বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

শেকড়বিচ্ছিন্ন তরুণ প্রজন্মের জাগরণ

‘কোনো অসুস্থ সমাজব্যবস্থায় সুস্থ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য।’ প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ বইয়ের এ লাইনটি আজকাল বড্ড মনে পড়ছে। সত্যি, আমরা এমন এক দুঃসময়ে এসে উপনীত হয়েছি যখন একজন তরুণ-যুবক, প্রেমিক, এমনকি কারও স্বামীও হয়ে যাচ্ছে ধর্ষকামী নরমাংসের পশু। অপরদিকে ডিজিটালাইজেশনের জিকিরে, আধুনিকতা-
কনজিউমারিজমের তত্ত্বে, মিডিয়ার প্ররোচনাকেন্দ্রিক প্রচারণায় আর দেশীয় সংস্কৃতির দেউলিয়াপনায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম দিন দিন শেকড়বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের সম্ভাবনাময় তারুণ্যকে ডাইভার্ট করে দেয়া হচ্ছে চিন্তা-চেতনায়, দৃষ্টিভঙ্গিগত শূন্যতার সুযোগে। যাতে তাদের ভেতরে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বৈশ্বিক রাজনীতি-অর্থনীতি কিংবা জীবন-জগৎ নিয়ে কোনো প্রশ্ন-ভাবনা-দায়িত্ববোধ বা জাগরণ তৈরি হতে না পারে।
তাহলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভাবনার জায়গাটা মূলত কোথায়? সাহিত্য-ইতিহাস-বিজ্ঞান, ক্রীড়া-সংস্কৃতি-বিনোদন কিংবা রাজনীতি চর্চা? ‘মেম সাহেব’ উপন্যাসে নিমাই ভট্টাচার্য বলেছেন- ‘বাঙালি যুবকরা যৌবনে হয় রাজনীতি করবে, না হয় সাহিত্যচর্চা করবে।’ কিন্তু আমাদের তরুণ-যুব সম্প্রদায়ের চক্ষু-মন বইয়ের পাতা ছেড়ে অ্যান্ড্রয়েড, টাচপ্যাড, ল্যাপটপ, ফেসবুক, ভাইভার, ইউটিউব ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। প্রচলিত ধারার বাম-ডান-মধ্যপন্থী কিংবা চলমান ছাত্র রাজনীতি তরুণদের আর টানে না।
আমাদের ভাওয়াইয়া-লালন, নজরুল-রবীন্দ্র, ক্ল্যাসিক সঙ্গীতগুলোর ঠাঁই হয় না তাদের হার্ডডিস্ক-মেমোরি কার্ডের ফোল্ডারে। এরা বলিউডি প্রেম কাহিনী, তামিল আর হলিউডি রগরগে দৃশ্য দেখে মোহাচ্ছন্ন হয়; কিন্তু ‘বেলাশেষে’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘মুক্তির গান’ এদের আলোড়িত করে না।
আমাদের ছোট্ট সোনামণিদের হাতে এখন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘গোপাল ভাঁড়ে’র বদলে মটুপাতলু, ডোরেমন, টম অ্যান্ড জেরি আর খেলনা গেমসের রিমোট। আর আমাদের মা-চাচি-আন্টিরা ওপারের অভিজাততন্ত্রের নাটুকেপনা সিরিয়াল দেখে আত্মরম্ভিতায় সাংসারিক জীবনে তৈরি করছে কৃত্রিম সুখের অসুখ।
কাঁটাতারের সীমান্ত আর জলসীমা দিয়ে তরুণদের জন্য অবাধে ঢুকছে বস্তাভর্তি ইয়াবা-গাঁজা-ফেনসিডিল আর আমাদের দোকান ভর্তি হয়ে আছে উত্তেজক এনার্জি ড্রিংকসে। ভদ্রপল্লীতে নিয়ন আলোয় উড়ছে সিসার ধোঁয়া। এরা ১০ টাকা দিয়ে বেনসন সিগারেট খায় অথচ বন্যার্ত-ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৫ টাকাও এদের মানিব্যাগে থাকে না। এরা দলবেঁধে বইমেলায় যায় আড্ডা দিতে, কিন্তু বই কেনে না। আমাদের লোকঘরানার গানের উৎসব যার উচ্চমার্গীয় অভিজাত নাম ‘ফোক ফেস্টিভাল’, সেখানে এরা যায় রাত জেগে আড্ডা দিতে, গান শুনতে নয়।
আমাদের শহুরে উচ্চবিত্ত তরুণ প্রজন্ম গেঁয়ো দাদাবাড়িতে যেতে চায় না। গ্রামীণ মেঠোপথ, ধানক্ষেত, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, নদীতে সাঁকো, পালতোলা নৌকা, পুকুরে সাঁতার কাটা, লাটিম-ডাঙ্গুলি খেলা- এসব তারা কেবল বইয়ে পড়ে, সিনেমায় দেখে অনুভূতির স্বাদ কুড়াতে চায়। এ ইয়াম্মি জেনারেশনটা বাসার ছাদে কবুতর-টিয়া-ময়না পোষে না, এদের কারও কারও বেডরুমে শোভা পায় মাম্মি-ড্যাডি অথবা ঠিক প্রেমিক নয় বয়ফ্রেন্ডদের কিনে দেয়া টেডি বিয়ার-ক্যাট আর বিদেশী ডগ।
অপরদিকে তরুণ প্রজন্মের একটা অংশকে ব্রেনওয়াশ করে ধর্মান্ধতার আফিম খাইয়ে বুঁদ করে রাখছে কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল। কেউবা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে পারলৌকিক টিকিটের চাবিকাঠি স্বরূপ মানুষ হত্যার চাপাতি।
এ সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া তারুণ্যের অপচয়ে রাষ্ট্রে একটা মেধাশূন্যতা তৈরি হচ্ছে। ফলে আজ ঘরে-বাইরে, ক্যাম্পাসে, রাস্তায়, উৎসবে-অনুষ্ঠানে হাজার তরুণের মাঝে ‘মানুষ নামের মানুষ আছে’; কিন্তু আমাদের ‘সেই মানুষটা নেই’। তাই দিনে-রাতে মা-বোনদের ইভটিজিং, সম্ভ্রমহানি ঘটছে। ওদের ফেরানোর কেউ নেই। শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে ১৫ হাজার কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা লুট, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২৬৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮১০ কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে; অথচ জবাবদিহি করার কেউ নেই! সুন্দরবন ধ্বংস করা হচ্ছে, দেশীয় সম্পদ তেল-গ্যাস-বিমানবন্দর-জীবনবৃত্তান্ত ইজারা দেয়া হচ্ছে ভিনদেশী বহুজাতিক কোম্পানিকে; অথচ রাষ্ট্রের জনগণ তথা তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকেও কোনো প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে উঠছে না! কিছু সংগঠন ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত প্রতিবাদ-সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
কেন এ অবস্থা? কারণ দিন দিন আমাদের চেতনার অপমৃত্যু ঘটছে। তরুণদের অনেকেই ধুঁকে ধুঁকে মরছে জীবনের বাঁকে বাঁকে। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে; তরুণ প্রজন্মের ভেতরে পুঁতে রাখা বারুদগুলো জ্বলে উঠছে ক্রমে ক্রমে। তরুণদের ইয়াম্মি জেনারেশনের একটা অংশ হিপহপ কালচার আর কনজিউমারিজমে ব্যস্ত থাকলেও পাল্টা আরেকটা অংশ কিন্তু ঠিকই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের গ্রাসে, গণতন্ত্রের অচলায়তনে এ তরুণ প্রজন্ম তাকিয়ে আছে নতুন কোনো তন্ত্রের পানে গণমানুষের মুক্তির আশায়।
তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ তিউনিশিয়ায় জাগরণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারী শাসকদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের এ তরুণরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, ব্লগার হত্যা, শিশু রাকিব-রাজন হত্যা, বর্ষবরণে যৌন নিপীড়ন, তনু-সুজন হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে। ক্রিকেটীয় বিনোদনের প্রেরণায় জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছে লাখো তরুণ। এরা ফেসবুকের ওয়াল টপকিয়ে ইভেন্ট খুলে রাজপথের প্রতিবাদ মিছিলে নেমেছে। এবার রাষ্ট্রকেও দেশীয় সংস্কৃতির অধিক চর্চা, সুস্থ বিনোদন, প্রকৃত ইতিহাসচর্চা, বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানচর্চা, মুক্তচিন্তার বিকাশ ও প্রসারের সুযোগ দিতে হবে। আমাদের মূল বা শেকড়বিচ্ছিন্ন ওই তরুণ প্রজন্মকে মূল স্রোতধারায় যুক্ত করে নিয়ে আসতে হবে মুক্তির মিছিলে।
‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের নেতৃত্বে লাখো পাঠক-শ্রোতা তৈরি হচ্ছে। ‘প্রতিটি গ্রামে হোক একটি পাঠাগার’ স্লোগানে আবদুস সাত্তার খানরা তরুণদের নিয়ে দেশব্যাপী ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’ চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘ড্রিমস ফর টুমরো’র স্বপ্ন নিয়ে জাভেদ পারভেজরা এগিয়ে যাচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণদের দুয়ারে। ওয়াসফিয়া নাজরীন-মাবিয়া আক্তাররা দেশের পতাকা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে উচ্চতর শিখরে। আমাদের তরুণদের সামনে প্রেরণার দ্বীপ জ্বেলে বহির্বিশ্বে আলো ছড়াচ্ছেন সালমান খান, জিয়া হায়দার রহমান, তরুণ উদ্যোক্তা সাবিরুল ইসলামসহ আরও অনেক আদর্শিক ব্যক্তি। এভাবেই একটা পাল্টা চেতনার জাগরণ-নীরব উত্থান ঘটছে আমাদের তরুণদের মাঝে। এবার রাষ্ট্রীয় নেতাদের শুভ বুদ্ধির উদয়ের অপেক্ষা। আঁধার পেরিয়ে ভোর হচ্ছে; জানি, আলো আসবেই।

শরীফ আহমেদ : সাবেক শিক্ষার্থী, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sharifdu221@gmail.com