অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২৮ জাতির জোট ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ব্রিটেন। 'ব্রেক্সিট' নামে পরিচিত কট্টরবাদী প্রচারণার পক্ষে ২৩ জুনের গণভোটে পরিস্কার ব্যবধানে 'না থাকা'র পক্ষে ভোট দিয়েছে ব্রিটেনের জনগণ।
এই গণভোট ও ফলাফল এমন এক সময়ে সামনে এলো যখন ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে কঠিন অভিবাসী সমস্যা মোকাবেলা করছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাত ইউরোপে ক্রমবর্ধমান জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে সম্ভাব্য কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা জানিয়ে বিশ্ব নেতারা নানা বক্তব্য-বিশ্লেষণ করেছেন। নেতিবাচক বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও বিরোধীদল লেবার পার্টির নেতারা বক্তব্য-প্রচারণা করলেও তা কোনো কাজে আসেনি। নানামুখী ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টি ও কট্টর নব্য-নাৎসীবাদী গোষ্ঠীর প্রচারণাকে সঠিক মনে করেছে ব্রিটেনের বৃহত্তর জনগণ।
ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে জাতি-গোষ্ঠীগত বিভিন্ন সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে কথনো বেশি কখনো কম অবস্থায় আছে। ইইউ জোট ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপে ওই সব সমস্যা মোটামুটিভাবে মোকাবেলা করা গেলেও ইইউ জোট থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে তা বড় ধরণের সমস্যা তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইইউ ছাড়লে ব্রিটেনের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি পাউন্ড। ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী অসবোর্নের ভাষায় এটি এক ‘কৃষ্ণগহ্বর’ যা পূরণ করা কার্যত অসম্ভব। তখন জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় হ্রাস ও কর বাড়ানো ছাড়া সরকারের সামনে বিকল্প কোন উপায় থাকবে না। এমনটাই জানিয়েছে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী। ব্রিটেনের ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সরাসরি ইইউ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত, আর ইইউ থেকে প্রতিবছর গড়ে ২৪ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ হয় ব্রিটেনে। ইইউ থেকে ব্রিটেন বের হলে দেশটির অর্থনীতিকে প্রায় ১০ হাজার কোটি ইউরোর ধাক্কা সামলাতে হবে বলে কনফেডারেশনস অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রি সাবধান করেছে। আর এই ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে যে অসন্তোষ আর অভিবাসীদের ওপরে যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চাপ তৈরি হবে, তা অনেকের কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলারপন্থীদের ন্যায় আচরণ ফিরে আসার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
থাকা না থাকার গণভোটের একক কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করছেন অভিবাসন সমস্যাকে। ১৯৭৩ সালে ব্রিটেন তৎকালীন ইউরোপিয়ান কমিউনিটিতে (ইএ) যোগ দেয়। ১৯৭৫ সালে ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে ৬৭ শতাংশ মানুষ ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটিতে (ইইএ) থাকার পক্ষে রায় দেয়। এরপর থেকে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। ২০০৪ সালে পূর্ব ইউরোপের তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশ পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, সাইপ্রাস, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়ার মত দেশ ইইউতে যোগ দিলে যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের আগমন বাড়তে থাকে। ফলে ২০১০ সালের নির্বাচনে যুক্তরাজ্যে প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় অভিবাসন।
গণভোটের আগে ব্রিটেনের জাতীয় পরিসংখ্যানবিদ জন পুলিনজার অভিবাসনের একটি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছিলেন। সেখানে দেখা যায়, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে ইইউভুক্ত দেশের ১৯ লাখ ৫৫ হাজার নাগরিক ব্রিটেনে বসতি গড়েছে। ওই বছর রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া যোগ দেয়ার পর, দ্রুত সেই সংখ্যা বর্তমানে ৩০ লাখের কোটা ছুঁয়েছে বলেও ধারণা।
২০১৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে ইইউ'র বাইরের দেশ থেকে এসে বসতি গড়া লোকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ লাখ। শুধু ২০১৫ সালে ব্রিটেনে নেট ইমিগ্রেশনের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার, এর মধ্যে ১ লাখ ৮৪ হাজার এসেছে ইইউর বাইরের দেশ থেকে।
ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করলে সরকারী ব্যয় হ্রাস করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে রেখেছেন। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) ও অবসরপ্রাপ্তদের পেনসনসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্রিটেন সরকার যে ব্যয় বছরের পর বছর বাড়িয়ে এসেছে ব্রেক্সিটের পর তা অব্যাহত রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। ক্রমবর্ধমান জঙ্গিবাদ ও নিরাপত্তা বিষয়ে ব্রিটেনকে নিজেদের মতো করে ভাবতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই চাপ তৈরি হবে। যদিও ব্রিটেনের কনজারভেটিভদের দাবি, ইইউ ছাড়লে ব্রিটেন ইউরোপে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করা নিজ অর্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরায় ফিরিয়ে সেটি তখন নিজের দেশে এনএইচএসের মতো খাতগুলোয় বিনিয়োগ করতে পারবে।
গত জি২০ ও জি৭ বৈঠকেও ব্রিটেনের ইইউতে থাকা না থাকার বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ক্ষমতাধর সব রাষ্ট্রই ব্রিটেনকে ইইউ না ছাড়ার বিষয়ে পরামর্শসহ ছাড়লে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে।
কিন্তু কোনো যুক্তি বা হুঁশিয়ারি কাজে আসেনি ব্রিটেনের গণভোটে। বরং ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে বিপক্ষে ভেদাভেদ এতটাই প্রকট হয়েছিল যে, এ বিতর্ককে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে একজন এমপি হত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। হত্যার অভিযোগে আটক টমি মেয়ার নামের যে ব্রিটিশ নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার সঙ্গে কট্টর ও নব্য-নাৎসীবাদী গোষ্ঠীর যোগাযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ইউরোপের বর্ণিল জাতিগত মিশ্রণ থেকে বেরিয়ে এসে শুধুমাত্র ব্রিটিশ নাগরিকদের দেশ তৈরির কট্টর প্রচারণাকে বেছে নিতে যাচ্ছে ব্রিটেন। ইইউ বিরোধী নেতারা বলেছেন কঠোর ইমিগ্রেশন আইনের কথা। তারা চান ব্রিটেনে ইমিগ্রেন্টের সংখ্যা ১৯৮০ এর আগে-পরের মতো নামিয়ে আনতে, যা বছরে প্রায় ৪০ হাজারের মতো। গণভোটে ব্রিটেন ইইউকে ছাড়লে ইইউ নাগরিকদের জন্যও পয়েন্ট বেইজড সিস্টেম চালুর কথাও বলেছে তারা। ডেভিড ক্যামেরনও অবশ্য ইইউতে থেকেই ব্রিটেনে ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সম্পাদিত লিসবন ট্রিয়েটির ফলে ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করলেও ইইউ ইমিগ্রেন্টদের ফেরত পাঠাতে পারবে না। আবার অনেক ব্রিটিশ নাগরিক ইইউয়ের অনেক দেশে কর্মরত ও ব্যবসা করছে। যারা ইইউ থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে (লিভ ক্যাম্পেইন) প্রচার চালিয়েছিলেন তারাও বলছেন না যে, গণভোটের ফলাফল ইইউর বিপক্ষে যাওয়া মাত্রই তারা ইইউ ইমিগ্রেন্টদের বের করে দেবেন। কিন্তু সামনের দিনগুলিতে বিষয়টি একটি 'কট্টর ও নাৎসীবাদী' রুপ নিতে পারে।
বৈশ্বিক অভিবাসী অস্থিরতা ও আঞ্চলিক নানা সংঘাতের মুখে ব্রিটেন ইইউ ছেড়ে শুধুমাত্র নিজেদের কথা ভেবে যে পথে হাটছে তা অনেকটাই মিলে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অ্যাডলফ হিটলারের চিন্তার সঙ্গে।
গণভোটের ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম, যা ১৯৮৫ সালের পর সর্বনিম্ন দাম। ইউরোপিয়ান জোটভূক্ত দেশগুলোর ভেতরে সহজ বাণিজ্য ও কাঁচামাল আমদানী-রপ্তানির যে সুযোগ নিয়ে ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীরা ইইউ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছিলো, ব্রিটেনের বেড়িয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্তের জন্য তাদের সমস্যায় ফেলবে। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের নাগরিক-ব্যবসায়ী যারা দ্বৈত নাগরিত্বের সুযোগ নিয়ে নিজ নিজ দেশের সঙ্গে ব্যবসা করছিলেন, তারাও শ্রমবল ও নতুন করের ঝামেলায় পড়বেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সতর্ক করেছে অনেক আগে থেকেই। তারা বলেছে, ব্রিটেন ইইউ ছাড়লে বড় ধরনের আর্থিক সংকট তৈরি হবে। যুক্তরাজ্য ফের মন্দায় পড়বে, বেকারত্ব বাড়বে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে, জীবনমানের অবনতি ঘটবে।
ইইউতে থাকা ব্রিটেনের অন্যতম বড় দুই বাণিজ্য অংশীদার জার্মানি ও ফ্রান্স গণভোটের আগে থেকেই তাদের শঙ্কার কথা জানিয়ে আসছে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্র্যাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইনমেইয়ার ইইউ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াকে 'বিকারগ্রস্ত' আচরণ হবে বলে আগেই সাবধান করেছেন। স্টেইনমেইয়ারের মতে, ব্রিটেন ইইউ ছাড়লে এক ইউরোপীয় দেশ অন্য ইউরোপীয় দেশের বিরোধী করে তুলবে। ফরাসী মন্ত্রীও তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।
আর ইইউ ছাড়ার ভয়াবহ পরিণতি সর্ম্পকে গত মে মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছিলেন, ২৮ জাতির জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। ডেভিড ক্যামেরন নানা উদাহরণ আর বিশ্লেষণ দিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকদের সতর্ক করে বক্তৃতা করেছিলেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টার পরে ফলাফল সামনে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকছে না ব্রিটেন। কিন্তু এই ফলাফলের ফলাফল হিসেবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যে 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ' শঙ্কার কথা বলেছিলেন, তার বাস্তবতার জন্য হয়তো আরো অপেক্ষা করতে হবে বিশ্ববাসীকে।
আব্দুল্লাহ আল সাফি
এই গণভোট ও ফলাফল এমন এক সময়ে সামনে এলো যখন ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে কঠিন অভিবাসী সমস্যা মোকাবেলা করছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাত ইউরোপে ক্রমবর্ধমান জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে সম্ভাব্য কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা জানিয়ে বিশ্ব নেতারা নানা বক্তব্য-বিশ্লেষণ করেছেন। নেতিবাচক বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও বিরোধীদল লেবার পার্টির নেতারা বক্তব্য-প্রচারণা করলেও তা কোনো কাজে আসেনি। নানামুখী ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টি ও কট্টর নব্য-নাৎসীবাদী গোষ্ঠীর প্রচারণাকে সঠিক মনে করেছে ব্রিটেনের বৃহত্তর জনগণ।
ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে জাতি-গোষ্ঠীগত বিভিন্ন সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে কথনো বেশি কখনো কম অবস্থায় আছে। ইইউ জোট ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপে ওই সব সমস্যা মোটামুটিভাবে মোকাবেলা করা গেলেও ইইউ জোট থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে তা বড় ধরণের সমস্যা তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইইউ ছাড়লে ব্রিটেনের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি পাউন্ড। ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী অসবোর্নের ভাষায় এটি এক ‘কৃষ্ণগহ্বর’ যা পূরণ করা কার্যত অসম্ভব। তখন জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় হ্রাস ও কর বাড়ানো ছাড়া সরকারের সামনে বিকল্প কোন উপায় থাকবে না। এমনটাই জানিয়েছে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী। ব্রিটেনের ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সরাসরি ইইউ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত, আর ইইউ থেকে প্রতিবছর গড়ে ২৪ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ হয় ব্রিটেনে। ইইউ থেকে ব্রিটেন বের হলে দেশটির অর্থনীতিকে প্রায় ১০ হাজার কোটি ইউরোর ধাক্কা সামলাতে হবে বলে কনফেডারেশনস অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রি সাবধান করেছে। আর এই ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে যে অসন্তোষ আর অভিবাসীদের ওপরে যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চাপ তৈরি হবে, তা অনেকের কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলারপন্থীদের ন্যায় আচরণ ফিরে আসার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
থাকা না থাকার গণভোটের একক কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করছেন অভিবাসন সমস্যাকে। ১৯৭৩ সালে ব্রিটেন তৎকালীন ইউরোপিয়ান কমিউনিটিতে (ইএ) যোগ দেয়। ১৯৭৫ সালে ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে ৬৭ শতাংশ মানুষ ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটিতে (ইইএ) থাকার পক্ষে রায় দেয়। এরপর থেকে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। ২০০৪ সালে পূর্ব ইউরোপের তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশ পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, সাইপ্রাস, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়ার মত দেশ ইইউতে যোগ দিলে যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের আগমন বাড়তে থাকে। ফলে ২০১০ সালের নির্বাচনে যুক্তরাজ্যে প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় অভিবাসন।
গণভোটের আগে ব্রিটেনের জাতীয় পরিসংখ্যানবিদ জন পুলিনজার অভিবাসনের একটি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছিলেন। সেখানে দেখা যায়, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে ইইউভুক্ত দেশের ১৯ লাখ ৫৫ হাজার নাগরিক ব্রিটেনে বসতি গড়েছে। ওই বছর রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া যোগ দেয়ার পর, দ্রুত সেই সংখ্যা বর্তমানে ৩০ লাখের কোটা ছুঁয়েছে বলেও ধারণা।
২০১৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে ইইউ'র বাইরের দেশ থেকে এসে বসতি গড়া লোকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ লাখ। শুধু ২০১৫ সালে ব্রিটেনে নেট ইমিগ্রেশনের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার, এর মধ্যে ১ লাখ ৮৪ হাজার এসেছে ইইউর বাইরের দেশ থেকে।
ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করলে সরকারী ব্যয় হ্রাস করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে রেখেছেন। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) ও অবসরপ্রাপ্তদের পেনসনসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্রিটেন সরকার যে ব্যয় বছরের পর বছর বাড়িয়ে এসেছে ব্রেক্সিটের পর তা অব্যাহত রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। ক্রমবর্ধমান জঙ্গিবাদ ও নিরাপত্তা বিষয়ে ব্রিটেনকে নিজেদের মতো করে ভাবতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই চাপ তৈরি হবে। যদিও ব্রিটেনের কনজারভেটিভদের দাবি, ইইউ ছাড়লে ব্রিটেন ইউরোপে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করা নিজ অর্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরায় ফিরিয়ে সেটি তখন নিজের দেশে এনএইচএসের মতো খাতগুলোয় বিনিয়োগ করতে পারবে।
গত জি২০ ও জি৭ বৈঠকেও ব্রিটেনের ইইউতে থাকা না থাকার বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ক্ষমতাধর সব রাষ্ট্রই ব্রিটেনকে ইইউ না ছাড়ার বিষয়ে পরামর্শসহ ছাড়লে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে।
কিন্তু কোনো যুক্তি বা হুঁশিয়ারি কাজে আসেনি ব্রিটেনের গণভোটে। বরং ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে বিপক্ষে ভেদাভেদ এতটাই প্রকট হয়েছিল যে, এ বিতর্ককে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে একজন এমপি হত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। হত্যার অভিযোগে আটক টমি মেয়ার নামের যে ব্রিটিশ নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার সঙ্গে কট্টর ও নব্য-নাৎসীবাদী গোষ্ঠীর যোগাযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ইউরোপের বর্ণিল জাতিগত মিশ্রণ থেকে বেরিয়ে এসে শুধুমাত্র ব্রিটিশ নাগরিকদের দেশ তৈরির কট্টর প্রচারণাকে বেছে নিতে যাচ্ছে ব্রিটেন। ইইউ বিরোধী নেতারা বলেছেন কঠোর ইমিগ্রেশন আইনের কথা। তারা চান ব্রিটেনে ইমিগ্রেন্টের সংখ্যা ১৯৮০ এর আগে-পরের মতো নামিয়ে আনতে, যা বছরে প্রায় ৪০ হাজারের মতো। গণভোটে ব্রিটেন ইইউকে ছাড়লে ইইউ নাগরিকদের জন্যও পয়েন্ট বেইজড সিস্টেম চালুর কথাও বলেছে তারা। ডেভিড ক্যামেরনও অবশ্য ইইউতে থেকেই ব্রিটেনে ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সম্পাদিত লিসবন ট্রিয়েটির ফলে ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করলেও ইইউ ইমিগ্রেন্টদের ফেরত পাঠাতে পারবে না। আবার অনেক ব্রিটিশ নাগরিক ইইউয়ের অনেক দেশে কর্মরত ও ব্যবসা করছে। যারা ইইউ থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে (লিভ ক্যাম্পেইন) প্রচার চালিয়েছিলেন তারাও বলছেন না যে, গণভোটের ফলাফল ইইউর বিপক্ষে যাওয়া মাত্রই তারা ইইউ ইমিগ্রেন্টদের বের করে দেবেন। কিন্তু সামনের দিনগুলিতে বিষয়টি একটি 'কট্টর ও নাৎসীবাদী' রুপ নিতে পারে।
বৈশ্বিক অভিবাসী অস্থিরতা ও আঞ্চলিক নানা সংঘাতের মুখে ব্রিটেন ইইউ ছেড়ে শুধুমাত্র নিজেদের কথা ভেবে যে পথে হাটছে তা অনেকটাই মিলে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অ্যাডলফ হিটলারের চিন্তার সঙ্গে।
গণভোটের ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম, যা ১৯৮৫ সালের পর সর্বনিম্ন দাম। ইউরোপিয়ান জোটভূক্ত দেশগুলোর ভেতরে সহজ বাণিজ্য ও কাঁচামাল আমদানী-রপ্তানির যে সুযোগ নিয়ে ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীরা ইইউ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছিলো, ব্রিটেনের বেড়িয়ে যাওয়ার এই সিদ্ধান্তের জন্য তাদের সমস্যায় ফেলবে। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের নাগরিক-ব্যবসায়ী যারা দ্বৈত নাগরিত্বের সুযোগ নিয়ে নিজ নিজ দেশের সঙ্গে ব্যবসা করছিলেন, তারাও শ্রমবল ও নতুন করের ঝামেলায় পড়বেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সতর্ক করেছে অনেক আগে থেকেই। তারা বলেছে, ব্রিটেন ইইউ ছাড়লে বড় ধরনের আর্থিক সংকট তৈরি হবে। যুক্তরাজ্য ফের মন্দায় পড়বে, বেকারত্ব বাড়বে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে, জীবনমানের অবনতি ঘটবে।
ইইউতে থাকা ব্রিটেনের অন্যতম বড় দুই বাণিজ্য অংশীদার জার্মানি ও ফ্রান্স গণভোটের আগে থেকেই তাদের শঙ্কার কথা জানিয়ে আসছে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্র্যাঙ্ক ওয়াল্টার স্টেইনমেইয়ার ইইউ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াকে 'বিকারগ্রস্ত' আচরণ হবে বলে আগেই সাবধান করেছেন। স্টেইনমেইয়ারের মতে, ব্রিটেন ইইউ ছাড়লে এক ইউরোপীয় দেশ অন্য ইউরোপীয় দেশের বিরোধী করে তুলবে। ফরাসী মন্ত্রীও তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।
আর ইইউ ছাড়ার ভয়াবহ পরিণতি সর্ম্পকে গত মে মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছিলেন, ২৮ জাতির জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। ডেভিড ক্যামেরন নানা উদাহরণ আর বিশ্লেষণ দিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকদের সতর্ক করে বক্তৃতা করেছিলেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টার পরে ফলাফল সামনে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকছে না ব্রিটেন। কিন্তু এই ফলাফলের ফলাফল হিসেবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যে 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ' শঙ্কার কথা বলেছিলেন, তার বাস্তবতার জন্য হয়তো আরো অপেক্ষা করতে হবে বিশ্ববাসীকে।
আব্দুল্লাহ আল সাফি