাঙ্গল ছিল কাঠের তৈরি। সেই লাঙ্গলে বলদ যুঁতে দিয়ে তারা নদীর ধারের মাটিতে লাঙ্গল টানত। মাটি বপনের উপযোগী হলে আসত বীজ বোনার পালা। চাষিরা তখন সারবেঁধে গান গাইতে গাইতে ঝুড়ি থেকে ছড়াত ইমমারের দানা। সেগুলো ছিল এক ধরনের গম বীজ। দাসদের ব্যবহার করা হতো ক্ষেতখামারকে আগাছামুক্ত রাখার জন্য। তখন মিশরে ছিল দুটো শ্রেণি। শোষক আর শোষিত। দাস আর প্রভু। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ধারায় দাস মালিকদের ছিল দাসদাসী, জমিজমা, শ্রমের হাতিয়ার, পশুসম্পদ, সোনা। তারা দাস এবং চাষিদের পরিশ্রমের ফসল ভোগ করত।

চাষিদের ছিল শুধু দু-এক টুকরো ভূমিখণ্ড। সামান্য কিছু হাতিয়ার। অল্প কয়েকটি পশু। তারা নিজেদের পরিশ্রমের ফসলের প্রধান অংশ তুলে দিত তাদের প্রভুদের কাছে। দাসদের কোনো কিছুতেই তখন অধিকার ছিল না। দাস মালিকদের পোশাক ছিল মিহি বস্ত্রের তৈরি। তাদের কোমরবন্ধে ঝুলত তামার ছোরা। ছোরার বাঁটে থাকত সোনার নকশা কাটা। সোনার বালা পরত তারা হাতে। বুকে ঝোলানো থাকত সোনার হার। তাদের গৃহ ছিল গাছপালায় ঘেরা বাগানের মাঝে।

সাড়ে তিন হাজার বছরের ব্যবধানে তার প্রায় সবকিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের অবয়বের পরিবর্তন হয়নি। পোশাক বদলেছে, গড়ন বদলায়নি। মিশরে ফারাওদের রাজত্ব শেষ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। কিন্তু তারা তো আর পিপীলিকার দলের মতো সর্বস্ব নিয়ে বিলীন হয়ে যায়নি। রাজা বদলেছে, কিন্তু প্রজারা তো রয়েই গেছে।

সায়মাকে বলি, আচ্ছা ঠিক এই অঞ্চলে আদিকালে কারা বাস করত?

সায়মা বলে, এখানে মধ্যমমানের লোকের বাস ছিল। তারা কারিগরশ্রেণির। মূলত রাজাদের কবর বানানোর কাজগুলো তারাই করত। হাতের কাজ করা, চাষবাস করা এদের পেশা ছিল। ক্রীতদাসেরা ঠিক এখানে ছিল না। থাকলেও খুব সামান্য। যেকোনো অবস্থাপন্ন লোক যেমন কৃষিকাজের জন্য কয়টা গরু বা চলাচলের জন্য ঘোড়া কিনত, তেমনি সস্তায় পেলে কিছু মানুষও কিনে ফেলত। তাদের দিয়ে পশুর মতো কাজ করাতো, এই যা। যতগুলো শারীরিক পরিশ্রমের কাজ ছিল, সবই করত ক্রীতদাসেরা, তাদেরকে চালাত সাধারণ গৃহস্থ।

আমরা একটা এলাবাস্টারের দোকানে ঢুকি। মিশরীয় এলাবাস্টার জগদ্বিখ্যাত। একসময় চমত্কার কিছু মূর্তি বানানো হতো এটা দিয়ে। এখন বানায় মিনি সাইজের মূর্তি। পকেটে নিয়ে ঘোরা যায় এমন তার সাইজ। তবে মূর্তির চেয়েও নানা রকমের লাইট শ্যাড, ঝাড়বাতি বা বাহারি ফুলদানি হয় এই এলাবাস্টারে।

দোকানি অনেক কসরত করেও তার একটি ফুলদানি বিকোতে পারল না আমাদের কাছে। ফাঁকতালে শিখে এলাম—কী করে আসল এলাবাস্টার চিনতে হয়। দোকানি বাতি জ্বালিয়ে দেখায়। বলে, অরিজিনাল এলাবাস্টার কিন্তু ট্রান্সলুসেনট। এটাই তার পরীক্ষা।

সায়মা বলে, এই গ্রামটিকে এখন ডাকা হয় ‘দেইর আল-মদিনা’ নামে। কিন্তু আদিকালে তার এই নাম ছিল না। আগে ডাকা হতো ‘মেত মাত’, মানে সত্যগ্রাম। খ্রিস্টানদের আমলে এখানকার হ্যাথর মন্দিরকে গির্জায় রূপান্তর করা হয়, তখনই জায়গাটির নতুন নাম দেওয়া হয় ‘দেইর আল-মদিনা’, মানে ‘উপাসনালয়ের শহর’। বহু শত বছর এ জায়গাটি লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল। ১৯২২ সালে তুতেনখামেনের কবর আবিষ্কারের পর থেকেই মূলত এ জায়গাটি সরগরম হয়ে পড়ে এবং তখনই বের হলো যে, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এখানে যে রাজপ্রাসাদ, মন্দির মিলে যে কমপ্লেক্স ছিল—প্রাচীন মিশরে আয়তনের দিক থেকে ওটাই ছিল সবচেয়ে বড়। লুক্সরের কর্নক মন্দির দেখে আমরা তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম, কিন্তু এটা ছিল কর্নক মন্দিরের চেয়েও বিশাল।

এই গ্রামের পেছনেই মরুভূমি, পাথরের পাহাড়। এসবই চুনাপাথর। পাহাড়ের তলা বরাবর বেশ কিছু পাথরের স্লাব পড়ে আছে। কোথাওবা ঘরের ভেঙে যাওয়া দেয়াল। তার মানে ওখানেই প্রাসাদটি ছিল?

এই গ্রামের খবর মিশরীয়দেরকে জানায় একদল ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। গ্রামের পাশের এক কূপের ভেতর থেকে তারা প্রায় পাঁচ হাজার টুকরা নিদর্শন সংগ্রহ করে। হায়ারোগ্লিফিক থেকে উদ্ধার করে তার ইতিহাস। সেখান থেকে জানে যে, ফারাও রাজ থুতমোসিসের আমল (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০৬-১৪৯৩) থেকেই এ গ্রামের সূচনা এবং ছোট-বড় মিলে ৬৮টি ঘর ছিল এ গ্রামে। ঘরগুলো কিছু কাদামাটি দিয়ে তৈরি এবং তার বাইরে সাদা চুনকাম করা।

১৩৮০ খ্রিস্টপূর্বে তৃতীয় আমেনহোতেপ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর পুত্র আখনাতেন মিশরের সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন চতুর্থ আমেনহোতেপ। তিনি শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসেবে ঘোষণা করলেন ‘আতুন’-কে। অস্বীকার করলেন আমেন-রাকে। তিনি মন্দির থেকে পুরোহিতদের বের করে দেন। বিভিন্ন দেবদেবীর নাম মুছে ফেলেন। এবং জনসাধারণকে নির্দেশ দেন ‘আতুন’ নামের নতুন দেবতার পূজা করার জন্য। এ কারণে তিনি তার নাম পরিবর্তন করে আতুনের অনুসরণে রাখেন আখনাতেন। প্রথম একেশ্বরবাদী ধারণার জন্ম দেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী ‘আতুন’ বিশ্বের একমাত্র উপাস্য দেবতা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা এবং ভালো-মন্দের স্রষ্টা। ইখনাটনের ধর্ম বিপ্লব স্থায়ী সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। পরবর্তী ফারাওরা তার তৈরি দর্শনকে গ্রহণ করেননি। ফারাও তুতেনখামেন দুর্নীতিপরায়ণ পুরোহিতদের অধিকার ফিরিয়ে দেন।

এ গ্রামটিকে বিলুপ্ত করা হয় সর্বশেষ রামসিস (একাদশ রামসিস)-এর আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ১১১০-১০৮০)। এই ফারাও রাজাই রামসিস বংশের শেষ রাজা ছিলেন, তার কবরটিই ওই ‘ভ্যালি অব কিংস’-এর সর্বশেষ কবর এবং তার বিনাশের পর থেকেই মিশরও অন্য রাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। ফলে এই অঞ্চলটি তার অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। নবম রামসিসের আমল থেকেই মূলত এই অঞ্চলের লোকজনের অবস্থা খারাপের দিকে যায়। রামসিসদের তেজোদীপ্ততা কমে আসে। কবর বানানোর কাজ কমে যায়। ফেরাউন তথা দ্বিতীয় রামসিসের আমলে হাজার হাজার সৈন্য মৃত্যুবরণ করার কারণে জৌলুস হারায় রামসিস পরিবার। এরপর নতুন নতুন যুদ্ধজয় করে সম্পদ আহরণও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে বেকার হয়ে পড়ে গোরখোদকের দল। বসে বসে কবরের ভেতর রেখে দেওয়া সোনাদানা লুণ্ঠনকারীদের পাহারা দেওয়া ছাড়া তেমন কাজ থাকে না তাদের। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয় এই গ্রাম।

এই গ্রামটি ছিল কারুশিল্পী আর রাজমিস্ত্রিদের এলাকা। তারা কাজ করত সপ্তাহে পাঁচ দিন। দুই দিন ছুটি কাটাত। এই দুই দিন নিজেদের কবর বানানোর কাজে ব্যয় করত। প্রায় পাঁচ শ’ বছর ধরে এখানে ৬২টি কবর তৈরি হয়েছে। এক-একটি কবরই নাকি মাটির তলার এক-এক প্রাসাদ। সেক্ষেত্রে গড়ে প্রায় দশ বছর সময় লেগেছে একেকটি কবর বানাতে। যখনই কোনো রাজা ক্ষমতায় আসতেন, তখনই তিনি প্রথমে তার কবরের জায়গাটি ঠিক করে নিতেন। কবর বানানোর কাজ চলত একদিকে গোপনে, আবার মন্দির বানানো বা মন্দির বাড়ানোর কাজ হতো আরেক দিকে। ধর্মপরায়ণ রাজারা নিজেদের প্রাসাদ সৌধ বানাতে খুব পরিশ্রম করেননি বলেই প্রাসাদগুলোর অস্তিত্ব আর নেই। আছে রাজাদের কবর আর মন্দির। তবে রাজা ছাড়াও মধ্যবিত্ত বা সচ্ছল লোকেরা, বিশেষ করে এই গ্রামের কারুশিল্পীরাও চমত্কার কিছু কবর তাদের নিজেদের জন্য বানিয়েছিলেন। সেগুলোর কয়েকটি আছে। রোদ পড়েছে অনেক, গরম হাওয়া। পাথরের পাহাড় থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে আমাদের শরীরে। সে কারণে ওগুলো দেখতে যাওয়া হয়নি আমাদের।

এই গ্রামটিতে খানিক হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। গাড়িতে উঠব, কিন্তু মাসুদ ভাইকে খুঁজে পাই না। একসময় আবিষ্কার করি তাকে একটা খচ্চরের ওপর। বলেন, ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে এলাম গ্রাম। যেতে পারো, খারাপ না।

আমি ঘোড়ায় চড়তে ভয় পাই। কিন্তু এই ঘোড়াগুলো ভয় পাওয়ার মতো না। ভালো গাধাও এদের চেয়ে ভালো বলে মনে হয় আমার। এরা পিঠের ওপর লোক বসিয়ে পাছা দোলাতে দোলাতে হেঁটে হেঁটে যায়।

সায়মাকে বলি, চলো, মাটির তলার কবরখানা দেখি।

সায়মা বলে, একটু দাঁড়ান। ওই পাশে দুজন পাহারাদার আছেন, তাদের দেখে আসি।

আমরা গাড়িতে উঠি এবং মিনিটখানেক গাড়ি চলার পর সেই দুই পাহারাদারের সামনে এসে থামি।

চল্লিশ হাত উঁচু দুটো পাথুরে মূর্তি বসে আছে নীলনদের দিকে মুখ করে। তার পেছনে পাথরের পাহাড়। মিশরের আইকনিক পোস্ট কার্ডে পিরামিডের পর এই যুগল মূর্তিই সবচেয়ে বেশি দেখেছি। আজ এত সহজে তার কাছে এসে পড়েছি! থ্যাংক ইউ, সায়মা।

আমাদের সামনে যিনি বসে আছেন, তার নাম তৃতীয় আমেনহোতেপ। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮২ থেকে ১৩৪৪, দীর্ঘ ৩৮ বছর তিনি মিশর শাসন করেছিলেন। ফেরাউন তথা দ্বিতীয় রামসিসের আগে তিনিই ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফারাও। তার নামের সঙ্গেও ‘দি গ্রেট’ শব্দটি ব্যবহার হতো।

এই তৃতীয় আমেনহোতেপের বিশাল কাহিনি শুনে এসেছিলাম কর্নক মন্দিরে। কর্নক মন্দিরের সম্প্রসারণের অনেক কাজ করেছিলেন তিনি। তার দাবি করা আমুন দেবতার উত্সব করার জন্য যে মন্দির বানিয়েছিলেন, ‘লুক্সর মন্দির’ নামে এখন সেটা পরিচিত। শুধু তা-ই নয়, লুক্সর মন্দির থেকে কর্নক মন্দির পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার পথে তিনি ভেড়ার স্ফিংক্সের সারি বসিয়েছিলেন।

তৃতীয় আমেনহোতেপ বেশ কিছু রাজ্য জয় করেছিলেন, একাধিক বিদেশি রাজকুমারীকেও বিয়ে করে এনেছিলেন মিশরে। বেশকিছু মন্দির ও প্রাসাদ বানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে ফেরাউন তথা রামসিস পরিবার ক্ষমতায় আসে এবং একে একে তাদের অর্জনসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। যে কারণে তৃতীয় আমেনহোতেপের আমলে বানানো লুক্সর মন্দিরে আমরা দেখি দ্বিতীয় রামসিসের জয়জয়কার। মন্দিরের সামনে, ভেতরে, সবখানেই ফেরাউন, দ্বিতীয় রামসিস।

তৃতীয় আমেনহোতেপের আমল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সৌধের নির্মাতা ছিলেন তিনি। লুুক্সরে নীলনদের পশ্চিম পাড়ে যেখানে এই ‘দেইর আল-মদিনা’ গ্রাম, এখানেই তিনি ৬৭ একর জায়গা নিয়ে বানিয়েছিলেন মন্দির। সেই মন্দিরকে পাহারা দিয়ে রাখার জন্য স্বঘোষিত ঈশ্বর কাম রাজা তৃতীয় আমেনহোতেপ বানিয়েছিলেন তার দুটো দানবিক আকারের মূর্তি। মন্দিরযুগল সরানো সম্ভব হয়নি বলে আজ এখনো আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে ৩৪০০ বছর আগে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রস্তরমূর্তি। বর্তমান কায়রোর আল-আমহার অঞ্চল থেকে সড়ক পথে ৪২০ মাইল পরিবহন করে ৭২০ টন ওজনের দুটো আস্ত পাথরখণ্ড এনে তাকে কেটে কেটে এই মূর্তিযুগল বানানো হয়। তৃতীয় আমেনহোতেপ বসে আছেন পূর্বদিকের নীলনদের দিকে। তার পায়ের কাছে দুটো মূর্তি। এদের একজন তার স্ত্রী তিয়ে, আরেকজন তার মা-মুতেমিয়া। ওদের উচ্চতা তার হাঁটুর সমান, তার নিজের উচ্চতা ৬০ ফুট। দুটো মূর্তির মধ্যে ফারাক আছে ৫০ ফুটের।

বেশ কিছু ট্যুরিস্টের জটলা এখানে। পাশে একটা ছোট বাজার, স্যুভেনির বিক্রির বাজার। আছে কিছু হকারও। এদের অত্যাচারে ভালো করে দেখার উপায় নেই অঞ্চলটি। যেখানে এই গ্রাম, এটা নীলনদের সবুজ বনানী অঞ্চলের শেষ মাথা, এখান থেকে শুরু হয়েছে মরু আর পাহাড়। পেছনে পশ্চিম দিকে তাকালে কতকগুলো পাহাড়কে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে দাঁড়িয়ে থাকা এই দুটো প্রস্তরমূর্তি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। উত্তর দিকে কিছু সবুজ ক্ষেত। ওখানে যব ফলানো হয়েছে।

সায়মার সাহায্য নিই আবার। সে বলে, এ দুটোর নাম গ্রিকরা রেখেছিল ‘কলোসি অব মেমনন’। হোমারারের লেখা ‘ইলিয়াড-এ ট্রয় যুদ্ধের এক নায়ক ছিল ‘মেমনন’, তার নামে এই নাম। মিশরীয়দের ঐতিহাসিক প্রায় সবকিছুই গ্রিকদের দেওয়া নাম। মিশরীয়দের অস্তিত্ব যখন নিজের কিছু আর ছিল না, গ্রিকরা এসব করে দিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা আরবি ভাষায় একে বলে ‘আস-সালাম’, বিদেশিরা এ নামে ডাকে না।

পর্যটক দলের কাছে এ জায়গাটা ছবি তোলার জন্য খুব পছন্দের। পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডটা খুব ভালো আসে। যেখানে এ দুটো মূর্তি দাঁড় করানো, তা আরেকটু নিচু জায়গায়। পর্যটকেরা তার পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করেন। মানুষগুলো তখন তার আকৃতির চেয়েও ছোট আকারের দেখায়। মানুষের সাপেক্ষে আমেনহোতেপ যে অন্তত দশগুণ বড় ছিলেন, এটুকু বোঝানোর জন্যই ছিল তার এই চেষ্টা। কারণ যিনি তখন রাজা হয়েই গেছেন, তখন তার নিজেকে ‘ঈশ্বর’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়াটাই কাজ ছিল।

লুক্সরের কর্নক মন্দিরের সামনে দ্বিতীয় রামসিসের একটা মূর্তি ছিল। সেটা চল্লিশ ফুট উঁচু। এই আমেনহোতেপ বসে আছেন, তাও তিনি ষাট ফুট উঁচুতে। তাহলে কি এইসব মূর্তি দেখে গিয়ে কোনো কোনো ওয়াজি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আগের যুগের, বিশেষ করে নবি মুসা বা ফেরাউনের সমসাময়িক মানুষগুলো দৈর্ঘ্যে অনেক লম্বা ছিল? তা তো হওয়ার নয়। তাদের যে মমিগুলো রাখা আছে সেখানেই তো তাদের উচ্চতা পরিষ্কার। তাহলে এই মূর্তিগুলো দেখেই কি ভ্রান্তি জেগেছিল, কখনো কারও?

ছিমছাম গ্রামটিতে লোকজন নেই। মিশরিরা এসব দেখতে আসে না। যে সকল বিদেশি আসে, তাদের কাছে নানারকম পুতলা বিক্রি তাদের উদ্দেশ্য। মূর্তিযুগলের সামনে একটা টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখেছে এলাবাস্টার দিয়ে বানানো বেশ কিছু পট, দেয়ালচিত্র আর ফারাওদের মূর্তি।

আমি এগুলোর ছবি তুলছি। এমন সময় হকার মহোদয় আমাকে চেপে ধরেন। ফটোগ্রাফি চার্জ দিতে হবে। আমি বলি, আমি তো আপনার ছবি তুলিনি, আমি তুলেছি এসব পুতুলের ছবি।

তিনি নাছোড়বান্দা। বলেন, পুতুলের ছবি তুললে পুতুলকে দিতে হবে চার্জ।

কত?

এক শ’ পাউন্ড।

পাঁচ পাউন্ড।

তুমি পাগল।

দশ পাউন্ড?

নেন।

আমি একটা তুতেনখামেন নিই। দশ পাউন্ড দিয়ে কেনা এই তুতেনখামেন এখন আমার মডেল হবেন। এই কিশোর ফারাও সম্পর্কে পড়েছি অনেক। তার শবাধার অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয় মাটির তলা থেকে ১৯২২ সালে। আঠারো বছর বয়সী এই কিশোরকে নিয়ে নানা উপকথা। এবার আমি পিতামহ তৃতীয় আমেনহোতেপ আর তাকে নিয়ে কম্পোজিশন করে ছবি তুলি।

আমেনহোতেপ-এর বিস্মৃত সৌধ দেখা শেষ। এবার আমরা ছুটি ‘ভ্যালি অব কিংস’-এর দিকে, যেখানে ছয়জন ফারাও রাজার সমাধিসৌধ ছিল পাহাড়ের তলায়। তাদের একটি, এই কিশোর ফারাও তুতেনখামেনেরও। শুনেছি, কিছুদিন আগে এটা খুলে দিয়েছে। আমরা তার ভেতরে যাব। দেখব তুতেনখামেন কোথায় ছিলেন।



রাজ শবাধারের উপত্যকায়

দিয়ার আল-মদিনা’র গ্রাম ছেড়ে আমরা পশ্চিমের দিকে এগোই। সামনেই কিছু পাহাড়ের সারি। এই পাহাড় সারি শেষ হয়েছে কোথায়? কী আছে তারপর?

এ প্রশ্নের জবাব জানার জন্য আমাদের গাইড সায়মার সাহায্য নেওয়ার দরকার হয় না। আমাদের সবার মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া। ঠাস করে গ্লোবাল পজিশন সার্চ করে বের করে ফেলি নিজের অবস্থান। দেখি, এই পাহাড় সারি চলতে চলতে শেষ হয়েছে লিবিয়াতে গিয়ে। মিশরের সীমানা এখান থেকে আর কিছুদূর যাওয়ার পর শেষ।

ফারাওদের নতুন রাজবংশের সময় এ অঞ্চলটি নিশ্চয়ই দুর্গম ছিল। কিছু কামলা শ্রেণির লোকজনকে এখানে চাকরি দিয়ে রাখা হয়েছিল, তাদের কাজ ছিল, রাজার জন্য কবর বানানো। সায়মাকে বলি, তুমি কি জানো শুধু কবর দেখানোর কাজে ভারত কী পরিমাণ আয় করে?

সায়মা ভ্যাবলার মতো তাকায়। মনে হয় কিছুই বোঝেনি। আমি বলি, তাজমহলের গল্প জানো?

সায়মা বলে, আমি তাজমহলের কথা শুনেছি, কিন্তু ইতিহাসটা ভালো জানি না।

বুঝলাম, মিশরের ইতিহাসতত্ত্ব মুখস্থই করেছে শুধু সায়মা। মোগল ইতিহাস পড়েনি। খানিকটা ধারণা দেওয়ার পর সে জানতে চায়, মমতাজ মহল কি বড় কোনো পীর ছিলেন? পীরদের মাজার হয়।

আমি বলি, না, তাজমহলের সঙ্গে ধর্মাধর্মির বিষয় নেই। ওটা প্রেমের বিষয়, শান-শওকত দেখানোর বিষয়। লাখ লাখ মানুষকে বঞ্চিত করে তাদের করের টাকায় কোনো এক রাজা তার রানির জন্য কবর বানানোর খায়েশ মেটানোর কাহিনি ছিল তাজমহল।

সায়মার চোখে মুখে বেশ আনন্দ। মনে হয় মজা পেয়ে গেছে সে। বলে, এখানেও তো বিষয় একই রকম। রাজ্যের সমস্ত সম্পদ দিয়ে নিজেদের কবর বানানোর কাজ শুরু করে দিতেন। ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই তাদের প্রত্যেকের মন্দিরে তাদের যুদ্ধজয়ের ছবি। যুদ্ধ জয় করে তারা যে সকল সম্পত্তি অর্জন করতেন, তা দিয়ে বানানো হতো কিছু মন্দির, তাদের মূর্তি, অবেলিস্ক আর মাটির নিচের কবরসৌধ বানাতেই খরচ করতেন।

মাটির নিচে কবরের এমন চিহ্ন দেখেছিলাম চীনের বেইজিংয়ের কাছে। চার-পাঁচ শ’ বছর আগেও চীনের মিং রাজাদের ধারণা ছিল যে, মৃত্যুর পর তাদের আত্মা আবার মানুষের মতো জেগে উঠবে পাতালপুরীতে। মাটির পঞ্চাশ ফুট নিচের এক মিং রাজের কবরের শেষ স্তরে গিয়ে দেখেছিলাম সেই ঘরে লোহার সিন্দুকের ভেতর পাঁচ শ’ বছর ধরে তার ছাইটুকু পড়ে আছে। পরপারে কেনাকাটার প্রয়োজন হতে পারে ভেবে নগদ স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা ও গচ্ছিত থাকত পাশের সিন্দুকে। শুধু তা-ই নয়, রাজার কাম প্রবৃত্তি নিবারণের জন্য তার মৃত্যুর পরপরই তার প্রিয় উপপত্নীসমূহদের পুড়িয়ে মেরে ফেলে তাদের ছাইটুকুও রেখে দেওয়া হতো মিংরাজের ছাই-এর ডিব্বার পাশে। এখানেও রাজ্যের সমূহ সম্পদ, যুদ্ধজয়ের সমূহ ক্রীতদাসকে দিয়ে বানানো হয়েছিল ওইসব পিরামিড, এইসব ‘ভ্যালি অব কিংস’।

মিং রাজাদের চেয়ে ফারাও রাজদের বুদ্ধি বেশিই ছিল। তারা মমি করতে জানত, বিস্ময়কর স্থাপনা তৈরি করেছিল। তারা ঔষধ বানাত, জ্যামিতি জানত, ফিজিক্স জানত, কেমিস্ট্রি জানত, কিন্তু জানতে পারেনি যে, মৃত্যুর পর কবরে নিয়ে যাওয়া তাদের সম্পদসমূহ কেবল চোর-ডাকাতের প্রয়োজনই মেটাতে পারে।

এই রাজ উপত্যকার ৬৩টি কবরের মধ্যে ৬২টি কবরই নিঃশেষ হয়েছিল। এ ধরনের চুরির ঘটনা ঘটা শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ১৪শ’ সাল থেকেই। এর মধ্যে বহু বছরই এই কবরগুলোর কোনো খোঁজখবর কেউ পায়নি। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে হায়ারোগ্লিফিক পাঠোদ্ধারের পর থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অনুমান করতে থাকেন যে, এই পাহাড়ি অঞ্চলেই রাজাদের মমি রাখা থাকবে। একেকটা কবরের সন্ধান পাওয়া মানে একেকটা রাজ্যের সম্পদ পাওয়া। এই সম্পদ আহরণের জন্য বড় বড় ধনকুবেররা পশ্চিমে বসে বছরের পর বছর ধরে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ বিনিয়োগ করেছেন অনুসন্ধানী প্রত্নতত্ত্ববিদদের পেছনে। একসময়, ১৯২২ সালে হাওয়ার্ড কার্টার সন্ধান পেলেন সোনার খনির। ‘ভ্যালি অব কিং’-এর সবচেয়ে দুর্বল শবাধারের মুখ উন্মোচন করে পাওয়া গেল কিশোর ফারাও তুতেনখামেনের মমি আর সম্পদ। সারা পৃথিবী হুমড়ি খেয়ে পড়ে এই সংবাদটি জানার পর। তারপর থেকে নতুন করে লেখা হতে থাকে তুতেনখামেনের ইতিহাস।

মিশরে যারা ফারাও ছিল, তারা নিজেদের ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের সরাসরি দূত হিসেবে নিজেকে মনে করত। অগাধ ধন-সম্পদের মালিক হলেও তারা মৃত্যুকেই শুধু জয় করতে পারেনি। কিন্তু এই মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে ছিল তাদের ভিন্ন ধারণা। তারা মনে করত মৃত্যুর পর তার দেহটিকে আড়াল করে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে পারলে সেই শরীরটি পরলোকের জীবন পাবে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে। এ কারণেই মমি করার প্রথা আসে মিশরে। মৃতের সামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভর করত মমির স্থায়িত্ব। এসব মমিকে লুকিয়ে রাখার জন্য বানানো হতো পিরামিড। তার ভেতরের গোপন প্রোকোষ্ঠে রাখা থাকত রাজার মমি, তার সঙ্গে স্বর্ণখচিত নানা ধরনের জিনিসপত্র।

খ্রিস্টপূর্ব উনিশ শতকে বন্ধ হয়ে যায় পিরামিড বানানোর কাজ। মিশরের রাজারা নতুন রাজবংশ নিয়ে চলে আসেন থিবসে, আজ যা লুক্সর নামে পরিচিত। এখানে এসে একের পর এক ফারাও রাজ ক্ষমতায় আসেন। একেকজন একেকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের ঘোষণা দেন। এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবনের জন্য আয়োজন করতে থাকেন।

পরকাল নিয়ে তাদের প্রায় এক রকমেরই ধারণা ছিল। তারা মনে করত যে মৃত্যুপরবর্তী জীবনই আসল। এ কারণে নিজেদের প্রাসাদ বানাত মাটি দিয়ে, আর মন্দির ও কবর বানাত শক্ত পাথর দিয়ে। খ্রিস্টপূর্ব পনের শতক থেকে পরবর্তী পাঁচ শ’ বছর ধরে নীলনদের পূর্বপারে রাজত্ব করা ফারাও রাজদের নীলনদের পশ্চিম পারে জনমানবহীন চুনাপাথরের পাহাড়ের গোপন উপত্যকায় আমাদের আলোচনা অনেকটুকু চলে। এর মধ্যে পীর ফকিরের মাজার, ওরস, স্মৃতিসৌধ এসব বিষয়েও আলোচনা হয় এবং একসময় আমরা উভয়পক্ষই প্রায় একমত হই যে, ফেরাউন বাদশা কিংবা সম্রাট শাহজাহান, তারা আসলে কেউই তাদের নিজের জন্য কিছুই করতে পারেননি। যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষ এইসব স্থাপনা দেখতে এসে ওই ভারত বা মিশরে ডলার খসিয়ে যায় আর সেইসব বাদশা বা সম্রাটকে মুখভর্তি করে উপহাস করে যায়। মিনিট দশেকের মধ্যেই কতগুলো পাহাড়ের বাঁক পেরিয়ে একটা জায়গায় এসে আমাদের গাড়ি থামল। আশপাশে গাছপালা তো নয়ই, ভালো কোনো ঘরও নেই। টংঘরের মতো একটা জায়গা। বলা হলো—এটাই হচ্ছে আমাদের টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি ৫০ পাউন্ড টিকিট। এক টিকিটে ৩টা রাজকবর দেখা যায়।

বুঝলাম সেই ‘ভ্যালি অব কিংস’-এ পৌঁছে গেছি। গাড়ি থেকে নামার আগেই সায়মা আমাদের মন খারাপ করিয়ে দেয়। বলে, এই পুরো এলাকাটি খুবই সংবেদনশীল এলাকা। এখানে ছবি তোলা নিষেধ।

বলে কী!

আমি বলি, সমস্যা নাই। আমি বড় ক্যামেরা রেখে যাচ্ছি, ছোট ক্যামেরা নিয়ে যাই।

হবে না, নিয়ম নাই।

গার্ডকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলব। এরা সবাই টাকা খায়।

আমি এলাও করব না। তাহলে আমার লাইসেন্স চলে যাবে।

মেয়েটি বলে কী! এখন কী হবে? এত জটিল একটা জায়গায় এসেছি, অথচ তার ছবি তুলতে পারব না, এমন কি হয়?

সায়মা বলে, এখনো পর্যন্ত এখানে ৬৩টি কবর পাওয়া গেছে। ফারাও রাজা, অমাত্যবর্গ, উজির, রাজস্থপতি, পুরোহিত, সেনাপ্রধান, এসব লোকের কবর ছিল এখানে। মৃত্যুর সময় তাদের যার যত স্বর্ণালংকার ছিল, সবই এই কবরে নিয়ে যেত। তিন হাজার বছর ধরে এই জিনিসগুলোর লোভে নানা রকমের চোরের উপদ্রব হয়েছে এখানে। এখনো খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ধারণা করা যাচ্ছে যে, আরও কিছু পাওয়া যেতে পারে। এই গোয়েন্দাগিরি অন্য কেউ যাতে করতে না পারে, এজন্য ছবি তোলা নিষেধ। অন্যকোনো কারণে নয়। তোমাদের ছবি দরকার, তোমরা নেটে সার্চ দিলেই পাবে, সমস্যা নেই।

এনায়েত ভাই গেছেন আমাদের টিকিট কাটতে। জনপ্রতি পঞ্চাশ পাউন্ড একটা টিকেটের দাম। একটা টিকিট দিয়ে যেকোনো ৩টা কবরের ভেতর ঢোকা যায়। প্রাচীন মিশরীয় রাজকবরগুলো দেখতে এসে আমরা যথার্থই ক্লান্ত। যদিও এখন অক্টোবর মাস, তবুও বাইরে প্রচণ্ড গরম। মাথার উপর সূর্যের কড়া তেজ। নিজেদের গাড়ির ভেতর ছাড়া ছায়াময় কোনো আশ্রয় এখানে নেই। কিছুক্ষণ পরপর কতগুলো ট্যুরিস্ট বাস এখানে এসে থামে। দলে দলে লোকেরা নিজেদের ক্যামেরা, মোবাইল ফোন গাড়িতে রেখে লাইন ধরে টিকিট কেটে কেটে ফুড়ুত করে এক-একটা সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে যাচ্ছেন। সুড়ঙ্গের অপর পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর একেকজন বেরিয়ে আসছেন। যেহেতু এখানে আসা সব লোকই মাটির নিচের সুড়ঙ্গে রাখা কবর দেখতে আসেন, তাই মাটির ওপর তেমন কাউকে দেখা যায় না। শুধু গাইডেরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি, গাইডদেরও প্রবেশাধিকার নেই ওখানে। কারণ ‘কবর’-এর ‘পবিত্রতা’ রক্ষার জন্য শব্দ করা নিষেধ।

সায়মা আমাদেরকে একটা বড় ডিসপ্লে বোর্ডের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে রাখে। একটা সাইট ম্যাপ এখানে আছে। কয়েকটা পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে কতগুলো বক্ররেখা চলে গেছে। সেখানে ইংরেজি ‘কেভি’যুক্ত কতগুলো সংখ্যা চিহ্নিত করা।

সায়মা বলে, প্রতিটা কবরকে সংক্ষেপে ‘কেভি’ বলা হয়, ‘ভ্যালি অব কিং’-এর সংক্ষিপ্ত এই রূপ। এই দেখো এখানে ৬৫টি কবরের চিহ্ন দেখানো আছে। কেভি-১ হচ্ছে সেই কবর যা সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল।

মাটির তলার এই কবরের সন্ধান প্রথম কবে পেয়েছিল মিশরি চোরেরা?

হাসে সায়মা। বলে, এগুলো প্রায় হাজার বছর আগেই বের হয়ে গিয়েছিল। ১৮৩৪ সালের দিকে প্রথম এদেরকে এভাবে নামকরণ করা হয়। এসব কাজ এ যুগের মিশরিরা করতে পারেনি। আগের মিশরীয়রা যে পরিমাণ বুদ্ধিমান ছিল, আধুনিক মিশরীয়রা সে পরিমাণ নয়। এগুলো সবাই পশ্চিমা প্রত্নতত্ত্ববিদ আর ইতিহাসবিদদের আবিষ্কার। সেই আবিষ্কার প্রায় দুশো বছর আগে থেকে শুরু হয়েছিল, এখনো চলছে।

কিন্তু কোনটা কার কবর, এটা কী করে বের করে ওরা?

সায়মা বলে, প্রায় প্রত্যেক কবরের ভেতরে ওই মরা লোকটির বৃত্তান্ত লেখা ছিল। তাদের নাম, বাপের নাম এমনকি মৃত্যুর তারিখও। ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদেরা হায়ারোগ্লিফিক শিখে এসে এগুলো উদ্ধার করে আমাদের জানায়, আমরা তাদের কথামতো ক্লাসে ওসব মুখস্থ করি, আর তোমাদের গাইড হিসেবে কাজ করে, সারা দিন বকবক করে দিন শেষে ৩শ’ পাউন্ড পাই, পঞ্চাশ পাউন্ড এজেন্সি নেয়। আমার থাকে আড়াইশ, এই যা।

প্রাচীন যুগের চোর এবং ডাকাতেরা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ঠিকই সমাধির পথ খুঁজে বের করতে এবং সকল ধন-সমপত্তি আত্মসাত্ করতে সক্ষম হয়েছিল। গুপ্তধনের আশায় মিশরের বুকে শত শত গবেষক হন্যে হয়ে সমাধিগুলোতে ঘুরে বেড়িয়ে নিজেদের জীবন শেষ করে দিয়েছেন। মিশরের অতিপ্রাচীন স্থাপত্য আবিষ্কারের অভিযানগুলো প্রকৃতপক্ষে পূর্ণাঙ্গ আঙ্গিকে শুরু হয় ১৮ শতাব্দীতে। ১৯ শতাব্দীতে এসে ইউরোপীয়রাও এ গুপ্তধনের সন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে হতাশ হতে হয়েছিল। কারণ যথেষ্ট গবেষণা করে কোনো সমাধি আবিষ্কারের পর দেখা যেত আগেই কেউ না কেউ সেই গুপ্তধন নিয়ে গেছে।

আমরা ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গের ভেতর ঢোকার প্রস্তুতি নিই। বাড়তি টিকিট কিনে আমরা এসেছি সবচেয়ে আলোকিত কবরটির কাছে। এটিই তুতেনখামেনের অরিজিনাল কবর।

সায়মা বলে, তুতেনখামেনের এই কবর ছাড়া বাকি ৬৪টি কবর থেকে মমি করা লাশ আর কিছু ব্যবহারি, অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। মমিগুলো এখান থেকে নিয়ে কায়রোর জাদুঘরে রাখা আছে, ওখানে গেলে দেখতে পাবে। বেশ কিছু মমিসহ এই কবরের সরঞ্জাম নিয়ে পৃথিবীর সেরা জাদুঘর যেমন ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ফ্রান্সের লুভ মিউজিয়াম বা আমেরিকার ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম সাজানো হয়েছে।

আমি যুক্ত করি, ভারতেও আছে। ১৯৯০ সালে কলকাতার ভারতীয় জাতীয় জাদুঘরে আমি ‘ইজিপশিয়ান ট্রেজার’ দেখেছি। একটা মমিও ওখানে ছিল।

খুশি হয় সায়মা। মিশর সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ তাকে আপ্লুত করে। বলে, আমাদের লোকজন এগুলোর খুব একটা খবর রাখে না।

আমি বলি, ফেরাউনের কবর কোথায়? ওটা দেখা যাবে না?

সায়মা বলে, দ্বিতীয় রামসিসের কবরটি এখন বন্ধ আছে। ভেতরে কাজ করা হচ্ছে। ৬৫টি কবরের মধ্যে ১০-১২টার বেশি একসঙ্গে খোলা হয় না।

সায়মাকে বলি, আরো কিছু কবর কি আছে মনে হয়? যেগুলো এখনো উদ্ধার করা যায়নি।

সায়মা বলে, সম্ভাবনা কম। ১৯২২ সালে এই তুতেনখামেনেরটা আবিষ্কারের পর থেকে হন্যে হয়ে খোঁজা হয়েছে। এর পর ৬৩ নম্বর কবরটির খোঁজ পাওয়া যায় ২০০৫ সালে, ৬৫ নম্বরটি পাওয়া যায় মাত্র গত বছর, ২০০৮ সালে। এ কবরগুলো ঠিক কার, তা জানা গেল না। কারণ, তেমন কিছু ছিল না, হায়ারোগ্লিফিকও না। মনে হয় সাধারণ কোনো রাজকর্মচারীর কবর ছিল এগুলো। আকারেও এগুলো বেশ ছোট।

কবরগুলোর আকার নানা রকমেরই হতো। সবচেয়ে ছোটটা একেবারেই একটা মাটির গর্ত। সবচেয়ে বড়টা ছিল দ্বিতীয় রামসিসের পুত্রদের কবর, কেভি-৫। ওখানে ১২০টি লাশ রাখার খুপরি পাওয়া যায়।

কর্নক মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম আহমোসকে গোপনে সমাহিত করা দিয়ে শুরু হয়েছিল এখানে গোপন কবর দেওয়ার ব্যবস্থা। রামসিস পরিবারের শেষ রাজা একাদশ রামসিসকে দিয়ে শেষ হয় পাহাড়তলার শবায়নের কাজ।

একসময় ভিড়ভাট্টা কমলে, লাইন ধরে আস্তে আস্তে কয়েকটা সিঁড়ি মাড়িয়ে নিচে চলে আসি। হিসাব করে দেখি খুব বেশি না, ৭-৮ ফুট নিচে নেমেছি মাত্র। ১৫টা সিঁড়ি ভেঙেছি। তারপর সামনে একটা দেয়াল। দেয়ালে কিছু ছবি আঁকা। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কিছুই দেখা যাবে না। টর্চলাইট হাতে নিচে কিছু লোক দাঁড়িয়ে বাতি দেখায়। ছবি দেখি। এসব ছবি এর আগে বিভিন্ন মন্দিরে দেখেছি। ডানে বামে দুটো পথ চলে গেছে। হালকা বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা আছে করিডরে। সেই করিডর ধরে ধরে ভেতরে গিয়ে এক জায়গায় লেখা দেখি ‘বুরিয়াল চেম্বার’। মানে—এটাই মূল কবরখানা? কিন্তু কোথায় সোনার পাতে মোড়ানো কফিন? সোনার খাট পালঙ্ক?

কোথাও কিছু নেই। এটা একেবারেই খালি একটা ঘর। এই ঘরের আদলে কবরখানা বানিয়ে রাখা হয়েছে কায়রোর ‘ফারাওনিক ভিলেজ’-এ, আর মূল জিনিসগুলো আছে কায়রো জাদুঘরে।

কায়রোতে গিয়ে আমরা আবার দেখা পাব তুতেনখামেনের, তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর আগে কেমন ছিল রাজার কবরখানা, সেটা চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হবে কায়রো যাওয়ার পর।

এমনি মাটির তলার পরিবেশ, তার ওপর কবরখানা। হোক না তা তারকা ফারাও তুতেনখামেনের কবর, বেশিক্ষণ ভালো লাগে না ওখানে। দ্রুত উঠে চলে আসি বাইরে।

তুতেনখামেনের কবরটি যে পাহাড়ে, ভুল করে সেই পাহাড়ের ওপর কিছু ঘরবাড়ি বানানো হয়েছিল বলে কোনো চোর এত শত বছরেও এখানে হাত দেওয়ার ইচ্ছা করেনি। তাই বেঁচে গিয়েছিল তাহার কবরের সম্পদ।

এই তুতেনখামেনের কবর নিয়ে নানা রকম রহস্যগল্প আছে। তুতেনখামেনের অভিশাপ তার কবরের উদ্ধারকারীকে কী পরিমাণ বিপর্যস্ত করেছিল, সেগুলো নিয়ে আছে লোমহর্ষক নানা কাহিনি।

আমরা এই রোদে পুড়ে এখন বেশ ক্লান্ত। নীলনদের ওপর নোঙর করা আমাদের রাজকীয় জাহাজ। অনেক আমুদে উপাদান আছে জাহাজটিতে, তার কিছুই আমাদের উপভোগ করা হয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আপাতত জ্ঞানার্জন আর নয়। আমরা এখন কেবলই নীলনদের স্বাদ নেব। বাকি দু-দিন দু-রাত আমাদের নীল বিহারের পালা।

শাকুর মজিদ





Find us on Facebook Nobin Kontho