সেখানে এক ‘কেয়ামতের’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সেটি ছিল একটি নিষ্ঠুর ও অপরাধমূলক বর্বরতার ঘটনা। জাপানের নাগরিকরা আজও আমেরিকার সেই গণহত্যার কথা ভুলে যায়নি। তারা আজও সে অপরাধ ক্ষমা করে দেয়নি। সেই হিরোশিমায় কোনো আমেরিকান রাষ্ট্রপতির এটিই ছিল প্রথম পদার্পণ। সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিল যে বারাক ওবামা আমেরিকার পক্ষ থেকে সে ঘটনার জন্য ক্ষমা চান কিনা। হিরোশিমায় গিয়ে ওবামা তার বক্তৃতায় অনেক কথাবার্তা বললেও, ৭১ বছর আগে সংঘটিত এই মহাপাপের জন্য আমেরিকার পক্ষ থেকে ক্ষমা চাননি। হিরোশিমার কান্না থামানোর জন্য এটুকু পদক্ষেপও তিনি নেননি। কিন্তু বিশ্ববাসী হিরোশিমার কান্নার কথা ভুলে নাই ভুলবে না। কাঁদো হিরোশিমা কাঁদো!
আজ থেকে ৭১ বছর আগে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকার আণবিক বোমা নিক্ষেপ ছিল ইতিহাসের একটি অতীব ভয়ঙ্কর অপরাধের ঘটনা। ইতিহাসের এই ঘটনা ভুলে থাকাটা হবে মহাপাপ। মনে রাখতে হবে— ইতিহাসকে ভুলে গেলে ইতিহাস তার প্রতিশোধ নিতে ভুল করে না। সে দিনের সে ঘটনার কথা বার বার মনে করা উচিত। তাই তার কিছু কথা আবার লিখছি।
ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে একবারই সক্রিয়ভাবে আণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে সর্বশেষ দিনগুলোতে, ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট তারিখে, আমেরিকানরা পর পর দু-দু’টি আণবিক বোমা প্রথমে জাপানের হিরোশিমা শহরে ও পরে তিন দিনের ব্যবধানে অপর জাপানি শহর নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করেছিল। এই ঘটনা সম্পর্কে একটি গুরুতর প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো— এটি কী ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বশেষ অধ্যায়, না কি তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঠাণ্ডা যুদ্ধ সূচনার প্রথম পদক্ষেপ? প্রশ্ন হলো, নতুন এই মানব বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল কি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ বা সেই যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য আদৌ এর কোনো দরকার ছিল কি? এসব প্রশ্নের জবাবের জন্য প্রথমে সেই সময়ের ঘটনাবলির দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
১৯৪৫-এর আগস্টের কিছুদিন আগেই, জুলাইয়ের শেষ দিকেই, আমেরিকানরা টোকিও শহরের ওপর বিধ্বংসী বোমাবর্ষণ করেছিল। টোকিও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। জাপানের সামরিক শক্তি প্রায় সম্পূর্ণরূপে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। মে মাসে বার্লিন মুক্ত হওয়ার পর জার্মানির নািস বাহিনী পরাজয় মেনে নিয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল। মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট ইতালির বিলুপ্তি হয়েছিল। ইউরোপে যুদ্ধ শেষ! পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘রেড আর্মি’ ইউরোপে বিজয়ী হয়ে পশ্চিম রণাঙ্গন ত্যাগ করে দুর্জয় সমরনায়ক মার্শাল জুকভের নেতৃত্বে এশিয়ার যুদ্ধে যোগদানের জন্য রওনা হয়ে গিয়েছিল। জাপানের ভূ-খণ্ডে যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। জাপানের সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। জাপানের হাইকমান্ড আত্মসমর্পণের কথা ভাবতে শুরু করেছিল। ইউরোপের পর এবার এশিয়া যুদ্ধও শেষ হওয়ার একেবারে দ্বারপ্রান্তে। তার পরেও জাপানে এটম বোমা নিক্ষেপের কোনো প্রয়োজন ছিল কি?
এসব তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কিম্বা এশিয়ার যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার জন্য হিরোশিমা-নাগাসাকিতে এটম বোমা নিক্ষেপের কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। তা সত্ত্বেও এই বোমা তবে নিক্ষেপ করা হয়েছিল কেন? প্রকৃত সত্য হলো, এই বোমা নিক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা ছিল অন্যত্র। কী সে প্রয়োজনীয়তা, কী সে কারণ, যে কারণে নিমিষে ‘টেন টু দি পাওয়ার ফাইভ’ (অর্থাত্ ১ লাখ) মানুষের প্রাণ হরণ করার মতো মারণাস্ত্র সেদিন আমেরিকা ব্যবহার করেছিল?
আণবিক বোমা আবিষ্কারের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল। অবশ্য আগেই কিছুটা আঁচ করা গিয়েছিল যে জার্মানরা এ ধরনের বোমা নিয়ে গবেষণা করছে ও আমেরিকা তা তৈরির জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ১৯৪২ সালে আমেরিকা ‘ম্যানহ্যাটন প্রজেক্ট’ নামে এ বিষয়ে গবেষণা কাজ শুরু করেছিল। অত্যন্ত সংগোপনে কাজ এগিয়ে নিয়ে ১৯৪৫ সালের প্রথমার্ধে ‘থিন ম্যান’ নামে পরিশুদ্ধ প্লুটোনিয়াম দিয়ে তৈরি একটি আণবিক বোমা প্রস্তুত করতে ও তা পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। একই প্রযুক্তিতে তৈরি আরো বড় একটি বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’ নাগাসাকিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে, তার আগেই, কোনো পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ব্যতিরেকেই, পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি ভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ও ট্রিগারিং ব্যবস্থা সম্বলিত ‘লিটল বয়’ বোমাটি হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ব্যবহূত ট্রিগারিং প্রযুক্তি বিপদ সৃষ্টি করতে পারে জেনেও কোনো ধরনের পূর্ব পরীক্ষা ছাড়াই সেটিকেই ব্যবহার করা হয়েছিল। সমস্ত বিষয়ে তাড়াহুড়া ও ঝুঁকি নেয়ার একটি বিশেষ কারণ ছিল বেশ তাত্পর্যপূর্ণ।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট রাত ভোর হওয়ার আগেই ২টা ৪৫ মিনিটে মেরিয়ানার টিনিয়ান দ্বীপ থেকে ‘এনোলা গে’ নামের একটি বি-৫৯ বোমারু বিমান জাপান অভিমুখে রওনা দিয়েছিল। বিমানটির বিশেষভাবে নির্মিত বোমার খাঁচায় ছিল ‘লিটল বয়’ সাংকেতিক নামের ৯ ফুট লম্বা, ২ ফুট ব্যাসের ও ৯ হাজার পাউন্ড ওজনের একটি আণবিক বোমা। স্থানীয় সময় ৮টা ১৬ মিনিটে হিরোশিমার মাটি থেকে প্রায় ২ হাজার ফুট উপরে থাকা অবস্থায় বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। বোমাটি ছিল পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম-২৩৫ দ্বারা তৈরি। ইউরেনিয়ামের প্রধান একটি বড় খণ্ড থেকে কয়েক ফুট দূরে, বোমার অপর মাথায়, তার আরেকটি ছোট অংশ রাখা ছিল। ছোট অংশটিকে ট্রিগারের সাহায্যে বড় অংশে প্রবেশ করানো মাত্র ইউরেনিয়ামের ‘ক্রিটিক্যাল ম্যাস’ অতিক্রম করায় সেখানকার ১৪০ পাউন্ড ইউরেনিয়ামে পারমাণবিক ফিশন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই ইউরেনিয়ামের ০.০২১ আউন্স ম্যাস E=mc2 ফর্মুলা অনুসারে মুহূর্তের মধ্যে গতি, তাপ, আলো প্রভৃতি ধরনের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে অভাবনীয় এক বিস্ফোরণের জন্ম দিয়েছিল। বিস্ফোরণের শক্তি ছিল ১৫ হাজার টন টিএনটি-র সমান। বিশাল ব্যাঙের ছাতার মতো কুণ্ডলী হিরোশিমার আকাশকে ছেয়ে ফেলেছিল। মুহূর্তের মধ্যে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল শহরের ৯০ শতাংশ অঞ্চল। নিমিষেই মৃত্যু হয়েছিল ৭৫ হাজার মানুষের। পরবর্তী ৪ মাসের মধ্যে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল এক লাখ ৬৬ হাজার।
হিরোশিমায় বোমাবর্ষণের তিন দিনের মাথায় ‘বকস্কার’ নামের অপর একটি আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমান দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের কাইউসু দ্বীপের কোকুরা অভিমুখে উড়ে এসেছিল। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সে তার গতিপথ পরিবর্তন করে নাগাসাকি শহরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সে বহন করছিল ‘ফ্যাট ম্যান’ সাংকেতিক নামের আণবিক বোমা। এই বোমার ‘কোর’টিতে ছিল তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম। সেটির চতুর্দিকে ছিল তার দিয়ে সংযুক্ত শক্তিশালী বিস্ফোরক পদার্থ। এসব বিস্ফোরক একসাথে বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে ‘কোরের’ প্লুটোনিয়ামে পারমাণবিক ফিশন-এর চেইন রিএ্যাকশন শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং বৃহত্তর আণবিক বিস্ফোরণটি ঘটেছিল। সেই বিস্ফোরণের মাত্রা দাঁড়িয়েছিল ২২ হাজার টন টিএনটির বিস্ফোরণ-শক্তির সমান। লম্বায় ১২ ফুট ও ব্যাসে ৫ ফুট আয়তনের ‘ফ্যাট ম্যান’ বোমাটিকে স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ২ মিনিটে বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। ০.০৩৫ আউন্স প্লুটোনিয়াম ম্যাস বিভিন্ন ধরনের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। হিরোশিমার বোমার চেয়ে শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও নাগাসাকির ভৌগোলিক কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম ছিল। তবুও নিমিষে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৪০ হাজার। গুরুতর আহত হয়েছিল ৭৫ হাজার মানুষ।
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত শুধু এদু’টি বোমাতেই লক্ষাধিক মানুষ নিমিষে প্রাণ হারিয়েছিল। দেড় লক্ষাধিক মানুষ গুরুতর আহত হয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে তাদেরও মৃত্যু হয়েছিল। বোমার তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের ফলে অচিরেই দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। হিরোশিমা-নাগাসাকির বীভত্স ধ্বংসযজ্ঞের কথা বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পেরেছিল চার সপ্তাহ পরে। আমেরিকা অনেকদিন একথা গোপন রেখেছিল যে এটি একটি তেজস্ক্রিয় এটম বোমা ছিল। এভাবে আণবিক তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করার সুযোগ থেকেও মৃত্যুপথযাত্রীদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। শুধু এ কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বোমার আঘাত ছিল বীভত্স, কিন্তু তার চেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল আমেরিকান এহেন ‘নীরবতার’ ফলাফল।
অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিক উইলফ্রেড গ্রাহাম বুর্চেট এটম বোমা নিক্ষেপের এই ঘটনার চার সপ্তাহ পর ২ সেপ্টেম্বর টোকিও থেকে হিরোশিমা পৌঁছেছিলেন। পরে তিনি তার চোখে দেখা বিবরণ নিউজ ডিসপ্যাচ আকারে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। সেই ডিসপ্যাচে বুর্চেট লিখেছিলেন, ‘তিরিশতম দিনে হিরোশিমা থেকে যারা পালাতে পেরেছিলেন তারা মরতে শুরু করেছেন।… চিকিত্সকরাও কাজ করতে করতে মারা যাচ্ছেন। বিষাক্ত গ্যাসের ভয়। মুখোশ পরে আছেন সকলেই।’ তিনি আরো লিখেছিলেন, ‘হিরোশিমাকে বোমা বিধ্বস্ত শহর বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, দৈত্যাকৃতির একটি রোলার যেন শহরটিকে পিষে দিয়ে গেছে।… পঁচিশ বা তিরিশ বর্গমাইল জুড়ে একটিও অট্টালিকা দাঁড়িয়ে নেই।’ তার ডিসপ্যাচে বুর্চেট আরো লিখেছিলেন, ‘বোমায় অক্ষত থাকা মানুষগুলো দিন কয়েক পরে অসুস্থ বোধ করতে শুরু করে ও হাসপাতালে যেতে থাকে। চিকিত্সকরা তাদের শরীরে ভিটামিন-এ ইনজেকশন দেয়। দেখা গিয়েছিল যে, ইনজেকশনের জায়গায় মাংস পচতে শুরু করেছে। এমন মানুষদের একজনও বাঁচেনি’। ৫ সেপ্টেম্বর বুর্চেটের ডিসপ্যাচটি ‘ডেইলি এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এই সাহসী সাংবাদিক বুর্চেট নিজেই তেজস্ক্রিয় বিকিরণে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৩ সালে ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল। সে বছরই তার লেখা ‘শ্যাডো অফ হিরোশিমা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণের শেষ নেই। তাদের থেকে জানা যায় যে, টার্গেটের কেন্দ্রে তাপমাত্রা বেড়ে কয়েক হাজার সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছিল। মানব দেহসহ সবকিছু মুহূর্তে সম্পূর্ণ ‘নাই’ হয়ে গিয়েছিল। ভূ-পৃষ্ঠের পাথরে বা কংক্রিটে কেবল মানব-মানবীর দেহ অবয়বের একটি অস্পষ্ট ছায়াচিহ্ন থেকে গিয়েছিল। চোখ ধাঁধানো আলো ও মহাপ্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে গিয়েছিল। ছাই-ভস্মসহ সবকিছু উড়ে গিয়েছিল ঊর্ধ্বাকাশে —এটম বোমার বিস্ফোরণের সিম্বল, ব্যাঙের ছাতা আকৃতির ধোঁয়ার বিশাল কুণ্ডলীতে।
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকা দ্বারা সংঘটিত এই কুকীর্তির বোঝা সত্তর বছর পরে আজও বয়ে চলেছে সেখানকার সন্তান-সন্ততিরা। প্রতিটি মাকে ভয়ে ভয়ে দিন গুনতে হয়, যে সন্তানটি তার ভূমিষ্ঠ হবে সে বিকৃত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবয়ব নিয়ে জন্মাবে না তো!
জাপানকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকা আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেনি। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকার এটম বোমা নিক্ষেপের পেছনে একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, ইয়ালটা চুক্তি অনুসারে ইউরোপে যুদ্ধ শেষের পর সোভিয়েত রেড আর্মি যেন এশিয়ার যুদ্ধে প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। রেড আর্মি জাপানে বড় রকম অপারেশন শুরু করার আগেই আমেরিকার কাছে একতরফা জাপানি আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে উঠেছিল। এশিয়াকে কমিউনিজমের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসের অংশ হিসেবেই আমেরিকা জরুরি ভিত্তিতে এটম বোমা নিক্ষেপ করেছিল। কমিউনিজম বিরোধী ক্রুসেডের স্বার্থে লাখ লাখ নিরপরাধ জাপানি বেসামরিক নাগরিককে নিমিষে বলি দিতে মার্কিনিরা কুণ্ঠিত হয়নি।
তাড়াহুড়া করে আমেরিকা তার নব উদ্ভাবিত আণবিক বোমা ব্যবহার করেছিল অপর যে গুরুত্বপূর্ণ কারণে, তা ছিল রাজনৈতিক। এটম বোমার মনোপলি তার হাতে থাকায় সেটিকে কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত (ও বিশ্বের অন্যান্য সব দেশকে) ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশ্যটি ছিল আমেরিকার প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু সে পরিকল্পনা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। অচিরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো শক্তিশালী আণবিক ও পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছিল এবং আমেরিকার আণবিক একাধিপত্য ভেঙে দিয়েছিল।
কিন্তু মানব ইতিহাসের যা ক্ষতি হওয়ার তা ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে পৃথিবীতে আত্মঘাতী পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীতে এখন যে পরিমাণ পারমাণবিক বোমা আছে তা বিস্ফোরিত হলে এই ভূ-মণ্ডল ১৪ বার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। সব পক্ষের হাতে এই মারণাস্ত্র থাকায় এবং বেশি বেশি করে থাকায় কেউ এটি ব্যবহার করতে সাহসী হবে না— এই ডেটারেন্ট (অর্থাত্ অপরকে নিবৃত্ত রাখা) তত্ত্বকে আণবিক ও পারমাণবিক অস্ত্র মজুদের যৌক্তিকতা হিসেবে উপস্থিত করার চেষ্টা হয়। কিন্তু আসলে তা হলো আগুন নিয়ে মরণ খেলা। এই তত্ত্বকে MAD (Mutually Assured Destruction) বলাটিই যথাযথ। পৃথিবী আজ আগ্নেয়গিরির মুখে রয়েছে। সব আণবিক বোমা ধ্বংস করে ফেলাসহ পরিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ, তথা অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ভূ-মণ্ডল ও বিশ্ব সভ্যতাকে বিপদমুক্ত করা যাবে না। বিশ্ববাসীকে গর্জে উঠে বলতে হবে, হিরোশিমা-নাগাসাকির ট্র্যাজেডি আর না! কিন্তু মার্কিনিরা তাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে রাজি না। তাই, প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্ষমাটুকুও চাইলেন না।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
E-mail : selimcpb@yahoo.com