খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে দশম শতকে পারস্যে ধর্মীয় অরাজকতা আর মূর্তি পুজার পৌত্তলিকতা যখন সমকালীন বিশ্বের ধর্ম বিশ্বাসে নিদারুণ নাভিশ্বাস তুলছিল, ধর্মীয় স্বেচ্ছাচার আর অনৈতিকতা যখন ধর্মকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল-তখন ধর্ম ও সমাজসংস্কারের ঔশ্বরিক ত্রাতা হিসেবে জরথস্র
আবির্ভূত হন। তার নিরন্তন সাধনা ও শিক্ষাদানে শীঘ্রই ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীভূত হয়ে সমাজে শুদ্ধতম ধর্মাচরণের ধারা সূচিত হয়। জরথুস্র বা জরোয়াস্টার (Zoroaster)। তার পিতা Pourushaspa বা ভগদু এবং মাতাDughdhova বা আশা। ভগদু ও আশা দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে জরথুস্র তৃতীয়। আধুনিক মধ্য এশিয়ার আজারবাইন প্রদেশের অন্তর্গত Media নামক স্থানে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ দশকের যেকোনো সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই পারসিকদের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দিকে সঠিক পথপ্রদর্শন করেন। জরথুস্রের প্রচারিত ধর্মমত “জরথুস্রবাদ” নামে পরিচিত। পারস্যের ধর্মীয় নেতা জরথুস্র গ্রিকদের নিকট জরাস্টার নামে পরিচিত।
জরথুস্র ধর্মাবলম্বীরা দু’দেবতায় বিশ্বাসী ছিলেন। এদের একজন আহুরমাজাদ (Ahuramazda) ছিলেন মঙ্গলের দেবতা। তিনি মানুষের জন্য আলো, সত্য ও সত্ নির্দেশ করতেন। দ্বিতীয়জন আহরিমান (Ahriman) ছিলেন সব ধরণের অকল্যাণ ও অন্ধকারের সত্তা। পূর্ববর্তী সমেরীয় ও ব্যাবলনীয় সভ্যতা প্রত্যেক দেবতার ভালো মন্দ ও দ্বিবিধ রূপ ছিল। একমাত্র জরথুস্রবাদে ভালো ও মন্দের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেবতা ছিল। দু’জন ভিন্ন দেবতা থাকায় তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিরামহীন যুদ্ধচলত। শেষ পর্যন্ত আলোর দেবতা আহুরমাজদা অন্ধকারের শক্তি আহরিমানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করবেন এবং পৃথিবীকে অন্ধকারের রাহু থেকে মুক্ত করবেন।
জরথুস্রবাদ প্রধানত একটি ধর্মরূপে পরিচিত। এ ধর্মমতে মানুষ ইচ্ছে করলে পুণ্য কাজ করতে পারে আবার পাপ কাজও করতে পারে। এ ধর্মে সত্ কাজের বিনিময়ে পুণ্য এবং অসত্ কাজের বিনিময়ে পাপ অর্জনের কথা উল্লেখ আছে। গর্ব করা, রাগান্বিত হওয়া, অপচয় করা, গর্ভপাত করানো ইত্যাদিকে পাপ কাজ বলে গণ্য করা হতো। একই ধর্ম বিশ্বাসী লোকের কাছ থেকে লগ্নিকৃত টাকার জন্য সুদ নেওয়া জঘন্যতম পাপ কাজ বলে বিবেচিত হতো। জরথুস্র মতাবলম্বীরা পৃথিবীতে মানুষের পাপ ও পুণ্য কাজের জন্য পরকালে শাস্তি ও পুরুষ্কার দেওয়া হবে বলে বিশ্বাস করতো। পাপী ব্যক্তিরা স্বল্পকালের জন্য নরকবীসা হবে। তারপর সকলের স্থান হবে স্বর্গ। কেননা এ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করতো যে, নরকের আগুন চিরস্থায়ী নয়।
জরথুস্র ধর্মে পাপ ও পুণ্যের কাজগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাজকে কেন্দ্র করে সম্পাদনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যেমন- রাজাকে মান্য করা, জমিতে আবাদ করা, মানুষকে সত্যবাদী হতে, একে অপরকে সাহায্য করতে ও ভালোবাসতে, গরিবের প্রতি সদয় হতে এবং অথিথিকে আপ্যান করতে আহুরমাজাদ নির্দেশ দেন। কৃষিকাজকে জরথুস্রবাদে ধর্মীয় কর্তব্য বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ কারণে গরুকে শ্রদ্ধা ও ভক্তির চোখে দেখা হতো। জরথুস্র মতাবলম্বীরা শেষ বিচারের দিন মৃতদের পুনরুত্থান ঘটবে বলে বিশ্বাস করতো। জরথুস্রবাদীদের বিশ্বাস অনুযায়ী বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড ১২০০০ বছর টিকে থাকবে। ৯০০ বছর পর জরথুস্র দ্বিতীয়বারের মতো পৃথিবীতে আসবেন মঙ্গলের জয়কে নিশ্চিত করতে। তা হবে অলৌকিকভাবে ছায়োমাস্ট – এর জন্মের মাধ্যমে। চূড়ন্ত জয়লাভের পর পৃথিবীর সমস্ত মৃত আত্মাকে কবর থেকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে তাদের কার্যাদির বিচারের জন্য।
জরথুস্রবাদের প্রবক্তা জরথুস্র ছিলেন জ্ঞান ও সত্যের প্রেমিক। জরথুস্র লোকালয় থেকে দূরে পাহাড়ের নির্জনে ধ্যামগ্ন অবস্থায় ঐশী গ্রস্থ আবেস্যা লাভ করেছিলেন। জরথুস্রবাদীরা বিশ্বাস করতো যে ঐশী গ্রন্থের সমস্ত বাণী সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে জরথুস্রর নিকট পাঠানো হয়েছে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য। জরথুস্রবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে এ ধর্মে অগ্নিপূজাকে নিষিদ্ধ করা হয়। সমসাময়িক অন্যান্য ধর্ম সভ্যতায় এবং প্রাচীন কালে পারস্যে অগ্নিপূজা প্রচলিত ছিল। জরথুস্র অগ্নিপূজা করতেন না। তার সময়ে তই অগ্নিপূজা প্রচলিত ছিল না। পরবর্তীকালে তার অনুসারীগণ অগ্নিপূজার আয়োজন করে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে পারসিকদের ধর্ম বিশ্বাস অর্থাত্ জরথুস্রবাদ এক নব অধ্যায়ের সূচনা করে। জরথুস্রের মৃত্যুর পর অবশ্য জরথুস্রবাদ দীর্ঘদিন তার মূল অবস্থায় টিকে থাকতে পারে নি। এ ধর্মের সাথে আদিম কুসংস্কার, জাদুবিদ্যা, পুরোহিত প্রভৃতির সংযোগ হওয়াতে এটা অনেকাংশে রূপান্তরিত হয়। সপ্তম খ্রিস্টাব্দের দিকে পারস্যে মুসলিম বিজয়ের পর জরথুস্রবাদ ধীরে ধীরে হারিয়ে যা। অবশ্য জরথুস্রের প্রচারিত মতবাজ, জীবনধারা ও ধর্মদর্শন পরবর্তীতে প্যালেস্টাইন, আরব ও এশিয়া মাইনরের জনগণকে প্রভাবিত করেছিল। পর্যায়ক্রমে এ ধারণা খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মেও প্রতিফলিত হয়।
উল্লেখ্য, ভারতের বিখ্যাত গান্ধী পরিবারের “গান্ধী” নামটির সাথে মহাত্মা গান্ধীর কোন সরাসরি সম্পকে নেই। গান্ধী নামটি আসে ইন্দিরা দেবী যখন ফিরোজ জাহাঙ্গীর গান্ধিকে বিয়ে করেন। ফিরোজ জাহাঙ্গীর গান্ধির ধর্ম ছিল জরথুস্রবাদ।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, iamfahmed@gmail.com