শুক্রবার, ২ মার্চ, ২০১৮

‘একটি পতাকা ও স্বাধীনতা’ : সঠিক তথ্য | ইউসূফ সালাহ উদ্দীন আহমদ

গত ৬ মার্চ যুগান্তরে প্রকাশিত ‘একটি পতাকা ও স্বাধীনতা’ শিরোনামে ডা. এম এ হাসানের নিবন্ধে একটি ভুল তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে ধরছি। আমি ১৯৬৯-৭০ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং আহসানউল্লাহ হলের ২০৪ নম্বর কক্ষে থাকতাম। বাংলাদেশের পতাকা তৈরিতে আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ডা. হাসানের আলোচ্য প্রতিবেদনে মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ ও আমার নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আহসানউল্লাহ হলের ২০৪ নম্বর কক্ষে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা তৈরি করা হয়। এ তথ্য সঠিক নয়। আমি ১৯৮৯ সাল থেকে আমেরিকায় প্রবাসী
জীবনযাপন করছি। ডা. হাসানের সঙ্গে আমার কখনও কোনো যোগাযোগ হয়নি। তার দেয়া তথ্যের উৎস কী আমি জানি না। তবে আমাদের আজকের ও আগামীর প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস রেখে যাওয়া জরুরি। তাই এ লেখার মাধ্যমে জানাতে চাই, ১৯৬৯-৭০ সালে আহসানউল্লাহ হলের আমার ২০৪ নম্বর কক্ষটি কার্যত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের যোগাযোগ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এ কক্ষেই ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী (নিউক্লিয়াসের) নেতাদের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। তবে আমার কক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি এবং ওটা তৈরিও হয়নি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার নিবন্ধে এবং ফেসবুকে পোস্টিং দেখি যেগুলোতে বাবু শিবনারায়ণ দাসকে অর্থাৎ আমার শ্রদ্ধেয় শিবুদাকে বাংলাদেশের পতাকার নকশাকার কিংবা রূপকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ডা. এম এ হাসান ইউসূফ সালাহউদ্দীন, অর্থাৎ আমাকে এবং মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশকে বাংলাদেশের পতাকার মূল পরিকল্পনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। এর কোনটাই সঠিক নয়। ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ই বাহিনী’ যেটাকে সবাই ‘জয়বাংলা বাহিনী’ বলে উল্লেখ করে থাকে সেই বাহিনীর পতাকা তৈরিতে ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের একজন হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ১৯৭০-এর ৬ জুন রাতে তৎকালীন ইকবাল হল, বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের নিচতলার ১১৮ নম্বর কক্ষে যৌথ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পতাকার নকশা ঠিক করা হয়। তাতে মুখ্য ভূমিকা ছিল শহীদ কাজী আরেফ আহমদের এবং নেপথ্যে ছিলেন সিরাজুল আলম খান ও মরহুম আবদুর রাজ্জাক। আর এ সবকিছুর স্বপ্ন দেখিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এছাড়া পতাকা তৈরিতে অন্য যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন বা যারা শ্রম দিয়েছেন তাদের নাম নিম্নোক্ত বর্ণনায় উল্লেখ করছি।

১৯৬০-এর দশকের ৬ দফাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আগুনঝরা দিনগুলোতে এ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে একাধিক গোপন ও কিছু প্রকাশ্য সংগঠন গড়ে ওঠে। ঢাকায় ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে ’৬০-এর দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬ দফাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় শাণিত ছাত্রলীগের একাংশের উদ্যোগে এমনই একটি সংগঠনের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারাধীন আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যা দিবস স্মরণে এ বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ই বাহিনী’, যেটাকে আজকাল ব্যাপকভাবে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বাহিনীর জন্য প্রয়োজন হয় বাহিনী পতাকার, যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘রেজিমেন্টাল কালার’। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১৯৭০ সালের ৭ জুন ৬ দফা দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানে শ্রমিক লীগ আয়োজিত সমাবেশের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকে বাহিনীর পক্ষ থেকে অভিবাদন প্রদান এবং বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে বাহিনী পতাকা গ্রহণের মাধ্যমে এ বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৬ জুন রাতে পতাকা তৈরি নিয়ে মিটিং বসে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ১১৮ নম্বর কক্ষে। এ কক্ষটি বরাদ্দ ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব আর শাহজাহান সিরাজের নামে। মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন কাজী আরেফ আহমদ, মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, হাসানুল হক ইনু, চিশতি শাহ্ হেলালুর রহমান, শিবনারায়ণ দাস এবং আমি। মিটিংয়ে অবস্থান না করে যারা পতাকা তৈরির জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ শহিদুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, গোলাম ফারুক, রফিকুল ইসলাম ওরফে লিটল কমরেড ও কামরুল আলম খান ওরফে খসরু অন্যতম। সভায় কাজী আরেফ আহমদের প্রস্তাবের ওপর আলাপ-আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হল পতাকায় সবুজ জমিনের ওপর থাকবে একটি লাল বৃত্ত, আর লাল বৃত্তের মাঝে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সবুজ জমিন বাংলার চির সবুজের প্রতীক, শহীদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠবে স্বাধীনতার সূর্য। সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত তারই প্রতীক; আর জন্ম নেবে একটি নতুন দেশ সোনালি আঁশের রঙে হবে যার পরিচয়। লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালি রঙের মানচিত্র হবে তারই প্রতীক।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই কাজে নেমে পড়লাম। খসরু ভাই কয়েকজন ছাত্রকর্মীকে নিয়ে গেলেন বলাকা সিনেমা হলের তিনতলায় এক বিহারি দর্জির দোকানে। বড় একটুকরা সবুজ কাপড়ের মাঝে সেলাই করে আনলেন লাল বৃত্তাকার কাপড়। এখন দেখা দিল আরেক সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সিদ্ধান্ত হল ওটা লাল বৃত্তের মাঝে রঙ দিয়ে আঁকা হবে। আঁকাআঁকিতে কুমিল্লার শিবুদার হাত ছিল ভালো। তিনি বললেন, ‘আমি বাপু পেইন্ট করতে পারব, তবে মানচিত্র আঁকতে আমি পারব না।’ কী করা যায়? ঠিক করলাম হাসানুল হক ইনু আর আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ট্রেসিং পেপারে ট্রেস করে নিয়ে আসব। আমরা গেলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ্ হলে (বর্তমানে তিতুমীর হল)। উল্লেখ্য, আমি এবং ইনু ভাই উভয়েই তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জিন্নাহ্ হলের (বর্তমানে তিতুমীর হল) ৩০৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন এনামুল হক (ইনু ভাইয়ের কাজিন)। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিলাম। ট্রেসিং পেপারে আঁকলাম পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। রফিকুল ইসলাম নিউমার্কেটে বন্ধুর দোকান থেকে রং আর তুলি জোগাড় করল। নিয়ে ফিরলাম সবাই ইকবাল হলের ১১৮ নম্বর কক্ষে। বাকি সবাই সেখানে অপেক্ষা করছিল। শিবুদা তার নিপুণ হাতে ট্রেসিং পেপার কেটে লাল বৃত্তের ওপর বসিয়ে তাতে সোনালি রং লাগিয়ে দিলেন। হয়ে গেল বাংলাদেশের মানচিত্র। তৈরি হয়ে গেল বাহিনী পতাকা।
পতাকা তৈরির সঙ্গে জড়িত যাদের নাম আমি উল্লেখ করেছি তারা ছাড়াও আরও অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এ বাহিনী সংগঠিত করার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে আ ফ ম মাহবুবুল হক, আফতাব উদ্দীন আহমদ, রেজাউল হক চৌধুরী, স্বপন কুমার চৌধুরী, বদিউল আলম, রায়হান ফেরদৌস, বিপ্লব রায়, আবদুল্লাহ সানি, মইনুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল হক, নজরুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ অন্যতম। এখানে বলা প্রয়োজন, উল্লিখিত নামের বাইরেও আরও অনেকেই এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যাদের অনেকের নাম আজ ৪৭ বছর পর আমার স্মরণে নেই।
পরদিন অর্থাৎ ৭ জুন সকালে আমরা বাহিনীর সদস্যরা সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাঙ্গণে জমায়েত হলাম। সেখান থেকে মিছিল করে পল্টন ময়দানে গেলাম। সেখানে মঞ্চে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জ্ঞাপন শেষে আ স ম রব বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে উপরোল্লিখিত বাহিনী পতাকা গ্রহণ করেন। এ পতাকা নিতেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি আর পরে এ পতাকাই মানচিত্র বাদ দিয়ে জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়।
এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন, ডা. হাসানের নিবন্ধে ঢাকা কলেজের ১৯৬৫-৬৭ ব্যাচের ছাত্রলীগ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, ইউসূফ সালাহউদ্দীন, মইনুল ইসলাম চৌধুরী, কাজী ফিরোজ শাহ, আবদুল্লাহ সানি ও গোলাম ফারুকের সমন্বয়ে গড়া যে গোপন সংগঠনের কথা বলা হয়েছে তা সঠিক। আমরা এ সংগঠনের নাম দিয়েছিলাম ‘বাংলা মুক্তি জোট’ (বামুজ)। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে এ রকম অনেক সংগঠন তখন সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল। তবে বামুজের সঙ্গে পতাকা তৈরির কোনো সম্পর্ক ছিল না।
ইউসূফ সালাহউদ্দীন আহমদ : মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
ysa4950@yahoo.com




Find Nobin Kontho on Facebook