আজকের রোহিঙ্গা সংকটের পেছনের কারণগুলো জানতে হলে একটু ইতিহাস চর্চা করা দরকার। বর্তমান মিয়ানমারের আগের নাম ছিল বার্মা। আর বর্তমান রাখাইন এলাকার আগের নাম ছিল আরাকান। আর রোহাঙ্গ (Rohang) হলো আরকানের পূর্বতন ইসলামি নাম। মূলত মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্তে বঙ্গোপসাগর
তীরবর্তী রাখাইন প্রদেশের অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে আগত জনগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গা বলে অভিহিত করা হয়। বার্মা সরকার রোহিঙ্গা শব্দটিকে অনুমোদন দেয়নি। তারা এই জনগোষ্ঠীকে ‘বাঙালি’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে রোহিঙ্গা বলে পরিচয় দেয়।
তীরবর্তী রাখাইন প্রদেশের অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে আগত জনগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গা বলে অভিহিত করা হয়। বার্মা সরকার রোহিঙ্গা শব্দটিকে অনুমোদন দেয়নি। তারা এই জনগোষ্ঠীকে ‘বাঙালি’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে রোহিঙ্গা বলে পরিচয় দেয়।
‘রোহিঙ্গা’ নামটির উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে নানা মত। কেউ কেউ মনে করেন, প্রাচীন আরাকানিরা তাদের বাসভূমিকে বলত ‘রখইঙ্গ’। এই শব্দটি কালক্রমে মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখায় ‘আরখং’ বা ‘রাখাংগ’-এ পরিণত হয়। সম্ভবত ইউরোপীয়দের উচ্চারণে সেটাই হয়ে যায় ‘আরাকান’। একইভাবে, এই রাখাংগ বা ‘রাখাইন’ শব্দ থেকে ‘রোয়াং’ ‘রোহাঙ্গ’ হয়ে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।
আর একটি মত হলো, অষ্টম শতাব্দীতে আরাকানে চন্দ্রবংশীয় রাজা মহৎ-ইঙ্গ-চন্দ্রের শাসনকালে সেখানে কয়েকটি আরবীয় বাণিজ্যতরী ডুবতে বসলে তার নাবিকরা ‘রহম, রহম’ (অর্থাৎ, দয়া) বলে চিৎকার শুরু করে। চিৎকার শুনে স্থানীয় আরাকানিরা তাদের উদ্ধার করে এবং রাজা মহৎ তাদের সেখানেই বসবাস করার অনুমতি দেন। যেহেতু স্থানীয় মানুষরা আরবি ভাষা জানত না, তাই তারা আরবের ওই বণিকদের ‘রহম’ বলেই চিহ্নিত করতে থাকে, যা পরবর্তী কালে রোঁয়াই > রোয়াই > রোয়াইঙ্গা > রোহিঙ্গা হয়ে যায়।
প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাচ্ছে, ১৫১ সাল নাগাদ আরাকানে বৌদ্ধ রাজত্বের পত্তন, যখন মগধ থেকে আগত বৌদ্ধ সেনারা সেখানকার আদিবাসীদের পরাজিত করে ও তাদের বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে দীক্ষিত করে তোলে। আরাকানে আরবীয় বণিকদের আনাগোনা শুরু হয় ৬৬০ সালের মধ্যে। রাজা মহতের সময় বসবাসের অনুমতি পেয়ে তারা ক্রমশ আরাকানি সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে। এভাবেই ক্রমশ আরাকান আরব বণিকদের দ্বিতীয় নিবাস হয়ে ওঠে, এবং তাদের বংশবৃদ্ধির ফলে সেখানে মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
এসব দশম-একাদশ শতাব্দীর ঘটনা। এর থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, রোহিঙ্গারা আদৌ বাঙালি নয় বা কোনও কালে ছিলও না, এবং প্রকৃতপক্ষে আরবি বহিরাগতদের সঙ্গে স্থানীয় আরাকানিদের বিবাহজ বা যৌন সম্পর্কের ফলেই আজকের রোহিঙ্গাদের উদ্ভব হয়েছে। কাজী আতাহার মুবারকপুরীর ‘আরব ওয়া হিন্দ আহদে রেসালাত’, আবদুল হক চৌধুরীর ‘প্রাচীন আরাকান: রোয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী’ ইত্যাদি কিছু বইয়ে এই সব প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে।
তবে আরাকানের বঙ্গ-সংসর্গ তো অনস্বীকার্য। সেটা ঠিক কী ভাবে শুরু হয়েছিল? মাহবুবুল আলমের বই ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস: পুরানা আমল’ থেকে জানা যায়, ১৪০৪ সালে আরাকানের রাজা নরমিখলা এক সামন্তরাজের বোনকে বলপূর্বক গ্রহণ করলে সেই সামন্ত তৎকালীন বর্মীরাজ মেঙশোওয়াইয়ের কাছে তার প্রতিকার চান। বর্মীরাজ আরাকান আক্রমণ করলে যুদ্ধে পরাজিত নরমিখলা আশ্রয় নেন বাংলায়। পরে বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ’র সহযোগিতায় তিনি আরাকান পুনর্দখল করে ‘মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ’ উপাধি নিয়ে আবার রাজত্ব শুরু করেন। এই সময়ে তার সঙ্গে আগত বাংলার অনেক সৈন্য স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে ওখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। উল্লেখ্য, এর পরেই আরাকানের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয় দৌলত কাজী, সৈয়দ আলাওল প্রমুখের হাত ধরে; যা আমরা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়েছি।
কিন্তু সেই সাহিত্য বাংলার মানুষের উপর দারুণ প্রভাব ফেললেও, রোহিঙ্গাদের ঠিক ততটা স্পর্শ করতে পারেনি। বরং সমন্বয়বাদী সুফি ঘরানার উদার ইসলামের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গারা ক্রমশ হয়ে ওঠে তাদের প্রকৃত পূর্বপুরুষ আরবদের মতো সালাফি বা ‘কট্টরপন্থী।’ এই কারণে আরাকানের বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে বার বার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে তারা। ১৯৪২ সালে মগ-রোহিঙ্গা দাঙ্গার মূল কারণই ছিল রোহিঙ্গাদের দ্বারা গৌতম বুদ্ধের অবমাননা।
আরাকানে বাঙালির পদার্পণের বহু আগে থেকেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল, এবং পরবর্তীকালে যাওয়া বাঙালিদের কেউ কেউ বিবাহসূত্রে সেই জনগোষ্ঠীতে মিশে গিয়েছে। অধিক জন্মহারের কারণে সংখ্যায় বেড়ে গিয়ে রোহিঙ্গারা সব সময়ই রাখাইন বৌদ্ধদের কাছে ‘শত্রু’ হিসেবে গণ্য হয়। সেখানকার বৌদ্ধরা সব সময়ই এক ধরনের ‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ অনুভব করে। তৈরি হয় বিদ্বেষ।
বার্মার স্বাধীনতার কিছু আগে থেকেই আরাকান এলাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখা দেয়। এটা মূলত ছিল ব্রিটিশবাহিনীতে নিযুক্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জাপান সমর্থক রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে। বার্মার স্বাধীনতার পর দেখা গেল বার্মা সরকারের উচ্চ বহুপদে রোহিঙ্গারা আসীন হয়েছে। অপরদিকে রাখাইন বৌদ্ধরা পৃথক আরকানি রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলে। ওদিকে রোহিঙ্গাদের বড় অংশ আরাকানের উত্তর অংশকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানাতে থাকে। এই পটভূমিতে রোহিঙ্গাদের প্রতি জাতিবিদ্বেষ ও বঞ্চনা বাড়তে শুরু করে। ১৯৬২ সালে সেনাবাহিনী কর্তৃক সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা দখলের পরে বার্মা প্রশাসন ঘোষণা করে যে, রোহিঙ্গারা বার্মার ১৩৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশ নয়। ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব আইনের পরিবর্তন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার পুরোপুরি কেড়ে নেয়। ১৯৮৯ সালে বার্মার নাম পরিবর্তন করে মিয়ানমার করা হয়। ৯০’র দশকে কিছু রোহিঙ্গা মুসলিম পরিচয়পত্র পেলেও নাগরিকত্বের অধিকার পায়নি। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত কমিশনের প্রচেষ্টায় বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে পুনরায় রাখাইন এলাকায় পুনর্বাসন করা হলেও রাখাইন বৌদ্ধদের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। উভয় অংশের মধ্যেই মৌলবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।
এই পটভূমিতেই একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালে রাখাইনে তীব্র দাঙ্গা সংঘঠিত হয়। এর ফলে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরা বার্মার প্রশাসন ও বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়। সরকারি হিসাবে ২০০ জন রোহিঙ্গা খুন হন। প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনে নথিভুক্ত হয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেয়। ২০১৩ সাল হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রতি কমবেশি আক্রমণের ঘটনা ঘটতে থাকে। ইতিমধ্যে ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর সামরিক জান্তার পরিবর্তে নির্বাচনের মাধ্যমে সুকি ক্ষমতা লাভ করেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রতি বঞ্চনা ও বিদ্বেষ বন্ধ হয়নি। তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির অধিবাসী বলেও গণ্য করে দমন-নির্যাতন চলতে থাকে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমালোচনার মুখে পড়ে সু চি। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। কফি আনান তার রিপোর্টে সতর্ক করেন যে, রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ বঞ্চনা বন্ধ না হলে তাদের মধ্যে মুসলিম জঙ্গিবাদের প্রভাব ব্যাপক বাড়বে। কিন্তু বিদ্বেষ ও বঞ্চনা বন্ধে কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
রোহিঙ্গা
উল্লিখিত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, রোহিঙ্গা সমস্যা নেহাতই একটি শরণার্থী সমস্যা নয়। এটি আসলে একটি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ অথবা নিশ্চিহ্ন করবার দীর্ঘদিনের একটি প্রক্রিয়ার ফল! প্রশ্ন হলো এই সংকটের নিরসন কীভাবে সম্ভব? আদৌ কী সম্ভব?
এই সংকটের সমাধানে প্রথমেই যা অপরিহার্য, তা হলো মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রীকরণ। মিয়ানমারকে সেই দেশে পরিণত হতে হবে, যেখানে জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিচারে প্রত্যেকে শান্তিতে ও সমমর্যাদায় থাকতে পারবে। রাখাইন-এর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে এবং সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকেও সক্রিয় ও তৎপর হতে হবে। অর্থাৎ ভারত চীন বাংলাদেশ থাইল্যান্ড মালয়েশিয়াকে সম্মিলিত প্রভাব বিস্তার করতে হবে, মিয়ানমারকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে হবে যে জাতি-নিপীড়ন আঞ্চলিক সাম্য ও মৈত্রীকে বিঘ্নিত করছে। তৃতীয়ত, আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ার স্তর অতিক্রম করে বিশ্বের দৃষ্টি ফেরাতে হবে মিয়ানমারের দিকে। বুঝতে ও বোঝাতে হবে যে শুধু ভূমধ্যসাগরে নয়, বঙ্গোপসাগরেও শত শত নিরাশ্রয়, বিতাড়িত রোহিঙ্গা পুরুষ-নারী-শিশু এখনও ভাসমান। বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা পুরুষ-নারী-শিশু নিরন্ন, দিশাহীন। শেষ কথা, এই গভীর সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে দেরি না করেই ব্যাপক আলোচনা শুরু হওয়া দরকার, যাতে যোগ দেবে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীও, যারা এত দিন ভূমধ্যসাগরে ভাসমান শরণার্থীদের নিয়েই ভাবিত ছিল।
আন্তর্জাতিক স্তরে জনমত গঠন ও প্রচার নিঃসন্দেহে জরুরি। সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধ নিয়ে যদি আলাপ-আলোচনা চলতে পারে, রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও তা শুরু হবে না কেন?
আর সকল মানবের কণ্ঠে শুধু নয়, হৃদয়ে গেঁথে দিতে হবে মহামতি বুদ্ধের পবিত্র বাণী : ‘অহিংসা পরমধর্ম, জীবহত্যা মহাপাপ।’
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, উল্লিখিত সবই থিওরি বা তত্ত্বকথা, বুকিশ কথাবার্তা! বাস্তবে নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা বাদ দিয়ে কে কার কথা শুনবে, আর কে-ই বা তা শোনাতে ও মানাতে বাধ্য করবে? তবে কী দশ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা অনন্তকাল বয়ে চলাই হবে আমাদের ভবিতব্য?
Find Nobin Kontho on Facebook