শুক্রবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আঞ্চলিক পর্যায়ে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি | শান্তনু মজুমদার

সরকারভেদে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে। সার্কভুক্ত প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় থাকার সময় দৃশ্যত ভারতের সাথে সম্পর্ক খানিকটা উষ্ণ থাকে। আবার ভারত-বিরোধিতার হাওয়া তোলা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী নামধারীরা ক্ষমতায় থাকার সময় ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক দৃশ্যতই কেমন যেন ঠান্ডা মেরে যায়। তবে কিছুদিন আগে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী
নামধারীদের প্রধান দলটির নেতার নয়াদিল্লি সফরের সময় থেকে যেসব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, তাতে এই দল আবার কখনও ক্ষমতায় এলে ভারতের সাথে সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিশ্চয় দেখার বিষয় হবে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে ক্ষেত্রে আবার বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের আমলে নিষ্ক্রিয়-নিশ্চল একটা ব্যাপার লক্ষ করা যায়। এতই নিশ্চল-নিষ্ক্রিয় যে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলের সরকার একাত্তরের মূল অপরাধী পাকিস্তানি জেনারেলদের বিচারের উদ্যোগ নিতে ভুলে যায়। পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনাগুলো নিয়ে কথাবার্তা বলে না; একাত্তরের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করায় চাপ দেওয়ার কথা ভুলে যায়। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের সমস্যাটি নিরসন নিয়েও ইসলামাবাদকে চাপ দেয় না ঢাকা। আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের সময় উষ্ণ না হলেও পাকিস্তানের সাথে আমাদের 'যেন কোনোদিন কিছু হয়নি' মতন একটা আবহ লক্ষ করা যায়। রাজনীতিতে যেসব ইতিহাস ও উপাদানগুলোর ওপর ভর করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামক একটি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছে, তার ঝান্ডা বহনকারীদের জন্য হয়তো পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে ক্ষেত্রে 'কোনোদিন কিছু হয়নি' ভাব অনুসরণ করাটাই লাভজনক। পররাষ্ট্রনীতি বলতে অর্থহীন সহবতচর্চা কিংবা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সুবিধাবাদ-চর্চা বোঝায়—তাহলে এসব ঠিক আছে। কিন্তু পররাষ্ট্রবিষয়ক কার্যক্রমের মধ্যে যদি নিজেদের ন্যায্য পাওনা বুঝে নেওয়া এবং নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের মতো ব্যাপারগুলো জড়িত থাকে, তাহলে ভারত ও পাকিস্তান কোনোটির সাথেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সে অর্থে সফল নয়।


সার্কভুক্ত বাকি প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে এখন অবধি তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আঞ্চলিক পর্যায়ে ইতিবাচকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সুযোগ নানা রকমের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অন্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বেশি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা কিংবা বিবাদ-মীমাংসার মতো ইস্যুগুলো ধরা যাক। ভালোভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এসব ক্ষেত্রে এখন অবধি নানাবিধ সঙ্গত-অনুমেয় কারণেই সার্কের বাকি সদস্যদেশের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পাবার মতো অবস্থাতে নেই ভারত। কারণ ক্ষুদ্র প্রতিবেশীরা ভারতের মধ্যে একধরনের মুরব্বিয়ানার দেখা পায়। ভারত হয় এটা সচেতনভাবে চায়, অথবা এই দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন নয়। আর ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক এমনই যে, আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারতের নেতৃত্ব পাকিস্তানের পক্ষে মেনে নেওয়াই সম্ভব হয় না। পাকিস্তানের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে ভারতের ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য। ছাড়াও বর্তমানে পাকিস্তানের ইমেজ এতটাই নেতিবাচক যে, প্রতিবেশী দেশগুলো কোনো ক্ষেত্রেই দেশটিকে সামনে রেখে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পা ফেলতে চাইবে বলে মনে হয় না।



সার্কের অপর দুই দেশ নেপাল শ্রীলঙ্কা। সামপ্রতিক বছরগুলোর কথা ধরলে প্রথম দেশটির রাজনৈতিক উন্নয়ন বিস্ময়কর। দেশটি রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সংবিধান রচনার কাজ নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠার পরিণতিতে নেপাল তার অনেক সম্ভাবনাই যেন হারিয়ে ফেলতে বসেছে। অন্যদিকে, তামিল বিদ্রোহ দমনের জন্য কয়েক বছর আগে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ যে মাত্রাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তা বিবাদ-মীমাংসার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে দ্বীপরাষ্ট্রটির গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে দিয়েছে। সার্কের আরও দুই দেশ হচ্ছেমালদ্বীপ ভুটান। বাস্তবতা হচ্ছে, এই যে দুটো দেশই বলতে গেলে একরকম নিজেদের মতো নিজেরা আছে। ছোট আয়তন, ছোট জনসংখ্যা, ছোট অর্থনীতি এখন অবধি প্রায়-গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে এদের অংশগ্রহণ বলতে গেলে নিতান্তই অংশগ্রহণমূলক। সার্কের নবীনতম সদস্য আফগানিস্তান প্রসঙ্গে আর কী- বা বলা যায়! এভাবে দেখলে বাকি থাকে বাংলাদেশ। সত্য বটে, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশটির প্রচুর সমস্যা। কিন্তু কথা হচ্ছে, রকম সমস্যা একটু কম একটু বেশি করে সার্ক অঞ্চলের প্রত্যেকটি দেশেরই আছে; বলতে কি, পৃথিবীর সব দেশেরই আছে। কিন্তু যাবতীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অন্যদের তুলনায় যে ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে তা হচ্ছে, প্রতিবেশীর নিকট গ্রহণযোগ্যতা। ইউরোপ-আমেরিকার মাটিতে বসে সার্কভুক্ত প্রতিবেশীদের মধ্যে ব্যক্তিগত বা সামাজিক আলাপ-সালাপে এটা খুব ভালোভাবে ধরা পড়ে। গড়ে ভারতের ব্যাপারে নেপালিদের কিংবা পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারতীয়দের কিংবা ভারতের ব্যাপারে পাকিস্তানিদের কিংবা পাকিস্তানের ব্যাপারে আফগানদের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার নেতিবাচক মনোভাব দেখা যায়। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় আর একাত্তর-পূর্ব জগতে বাস করা কিছু বোকা পাকিস্তানি ছাড়া আর কারও মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে তেমন উচ্চমাত্রার কোনো নেতিবাচক মনোভাব দেখা যায় না। সাংঘাতিক রকম ইতিবাচক ইমেজ না থাকলেও সাংঘাতিক নেতিবাচক ইমেজ না থাকাটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বড় মূলধন। 



উপরোক্ত মূলধন কাজে লাগিয়ে শুধু নিজের নয়, পুরো সার্ক অঞ্চলের অবস্থার উন্নতিতে ভূমিকা রাখায় সক্রিয় হওয়ার কথা ভাবতে পারে বাংলাদেশ। তবে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা বিষয়টি হচ্ছে মূল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের সরকারি বিরোধীদলীয় পাওয়ার এলিটদের বুঝতে হবে, এখন সময় বিচ্ছিন্নতার নয় বরং আপন স্বার্থ সমুন্নত রেখে সহযোগিতার। ভোটব্যাংক অক্ষত রাখার প্রয়োজনীয়তা-তাড়িত হয়ে প্রতিবেশীকে সর্বক্ষণ সর্বক্ষেত্রে শত্রুরূপে চিহ্নিত করে বিষোদ্গার কিংবা বন্ধু-প্রতিবেশী কী মনে করবে, সে চিন্তা দ্বারা পরিচালিত হয়ে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে পিছিয়ে থেকে কোনো সরকার, তা সে যে দলেরই হোক না কেন, দেশের তথা জনসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে না। আঞ্চলিক পর্যায়ে নেতৃত্বের প্রসঙ্গটিও তখন হয়ে পড়ে অবান্তর। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তথাকথিত বিশ্বায়নের এই যুগে কথার ফুলঝুরি রাষ্ট্রপরিচালকদের জন্য যথেষ্ঠ নয়। দেশের ষোল কোটিসহ আঞ্চলিক পর্যায়ে চালকের আসনে যেয়ে পৃথিবীর অনধিক একশ ষাট কোটি মানুষের অবস্থার উন্নতির লক্ষে কাজ করতে বাসনা থাকলে পররাষ্ট্রনীতিতে প্রজ্ঞার ছাপ রাখতেই হবে বাংলাদেশি নেতৃত্বকে। এর বাইরে অবশ্যই আসবে পররাষ্ট্র কার্যক্রম-সংক্রান্ত আমলাতন্ত্রের দক্ষতার প্রসঙ্গটি। জাতিগত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকে পড়া, তাদের ঢোকা ঠেকানো, আশ্রয় দেওয়া বা না দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে দক্ষিণের প্রতিবেশী মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক গত কিছুদিন ধরে জটিল হয়ে উঠেছে। এই জটিলতা নিরসন করে প্রতিবেশী দেশটির সাথে সম্পর্ক রক্ষা এবং নিজদের স্বার্থ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রেও মাঠ-মিডিয়া গরম করা কথাবার্তা নয় বরং রাজনীতিকদের প্রজ্ঞা এবং কূটনীতিকদের দক্ষতাই ভূমিকা রাখবে। 




লেখক :শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


 ১৬ ডিসেম্বর ২০১২