গত ক’দিন ধরে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরির লেখা ‘neither a hawk nor a Dove- An Insider’s Account of Pakistan’s foreign Policy’ বইটি পড়ছিলাম। নির্ঘণ্টসহ বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৫১। বইটি ২০১৫ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, পাকিস্তান এবং একই সালে ভারত থেকে পেঙ্গুইন
বুকস ইন্ডিয়া প্রকাশ করেছে। খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে জনাব কাসুরি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের ভেতরকার কাহিনীগুলো অত্যন্ত সাবলীল ও পাঠকবান্ধব ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এ বইয়ে তিনি নিজেকে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক দেখতে চান, তবে তা হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে।
বুকস ইন্ডিয়া প্রকাশ করেছে। খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে জনাব কাসুরি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের ভেতরকার কাহিনীগুলো অত্যন্ত সাবলীল ও পাঠকবান্ধব ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এ বইয়ে তিনি নিজেকে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক দেখতে চান, তবে তা হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে।
জনাব খুরশিদ কাসুরি পাকিস্তানের একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদ। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু এয়ার মার্শাল আসগর খানের ‘তাহরিক ই ইশতিকলাল’ পার্টির মধ্য দিয়ে। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। কারাগারে শাসকের রোষে তাকে ফাঁসির বন্দিদের সেলেও থাকতে হয়েছে। তার পিতা ছিলেন মরহুম মাহমুদ আলী কাসুরি। পাকিস্তানের প্রগতিশীল আন্দোলনে তিনি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। উপমহাদেশে বার এট ল’ পরীক্ষায় তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি প্রথম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন। আইনজীবী হিসেবে সাংবিধানিক আইন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে তার দক্ষতা ছিল সমপরিমাণ। আদালতে তিনি পাকিস্তানি রাজনীতিকদের নিবর্তনমূলক বন্দিত্বের বিরুদ্ধে অনেক আইনি লড়াই করেছেন। যখনই মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে তখনই তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাতে মরহুম মাহমুদ আলী কাসুরি পিছপা হননি। তার প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার স্বীকৃতি হিসেবে প্রখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের উদ্যোগে ভিয়েতনাম যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে যে বেসরকারি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় তার সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন মাহমুদ আলী কাসুরি। খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি তার পিতা সম্পর্কে বলেছেন, তিনি ছিলেন একজন ধর্মভীরু মুসলমান। একই সঙ্গে প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার অনুরাগী হতে তার কোনো জড়তা ছিল না।
খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি তার চিন্তা ও চেতনার জগৎ গঠনে তাদের লাহোরের ৪ নম্বর ফেইন রোডের বাসভবনে যারা আসা-যাওয়া করতেন কিংবা সাময়িকভাবে অবস্থানও করতেন সেসব রাজনীতিবিদের সম্পর্কে আলোচ্য গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং চিন্তার ওপরও আলোকপাত করেছেন। এসব স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, খান আবদুল গাফফার খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, খান আবদুল ওয়ালী খান, আতাউর রহমান খান, মাহমুদ আলী, আবদুল সামাদ খান আচাকজাই, জিএম সৈয়্যদ, মীর গাউস বক্স বিজেনজো, মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, এয়ার মার্শাল (অব.) মুহাম্মদ আসগর খান, নওয়াবজাদা নাসিরুল্লাহ খান, মালিক গোলাম জিলানী, মাজহার আলী খান, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, হাবিব জালিব, সিআর আসলাম, এম আফজাল বাংগাশ এবং শেখ মোহাম্মদ রশিদ। এর বাইরে তিনি যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন সেসব প্রতিষ্ঠানও এর মনোজগতের ওপর ছাপ ফেলেছে। তিনি যে কলেজে পড়েছেন তার অধ্যক্ষ ছিলেন খান আবদুল ওয়ালী খান। যিনি মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশেরও একজন শুভাকাক্সক্ষী।
পাক-ভারত সম্পর্কের উন্নতি না হওয়ার পেছনে পঠিত ইতিহাসের প্রভাব রয়েছে বলে খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি মনে করেন। যে ইতিহাস পাকিস্তান ও ভারতে ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পর করানো হয় তা এক ধরনের সংশোধনবাদী ইতিহাস বলে মনে করেন খুরশিদ কাসুরি। এ প্রসঙ্গে সংশোধনবাদ কথাটির একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। মার্কসবাদী লেনিনবাদীরা ওইসব মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের সংশোধনবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে, যারা মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের তত্ত্বের বিকৃতি ঘটায় পরিবর্তিত পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে। খুরশিদ কাসুরি পাকিস্তান ও ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অনেক তথ্য গোপন করে সাময়িক রাজনৈতিক প্রয়োজনে যে ইতিহাস ছাত্রছাত্রীদের জন্য রচনা করা হচ্ছে তাকেই ইতিহাসের সংশোধনবাদ হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। পাকিস্তানে এ সংশোধনবাদের মাত্রা বেশি, যার জন্য পাকিস্তানকে বড় মূল্য দিতে হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন দুই দেশেই ইতিহাসের সংশোধনবাদ পারস্পরিক বোঝাপড়াকে দুরূহ করে তুলেছে।
খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি বলেছেন, পাকিস্তানে ইতিহাস বিষয়টি খুবই কম গুরুত্ব পায়। পাকিস্তানি শিশুদের উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে খুব কমই জানানো হয়। যা জানানো হয় তাও খুব ভ্রান্ত। তার মতে, পৃথিবীর কোথাও পক্ষপাতমুক্ত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। কেননা সর্বত্রই ইতিহাস বর্ণনাকারীর পক্ষপাতিত্ব দ্বারা প্রভাবিত। এটা হতে পারে সচেতনভাবে অথবা অচেতনভাবে।
তুর্কি, ইরানি, মিসরীয় এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে বসবাসকারী মুসলমানেরা খুব ভালো মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্ববোধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মকে মেহেরগড় সভ্যতা সম্পর্কে খুব কমই বলা হয়। বোলান গিরিপথের কাছে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০-৩২০০ সালে বেলুচিস্তানের কাচ্চি সমতল ভূমিতে এ সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। খুব কমই বলা হয়, গান্ধারা সভ্যতার কথা। এ সভ্যতার বিকাশকাল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্ট পরবর্তী ৫০০ অব্দ পর্যন্ত। এ সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন খোয়া প্রদেশে। অথবা সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কেও খুব কিছু জানানো হয় না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, আমাদের বয়সীরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্কুলে ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ করতে গিয়ে এ সভ্যতাগুলো সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়েছিলাম। উল্লেখ্য, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পুত্র গওহর আইয়ুব যে শিল্প কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন তার নাম ছিল ‘গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজ’। খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি আরও উল্লেখ করেছেন, শিখ রাজা রঞ্জিত সিং পাঞ্জাব এবং পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলজুড়ে বিরাট রাজ্যের অধিকর্তা ছিলেন। কিন্তু এখন আর তা ইতিহাসের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত নেই। খুরশিদ কাসুরি আরও বলেছেন, পুরু ও রঞ্জিত সিং সেসব মুষ্টিমেয় পাঞ্জাবি নেতাদের অন্তর্গত যারা বৈদেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। পুরু লড়েছিলেন মহামতি আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে এবং রঞ্জিত সিং লড়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে। খুরশিদ কাসুরি বলছেন, তার পিতা মাহমুদ কাসুরি একজন ধর্মভীরু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পুরু এবং রঞ্জিত সিংকে পাঞ্জাবি বীর হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি। খুরশিদ কাসুরি মনে করেন, তরুণ প্রজন্মকে অতীত সম্পর্কে অন্ধকারে রেখে কোনো লক্ষ্য হাসিল হয় না। ফলে পাকিস্তানি জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, কবি আল্লামা ইকবাল লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘সারে জাঁহা ছে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা, হাম বুলবুলি হ্যায় ইসকি, ইয়ে গুলিস্তা হামারা।’ ওই ভারত ও পাকিস্তান এক দেশ ছিল। একই ধারায় তিনি বলছেন, পাকিস্তানের অনেকেই জানে না যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন এবং তাকে হিন্দু মুসলমান মিলনের দূত বলা হতো। লাহোরের ফোয়ারা চককে ভগত সিং চক নামে নামকরণ করতে গিয়ে যে বিতর্ক হয়েছিল সেটাও ছিল দুঃখজনক। ভগত সিং ছিলেন একজন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী।
পাকিস্তানি সমাজে আজ যে অসহিষ্ণুতা লক্ষ্য করা যায় তার মূলে রয়েছে ইতিহাসের বিকৃত বয়ান। পাকিস্তানে ইতিহাস বিকৃতির সচেতন প্রচেষ্টা রয়েছে এবং একই সঙ্গে পাঠ্যক্রমে ভাবাদর্শ ঢুকিয়ে দেয়ারও প্রয়াস রয়েছে। ফলে অনুসন্ধানী চিন্তা ব্যাহত হয়েছে এবং বিকৃত ইতিহাস মুখস্থ করে চিন্তা ও যুক্তি বিবর্জিত একটি জনগোষ্ঠী গড়ে উঠছে।
একইভাবে ভারতে জিন্নাহ এবং তার সহকর্মীদের যারা মুসলিম লীগে ছিলেন তাদের ব্রিটিশ এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাকিস্তানে যেভাবে গান্ধীকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়, একইভাবে ভারতে জিন্নাহকেও খাটো করা হয়। পাকিস্তানিরা অনেকেই জানে না যে, গান্ধী পাকিস্তানকে তার প্রাপ্য অর্থের হিস্যা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য অনশন করেছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে চরমপন্থী হিন্দু নাথুরাম গডসে গান্ধীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। গডসে মনে করেছিল গান্ধী পাকিস্তান ও মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল। একইভাবে জিন্নাহ কেবিনেট প্ল্যান গ্রহণ করে ভারতের অখণ্ডত্ব রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা কেবিনেট প্ল্যান প্রত্যাখ্যান করে ভারতের বিভাজন অনিবার্য করে তোলেন। যাই হোক, ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত না হওয়ার ফলে এবং ইতিহাসে সংশোধনবাদ ঢুকে পড়ার ফলে উপমহাদেশে দ্বন্দ্ব ও অশান্তি অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উপমহাদেশে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হওয়ার জন্য ইতিহাসকে সংশোধনবাদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এটাই মনে করেন খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি। বাংলাদেশেও ইতিহাস চর্চার নামে যা হচ্ছে তা কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সে সম্পর্কেও আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কয়েকদিন আগে বদরুদ্দীন উমর সাহেব যুগান্তরে একটি লেখায় লিখেছেন, আমাদের পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস শেখানোর বিষয়টি খুবই গৌণ হয়ে গেছে। এ কারণেই টেলিভিশনের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা যখন তরুণ-তরুণীদের ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে অদ্ভুত সব জবাব শুনতে পাই। এ দুঃখ কোথায় রাখব? ইতিহাসের সংশোধনবাদ অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং একইভাবে ক্ষতিকর ইতিহাসবিমুখতা। বাংলাদেশে যেভাবে ইতিহাসবিমুখতা চলছে তার জন্য এখনই সচেতন হতে হবে। অন্যথায় জাতীয় সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকবে। এটি কারও কাম্য হতে পারে না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক