মধ্যবিত্ত সুশীল সমাজ যেভাবে দিনের পর দিন রাজনীতিকের সমালোচনার নামে রাজনীতির বিষোদ্গার করে চলেছেন তা অব্যহত থাকলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। কে জানে না রাজনীতির বাইরে কিছু নেই। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, প্রেম, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্ম, গৃহস্থালি, দাম্পত্য – কি নয়? “গণতন্ত্র ঘাটতি” পর্ব অতিক্রম করে “সুষম গণতন্ত্র” পেতে হলে আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যায়, গনতন্ত্রকে “উপচে পড়া” পর্যায় নিয়ে যেতে চাইলে বর্তমানকার কথামালা নির্ভর “বাকবাকুম গণতন্ত্র” নয়, বরং
কোনো ধরনের বাড়তি গুন আরোপ বা অযথা প্রত্যাশা বাদ রেখে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সারকথাগুলোতে মনোনিবেশ করতেই হবে রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের। এ কাজটা সেভাবে হচ্ছে অনেকে দাবি করেন, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নত শাসন ব্যবস্থা নাকি আর নেই। এহেন দাবির সঙ্গে পূর্ণদৈর্ঘ্য দ্বিমত ব্যক্ত করা সম্ভব। তবে লোকপ্রিয়তার বিচারে এটি যে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা তা নিয়ে সহমত পোষণ করা ছাড়া উপায় নেই।
অনেকে দাবী করেন যে, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নত শাসনব্যবস্থা নাকি আর নেই। এহেন দাবীর সাথে পূর্ণদৈর্ঘ্য দ্বিমত ব্যক্ত করা সম্ভব। তবে লোকপ্রিয়তার বিচারে এটি যে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কাঙ্খিত ব্যবস্থা তা নিয়ে সহমত পোষণ ভিন্ন উপায় নেই। উল্লেখ্য, আজকাল গণতন্ত্র বলতে ব্যক্তি মালিকানাময় পুঁজিবাদের অধীন পশ্চিমা উদারনীতিক গণতন্ত্রকেই শুধুমাত্র বোঝানো হয়। কারু পছন্দ হোক বা না হোক, গণতন্ত্রের এই মডেলটি এখন বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সর্বাধিক পছন্দের; লোকেরা গণতন্ত্র বলতে পশ্চিমা উদারনীতিক গণতন্ত্র বুঝে। এই গণতন্ত্রে শাসনক্ষমতা কে বা কার হাতে থাকবে তা নির্ধারণে ভোট-কেন্দ্রিক সম্মতিকে বোঝানো হয়; শাসক পরিবর্তন হতে হয় নির্ধারিত বিরতিতে। দলের নেতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দলের লোকেদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রধান বিষয়। গণতন্ত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার অবস্থার আমূল পরিবর্তন নয় বরং সংবিধানসম্মত পন্থাতে সংষ্কারের মাধ্যমে পরিবর্তনের কথা বলা হয়। এই গণতন্ত্র মনুষ্য সমাজে অশান্তি নির্মানে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থ্যাৎ অসমতার বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনা। তবে ঠিকঠাক মত চললে গরীবির অবসান ঘটানো যায়, ক্ষমতাসীন শ্রেনীর মধ্যে ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সে বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হয়। গণতন্ত্র রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের ব্যবহারেরও বিরোধীতা করে। এসব শর্ত পূরণ হলে সম্মতির-সঙ্কট অতিক্রম সম্ভব হয়; সহিংসার আশঙ্কা দূরীভূত হয়। বাঙালি সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে এ বিষয়গুলোই চেয়েছে; না পেয়ে বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ কথাটা কথার কথা মাত্র নয় ভুলতে কই পারা যায় তিন মিলিয়ন মানুষের প্রান, অপরিমেয় সম্পদহানী, প্রতিবেশী দেশে এক কোটির বেশি শরনার্থী, বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পরিচালিত হত্যাকান্ড-ধবংসযজ্ঞে সহায়কের ভূমিকায় বাঙালি।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মজ জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখান করে ‘ওদের’ তথা পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ‘আমাদের’ অর্থ্যাৎ বাঙালিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে আসে। কিন্তু গণতন্ত্র অর্থ্যাৎ কিনা উদারনৈতিক গণতন্ত্র কই আসে স্বাধীনতার হাত ধরাধরি করে? উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যে বাঙালিদের কাছে মডেল ছিলো ওয়েস্টমিনিস্টার তথা ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্র। চুয়াত্তরে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে নিমিষে রাষ্ট্রপ্রধান শাসিত ব্যবস্থায় চলে যাবার মধ্যে গণতন্ত্রের দেখা মেলে না। যদি গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দেয়ার প্রশ্ন ওঠে তাহলে বিদ্যমান পরিস্থিতির যুক্তি দেখিয়ে এহেন একটি অতি-গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনা বা সম্মতিগ্রহনের অনুপস্থিতিকে যৌক্তিকতা দেয়া যায় না। প্রথম গণতান্ত্রিক শাসনামলে গণতন্ত্রকে প্রশ্রয় না দেয়ার আরো উদাহরণ দেয়া যায় চাইলে। সূচনাপর্বে যে ‘ডেমোক্র্যাসি ডেফিসিট’ বা ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ দেখা দেয় বর্তমানে তা থেকে উত্তরণ ঘটে গেছে এমন দাবী করা মুশকিল। এই বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। অবশ্য তাই বলে বুর্জোয়া গণতন্ত্র শক্তিশালী হবার পথে আমরা একটুও এগুতে পারিনি বলাটা হবে দুঃখবিলাস অথবা উদ্দেশ্যমূলক। গণতন্ত্র প্রসঙ্গে সামরিক শাসনগুলো সম্পর্কে আলোচনা অবান্তর। কথা হতে পারে গণতন্ত্র সরকারগুলোর সময়ে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ প্রসঙ্গে।
‘ডেমোক্র্যাসি ডেফিসিট’ বলতে কি বুঝবো? স্যানফোর্ড লেভিনসন মনে করেন এটি এমন এক পরিস্থিতি যখন দৃশ্যত গণতান্ত্রিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের শর্তগুলো পূরণে ব্যর্থ হয়। রাজনীতিক নেতৃত্বের সাথে সাধারণ জনগনের সম্পর্কহীনতা তৈরি হয়ে যাওয়াটাও এই ব্যাধির আরেকটি লক্ষন হিসাবে বিবেচিত। বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন? উত্তর হয় এই যে এই দেশে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে। ফলশ্রুতিতে গণতন্ত্র স্পর্শকাতরতায় ভূগছে; অগণতান্ত্রিক শক্তির একটু টোকাতেই এই গণতন্ত্র কেঁপে-কেঁপে উঠছে। এ প্রসঙ্গে এক-এগারোর প্রায়-দুই বছর স্মর্তব্য। কেন এমন হচ্ছে? মনে হয় যে বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থাটি বাজে-বনিকদের নিয়ন্ত্রনে থাকার সাথে বিদ্যমান ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’র সম্পর্ক আছে। যাদেরকে রাজনীতিক হিসাবে পরিচিত করানো হয় তাদের বড় একটি অংশ আসলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে অতি-সস্তা শ্রমের সুযোগ ব্যবহার করে ধনী দেশগুলির জন্য পন্য উৎপাদন, দেশীয় শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ করা বিদেশী পন্যের আমদানী, আমদানী-রপ্তানীজনিত কমিশনবাজী অথবা সামরিক-বেসামরিক আমলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের বদৌলতে অতি-ধনী হয়ে ওঠা মানুষজন। এদের কাছে রাজনীতি জনসেবা হবার কারণ নেই বরং নিজের বা গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষাই বড় কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতে ‘বাইশ পরিবারের’ হাত থেকে অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে আনার কথা ছিলো। তা হয়নি মোটেই।
এদিকে মধ্যবিত্ত সুশীল সমাজ যেভাবে দিনের পর দিন রাজনীতিকের সমালোচনার নামে রাজনীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের করে চলেছে তা অব্যাহত থাকলে পরিনতি হবে ভয়াবহ। রাজনীতি-প্রীতির স্থলে রাজনীতি-বিমুখতাই এখন ফ্যাশন; এই ধারাবাহিকতাতে কিছুদিন পরে হয়তো রাজনীতি-বিরোধীতাই হবে ফ্যাশন। অথচ কে না জানে যে রাজনীতির বাইরে কিছু নেই সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, প্রেম, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্ম, গৃহস্থালী, দাম্পত্য কি নয়? ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ পর্ব অতিক্রম করে “সুষম গণতন্ত্র” পেতে হলে, আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যায় গণতন্ত্রকে “উপচে পড়া’ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইলে বর্তমানকার কথামালা নির্ভর “বাকবাকুম গণতন্ত্র” নয় বরং কোন ধরণের বাড়তি গুন আরোপ বা অযথা প্রত্যাশা বাদ রেখে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সারকথাগুলোতে মনোনিবেশ করতেই হবে রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের। একাজটা সেভাবে হচ্ছে না। উদাহরণস্বরুপ, নব্বই পরবর্তী সময়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে যখন যেটি ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন সেটি তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে জোরদার অবস্থান নেয়; সুশীল সমাজও উচ্চকন্ঠ হয়। কিন্তু কেন? তিন জোটের রুপরেখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা স্বীকার করে নিলেন যে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে তাঁরা ব্যর্থ; অতএব চাই অনির্বাচিত লোকেদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর যারা একটি নির্বাচন করিয়ে দেবেন! এ কেমন কথা!? বাংলাদেশের রাজনীতিকরা কি এতটাই নিম্মমান যে তাঁরা একটি সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হবার পরে পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবেন না? পারষ্পরিক অবিশ্বাস আছে একথা সত্য কিন্তু তাই বলে অনির্বাচিত লোকেদের হাতে ক্ষমতা? তিয়াত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পরে পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত নির্বাচনগুলো হিসাবে আসে না। সামরিক আমলের নির্বাচন হিসাবে ধরতে হয় না। পরিপূর্ণ জালিয়াতিনির্ভর এসব নির্বাচনের কোন আগা-মাথা নেই। দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক আমলে খালেদা জিয়ার চার দিন স্থায়ী একদলীয় নির্বাচনটি কিংবা মাগুরা উপনির্বাচনের মত গোটাকয় ঘটনা কি জনমের তরে বাংলাদেশী রাজনীতিকের মুখে চিরস্থায়ী কলঙ্কের কালি মেখে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ? অরাজনৈতিক লোকেদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার বিধান চিরস্থায়ী করার জন্য যথেষ্ঠ? রাষ্ট্রগঠন সংক্রান্ত তত্তে¡ টমাস হবস, জন লক ও জ্যাঁ জ্যাঁকুয়েস রুশো আমাদের জানান যে রাষ্ট্রগঠিত হবার পূর্ববর্তী পর্যায়ে ‘প্রকৃতির রাজ্যের’ লোকেরা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে পারষ্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সার্বভৌমের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। সম্মতিহীন লোকের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া কথা বলা হয়নি কিন্তু। বাংলাদেশের তত্ত¡াবধায়ক সরকার সম্মতিবিহীন সরকার। আওয়ামীলীগ ও বিএনপি যে সময়ে-সময়ে এর পক্ষ নেয় তা গণতন্ত্রের চেতনা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী এবং ‘গণতন্ত্র ঘাটতির’ শক্তিশালী নির্দেশক।
বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ পরিস্থিতিকে নোয়াম চমস্কির চিন্তার আলোকেও দেখা যেতে পারে। ২০০৯ সালের অগাস্ট মাসে মার্কিন গণতন্ত্র প্রসঙ্গে অনলাইন নলেজ ফোরাম ‘বিগ থিংক’ কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে জানান যখন লোকজনের মধ্যে একটা অক্ষমতা, একটা অসহায়ত্বের বোধ কাজ করে, যখন মনে হয় যে সবকিছু চালাচ্ছে অন্য কেউ, আমার কোন কিছু করার মত নেই তখন বুঝতে হবে যে রাষ্ট্রব্যবস্থাটির মধ্যে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ বিরাজ করছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি নির্দেশ করেছে?
শান্তনু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
কোনো ধরনের বাড়তি গুন আরোপ বা অযথা প্রত্যাশা বাদ রেখে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সারকথাগুলোতে মনোনিবেশ করতেই হবে রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের। এ কাজটা সেভাবে হচ্ছে অনেকে দাবি করেন, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নত শাসন ব্যবস্থা নাকি আর নেই। এহেন দাবির সঙ্গে পূর্ণদৈর্ঘ্য দ্বিমত ব্যক্ত করা সম্ভব। তবে লোকপ্রিয়তার বিচারে এটি যে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা তা নিয়ে সহমত পোষণ করা ছাড়া উপায় নেই।
অনেকে দাবী করেন যে, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নত শাসনব্যবস্থা নাকি আর নেই। এহেন দাবীর সাথে পূর্ণদৈর্ঘ্য দ্বিমত ব্যক্ত করা সম্ভব। তবে লোকপ্রিয়তার বিচারে এটি যে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কাঙ্খিত ব্যবস্থা তা নিয়ে সহমত পোষণ ভিন্ন উপায় নেই। উল্লেখ্য, আজকাল গণতন্ত্র বলতে ব্যক্তি মালিকানাময় পুঁজিবাদের অধীন পশ্চিমা উদারনীতিক গণতন্ত্রকেই শুধুমাত্র বোঝানো হয়। কারু পছন্দ হোক বা না হোক, গণতন্ত্রের এই মডেলটি এখন বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সর্বাধিক পছন্দের; লোকেরা গণতন্ত্র বলতে পশ্চিমা উদারনীতিক গণতন্ত্র বুঝে। এই গণতন্ত্রে শাসনক্ষমতা কে বা কার হাতে থাকবে তা নির্ধারণে ভোট-কেন্দ্রিক সম্মতিকে বোঝানো হয়; শাসক পরিবর্তন হতে হয় নির্ধারিত বিরতিতে। দলের নেতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দলের লোকেদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রধান বিষয়। গণতন্ত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার অবস্থার আমূল পরিবর্তন নয় বরং সংবিধানসম্মত পন্থাতে সংষ্কারের মাধ্যমে পরিবর্তনের কথা বলা হয়। এই গণতন্ত্র মনুষ্য সমাজে অশান্তি নির্মানে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থ্যাৎ অসমতার বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনা। তবে ঠিকঠাক মত চললে গরীবির অবসান ঘটানো যায়, ক্ষমতাসীন শ্রেনীর মধ্যে ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সে বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হয়। গণতন্ত্র রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের ব্যবহারেরও বিরোধীতা করে। এসব শর্ত পূরণ হলে সম্মতির-সঙ্কট অতিক্রম সম্ভব হয়; সহিংসার আশঙ্কা দূরীভূত হয়। বাঙালি সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে এ বিষয়গুলোই চেয়েছে; না পেয়ে বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ কথাটা কথার কথা মাত্র নয় ভুলতে কই পারা যায় তিন মিলিয়ন মানুষের প্রান, অপরিমেয় সম্পদহানী, প্রতিবেশী দেশে এক কোটির বেশি শরনার্থী, বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পরিচালিত হত্যাকান্ড-ধবংসযজ্ঞে সহায়কের ভূমিকায় বাঙালি।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মজ জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখান করে ‘ওদের’ তথা পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ‘আমাদের’ অর্থ্যাৎ বাঙালিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে আসে। কিন্তু গণতন্ত্র অর্থ্যাৎ কিনা উদারনৈতিক গণতন্ত্র কই আসে স্বাধীনতার হাত ধরাধরি করে? উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যে বাঙালিদের কাছে মডেল ছিলো ওয়েস্টমিনিস্টার তথা ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্র। চুয়াত্তরে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে নিমিষে রাষ্ট্রপ্রধান শাসিত ব্যবস্থায় চলে যাবার মধ্যে গণতন্ত্রের দেখা মেলে না। যদি গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দেয়ার প্রশ্ন ওঠে তাহলে বিদ্যমান পরিস্থিতির যুক্তি দেখিয়ে এহেন একটি অতি-গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনা বা সম্মতিগ্রহনের অনুপস্থিতিকে যৌক্তিকতা দেয়া যায় না। প্রথম গণতান্ত্রিক শাসনামলে গণতন্ত্রকে প্রশ্রয় না দেয়ার আরো উদাহরণ দেয়া যায় চাইলে। সূচনাপর্বে যে ‘ডেমোক্র্যাসি ডেফিসিট’ বা ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ দেখা দেয় বর্তমানে তা থেকে উত্তরণ ঘটে গেছে এমন দাবী করা মুশকিল। এই বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। অবশ্য তাই বলে বুর্জোয়া গণতন্ত্র শক্তিশালী হবার পথে আমরা একটুও এগুতে পারিনি বলাটা হবে দুঃখবিলাস অথবা উদ্দেশ্যমূলক। গণতন্ত্র প্রসঙ্গে সামরিক শাসনগুলো সম্পর্কে আলোচনা অবান্তর। কথা হতে পারে গণতন্ত্র সরকারগুলোর সময়ে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ প্রসঙ্গে।
‘ডেমোক্র্যাসি ডেফিসিট’ বলতে কি বুঝবো? স্যানফোর্ড লেভিনসন মনে করেন এটি এমন এক পরিস্থিতি যখন দৃশ্যত গণতান্ত্রিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের শর্তগুলো পূরণে ব্যর্থ হয়। রাজনীতিক নেতৃত্বের সাথে সাধারণ জনগনের সম্পর্কহীনতা তৈরি হয়ে যাওয়াটাও এই ব্যাধির আরেকটি লক্ষন হিসাবে বিবেচিত। বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন? উত্তর হয় এই যে এই দেশে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে। ফলশ্রুতিতে গণতন্ত্র স্পর্শকাতরতায় ভূগছে; অগণতান্ত্রিক শক্তির একটু টোকাতেই এই গণতন্ত্র কেঁপে-কেঁপে উঠছে। এ প্রসঙ্গে এক-এগারোর প্রায়-দুই বছর স্মর্তব্য। কেন এমন হচ্ছে? মনে হয় যে বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থাটি বাজে-বনিকদের নিয়ন্ত্রনে থাকার সাথে বিদ্যমান ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’র সম্পর্ক আছে। যাদেরকে রাজনীতিক হিসাবে পরিচিত করানো হয় তাদের বড় একটি অংশ আসলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে অতি-সস্তা শ্রমের সুযোগ ব্যবহার করে ধনী দেশগুলির জন্য পন্য উৎপাদন, দেশীয় শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ করা বিদেশী পন্যের আমদানী, আমদানী-রপ্তানীজনিত কমিশনবাজী অথবা সামরিক-বেসামরিক আমলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের বদৌলতে অতি-ধনী হয়ে ওঠা মানুষজন। এদের কাছে রাজনীতি জনসেবা হবার কারণ নেই বরং নিজের বা গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষাই বড় কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতে ‘বাইশ পরিবারের’ হাত থেকে অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে আনার কথা ছিলো। তা হয়নি মোটেই।
এদিকে মধ্যবিত্ত সুশীল সমাজ যেভাবে দিনের পর দিন রাজনীতিকের সমালোচনার নামে রাজনীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের করে চলেছে তা অব্যাহত থাকলে পরিনতি হবে ভয়াবহ। রাজনীতি-প্রীতির স্থলে রাজনীতি-বিমুখতাই এখন ফ্যাশন; এই ধারাবাহিকতাতে কিছুদিন পরে হয়তো রাজনীতি-বিরোধীতাই হবে ফ্যাশন। অথচ কে না জানে যে রাজনীতির বাইরে কিছু নেই সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, প্রেম, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্ম, গৃহস্থালী, দাম্পত্য কি নয়? ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ পর্ব অতিক্রম করে “সুষম গণতন্ত্র” পেতে হলে, আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যায় গণতন্ত্রকে “উপচে পড়া’ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইলে বর্তমানকার কথামালা নির্ভর “বাকবাকুম গণতন্ত্র” নয় বরং কোন ধরণের বাড়তি গুন আরোপ বা অযথা প্রত্যাশা বাদ রেখে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সারকথাগুলোতে মনোনিবেশ করতেই হবে রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিবৃত্তিক এলিটদের। একাজটা সেভাবে হচ্ছে না। উদাহরণস্বরুপ, নব্বই পরবর্তী সময়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে যখন যেটি ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন সেটি তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে জোরদার অবস্থান নেয়; সুশীল সমাজও উচ্চকন্ঠ হয়। কিন্তু কেন? তিন জোটের রুপরেখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা স্বীকার করে নিলেন যে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে তাঁরা ব্যর্থ; অতএব চাই অনির্বাচিত লোকেদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর যারা একটি নির্বাচন করিয়ে দেবেন! এ কেমন কথা!? বাংলাদেশের রাজনীতিকরা কি এতটাই নিম্মমান যে তাঁরা একটি সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হবার পরে পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবেন না? পারষ্পরিক অবিশ্বাস আছে একথা সত্য কিন্তু তাই বলে অনির্বাচিত লোকেদের হাতে ক্ষমতা? তিয়াত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পরে পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত নির্বাচনগুলো হিসাবে আসে না। সামরিক আমলের নির্বাচন হিসাবে ধরতে হয় না। পরিপূর্ণ জালিয়াতিনির্ভর এসব নির্বাচনের কোন আগা-মাথা নেই। দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক আমলে খালেদা জিয়ার চার দিন স্থায়ী একদলীয় নির্বাচনটি কিংবা মাগুরা উপনির্বাচনের মত গোটাকয় ঘটনা কি জনমের তরে বাংলাদেশী রাজনীতিকের মুখে চিরস্থায়ী কলঙ্কের কালি মেখে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ? অরাজনৈতিক লোকেদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার বিধান চিরস্থায়ী করার জন্য যথেষ্ঠ? রাষ্ট্রগঠন সংক্রান্ত তত্তে¡ টমাস হবস, জন লক ও জ্যাঁ জ্যাঁকুয়েস রুশো আমাদের জানান যে রাষ্ট্রগঠিত হবার পূর্ববর্তী পর্যায়ে ‘প্রকৃতির রাজ্যের’ লোকেরা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে পারষ্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সার্বভৌমের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। সম্মতিহীন লোকের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া কথা বলা হয়নি কিন্তু। বাংলাদেশের তত্ত¡াবধায়ক সরকার সম্মতিবিহীন সরকার। আওয়ামীলীগ ও বিএনপি যে সময়ে-সময়ে এর পক্ষ নেয় তা গণতন্ত্রের চেতনা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী এবং ‘গণতন্ত্র ঘাটতির’ শক্তিশালী নির্দেশক।
বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ পরিস্থিতিকে নোয়াম চমস্কির চিন্তার আলোকেও দেখা যেতে পারে। ২০০৯ সালের অগাস্ট মাসে মার্কিন গণতন্ত্র প্রসঙ্গে অনলাইন নলেজ ফোরাম ‘বিগ থিংক’ কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে জানান যখন লোকজনের মধ্যে একটা অক্ষমতা, একটা অসহায়ত্বের বোধ কাজ করে, যখন মনে হয় যে সবকিছু চালাচ্ছে অন্য কেউ, আমার কোন কিছু করার মত নেই তখন বুঝতে হবে যে রাষ্ট্রব্যবস্থাটির মধ্যে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’ বিরাজ করছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি নির্দেশ করেছে?
শান্তনু মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক