রবিবার, ১৯ জুন, ২০১৬

বাণিজ্যের জন্য নতজানু মোদি

এবার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটনে চারবার এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট ২৭ বার দেখা হল। তাতে ভারতের কী লাভ হয়েছে, এই প্রশ্ন উঠেছে দেশের সর্বত্র। ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার পর আমেরিকা মোদিকে সে দেশে যাওয়ার ভিসা বন্ধ করে দেয়। বিগত লোকসভা ভোটের ফল বের হওয়ার কিছুদিন আগে সে
নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা দ্রুতবেগে ভারত দখল করে একটানা দুশো বছর রাজত্ব করেছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন– ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা ছিল রাজদণ্ডরূপে’। মোদির সদ্য আমেরিকা সফরে ভারত কী পেল, আর আমেরিকাই-বা কী পেল, তার চুলচেরা বিচার শুরু হয়ে গেছে। সে প্রসঙ্গেই কবিগুরুর ওই কথা মনে পড়ল।

১৯৯১ সালে বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারত আমেরিকার কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার বরাত দিয়েছিল। আর দুবছরে মোদি দিয়েছেন ২ বিলিয়ন ডলারের বরাত। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও আরও কয়েক বিলিয়ন ডলারের বরাত দিয়ে এসেছেন তিনি।

আরও এমন একটি সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে এসেছেন যা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে; তা হল, আমেরিকার ধাঁচে ভারতের রাজ্যগুলি সরাসরি আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে। মোদি কি শুধু গুজরাতের কথা ভেবেই এত বড় সিদ্ধান্ত নিলেন? নাকি গোটা দেশ বিক্রি করে দিলেন, ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে আমেরিকাকে এদেশে ঢোকার ব্যবস্থা করে এলেন?

এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাশের দেশ বাংলাদেশকে এখনও কব্জা করতে পারেনি আমেরিকা। অথচ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে কার্যত আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার রাস্তা খুললেন নরেন্দ্র মোদি। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, জার্মান রাজ্যগুলিকে যে আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে তার গ্যারান্টার হয় ভারত সরকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির গ্যারান্টার কে হবে? এটা কি ভারতের সংবিধানসম্মত বিষয়?

প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার আগে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে আরএসএস প্রচারক ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই সময় থেকেই গুজরাতের যে ব্যবসায়ীরা আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় থিতু হয়েছিলেন মোদি তাদের সংস্পর্শে আসেন। তারাই এখন আমেরিকায় মোদির পুুঁজি। মোদি সে দেশে গিয়ে এখন ব্যবস্থা করে এসেছেন যে, মার্কিন ব্যবসায়ীরা এবার সরাসরি রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। সে জন্য তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে না।

এমনকি আমেরিকা এমনও ঠিক করেছে যে, মার্কিন মুল্লুকে তারা ভারতের মুখ্যমন্ত্রীদের আলোচনা সভা (কনক্লেভ) বসাবে। সেখানে তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন মার্কিন পুঁজিপতিরা। এমনকি মার্কিন শিল্পপতিদের সামনে ভারতের মুখ্যমন্ত্রীরা তাদের রাজ্যে বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরতে পারেন, তার ব্যবস্থাও করা হবে। তবে ঠিক কবে এ ধরনের কনক্লেভ করা হবে সে ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ের বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়েছিলেন। সেটা এক রকম। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য গোটা দেশে উন্মুক্ত পরিবেশ তৈরি করার বিষয়টি অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না।

 প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে মার্কিন কংগ্রেস এবং সেনেটে যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় টিভির পর্দায় তাঁর যে শরীরী ভাষা দেখা গেছে তা ভারতীয়রা ভালোভাবে নেননি। তার অন্যতম কারণ হল এটাই যে, তিনি বারবার অটল বিহারী বাজপেরীর কথা উল্লেখ করে সেনেট সদস্যদের মন জয় করার চেষ্টা করছিলেন। ভারত ১৯৪৯ সালে নেহেরুর নেতৃত্বে যে বিদেশনীতি (জোটনিরপেক্ষ) নিয়েছিল, অনেকেরই ধারণা হয়েছে, মোদি সেই নীতি থেকে সরে গিয়ে আমেরিকার তাঁবেদারি করা শুরু করে দিয়েছেন। এটা কি তিনি আগামী লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে করলেন, নাকি নেহেরু-গান্ধী পরিবারকে আরও ছোট করার জন্য? আলোচনা চলছে এসব নিয়েও।

নেহেরুর জোটনিরপেক্ষ নীতির যিনি সহায়ক ছিলেন তিনি ভারতের প্রথম বিদেশ ও কমনওয়েলথ সচিব, চট্টগ্রামের সুবিমল দত্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ঢাকায় প্রথম রাষ্ট্রদূত হয়ে যান। তাঁর মুখে শুনেছি, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, মিশরের নাসের, যুগোস্লাভিয়ার মার্শল টিটোকে একই সঙ্গে ভারতে ডেকে নেহেরু বুঝিয়েছিলেন যে, বৃহৎ দুই শক্তি, আমেরিকা ও সোভিয়েতের জোট থেকে দূরে থাকতে হবে।

সে নীতি এখনও অব্যাহত রয়েছে। ২০০৭ সালে হাভানায় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিং এই নীতির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করেন। তখন কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো অসুস্থ। গভীর রাতে মনমোহন সিংএর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। আমিও সে সময় ছিলাম। কাস্ত্রো বলেছিলেন, জোটনিরপেক্ষতার প্রশ্নে ভারত ও কিউবা কতটা ব্যাগ্র তা গোটা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের দেখা উচিত।

জোটনিরপেক্ষ থাকাটা যে পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে, মোদি হয়তো এখনও তা অনুধাবন করতে পারেননি। কিংবা বিদেশ মন্ত্রক থেকে সেভাবে ‘ইনপুট’ পাননি। কারণ তিনি বড় হয়েছেন আরএসএস পরিমণ্ডলে।

মোদির আমেরিকা সফরে ভারত কী পেল, আর কী দিল, সে হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, ভারত দিয়েছে বেশি, পেয়েছে কম। কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে আসল কথা সম্পর্কে টু শব্দটিও করা হয়নি। তা হল চীন প্রসঙ্গ। চীন এশিয়ার বড় শক্তি। বিশ্বেও উদীয়মান শক্তি হিসেবে চিহ্নিত। চীনকে উপেক্ষা করে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে মোদি কি আবার ব্রিটিশদের মতো আমেরিকানদের আনতে চাইছেন? দক্ষিণ চীন সমুদ্র অঞ্চলের দখলদারি এবং সেখানে আবরিতভাবে মার্কিন নৌবহরের টহল সম্পর্কে একটি কথাও বলা হয়নি।

কৌশলগত ক্ষেত্রে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমঝোতা হয়েছে। এর আওতায় ভারতের প্রতিরক্ষা এবং পরমাণু ক্ষেত্রও রয়েছে। বলা হয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি এই সমঝোতা চুক্তির আকার নেবে। কিন্তু সে ব্যাপারে ভারত ও আমেরিকা কোনো পক্ষই এখনও উচ্চবাচ্য করেনি।

উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, এর আগের দুবারের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দুটি দেশই বলেছিল দক্ষিণ চীন সমুদ্র অঞ্চলে নিয়ে সদর্থক আলোচনা করতে হবে। বিশেষ করে জলপথের অধিকার এবং এশিয়া নিয়ে মার্কিন ও পশ্চিমি নৌবাহিনীর সঙ্গে প্রায় যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়, সে ব্যাপারটি সমাধা করার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দক্ষিণ চীন প্রসঙ্গটাই ওঠেনি দুই রাষ্ট্রনেতার বৈঠকে। তার ওপর প্রতিরক্ষা ও পরমণুৃ ক্ষেত্রসহ ভারত ও আমেরিকার মধ্যে চূড়ান্ত গোপন সমঝোতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা।

ভারতের সংসদ অধিবেশন শুরু হলে মোদির আমেরিকা সফর নিয়ে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই। মার্কিন কংগ্রেসের ৪৫ মিনিটের বক্তৃতায় মোদি বলেছেন, তাঁর কাছে সংবিধান অতি পবিত্র গ্রন্থ। কিন্তু বাস্তবে সংবিধানকে আদৌ গুরুত্ব দেন না মোদি। প্রশ্ন উঠেছে, আরএসএসএর ভরসাতেই কি তিনি এত বেপরোয়া? কারণ যে সংবিধানের নামে তিনি শপথ নিয়েছিলেন, প্রতি মুহূর্তে তা তিনি ভঙ্গ করছেন।

২০০৫ সালে ইউপিএ-১ আসনে ভারত মার্কিন পরমাণু চুক্তি নিয়ে দেশজুড়ে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশীয় রাজনীতির চিত্রটাই বদলে দিয়েছিল। সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতায় একাধিকবার সংসদ অচল করে দিয়েছিল নরেন্দ্র মোাদিরই দল। সে চুক্তি সম্পদিত হলেও বাস্তবে তা রূপায়ন করা যায়নি। আর সেই নরেন্দ্র মোদিই কিনা আমেরিকা সফরে গিয়ে পরমাণু শক্তির বিষয়ে বেশ কয়েকটা সমঝোতা করে এলেন।

এই সমঝোতার ফলেই দক্ষিণ ভারতে ছটি পরমাণু চুল্লি তৈরি করবে মার্কিন কয়েকটি সংস্থা। বিপুল অর্থ ব্যয় করে এসব পরমাণু চুল্লি তৈরির প্রসঙ্গ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে দেশের বিরোধী দলগুলি। তারা জানিয়েছেন, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি একই স্থানে ছটি চুল্লী নিরাপত্তার দিক থেকেও বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু বাণিজ্য শুরু হওয়ায় আরএসএস এবং বিজেপি নরেন্দ্র মোদির নামে ধন্য ধন্য করছে ঠিকই। কিন্তু দেশের বিরাট অংশের মানুষ মনে করছেন, পরমাণু বাণিজ্যের খাতিরে নরেন্দ্র মোদি যে পরিমাণ নতজানু হলেন, তাতে ভারতের লাভ কী হল? এই ছটি পরমাণু চুল্লির খরচ তো আছেই, সেই সঙ্গে চুল্লিগুলির নির্মাণ ও ঝুঁকির দায়িত্ব নিতে হবে ভারতের বীমা সংস্থাগুলিকে। অর্থাৎ মোদির মার্কিন-প্রেমের খরচ মেটাতে হবে সাধারণ মানুষের দেওয়া করের টাকায়। তাতে কারও আপত্তি রয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে গুরুত্বই দিতে চাইছেন না মোদি সরকার।

যে সংবিধানের কথা বলে তিনি আমেরিকায় মুর্হূমুর্হূ পেলেন, তা তিনি নিজেই ভেঙ্গে চলেছেন একের পর এক ঘটনায়। বিশেষ করে যদি ভারতীয় মুখ্যমন্ত্রীদের সত্যিই আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে হাজির করেন, তাহলে দেশ ও সংবিধানের প্রতি সব থেকে বড় তঞ্চকতা করবেন তিনিই। ভারতবাসী এখন সেদিকেই তাকিয়ে।

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

আনন্দবাজার পত্রিকার সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি; কলামিস্ট

কলকাতা; ১৪ জুন, ২০১৬