সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬

মরণবাঁধ ফারাক্কা, ষোলই মে ও মওলানা ভাসানী

খুব নিঃশব্দেই ১৬ মে চলে গেল। তারপরও ফারাক্কা লংমার্চ উদযাপন কমিটিকে অশেষ ধন্যবাদ জানাতে হয়। তারা দিনটি বিস্মৃত হতে দেননি। তারা রাজশাহীতে এক বিশাল গণজমায়েতের আয়োজন করেছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সেখানে আরও অনেকের সঙ্গে অংশগ্রহণ করার। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার অসুস্থ শরীরে ছুটে এসেছিলেন। এসেছিলেন ড. এসআই খান, প্রকৌশলী এম
ইনামুল হক, সৈয়দ ইরফানুল বারী, হাসনাত কাইয়ুম, সাংবাদিক ও সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার ও আরও অনেকে। রাজশাহীর স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়া সৌভাগ্য বটে। ধন্যবাদ মাহবুব সিদ্দিকী ও এডভোকেট মো. এনামুল হক।

অবাক লাগে। যেখানে পুরো জনগোষ্ঠীর জৈবিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে, সেখানে আমরা ১৬ মে ভুলি কীভাবে? ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানের খরা চলছে সর্বত্র। এবার প্রায় সব জেলাতেই তাপমাত্রার দাহ সবাই বোধ করেছে। উষ্ণতা বাড়ছে পৃথিবীর, একইভাবে বাংলাদেশেরও। দাবদাহ ও খরায় উত্তরবঙ্গে অসহনীয় পরিস্থিতি। আর এ বাস্তবতার মধ্যেই ভারত থেকে এবার সবচেয়ে কম পানি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী যে পানি পাওয়ার কথা সেই পানি ভারত দেয়নি। তারপরও আমরা ১৬ মে ভুলে গিয়েছি। আমরা ভুলে গিয়েছি যে, আজ থেকে ৪০ বছর আগে এই দিনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কার বিরুদ্ধে লংমার্চে অসুস্থ শরীরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার ওফাতের আগে জাতীয় ক্ষেত্রে এটাই ছিল তার শেষ অথচ দূরদর্শী ভূমিকা।

ফারাক্কা মার্চের মধ্য দিয়ে তিনি তিনটি মৌলিক সিদ্ধান্ত পরবর্তী প্রজন্মের পর্যালোচনার জন্য রেখে গিয়েছেন। প্রথম বিষয় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চরিত্র সম্পর্কে। ভাসানী বুঝেছিলেন দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে মতান্তর ও দ্বন্দ্ব^ থাকবে। সেসব মতান্তর ও বিরোধ স্থায়ী না হতে পারে, কিন্তু পানি ও নদীপ্রবাহের ওপর ভারতের দখলদারিত্বের চরিত্র বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন নদীর প্রবাহ ও পানির প্রাপ্তি দ্বারাই শেষাবধি ঠিক হবে। এটাই অন্যসব বিরোধ ও দ্বন্দ্বকে তীব্র করবে। এই বিরোধ প্রশমনের সঙ্গে অন্যান্য বিরোধ প্রশমনের সম্পর্ক জড়িত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংঘাতের কারণ হয়ে উঠবে পানি ও নদী। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জনগণের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করছে পানি ও নদীর প্রবাহের ওপর। যখন নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করা হবে এবং পানির ন্যায্য হক ও অধিকার থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হবে, তখন তা প্রবল বিরোধের রূপ নেবে।

মওলানা ভাববাদী ছিলেন না, তিনি মাটিতে মাটির ঘরে বাস করতেন। দালানে না। ইসলামী জীবনযাপন বলতে কী বোঝায় তিনি তার সাক্ষাৎ নিদর্শন ছিলেন। তাকে দিয়ে আমরা অন্যদের সহজেই মূল্যায়ন করতে পারি। তাকে কে কীভাবে ব্যবহার করেছে কিংবা মওলানা কেন তার চিন্তাচেতনা থেকে ভিন্ন আদর্শের লোকজনের সঙ্গে কাজ করেছেন সেটা ভিন্ন তর্ক। তবে বলা যায়, তার সত্যিকারের অনুসারী বলি কী মুরিদ বলি, তারা ছিল গায়ে কাদা-হাতে কাদা কৃষক। তাদের কারবার বাস্তবের সঙ্গে। মাটিতে। যারা ‘দেশ’ বা ‘জাতি’ নামক বিমূর্ত কোনো আত্মপরিচয়ের নিশানা দিয়ে নয়, বরং তার নিজেকে এবং সব মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে বাস্তবে সম্বন্ধযুক্ত সত্তা হিসেবে উপলব্ধি করে। এটা তাদের দৈনন্দিন চাষাবাদের চর্চা থেকে তৈরি। ফলে মওলানা নিজে এবং তার অনুসারী ও ভক্ত সবাই এই সম্বন্ধের গুরুত্ব বুঝতেন। তাই তারা সহজেই বুঝেছেন, পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না। জীবের জীবন অচল হয়ে পড়ে। পানি ছাড়া প্রকৃতির ধ্বংস অনিবার্য। পানি, নদীপ্রবাহ ও জীবনের পারস্পরিক বাস্তব সম্বন্ধের এই ইহলৌকিকতাই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আধাত্মিকতা শুধু আজগবি বা পারলৌকিক ব্যাপার নয়। স ষ্টার যিনি দাস তার সৃষ্টিকে রক্ষা করাই বান্দার প্রথম কাজ। এ বাস্তবতাই দূরদর্শী ভাসানীকে বুঝিয়ে দিয়েছে, ফারাক্কা শুধু বাংলাদেশের নয়, সীমান্তের দুই পাশের নদীকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর বাঁচা-মরার সঙ্গে জড়িত।

কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার জন্য ফারাক্কা নির্মাণ করা হয়েছিল, লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য ও ব্যবসা। ফারাক্কা গঙ্গার নাব্যতা বৃদ্ধির সমাধান ছিল না। কিন্তু উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে ব্যবসা বিশেষত ছোট-বড় নির্মাণ কোম্পানির বিনিয়োগের স্বার্থ জড়িত। ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো নির্মাণ একই সঙ্গে রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বিনিয়োগ।

ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করে হিন্দুস্তান কন্সট্রাকশন কোম্পানি। এদের সদর দফতর মুম্বাই। ১৯২৬ সালে শেঠ বালচাঁদ হিরাচাঁদ এ কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করে। ফারাক্কা ব্যারাজের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে। ষাট দশক ছিল উপনিবেশোত্তর যুগে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বিস্তারের দরকারে রাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালনের যুগ। রাষ্ট্রই জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নামে বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগ ক্ষেত্র নির্ণয় ও সেখানে বিনিয়োগের জন্য সব রাজনৈতিক শর্ত নিশ্চিত করে। দাবি করা হয়, গঙ্গা থেকে পানি সরিয়ে হুগলি নদীতে দিলে হুগলির নাব্যতা বাড়বে। এ ধরনের বৃহৎ ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পকে পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়া থেকে আলাদা করে বিচার করা পদ্ধতিগতভাবে ভুল। হুগলির নাব্যতা বৃদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট হাইড্রলজিক্যাল যুক্তি না থাকলেও এই ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে।

তাহলে দূরদর্শী মওলানা ভাসানী ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে দীর্ঘ পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় যে বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন সেটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল আধুনিক রাষ্ট্র, বৃহৎ পুঁজি এবং বড় বড় ড্যাম, বাঁধ বা বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ছাড়া পুঁজির পুঞ্জীভবন ও বিস্তার ষাট দশক থেকে সাম্প্রতিক গোলকায়নের পর্ব পর্যন্ত অসম্ভব ছিল। আধুনিক রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে প্রধান ভুমিকা পালন করেছে। এই সম্বন্ধ এখনও জারি রয়েছে, তবে গোলকায়নের যুগে লগ্নিকারী পুঁজির গোলকায়ন প্রধান হয়ে উঠেছে। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাস্তব রূপান্তর বোঝার জন্য এ দিকগুলো বোঝা জরুরি। যদি আমরা বাস্তবে পুঁজির পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতির কারবার ঐতিহাসিকভাবে বুঝতে চাই, তাহলে বুঝতে হবে কীভাবে আধুনিক রাষ্ট্র পুঁজির বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় এবং বৃহৎ পুঁজির বিচলন ও মুনাফা নিশ্চিত করে।

দুই

তাহলে ফারাক্কা বাঁধবিরোধী লংমার্চ মোটেও ভারতবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। এই সেই সময় যখন মওলানা ভাসানীর মধ্যে আমরা বরং নতুন রাজনৈতিক চিন্তার পরিগঠনের চেষ্টা দেখতে পাই। যেটা তার রবুবিয়াত বা পালনবাদ সংক্রান্ত মৌলিক রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। যা ইসলামপন্থী রাজনীতির সংকীর্ণতা এবং একই সঙ্গে কমিউনিস্টদের চিন্তাভাবনার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যেতে চেয়েছে। এখান থেকে আমরা তার তৃতীয় সিদ্ধান্তের ওপর আলোকপাত করতে পারি। সেটা হচ্ছে মরণবাঁধ ফারাক্কাকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ভাঙতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই।

এই সিদ্ধান্ত, বলা বাহুল্য, হঠাৎ অবাস্তব মনে হবে। কিন্তু তর্কটা এটা নয় যে, বাংলাদেশের হিম্মত নাই তাই ফারাক্কাকে গুঁড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কিংবা হিম্মত থাকলে ভাসানী লংমার্চ করে গিয়ে ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দিয়ে আসতেন। না, এটা মোটেও বাস্তব/অবাস্তবের তর্ক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ভাসানী কেন মরণবাঁধ ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা বললেন? কোন যুক্তি বা কোন নীতির ভিত্তিতে? তার এ সিদ্ধান্ত বুঝতে হলে তার ‘রবুবিয়াত’ সংক্রান্ত ধারণাকে ঘনিষ্ঠভাবে বোঝা দরকার। এখানে সেটা বিস্তৃত ব্যাখ্যার সুযোগ নাই। ভাসানী নিজেও বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন তা নয়। কিন্তু আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু কথা আপাতত পেশ করে শেষ করব। ‘হুকমতে রব্বানিয়া’ কী ও কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভাসানী বলছেন :

‘আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলিয়াছেন, আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং উহাদিগের মধ্যে কোনো কিছুই ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করি নাই, আমি এই দুইটি অযথা সৃষ্টি করি নাই : কিন্তু উহাদিগের অধিকাংশই ইহা জানে না (সুরা দূখান)।

‘পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির যথার্থতা সম্পর্কে বলিয়াছেন। কোনো কিছুই তামাশা কিংবা খামখেয়ালির বসে সৃষ্টি করা হয় নাই। তাই কোনো কিছুর সৃষ্টিই অহেতুক নহে। সকল সৃষ্টির অন্তরালে সামগ্রিক এবং বিষয় বিশেষে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘রব’ গুণে গুণান্বিত হইয়া শুধু সৃষ্টিই করিয়া যাইতেছেন না। সবকিছুই বিশেষ উদ্দেশ্যে লালনপালনও করিতেছেন। স ষ্টার এই পালনবাদের আদর্শই হইল রবুবিয়ত। সকল কর্মসূচি ও পরিকল্পনায় রবুবিয়তের আদর্শ যে রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হইবে তাহাই হুকুমতে রব্বানিয়া। সে রাষ্ট্রে থাকিবে স ষ্টার পালনবাদ, মানুষের শাসনবাদ নহে। আজকের দুনিয়ায় রাজনৈতিক সকল মতবাদ মানুষের নিজস্ব শাসন আরোপ করিয়াছে। তাহা এককথায় হইয়াছে নফসানিয়াত, যাহার দরুন প্রকৃতপক্ষে পালনবাদের স্থলে কায়েম হইয়াছে শাসনবাদ। তাই দেখা যাইতেছে ধনবাদী হউক আর সমাজবাদী হউক কোন ব্লকের মানুষই সুখী হইতে পারে নাই, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয় নাই। ধনবাদী সমাজের শাসন ও শোষণ মানবজাতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলিয়া দিয়াছে। তথাকথিত সমাজবাদী দুনিয়ার শাসন ও সঙ্কোচন মানুষকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিয়াছে। সেখানে আত্মিক বিকাশের কোন মুক্ত পথ কিংবা অনুমতি নাই।’

এ বক্তব্য থেকে কয়েকটি কথা পরিষ্কার।

এক. সৃষ্টির কোনো কিছুই উদ্দেশ্যহীন নয়। সামগ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিটি বস্তু, অবস্তু বা প্রাণের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। তাহলে মানুষের কর্তব্য হচ্ছে কোনো কিছুই ধ্বংস বা বিনাশ সাধন না করে তাদের বিকাশ ও পালন নিশ্চিত করা। দুনিয়ার প্রভু হওয়া বা প্রকৃতি জয় করে প্রকৃতির ওপর খবরদারি করা, কিংবা প্রকৃতিকে শুধু মানুষের ভোগ বিলাসের উপায়ে পরিণত করার বিরোধিতা করছেন মওলানা ভাসানী। প্রকৃতি উৎপাদনের উপায় মাত্র নয়, কাঁচামালের জোগানদারও নয়। মানুষ সৃষ্টি থেকে আলাদা কিছু নয়। সৃষ্টির মধ্যেই তার মহিমা খচিত।

গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, তার সিদ্ধান্তের পক্ষে তিনি কোরআনকে সাক্ষী মেনেছেন। প্রকৃতিকে ব্যবহার করা যাবে, অবশ্যই তিনি ব্যবহারের বিরোধিতা করছেন না। কিন্তু প্রকৃতির কোনো ক্ষতি করা যাবে না। তাদের স্বাভাবিক ভূমিকার মধ্যে কোনো বিকৃতি ঘটানো যাবে না। তিনি চাইছেন আমরা যেন সৃষ্টিকর্তার পালনবাদের নীতি মেনে চলি।

তার যুক্তি অনুসারে নদী শাসন করা, তার গতিপথ ও প্রবাহ ভিন্নদিকে প্রবাহিত করানো, প্রবাহের বিকৃতি ঘটানো এ সবই পালনবাদের বিরোধী। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এর বিরুদ্ধে জিহাদ প্রতিটি পালনবাদীর কর্তব্য। মুসলমানদের জন্য এটা ঈমানি দায়িত্ব। নিজের নফসানিয়াত বা ভোগী স্বভাবের বিরুদ্ধে জিহাদ করেই মুসলমান পালনকর্তার স্বভাব অর্জন করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর গুণাবলী তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। একমাত্র ভোগীরাই, মুসলমান হোক বা না হোক, এই জিহাদ থেকে দূরে সরে থাকবে।

দ্বিতীয়ত, তিনি বলছেন, যে রাষ্ট্র রবুবিয়তের আদর্শ বাস্তবায়ন করবে সেই রাষ্ট্রই হচ্ছে পালনবাদী রাষ্ট্র কিংবা তার ভাষায় ‘হুকুমতে রাব্বানিয়া’। ভাসানী সম্পূর্ন নতুন ধরনের রাষ্ট্রের কথা বলছেন। তিনি তার রাষ্ট্রের ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়ে স্পষ্টভাবে একে পালনবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু ‘হুকুমতে রাব্বানিয়া’ যেহেতু আরবি, বাংলাদেশের সেকুলাররা একে এক ধরনের ইসলামী রাষ্ট্র ভেবেছে। যে ভাষা সাধারণ মানুষ সহজে বোঝে, সেই ভাষা বুঝত না বলে কমিউনিস্টদের ওপর বিরক্ত ছিলেন তিনি। ইসলাম বিদ্বেষ অনেকের মধ্যে আরবি ভাষার প্রতি বিদ্বেষ হিসেবেও প্রকাশ পেত।

উপরের উদ্ধৃতিতে তার তৃতীয় পয়েন্ট হচ্ছে, আজকের দুনিয়ায় রাজনৈতিক সব মতবাদ মানুষের নিজস্ব শাসন আরোপ করেছে। এর মানে এই নয় যে, মানুষের দ্বারা রচিত আদর্শ বলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করছেন। তিনি প্রত্যাখ্যান করছেন কারণ তা আসলে ‘নফস’ বা ভোগী, লোভী, স্বার্থপর ও ব্যক্তিবাদী মানুষের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার গূঢ় ও অন্তর্গত সম্পর্ককে মূল্য দেয়নি। অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেন সেই রুহানিয়াতের পরিবর্তে নফসানিয়াতের হুকুমত তারা কায়েম করেছে। যার দরুন সেসব রাষ্ট্র পালনবাদী না হয়ে শাসনবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সে কারণে তাদের চরিত্রে বিশেষ ফারাক হয়নি। ধনবাদী কিংবা সমাজবাদী কোনো ব্লকের মানুষ সুখী হতে পারেনি। ফলে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ও শোষণ মানবজাতিকে ধ্বংসের পথে যেমন ঠেলে দিয়েছে, তেমনি তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার শাসন ও সঙ্কোচন মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সেখানে রুহানিয়াতের, অর্থাৎ আত্মিক বিকাশের কোনো মুক্ত পথ নাই। কিংবা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো ‘অনুমতি’ নাই।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, পালনবাদের ধারণার জায়গা থেকেই ভাসানী ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। এর কোনো বিকল্প নাই। তিনি পানি নিয়ে দেনদরবারের তর্কে যাননি। সেটা বরং তার নীতির বিরুদ্ধে। নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করা হয়েছে, নদীকে আপন এবং তার প্রবাহের সুফল প্রাণ-প্রকৃতির মধ্যে স্বাভাবিকভাবে সঞ্চারিত না হতে দিয়ে দিল্লি যে অন্যায় করেছে, তা গঙ্গার পানির হিস্যা পাওয়া-না পাওয়ার তর্ক নয়। দিল্লি এটা করতে পারে না। জাতিধর্ম নির্বিশেষে যারাই নদীর বিকৃতি ও প্রকৃতি বিনাশী কাজের বিরোধী, তাদের কর্তব্য হচ্ছে এর বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হওয়া, ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দেয়া।

ভাসানী একটি পরিচ্ছন্ন দর্শন ও রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এ অবস্থান জানা ও বোঝা জরুরি। পানি প্রকৃতির সম্পদ। প্রকৃতির সাধারণ সম্পত্তি। মওলানার ভাষায়, ‘আল্লাহর রহমত’। ভারত একতরফাভাবে নদীর প্রাকৃতিক ধারাকে বন্ধ করে দিয়ে অপরাধ করেছে। এটা অতীব ঘৃণ্য ও জঘন্য অপরাধ। তার সংগ্রামের এই নীতিগত দিকটা যদি আমরা বুঝি তাহলে দেশের ভেতরে বা বাইরে পানি সম্পদ ‘ব্যক্তিগতকরণের’ (Privatization) বা প্রকৃতিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। পানির পরিমাণ কোন দেশ কতটা পাবে তা নির্ণয়ের কোনো মানদণ্ড নির্মাণ অসম্ভব। কারণ পালনবাদের দৃষ্টিতে পানি শুধু মানুষের নয়, তার ওপর সব প্রাণের হক বা অধিকার রয়েছে। তাহলে কীভাবে আমরা পাখি, পশু, জীব, অণুজীব, মাছ, গাছপালা এসবের চাহিদা পরিমাপ করব? কীভাবে? পরিমাণ নিয়ে দেনদরবার পালনবাদী চিন্তার বিরোধী। ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নাই।

২০ মে, ২০১৬/৬ জৈষ্ঠ্য, ১৪২৩, শ্যামলী

ফরহাদ মজহার