বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৭

বিসিএস প্রজন্ম ও করের টাকার অপচয় | নাজমুল হাসান

দেশের সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের নিকট সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় কী? যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন? সবাই একসাথে বলে উঠবে বিসিএস। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের সংক্ষিপ্ত নাম বিসিএস। বলতে গেলে অনেকটাই সোনার হরিণ এই বিসিএস। খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে এই হরিণ ধরতে পারলেই হলো। জীবন সুনিশ্চিত। এই হরিণের পেছনে ছুটে সেটাকে ধরতে চাওয়া অপরাধ নয়। তবে ধরার
চেষ্টা করতে গিয়ে দেশ কিংবা নিজের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে কেউ কি একবার ভেবে দেখেছেন?

কিছুদিন আগে ৩৬তম বিসিএস-এর সর্বশেষ ফলাফল প্রকাশিত হলো। আমার ক্যামপাসে একজন তুমুল আলোচনায়। তিনি কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়েছিলেন, তারপর এখন তিনি ফরেন ক্যাডার। এবং খুবই ভালো অবস্থানে থেকে সুযোগ পেয়েছেন। সবার বাহবা শুনতে শুনতে হয়তো এতক্ষণে তিনি ক্লান্ত। তবে তিনি কি ভেবে দেখেছেন সরকার তার শিক্ষার জন্য যে টাকা ব্যয় করেছে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে, তার পুরোটাই তিনি অপচয় করে দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, পাশের বাড়িতে এক আপু থাকেন। ফার্মাসিস্ট। বেসরকারি চাকরি। ভালো বেতন। তবুও দেখতাম আপু হতাশ। কেন? জানতে চাইলে বলতেন ভবিষ্যত্ নিশ্চিত নয়। সেজন্য বিসিএস-এর চেষ্টা করছিলেন। এবং হয়েও গেলো। এখন তিনি একজন সিভিল সার্ভিসের ক্যাডার। ফার্মাসী সম্পর্কিত কোনো কাজ তাকে আর করতে হবে না। তাহলে ফার্মাসী শিল্পে উন্নতি করার লক্ষ্যে জনগণের টাকায় কেন পড়ালেখা করলেন? কেনইবা মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকা থেকে দেয়া করের অপচয় করলেন? তাহলে বলা যায় বিসিএস-এর সফল দিকের সাথে ব্যর্থ দিকও আছে বটে।

অনেকে বলতে পারেন, এসব গুটিকয়েক উদাহরণ দিয়ে পুরো ব্যবস্থাকে বিচার না করতে। আমি বলবো, গুটিকয়েক নয় বর্তমানে সারা দেশের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে শুধু বিসিএসকেন্দ্রিক চিন্তাধারা। ডাক্তারি পাস করে পুলিশ হচ্ছে। বুয়েট থেকে বের হয়ে প্রকৌশলী হবার কথা, সেই জায়গায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করছে। কৃষি থেকে পড়ে যেখানে কৃষির উন্নয়নের জন্য কাজ করার কথা সেখানে সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছে। এরকম নজির অহরহ। শুধু দেখার দৃষ্টি প্রয়োজন। আমরা দেখেও দেখছি না। এভাবে অন্ধভাবে বিসিএস-এর পেছনে ছুটে চলাকে পানিতে ভাসা মৃত মাছের সাথে তুলনা করা যায়। পানিতে ভাসা মাছ যেমন স্রোতের সাথে ভেসে চলে যায় তেমনি আমাদের এই বিসিএস প্রজন্ম। স্রোতে গা এলিয়ে দিয়ে ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করছে। আর দেশের কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা পড়ালেখার নামে অপচয় করছে।

চিকিত্সা আর প্রকৌশল খাতে সরকারের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনে একজন শিক্ষার্থীর এই খরচের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ অর্থ সরকার অর্থাত্ জনগণ তথা ট্যাক্সপেয়ারদের টাকায় মেটায়। তাছাড়া সেশনজট, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, ক্যামপাস সহিংসতার কারণে চার বছরের স্নাতক করতে ছয় বছর পর্যন্ত লেগে যায়। ফলে সরকারের অপচয় হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। না, আমি বলছি না বিসিএস-এর প্রয়োজন নেই। অবশ্যই দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে মেধাবীদের প্রয়োজন আছে। তবে যে বা যারা যে বিষয়ে পড়েছেন, তার বা তাদের সেই বিষয় সম্পর্কিত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে পারাটাই সময়ের দাবি। এছাড়া  দেশের সবাইকে বিসিএস নামক একটা চাকরিকেই ধ্যানজ্ঞানে পরিণত করে ফেলতে হবে কেন? প্রতিবছর বিসিএস-এর জন্য দুই তিন লাখ পরীক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে অকৃতকার্য হয় যারা তারা কী খুব খারাপ আছেন? খারাপ থাকলে তা আমাদের সমাজের দোষ। জন্মদাতা থেকে কন্যাদাতা, সবাই সরকারি চাকরিজীবী চায়। আর এই চাপের কারণেই কেউ নির্ভাবনার জীবন কাটাতে পারে না। সাথে কোচিং ব্যবসায়ীরা তো আছেই। বড় বড় স্বপ্ন ফ্রিতে দেখিয়ে গাইড হাতে ধরিয়ে দেয়। আর সেই গাইডের বিনিময়ে কাঁড়ি-কাঁড়ি অর্থ নিজের পকেটে নিয়ে নিচ্ছে। অথচ সরকারি চাকরিই করতে হবে এই ভাবনার কারণে জীবনের বহু মূল্যবান সময় যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি নষ্ট হচ্ছে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ। সরকার যেখানে প্রযুক্তি, চিকিত্সা, রসায়ন, ফিজিক্স, বাংলা, কৃষি প্রভৃতি বিষয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে সাহায্য নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা করে বসে আছে, সেখানে সবাই ব্যস্ত সরকারি ব্যাংক বা বিসিএস ক্যাডার হয়ে ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করতে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। যদিও সংখ্যাটা কম। নিজ উদ্যোগে সৃজনশীল কাজ করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চেষ্টা করছে, গবেষণা করছে, বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে, নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবটুকু দিয়ে উন্নয়নের চেষ্টা করে চলেছেন অনেকেই। আমার দৃষ্টিতে তারাই বাহবা পাবার যোগ্য।

দেশের স্বার্থে বিসিএস-এর প্রয়োজন আবার দেশেরই স্বার্থেই বিসিএস চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীন প্রযুক্তিশিল্পে দিন দিন উন্নতি করে চলছে। আর আমাদের শিক্ষার্থীরা? বিসিএস গাইড হাতে সকাল সকাল লাইব্রেরিতে দৌড়, একটা ভালো আসনে যে বসতে হবে। একাডেমিক ক্লাসের তোয়াক্কা না করে কোচিং সেন্টারে ক্লাস করছে। এমন অবস্থার পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। ভারত, চীন তথা দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের মানুষের কি সরকারি চাকরির দরকার নেই? অবশ্যই আছে। তবে সরকারি চাকরিই করতে হবে এমন মানসিকতা তাদের নেই। যা আমাদের মাঝে তৈরি করা প্রয়োজন। জীবনধর্মী ও কর্মমুখী শিক্ষাই পারে বিসিএস চিন্তাধারা ভুলে সৃজনশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে। আর বেসরকারি চাকরি জীবনেও চাই নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়





Find Nobin Kontho on Facebook