বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৬

যিশুর পুনরুত্থান মহোৎসব: ইস্টার বা পাস্কা

আজ ২৭ মার্চ, রোববার। সারা পৃথিবীতে খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা আজ মহাসমারোহে পালন করছে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রভু যিশুর গৌরবময় পুনরুত্থান মহোৎসব পাস্কা বা ইস্টার। সবাই উচ্চকণ্ঠে গেয়ে উঠছে, জয় জয় প্রভুর জয়! ২৫ মার্চ ছিল গুড ফ্রাইডে বা পুণ্য শুক্রবার; স্মরণ করা হয়েছে যিশুর পরিত্রাণদায়ী মৃত্যু।
মানুষ কৃচ্ছ্রসাধন করে, উপবাস করে নিজ পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে; নিজ পাপ স্বীকার করে ঈশ্বর ও মানুষের সঙ্গে হয়েছে পুনর্মিলিত। আজ আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে, পালন করা হচ্ছে প্রভু যিশুর গৌরবময় পুনরুত্থান মহোৎসব পাস্কা। আমরা পাস্কা-রহস্যটি যতই অনুধ্যানে অনুধাবন করতে পারব, ততই ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে যিশুর সঙ্গে নতুন হয়ে উঠতে পারব।
আলোর মহোৎসব পাস্কা বা ইস্টার
বস্তুত শনিবার রাত থেকেই এই নবজীবনের মহোৎসব পাস্কা শুরু হয়। অন্ধকার। এরই মাঝে আগুন আশীর্বাদ, প্রার্থনায় যাচনা করা হয় খ্রিষ্টের পুনরুত্থান আলো যেন মানুষের মনের সব অন্ধকার দূর করে। আশীর্বাদী আগুন থেকে জ্বালানো হয় পুনরুত্থান প্রদীপ, চলতি সাল সমেত পঞ্চক্ষতের পাঁচটি ধূপকাঠি লাগানো এক বিরাট আকারের মোমবাতি, যা ঘোষণা করে: আদি ও অনন্ত যিনি সেই যিশুর পুনরুত্থান মানুষের জীবনে এনেছে নতুন আলো, নতুন জীবন, যিশুর পুনরুত্থান দূরীভূত করেছে পাপের অন্ধকার, মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী যিশুখ্রিষ্টের সঙ্গে হয়েছে নবীভূত। আজকের এই মহোৎসব আলোর মহোৎসব। তাই পুনরুত্থান বাতি সামনে নিয়ে প্রজ্বালিত বাতি হাতে নিয়ে শোভাযাত্রা করে প্রবেশ করে উপাসনালয়ে, ঘোষণা করে পুণ্য জ্যোতির মহিমা।
এই উৎসব আমাদের সবাইকে আলোকিত ও নবায়িত মানুষ হয়ে যিশুর সঙ্গে পুনরুত্থিত হয়ে তাঁর আলোতে উদ্ভাসিত হতে আহ্বান জানায়। আর তাই ভক্তসমাজ তার দীক্ষার প্রতিজ্ঞা নবায়ন করে এবং আশীর্বাদিত দীক্ষাজল দ্বারা নিজেকে সিঞ্চিত করে। আর এভাবেই ভক্ত পাপ পরিত্যাগ করার সংকল্প করে আর বিশ্বাস নবায়ন করে পুনরুত্থিত খ্রিষ্টে নতুন ‘আমিতে’ পরিণত হয়।
আসুন সাধু পলের মতো আমরাও বলি:
আমার পুরোনো ‘আমি’ যিশুর সঙ্গে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছে, যিশুর সঙ্গে আমার নতুন ‘আমি’টি জেগে উঠেছে। (গালাতীয় ২: ২০-২১)।
পুনরুত্থান বা পাস্কা রোববার, ইস্টার সানডে
আজ নতুন সাজে ছোট-বড় সবাই পুনরুত্থানের খ্রিষ্টযোগে তথা উপাসনায় অংশগ্রহণ করে। গির্জাঘর থাকে খ্রিষ্টভক্ত দিয়ে পূর্ণ। খ্রিষ্টযোগে পুরোহিত যিশুর পুনরুত্থানে আমাদের নতুন জীবন, আমার জীবনে পুনরুত্থিত যিশুর উপস্থিতি ও বাস্তব প্রকাশ, এমন সব দিকগুলো অনুধ্যানে নিয়ে আসে। উপাসনার পরেই চলে আপন আপন কৃষ্টিতে ইস্টারের শুভেচ্ছা বিনিময়। ঘরে ঘরে আজ আয়োজন করা হয় দই-চিড়া, মুড়ি-মুড়কির মতো হরেক রকম মুখরোচক আহার সামগ্রী। এতে অংশগ্রহণ করবে ঘরের সবাই, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই। এই আসরে অনেক সময়ই নিমন্ত্রিত হয় হিন্দু-মুসলিম ভাইবোনেরাও।

পাস্কা পর্ব ও বাস্তবতা
অপ্রিয় হলেও সত্য যে আমাদের দেশে অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে মানুষ ভীষণভাবে নৈতিকতার দিক থেকে অসুস্থ। অনেক মানুষই আজ মিথ্যা, চুরি, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ, হানাহানি, খুনোখুনি, পরচর্চা, পরনিন্দা, প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি—এমন সব পাপের গহ্বরে পড়ে আছে। আজকের এই ইস্টার বা পুনরুত্থান পর্ব এমন অন্ধকারের জীবন থেকে বের হয়ে বাংলার মানুষকে আলোর রাজ্যে আসার আহ্বান জানায়।
পুনরুত্থিত বা আলোকিত জীবনের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী হতে পারে? : যেখানে বৈষম্য ও দলাদলি থেকে আসে মিলন ও ভ্রাতৃত্ব, যেখানে অশান্ত থেকে আসে শান্তি, যেখানে ঝগড়া-বিবাদ থেকে আসে ক্ষমা, যেখানে জটিলতা ও অস্বাস্থ্যকর জটিলতা-কুটিলতা থেকে আসে সরলতা ও স্বচ্ছতা, যেখানে নেই ধর্ষণ বা মানব-নিধন, যেখানে নেই কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি, যেখানে নেই মিথ্যার ছড়াছড়ি, সেখানেই তো নবজীবন, পুনরুত্থিত জীবন। আসুন, আমরা পাপপঙ্কিলতা ত্যাগ করে স্বচ্ছ-সুন্দর পবিত্র জীবন নিয়ে পুনরুত্থিত মানুষে পরিণত হই। আর এ প্রসঙ্গেই দেখা যাবে যে এই পাস্কা পর্ব শুধু খ্রিষ্টবিশ্বাসীদেরই নয়, এই মহোৎসবের আবেদন, তাগিদ ও এর আহ্বান সর্বজনীন।
বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই শান্তিপ্রিয়, উগ্রতা তার ধর্ম নয়। ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের দেশের মানুষ মিলনের কৃষ্টির মানুষ, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান একত্রে বাস করে আসছে যুগ যুগ ধরেই। বাংলার মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যান বিদেশি বন্ধুরা। অতএব আমাদের শক্তি আছে এই মূল্যবোধগুলো নিয়ে উল্লিখিত পাপগুলোর ওপর জয় করে পুনরুত্থিত মানুষে পরিণত হওয়া। আর এই প্রসঙ্গে যিশুর পুনরুত্থান আমাদের প্রত্যেকের জন্য পাপের ওপর বিজয়ী হওয়ার একটি বড় চেতনা ও প্রেরণা।

ইস্টার এবং স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষ
অত্যন্ত মজার দিক হলো এ বছর স্বাধীনতা দিবস ইস্টার সানডের এক দিন আগে। স্বাধীনতা হলো বন্দিদশা থেকে মুক্তি। কত ভাইবোন এই মুক্তির জন্য প্রাণ দিয়েছেন। আর পাপের বন্দিদশা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে যিশু একবারই মৃত্যুবরণ করে ও পুনরুত্থান করে মুক্তি এনে দিয়েছেন। পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ এই পাস্কা বা ইস্টার সানডের দুই সপ্তাহ পরেই। নববর্ষ তো নতুন জীবনই ঘোষণা করে। নতুনকে স্বাগতম জানিয়ে সেদিন গেয়ে উঠব: এসো হে বৈশাখ, এসো এসো। একইভাবে আমরা এই পুনরুত্থান উৎসবে নতুন জীবনকে স্বাগত জানাই। আমাদের জীবন ঘোষণা করুক যে আমরা কথায়, কাজে, আচরণে, সম্পর্কে, ধর্মীয়, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনে হয়েছি নতুন।

একটি আক্ষেপ
এই আনন্দের দিনেও একটি আক্ষেপ! ইস্টার তথা যিশুর পুনরুত্থান-রহস্য খ্রিষ্টধর্মে একটি প্রধান ধর্মীয় বিষয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের ভিত্তিই হলো যিশুর এই পুনরুত্থান। অন্যান্য ধর্মের যেমন প্রধান প্রধান ধর্মীয় পূজা বা ঈদ রয়েছে, ইস্টার তেমনই একটি মুখ্য খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় মহোৎসব। পরিতাপের বিষয়, দিনটি ছুটির দিন নয়। এই দিনটিতে খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা মুক্ত ধারায় মহোৎসবটি পালন করতে পারছে না। এমনকি এই দিনটিতেই ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার তারিখও পড়ে যায়। দেশের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বিষয়টি বিবেচনায় আনবেন, এটি আমাদের প্রত্যাশা। এই ইস্টারে খ্রিষ্টবিশ্বাসী আমাদের সবার বিনম্র অনুরোধ যে এই দিনটিকে ঐচ্ছিক নয় বরং সাধারণ ছুটি হিসেবে অনুমোদন দিলে পুনরুত্থান রোববারে মুক্ত মন নিয়ে খ্রিষ্টান ছাত্রছাত্রীরা, চাকরিজীবীরা ও সকল পর্যায়ের খ্রিষ্টান নারী-পুরুষ গির্জায় যেতে পারবে এবং পারিবারিক, সামাজিক, কৃষ্টিগত ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে, সর্বোপরি সর্বজনীনভাবে খ্রিষ্টবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় রহস্যভিত্তিক এই মহোৎসবটি সবার কাছেই সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে, পরিচিত হবে।
হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সবার প্রতি রইল শুভ পাস্কা পর্বের প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা। পুনরুত্থিত যিশুর শান্তি ও আনন্দ সবার ঘরে ঘরে বিরাজ করুক। শুভ পাস্কা, শুভ পুনরুত্থান, হ্যাপি ইস্টার! খ্রিষ্ট সত্যই পুনরুত্থান করেছেন, আলে­লুইয়া!
ফাদার প্যাট্রিক গমেজ: আহ্বায়ক, আন্তধর্মীয় সংলাপ কমিশন, রাজশাহী ধর্ম প্রদেশ।