গত বছর মানে ১৯৮৯ সালে, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রকাশক সমিতি ধানমণ্ডি মাঠে একটা গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিলেন। এই মেলাটি বসেছিল কলাবাগানের বিপরীত দিকের মাঠটিতে। সাত কি আট দিন ধরে চলেছিল। ঐ মেলায় বেচাবিক্রি কেমন হয় জানার আগ্রহ হয়েছিল। তাই একটুখানি কৌতূহলের বশেই প্রতিদিন সন্ধেবেলা আমি ঐ মেলাতে গিয়েছি। কত টাকার বই বিক্রি হল প্রকাশকদের কাছে খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করেছি।
‘মুক্তধারা’র মতো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আমাকে জানালেন যে, বই বিক্রির পরিমাণ কোনোদিনই পাঁচশো টাকার উপরে যায়নি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লোকেরাও জানালেন যে এই মেলায় এসে তাঁদের একটা কড়া শিক্ষা হয়ে গেছে। মেলায় বিক্রির পরিমাণ এতই নগণ্য যে তাঁদের আসা-যাওয়ার খরচ পর্যন্ত ওঠেনি। অন্য একজন প্রকাশক আক্ষেপ করে বললেন, একেকটি মামুলি উপজেলার বই মেলায়ও এর চাইতে অধিক বইপত্র বিক্রি হয়ে থাকে। একটি উপজেলার বইমেলায়ও ধানমণ্ডির চাইতে বেশি বইপত্র বিক্রি হয়, এই তথ্যটি জানতে পেরে আমি একরকম আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম।
ধানমণ্ডি ঢাকা শহরের দু’তিনটি ধনী এলাকার একটি। লেখাপড়ায়, জ্ঞানে-বুদ্ধিতে, অর্থ-সামর্থ্যে একমাত্র গুলশান এবং বনানী এলাকার বাসিন্দারাই ধানমণ্ডির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এই রকম একটা ধনী এলাকায় সাত-আট দিন বইমেলা চলার পরও বিক্রির পরিমাণ যা দাঁড়াল, সচরাচর একটি উপজেলার বই মেলাতেও তার চাইতে বেশি টাকার বই বিক্রি হয়ে থাকে। পেছনের কারণ কি?
প্রকাশকেরা একবাক্যে জানালেন, ধানমণ্ডির মানুষ বই পড়ে না, পড়লেও বাংলা বই পড়ে না। বাংলাদেশে বসবাস করে অথচ বাংলা ভাষার বইপত্র পাঠ করে না এ কেমন কথা! বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। বাংলা ভাষার বইপত্র না পড়া মানে তো বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করা। গোটা জাতির সব চাইতে শাঁসালো এবং সম্পন্ন অংশের সঙ্গে দেশের জ্ঞান, বুদ্ধি, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক না থাকলে দেশের কি রকম চেহারা দাঁড়ায়! দেশের কি অবস্থা হয়েছে সে সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি আমাদের জাতীয় জীবনের মূল স্রোতের সঙ্গে আমাদের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কোনো সংযোগ নেই। আমি নানা কার্যব্যপদেশে ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী এলাকার অনেক আধুনিক রুচিসম্পন্ন ধনাঢ্য ভদ্রলোকের বাড়িতে যাতায়াত করেছি। ঐ সকল এলাকার কমসংখ্যক মানুষই বাড়ীঘরে বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন। তরুণ বয়েসি ছেলেমেয়েরা যে-সকল বাংলা শব্দ ব্যবহার করে থাকে, সেগুলোর ইংরেজী প্রতিশব্দ তারা জানে না। আর বাংলা বললেও এমন একটা ভঙ্গীতে বলে, মনে হবে আপনার প্রতি কৃপাবশত সে এই ভাষাটিতে বাতচিত করছে। এই সমস্ত ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা আকারে-প্রকারে, ভাবে-ভঙ্গীতে আপনাকে জানিয়ে দিতে কসুর করবেন না, নেহায়েত করুণা করেই, দায়ে পড়ে, ঠেকে এই দেশটিতে বসবাস করছেন। তাঁদের বাড়ীঘরের আসবাবপত্রে, সাজসরঞ্জামে বাংলাদেশের কোনো চিহ্ন আপনি খুঁজে পাবেন না। এঁদের ঘরের ছেলেমেয়েরা ভিসিপিতে বিদেশী ছবি দেখে থাকে। বিদেশী সঙ্গীত শুনে সঙ্গীত-পিপাসা মেটায়, আচারে-ব্যবহারে, কথাবার্তায় এমন একটা ভঙ্গী ফুটিয়ে তোলে যেন তারা এদেশের কেউ নয়।
আমার বন্ধু, সম্ভবত এই দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীক্ষ্ণদৃষ্টি রিপোর্টার নাজিমুদ্দিন মোস্তান ঢাকা শহরকে মোটা দাগে তিনটি এলাকায় ভাগ করেছেন। নারিন্দা, গেণ্ডারিয়া, ইসলামপুর, চকবাজার, মৌলভীবাজার, পুরনো ঢাকার এসকল এলাকাকে উৎপাদন এলাকা বলে চিহ্নিত করেছেন। আজিমপুর, মতিঝিল, মীরপুর, মোহাম্মদপুর ইত্যাদি যে সকল এলাকায় অধিকাংশ চাকুরীজীবী মানুষ বসবাস করে থাকেন সেগুলোকে ভোগের এলাকা বলেছেন। ধানমণ্ডি, লালমাটিয়া, বনানী, গুলশান ইত্যাদি যে সকল এলাকায় উচ্চবিত্ত লোকেরা বসবাস করেন সে সকল এলাকাকে লুণ্ঠনকারী এলাকা বলে অভিহিত করেছেন। আমার অপর বন্ধু ড. কামাল সিদ্দিকী ঢাকার ওপর তাঁর যে গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও ঢাকা মহানগরীকে এলাকাওয়ারী ভাগ করে জীবিকা সঞ্চয়ের ওপর এবং জীবনদৃষ্টির ব্যাখ্যা করে যে মতামত দিয়েছেন, তার সঙ্গে নাজিমুদ্দিন মোস্তানের এলাকা বিন্যাসের বেশি গরমিল নেই।
আমি যে কথাটি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে চাই, আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে দেশের জনগণের ভালমন্দ, সুখদুঃখের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা সম্পদের শক্তির জোরে এদেশবাসীর বুকে পা দিয়ে টিকে আছেন। এই দেশের কোনকিছুকে চিন্তাচেতনায় তাঁরা ধারণ করেন না। দুনিয়ার এই দরিদ্র দেশটিতে এই শ্রেণীটাই হলো সবচাইতে অস্বাভাবিক এবং বিদঘুটে অস্তিত্বের অধিকারী। শ্রেণীগতভাবে এদের সমূহ অবস্থানের কথা চিন্তা করলে মনের মধ্যে সতত একটা কথাই জেগে ওঠে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন দেশটির সবকিছুকে ভ্যাঙ্গানোর জন্য এ অর্থে-বিত্তে, জ্ঞানে-বুদ্ধিতে অগ্রসর শ্রেণীটিই মূর্তিমান অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁরা এই দেশে বিদেশীদের চাইতেও বিদেশী। এই দেশটিকে তাদের একমাত্র লুণ্ঠন করার জন্যই প্রয়োজন। দেশের জ্ঞান-বুদ্ধি, শিক্ষা-সংস্কৃতি কিছুতেই তাদের অবদান নেই, কিছুতেই তাদের অংশগ্রহণ নেই, আর প্রয়োজনও নেই। এয়ারপোর্ট আর সী-পোর্ট থাকলেই হবে। সী-পোর্ট দিয়ে তাদের বিলাস এবং ভোগের সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানী করবেন। আর কোনরকমের বিপদ-অঘটন ঘটলে এয়ারপোর্ট দিয়ে পালিয়ে যাবেন।
সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এরকম সম্পর্কহীন কোনো উচ্চবিত্ত শ্রেণী দুনিয়ার অন্য কোনো দেশে আছে বলে আমাদের জানা নেই। বাদবাকি জনগণের ভাগে একটাই দায়িত্ব। একবেলা খেয়ে না খেয়ে এই শ্রেণীটাকে একইরকমভাবে টিকিয়ে রাখা। দরিদ্র মানুষ দরিদ্রতর হচ্ছে আর দেশে উচ্চবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। অবস্থা এমন নয় যে, বিত্তমানেরা বিত্ত সঞ্চয় করছে এবং একই সঙ্গে দরিদ্রের দারিদ্র্য-মোচনের কোনো উপায় বা কর্মসূচী গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে উঁচুবিত্তবানেরাই হলো বাংলাদেশের সবচাইতে কৃত্রিম বাঙালী। দেশকে শোষণ করে তারা টিকে আছে, বিনিময়ে তারা দেশকে কিছুই দিচ্ছে না।
অনেককে ইদানীং বলতে শোনা যায়, বিপ্লবের গালভরা বুলির দিন শেষ। এখন একমাত্র উন্মাদ ছাড়া কেউ বিপ্লবের কথা বলে না। এমনকি অনেক বিপ্লবী রাজনৈতিক দলও এই ‘বিপ্লব’ শব্দটিকে অনেকটা বর্জ্য হিসেবে গণ্য করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু বিপ্লবের কথা চিন্তা না করে এখানে মানুষের বাসযোগ্য একটি সমাজ কিভাবে নির্মাণ করা সম্ভব আমার জ্ঞান-বুদ্ধিতে আসে না। একটা বিরাট আকারের ভাঙচুর, একটা ওলটপালটের মাধ্যমে সমাজকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে না পারলে বিরাজমান পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে, তা চিন্তা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের এই সাড়ে এগারো কোটি মানুষের মুখে দানাপানি তুলে দিতে হলে, তাদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান করতে হলে, একটা শিক্ষিত জাতি সৃষ্টি করতে হলে, বাসস্থানের নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রশ্ন উঠলে অনিবার্যভাবে বিপ্লবের কথা এসে পড়ে। চীন, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলী দেখে অনেকে ভেবে বসে আছেন যে, আমাদের সমাজে বিপ্লবের প্রয়োজন নেই এবং এখানে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডেরও কোনো প্রয়োজন নেই।
এক যুগের বিপ্লবের বিশেষ তত্ত্ব অন্য যুগের প্রয়োজন হয়তো মেটাতে সক্ষম নয়। তাই বলে বিপ্লবের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, একথা মোটেও সত্যি নয়। সমাজে যখন বৈষম্য বিরাজমান থাকে, যখন অন্যায়-অবিচার চলে, দারিদ্র্য এবং হতশ্রী প্রকাণ্ড আকার ধারণ করে সমাজে প্রাণধারণের ক্ষীণতম সম্ভাবনাও রোধ করে দাঁড়ায়; তখন কি সমাজের ভেতর থেকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? পূর্ব-ইউরোপীয় দেশসমূহে যা ঘটেছে সেগুলোও এক ধরনের বিপ্লব। একটি সামাজিক ব্যবস্থার নামে একটি আমলাতান্ত্রিক শ্রেণীর শোষণ এবং লুণ্ঠন জনগণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
আগে সমাজ-বিপ্লবের যে প্রচলিত সংজ্ঞা ছিল সেটি অচল প্রমাণিত হলে বিপ্লবের প্রয়োজন বাসি হয়ে যাবে, সেটা কখনো সত্যি নয়। বাংলাদেশের জনগণকে বাসযোগ্য সমাজ নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই একটি সমাজ-বিপ্লবের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তার জন্য দরকার বিপ্লবের একটি নতুন সংজ্ঞা – সে সংজ্ঞার সঙ্গে পূর্বের পাঠ্যপুস্তকের সংজ্ঞার যদি গরমিল ঘটে যায়, কিছু আসে যায় না।
আহমদ ছফা (১৯৮৯)
‘মুক্তধারা’র মতো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আমাকে জানালেন যে, বই বিক্রির পরিমাণ কোনোদিনই পাঁচশো টাকার উপরে যায়নি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লোকেরাও জানালেন যে এই মেলায় এসে তাঁদের একটা কড়া শিক্ষা হয়ে গেছে। মেলায় বিক্রির পরিমাণ এতই নগণ্য যে তাঁদের আসা-যাওয়ার খরচ পর্যন্ত ওঠেনি। অন্য একজন প্রকাশক আক্ষেপ করে বললেন, একেকটি মামুলি উপজেলার বই মেলায়ও এর চাইতে অধিক বইপত্র বিক্রি হয়ে থাকে। একটি উপজেলার বইমেলায়ও ধানমণ্ডির চাইতে বেশি বইপত্র বিক্রি হয়, এই তথ্যটি জানতে পেরে আমি একরকম আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম।
ধানমণ্ডি ঢাকা শহরের দু’তিনটি ধনী এলাকার একটি। লেখাপড়ায়, জ্ঞানে-বুদ্ধিতে, অর্থ-সামর্থ্যে একমাত্র গুলশান এবং বনানী এলাকার বাসিন্দারাই ধানমণ্ডির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এই রকম একটা ধনী এলাকায় সাত-আট দিন বইমেলা চলার পরও বিক্রির পরিমাণ যা দাঁড়াল, সচরাচর একটি উপজেলার বই মেলাতেও তার চাইতে বেশি টাকার বই বিক্রি হয়ে থাকে। পেছনের কারণ কি?
প্রকাশকেরা একবাক্যে জানালেন, ধানমণ্ডির মানুষ বই পড়ে না, পড়লেও বাংলা বই পড়ে না। বাংলাদেশে বসবাস করে অথচ বাংলা ভাষার বইপত্র পাঠ করে না এ কেমন কথা! বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। বাংলা ভাষার বইপত্র না পড়া মানে তো বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করা। গোটা জাতির সব চাইতে শাঁসালো এবং সম্পন্ন অংশের সঙ্গে দেশের জ্ঞান, বুদ্ধি, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক না থাকলে দেশের কি রকম চেহারা দাঁড়ায়! দেশের কি অবস্থা হয়েছে সে সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি আমাদের জাতীয় জীবনের মূল স্রোতের সঙ্গে আমাদের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কোনো সংযোগ নেই। আমি নানা কার্যব্যপদেশে ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী এলাকার অনেক আধুনিক রুচিসম্পন্ন ধনাঢ্য ভদ্রলোকের বাড়িতে যাতায়াত করেছি। ঐ সকল এলাকার কমসংখ্যক মানুষই বাড়ীঘরে বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন। তরুণ বয়েসি ছেলেমেয়েরা যে-সকল বাংলা শব্দ ব্যবহার করে থাকে, সেগুলোর ইংরেজী প্রতিশব্দ তারা জানে না। আর বাংলা বললেও এমন একটা ভঙ্গীতে বলে, মনে হবে আপনার প্রতি কৃপাবশত সে এই ভাষাটিতে বাতচিত করছে। এই সমস্ত ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা আকারে-প্রকারে, ভাবে-ভঙ্গীতে আপনাকে জানিয়ে দিতে কসুর করবেন না, নেহায়েত করুণা করেই, দায়ে পড়ে, ঠেকে এই দেশটিতে বসবাস করছেন। তাঁদের বাড়ীঘরের আসবাবপত্রে, সাজসরঞ্জামে বাংলাদেশের কোনো চিহ্ন আপনি খুঁজে পাবেন না। এঁদের ঘরের ছেলেমেয়েরা ভিসিপিতে বিদেশী ছবি দেখে থাকে। বিদেশী সঙ্গীত শুনে সঙ্গীত-পিপাসা মেটায়, আচারে-ব্যবহারে, কথাবার্তায় এমন একটা ভঙ্গী ফুটিয়ে তোলে যেন তারা এদেশের কেউ নয়।
আমার বন্ধু, সম্ভবত এই দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীক্ষ্ণদৃষ্টি রিপোর্টার নাজিমুদ্দিন মোস্তান ঢাকা শহরকে মোটা দাগে তিনটি এলাকায় ভাগ করেছেন। নারিন্দা, গেণ্ডারিয়া, ইসলামপুর, চকবাজার, মৌলভীবাজার, পুরনো ঢাকার এসকল এলাকাকে উৎপাদন এলাকা বলে চিহ্নিত করেছেন। আজিমপুর, মতিঝিল, মীরপুর, মোহাম্মদপুর ইত্যাদি যে সকল এলাকায় অধিকাংশ চাকুরীজীবী মানুষ বসবাস করে থাকেন সেগুলোকে ভোগের এলাকা বলেছেন। ধানমণ্ডি, লালমাটিয়া, বনানী, গুলশান ইত্যাদি যে সকল এলাকায় উচ্চবিত্ত লোকেরা বসবাস করেন সে সকল এলাকাকে লুণ্ঠনকারী এলাকা বলে অভিহিত করেছেন। আমার অপর বন্ধু ড. কামাল সিদ্দিকী ঢাকার ওপর তাঁর যে গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও ঢাকা মহানগরীকে এলাকাওয়ারী ভাগ করে জীবিকা সঞ্চয়ের ওপর এবং জীবনদৃষ্টির ব্যাখ্যা করে যে মতামত দিয়েছেন, তার সঙ্গে নাজিমুদ্দিন মোস্তানের এলাকা বিন্যাসের বেশি গরমিল নেই।
আমি যে কথাটি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে চাই, আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে দেশের জনগণের ভালমন্দ, সুখদুঃখের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা সম্পদের শক্তির জোরে এদেশবাসীর বুকে পা দিয়ে টিকে আছেন। এই দেশের কোনকিছুকে চিন্তাচেতনায় তাঁরা ধারণ করেন না। দুনিয়ার এই দরিদ্র দেশটিতে এই শ্রেণীটাই হলো সবচাইতে অস্বাভাবিক এবং বিদঘুটে অস্তিত্বের অধিকারী। শ্রেণীগতভাবে এদের সমূহ অবস্থানের কথা চিন্তা করলে মনের মধ্যে সতত একটা কথাই জেগে ওঠে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন দেশটির সবকিছুকে ভ্যাঙ্গানোর জন্য এ অর্থে-বিত্তে, জ্ঞানে-বুদ্ধিতে অগ্রসর শ্রেণীটিই মূর্তিমান অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁরা এই দেশে বিদেশীদের চাইতেও বিদেশী। এই দেশটিকে তাদের একমাত্র লুণ্ঠন করার জন্যই প্রয়োজন। দেশের জ্ঞান-বুদ্ধি, শিক্ষা-সংস্কৃতি কিছুতেই তাদের অবদান নেই, কিছুতেই তাদের অংশগ্রহণ নেই, আর প্রয়োজনও নেই। এয়ারপোর্ট আর সী-পোর্ট থাকলেই হবে। সী-পোর্ট দিয়ে তাদের বিলাস এবং ভোগের সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানী করবেন। আর কোনরকমের বিপদ-অঘটন ঘটলে এয়ারপোর্ট দিয়ে পালিয়ে যাবেন।
সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এরকম সম্পর্কহীন কোনো উচ্চবিত্ত শ্রেণী দুনিয়ার অন্য কোনো দেশে আছে বলে আমাদের জানা নেই। বাদবাকি জনগণের ভাগে একটাই দায়িত্ব। একবেলা খেয়ে না খেয়ে এই শ্রেণীটাকে একইরকমভাবে টিকিয়ে রাখা। দরিদ্র মানুষ দরিদ্রতর হচ্ছে আর দেশে উচ্চবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। অবস্থা এমন নয় যে, বিত্তমানেরা বিত্ত সঞ্চয় করছে এবং একই সঙ্গে দরিদ্রের দারিদ্র্য-মোচনের কোনো উপায় বা কর্মসূচী গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে উঁচুবিত্তবানেরাই হলো বাংলাদেশের সবচাইতে কৃত্রিম বাঙালী। দেশকে শোষণ করে তারা টিকে আছে, বিনিময়ে তারা দেশকে কিছুই দিচ্ছে না।
অনেককে ইদানীং বলতে শোনা যায়, বিপ্লবের গালভরা বুলির দিন শেষ। এখন একমাত্র উন্মাদ ছাড়া কেউ বিপ্লবের কথা বলে না। এমনকি অনেক বিপ্লবী রাজনৈতিক দলও এই ‘বিপ্লব’ শব্দটিকে অনেকটা বর্জ্য হিসেবে গণ্য করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু বিপ্লবের কথা চিন্তা না করে এখানে মানুষের বাসযোগ্য একটি সমাজ কিভাবে নির্মাণ করা সম্ভব আমার জ্ঞান-বুদ্ধিতে আসে না। একটা বিরাট আকারের ভাঙচুর, একটা ওলটপালটের মাধ্যমে সমাজকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে না পারলে বিরাজমান পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে, তা চিন্তা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের এই সাড়ে এগারো কোটি মানুষের মুখে দানাপানি তুলে দিতে হলে, তাদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান করতে হলে, একটা শিক্ষিত জাতি সৃষ্টি করতে হলে, বাসস্থানের নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রশ্ন উঠলে অনিবার্যভাবে বিপ্লবের কথা এসে পড়ে। চীন, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলী দেখে অনেকে ভেবে বসে আছেন যে, আমাদের সমাজে বিপ্লবের প্রয়োজন নেই এবং এখানে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডেরও কোনো প্রয়োজন নেই।
এক যুগের বিপ্লবের বিশেষ তত্ত্ব অন্য যুগের প্রয়োজন হয়তো মেটাতে সক্ষম নয়। তাই বলে বিপ্লবের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, একথা মোটেও সত্যি নয়। সমাজে যখন বৈষম্য বিরাজমান থাকে, যখন অন্যায়-অবিচার চলে, দারিদ্র্য এবং হতশ্রী প্রকাণ্ড আকার ধারণ করে সমাজে প্রাণধারণের ক্ষীণতম সম্ভাবনাও রোধ করে দাঁড়ায়; তখন কি সমাজের ভেতর থেকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে? পূর্ব-ইউরোপীয় দেশসমূহে যা ঘটেছে সেগুলোও এক ধরনের বিপ্লব। একটি সামাজিক ব্যবস্থার নামে একটি আমলাতান্ত্রিক শ্রেণীর শোষণ এবং লুণ্ঠন জনগণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
আগে সমাজ-বিপ্লবের যে প্রচলিত সংজ্ঞা ছিল সেটি অচল প্রমাণিত হলে বিপ্লবের প্রয়োজন বাসি হয়ে যাবে, সেটা কখনো সত্যি নয়। বাংলাদেশের জনগণকে বাসযোগ্য সমাজ নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই একটি সমাজ-বিপ্লবের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তার জন্য দরকার বিপ্লবের একটি নতুন সংজ্ঞা – সে সংজ্ঞার সঙ্গে পূর্বের পাঠ্যপুস্তকের সংজ্ঞার যদি গরমিল ঘটে যায়, কিছু আসে যায় না।
আহমদ ছফা (১৯৮৯)