শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

নতুন সম্ভাবনা ও বেক্সিট প্রসঙ্গ | ফাহিম আহমেদ

১৯৯২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের জন্য ছিল একটি কালো বুধবার। কেননা সেদিন ইউরোপের অভিন্ন মুদ্রা নীতির (এক্সচেঞ্জ রেট ম্যাকানিজম) বিপরীতে ব্রিটেন তার পাউন্ডের মান ধরে রাখতে পারছিল না বলে ইইউ'র মুদ্রা নীতি থেকে বেরিয়ে আসে ব্রিটেন। এর কারণে বহু বছর ভুগতে হয়েছে ব্রিটেনকে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের অর্থমন্ত্রী ছিলেন নরম্যান ল্যামেন্ট।
সেদিনকার অর্থমন্ত্রনালয়ের একজন উপদেষ্টা ছিলেন আজকের ডেভিড ক্যামেরুন। তার হাত ধরেই আরো একটি কালো দিবসের সাক্ষী হল ব্রিটেনবাসী। অন্তত ৪৮ শতাংশ ব্রিটেনবাসী। ২৩ জুনের গণভোটে ব্রিটেনের ইইউতে থাকা না থাকার প্রশ্নে ভোট দেয় আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, ইংল্যান্ড ও ব্রিটিশ শাসিত স্পেন উপকূলের জিব্লাটারের সাড়ে ৪ কোটি ভোটার।



উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে ব্রেক্সিটের (ব্রিটিশ + এক্সিট = ব্রেক্সিট) বিপক্ষে অধিক ভোট পড়লেও ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে জয় লাভ করে ব্রেক্সিটের পক্ষের শক্তি। আর এর ফলে ব্রেক্সিটের পক্ষে ৫৮ শতাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ইউরোপের নেতৃত্ব দান করার জন্য যে পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের হাত ধরে তার অনানুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটল ৪৩ বছল পর ডেভিড ক্যামেরুনের সরকারের আমলে যদিও দুজনই চেয়েছিলেন ব্রিটেনকে ইউরোপের নেতৃত্বের আসনে বসাতে। ব্রেক্সিটের পক্ষের শক্তি জয়লাভ করায় ইতমধ্যে পদত্যাগের ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছেন ক্যামেরুন। অক্টোবরেই ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়বেন ক্ষমতাবান কনজারভেটিভ দলের দ্বিতীয় মেয়াদে আসীন এ প্রধানমন্ত্রী।

বেক্সিটের বিপক্ষে একটি অন্য়তম যুক্তি হল সমগ্র ইউরোপে ব্রিটেনের নাগরিকদের সহজ বিচরণ ও চাকরীর সুবিধা। তবে এর পক্ষের একটি অন্য়তম যুক্তি হল ইইউর সদস্য় রাষ্ট্রগুলোর ওপর অধিকপ্রভাব বিস্তারকারী মনোভাব। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বহু ব্রিটিশ নাগরিক নব্য় সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে আখ্য়া দিয়েছেন।

ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক অবনতির দিকে যাওয়ার পথে। কেননা ব্রিটেনে এতদিন ইইউভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকেরাই বিশেষ সুবিধা পেত। ব্রেক্সিটের ফলে ব্রিটেনে স্বভাবতই কমনওয়েলথভুক্ত দেশ সমূহের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যেতে পারে কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর কমনওয়েলথই হল এমন এতটি বেসামরিক জোট যেখানে এখনও ব্রিটেনের প্রভাব অপরিসীম। তাছাড়া এর ফলে বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানসহ কমনওয়েলথভুক্ত এশিয় দেশগুলোর সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে । ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের একটি বড় অংশ রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত। কিন্তু অভিবাসন সংকটের দোহাই দিয়ে এতদিন বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এতদিন ব্রিটেনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার কর্মী সংকট নিরসনে রোমানিয়দের নিয়োগ করার জন্য টরি দল থেকে আহ্বান করা হয়। এর কারণ রোমানিয়া ইইউভুক্ত ও তাদের সস্তা শ্রম। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন আর সম্ভব হবে না। এর ফলে ব্রিটেনে অভিবাসন বিরোধী নীতির পরিবর্তন ঘটতে পারে। অপরদিকে ভারতীয়দের বেশ কদর আছে দক্ষ স্বাস্থ্য় কর্মী হিসেবে। এসব দিক বিবেচনা করে দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর জন্য নতুন সম্ভানার তৈরি করবে বেক্সিট। তবে ভারতের আশার আলো আরো উজ্জ্বল করবে সে দেশে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনৈতিক কর্মীরা।

এদের অন্যতম হলেন প্রীতি প্যাটেল যিনি টরি দলের মাধ্যমে বেক্সিটের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি ভারতীয়দের জন্য নতুন সম্ভাবনার পথ প্রস্তুতে কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশের জন্য এ ধরণের কোন পদক্ষেপ সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পার্লামেন্ট সদস্যরা করছেন না। ব্রিটেনে বসবাস করে ও সেখানকার রাজনৈতিক মঞ্চে উন্নীত হওয়ার ফলে তাদের এখন আর এদেশের স্বার্থ দেখার সময় নেই। তবে বেক্সিটের ফলাফলের প্রকৃত অনুধাবন এখনই সম্ভব নয়। কেননা লিসবন চুক্তির আর্টিকেল ৫০ ধারা মোতাবেক ব্রিটিশ সরকারের সাথে ইইউ'র বিগত ৪০ বছরেরও বেশী সময়ের হিসাব নিকাশ শেষ করতে হবে যা সম্পন্ন করতে প্রায় দুই বছর পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ব্রেক্সিটের প্রকৃত প্রভাব অনুধাবন ২০২০ সালের আগে সম্ভব হবে না। ততোদিনে যদি স্কল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য আরেকটি গণভোটের দাবি উঠে যায় অথবা স্কটল্যান্ড স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে ফেলে তাহলে অবাক হওয়ার মত কিছু হবে না।

ফাহিম আহমেদ

শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,