জিয়াম রাষ্ট্র না থাকলে কঙ্গো বলে কোনো অস্তিত্বই গড়ে উঠত না। এই প্রচারণার শুরু উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। এই ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত বেলজিয়ামের তৎকালীন রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের সুচারু বুদ্ধি ও ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে রফা
করতে পারার সক্ষমতা আর কঙ্গোর মানুষের সরলতা। কঙ্গো নামে পরিচিত মধ্য আফ্রিকার দেশটির উপনিবেশে পরিণত হওয়ার ইতিহাস বাংলার ইতিহাসকেও যেন ছাড়িয়ে যায়। আঠারো শতকের মাঝামাঝি বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়েছিল একটি কোম্পানির হাতে।
কঙ্গোর ইতিহাস আরও করুণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে এই দেশটি অন্য কোনো দেশ এমনকি বাংলার মতো কোনো একটি কোম্পানি নয়; বরং একজন মাত্র ব্যক্তি বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৮৭৬ সালের দিক থেকে কঙ্গো বেসিন অঞ্চলটিকে হস্তগত করার কুশলী উদ্যোগ শুরু করেন তিনি। এক দশকের কম সময়ের ব্যবধানে, ১৮৮৫ সালে ইউরোপের অন্য শক্তিগুলোর সঙ্গে রফার ভিত্তিতে কঙ্গো বেসিন লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত উপনিবেশে পরিণত হয়। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে এই ভূখণ্ডের নামকরণ করা হয় কঙ্গো ফ্রি স্টেট! পরবর্তী দুই দশকে ফ্রি স্টেট কর্তৃপক্ষের নিপীড়ন-নির্যাতন ও লুটপাট চরমে পৌঁছে যায়। এ অবস্থায় উপনিবেশ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে ১৯০৮ সালে বেলজিয়াম সরাসরি দেশটির নিয়ন্ত্রণভার হাতে নেয়। এবার কঙ্গোর নাম হয় বেলিজিয়ান কঙ্গো! বেলিজিয়ামের রাজার জায়গায় বেলজিয়াম রাষ্ট্র এসে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ধরনগুলোকে আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে।
তখন ১৯২৫ সাল। উপনিবেশের সূর্য মধ্য গগনে। শাসন-শোষণের সুচারু ব্যবস্থাপনা আর তথাকথিত ‘হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’-এর নামে অশ্বেতাঙ্গদের ওপরে শ্বেতাঙ্গদের শাসনের বৈধতার প্রচারণার জোয়ারে কঙ্গো তখন নিস্তেজ, প্রতিরোধহীন। এমনি এক বন্ধ্যা সময়ে স্বাধীন কঙ্গো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিস লুমুম্বার জন্ম দেশের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ কাসাইয়ের সানকুরা অঞ্চলের ওনালুয়া গ্রামে। উপনিবেশের আশাহীন বাস্তবতায় জন্ম নেওয়া লুমুম্বাকে শিক্ষক বানানোর স্বপ্ন দেখেন কৃষক পিতা। কিশোর লুমুম্বাকে পাঠানো হয় একটি মিশনারি স্কুলে। নামে স্কুল, আসলে কালো মানুষদের কায়িক শ্রম প্রশিক্ষণকেন্দ্র। তবে লুমুম্বার পড়ার দারুণ আগ্রহ দেখে শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে বই ধার দিতেন স্কুলে বসে সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত পড়ার জন্য। রাতে পড়ার জন্য বই বাড়ি নেওয়ার প্রশ্ন আসে না; কারণ সন্ধ্যা হলে বাড়িতে আলো জ্বালানোর সামর্থ্য লুমুম্বাদের ছিল না।
কিশোর লুমুম্বা গ্রামের পুরোনো আমলের লোকদের কাছে শোনেন লিওপোল্ডের আমলের নিষ্ঠুরতার কাহিনি। মালিকের জন্য ঠিকঠাকমতো রাবার আর হাতির দাঁত সংগ্রহ করতে না পারলে কেটে নেওয়া হতো হাত। কে কার হাত কাটে? সাদা বেলজিয়াম কালো কঙ্গোর হাত কাটে। এ সময় থেকেই লুমুম্বা বুঝি বুঝতে শুরু করেন কীভাবে নিজেরই দেশে নিজেরই ‘দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায় ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়’। বেড়ে উঠতে উঠতে আপন মনে পড়তে পড়তে ফরাসি চিন্তাবিদদের ভালোবাসতে শুরু করেন লুমুম্বা। ভলতেয়ার, রুশো, ভিক্টর হুগো ও মলিয়ের ভর করে তাঁকে। লুমুম্বা বুঝতে শুরু করেন গ্রামের প্রাচীনদের মুখে শোনা রক্ত ঝরার ইতিহাস আসলে ইতিহাস হয়ে থেমে থাকেনি। তরুণ লুমুম্বা বুঝে যান, লিওপোল্ডের কঙ্গো ফ্রি স্টেটের সঙ্গে বেলিজিয়ান কঙ্গোর কোনো ভেদ নেই।
লুমুম্বার শিক্ষাজীবন আঠারোতেই শেষ হয়ে যায়। অতঃপর এ শহর-সে শহরে ছোট ছোট চাকরি। ১৯৪৪ সালে এসে ঠাঁই নেন স্ট্যানলিভিল শহরে। বিরাট শহর। বড় বড় বাড়ি, বড় বড় গাড়ি, শানবাঁধানো ফুটপাত, সুইমিংপুল, ফুলেল পার্ক, রং বাহারি পোশাক। লুমুম্বা দেখেন এসবের কোনো কিছু কঙ্গোবাসী তথা আফ্রিকান তথা কালো মানুষদের জন্য নয়। তারা বাসের পেছন সিটে বসে; তারা সাহেব এলাকার বাইরে থাকে। রেস্টুরেন্ট, থিয়েটারসহ হরেক মজা সব সাদা সাহেবদের জন্য। স্ট্যানলিভিল লুমুম্বাকে ভবিষ্যতের লুমুম্বা বানাতে থাকে।
মৃত্যুর এক বছর আগে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর লুমুম্বা, হাতে শেকলের ক্ষত, জানুয়ারি ১৯৬০সময়টাও লক্ষ করার মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষাশেষি। জার্মানির ভয়ে লন্ডন শহরে আস্তানা গাড়া বেলজিয়ামের প্রবাসী সরকারের পুরো খরচ বহন করতে হচ্ছে কঙ্গোকে। দশকের পর দশক ধরে বেলজিয়ামের হাতে লুণ্ঠিত কঙ্গোর জেগে ওঠার সময় এটা। আসলে এটা গোটা আফ্রিকার জেগে ওঠার সময়। ঔপনিবেশিক শাসকেরাও যেন দেয়ালের লিখন পড়তে শুরু করেছে। লুমুম্বার সঙ্গে কঙ্গোর বুদ্ধিজীবী আর উদারপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গে জানাশোনার শুরু এ সময় থেকেই। ১৯৪৭ সাল নাগাদ লুমুম্বাকে শ্রমিক ইউনিয়ন আর নানান বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায়। আফ্রিকাতে বর্ণ-সম্পর্ক উন্নত করার প্রয়াসেও শামিল হন লুমুম্বা। ১৯৫০-এর দশকের শুরুতেই ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী উদারপন্থী পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। এ সময় তাঁর কলমে আরও আসে কবিতা, কঙ্গো আর কালো মানুষের জন্য কবিতা।
১৯৫৫ সাল লুমুম্বার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। এই বছর বেলজিয়ামের রাজা বদোয়াঁ কঙ্গো সফর করেন। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে রাজার কথা শুনতে পারার সুযোগ পাওয়া হাতে গোনা মাত্র কয়জন কঙ্গোবাসীর একজন হতে পারেন লুমুম্বা। রাজ দর্শনকালে রাজার সঙ্গে সামান্য কথাবার্তা হয় তাঁর। এই কথাবার্তার ধারাবাহিকতায় কঙ্গোর ভবিষ্যৎ নিয়েও লুমুম্বার সঙ্গে মতবিনিময় হয় বদোয়াঁর। এই ঘটনা লুমুম্বাকে জাতীয় পরিচিত দেয়। অন্যদিক এই ঘটনায় ঔপনিবেশিক প্রশাসনের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি। সহকর্মীর টাকা চুরির মিথ্যা অভিযোগ এনে ১১ মাস জেল খাটানো হয় তাঁকে। এই ঘটনা লুমুম্বাকে কিছুদিনের জন্য মানসিকভাবে খানিকটা দমিয়ে দিলেও লুমুম্বার ভেতরের আসল লুমুম্বাকে নিঃশেষ করতে পারেনি। আর সে কারণেই দেখা যায়, সারা বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসনাবসান ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের ধ্বনিকে কঙ্গোতে প্রতিধ্বনিত করায় লুমুম্বা থাকেন সবার সামনে।
১৯৫৭ সালের মার্চের শুরুতে আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে ঘানা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়। ঘানার স্বাধীনতার হিল্লোল পুরো আফ্রিকাতে বয়ে যায়। স্বাধীনতা সম্ভব—এই বোধের জাগরণের চাপে পড়ে মহাদেশের প্রধান দুই ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো বেলজিয়াম কর্তৃপক্ষও কঙ্গোর জন্য কিছু রাজনৈতিক ছাড়ে বাধ্য হয়। এ সময় কঙ্গোতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। লুমুম্বার নেতৃত্বে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে গঠিত হয় দ্য ন্যাশনাল কঙ্গোলিজ মুভমেন্ট (এমএনসি)। সংগঠনের কাজে সারা দেশে ঘুরতে শুরু করেন লুমুন্বা। জনগণের মনের কথা পড়তে পারার সক্ষমতায় অনতিবিলম্বে লুমুম্বার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় অমোঘ সেই শব্দ, স্বাধীনতা। কোনো দ্বিধা নয়, কোনো আপস নয়, ভয় নয়, পিছুটান নয়—কঙ্গোর জন্য তিনি চাইলেন স্বাধীনতা। লুমুম্বা বললেন, ‘কঙ্গো আমাদের দেশ। আমাদের দেশে অবশ্যই আমরাই হব আমাদের প্রভু। তাই আসুন, আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করা যাক। আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই আর স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে যাই।’
লুমুম্বার এমএনসির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে অনুমেয়ভাবেই জেল-জুলুম আর অর্থের জোয়ারে আন্দোলন নষ্ট করে দেওয়ার রাস্তায় নামে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তত দিনে লুমুম্বার ডাক কঙ্গোবাসীর অন্তর স্পর্শ করেছে। উত্তাল পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির প্রয়োগ জোরদার করে শাসকেরা। কিন্তু তেমন কাজ হয় না। কিছু কিছু সংস্কার প্রস্তাব করেও পরিস্থিতি অনুকূলে নিতে ব্যর্থ হয় শাসকেরা। ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে ঘানার আক্রাতে অনুষ্ঠিত প্যান-প্যাসিফিক পিপলস কনফারেন্সে যোগ দিয়ে কেবল কঙ্গো নয়, গোটা আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসনমুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন লুমুম্বা। ১৯৫৯ সালজুড়ে সব রাজনৈতিক দলকে মতৈক্যে আনতে সর্বশক্তি ব্যয় করেন তিনি। কিন্তু ১৯৬০-এর মে মাসে জাতীয় নির্বাচন লুমুম্বার প্রচেষ্টার পক্ষে কথা বলেনি। ১৩৭ আসনের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে লুমুম্বার এমএনসি মাত্র ৩৩ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কঙ্গোর আরেক জাতীয়তাবাদী নেতা জোসেফ কাসাভুবুর আবাকো দল পায় ১৩টি আসন। বিদ্যমান বাস্তবতায় নিরুপায় লুমুম্বা কাসাভুবুকে প্রেসিডেন্ট পদ দিয়ে নিজে হলেন কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এই নাজুক ধারাবাহিকতাতেই জুনে স্বাধীন হয় কঙ্গো।
কঙ্গো হাতছাড়া হয়ে গেলেও কঙ্গোতে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাখতে সক্ষম হয় এত দিনের প্রভুরা। কঙ্গোজুড়ে অরাজকতা ছড়িয়ে দেওয়ায় কাজে লাগানো হয় অনুগত রাজনীতিক ও সেনাবাহিনীকে। অল্প কিছু দিন যেতে না যেতেই খনিজসমৃদ্ধ কাতাঙ্গানা প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাতাঙ্গানা ফিরিয়ে আনতে আমেরিকার পরামর্শে লুমুম্বা জাতিসংঘ বাহিনীকে ডেকে আনেন, কিন্তু তাদের কাজে নামাতে ব্যর্থ হন। এই পরিস্থিতিতে কঙ্গোর সহায়তায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে এলে লুমুম্বার ভবিষ্যৎ এঁকে ফেলে সাম্রাজ্যবাদীরা। বিষয়টি তখন আর কঙ্গো বনাম বেলজিয়ামে সীমাবদ্ধ থাকে না। মধ্য আফ্রিকার এই দেশে লুমুম্বার মধ্যে দিয়ে ‘কমিউনিজমের ভূত’ দেখতে শুরু করে আমেরিকা। লুমুম্বাকে ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত তখনই হয়ে যায়।
এই প্রচারণার বিপদ বুঝতে সময় লাগেনি লুমুম্বার। সে সময় ফরাসি দৈনিক ফ্রাঁস-সোয়্যাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। ঔপনিবেশিক শাসকেরা সারা দেশে আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে, কারণ আমি একজন বিপ্লবী। আমাদের মানব মর্যাদাকে তাচ্ছিল্য করা ঔপনিবেশিক শাসনের আমি অবসান দাবি করি। তারা আমাকে কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে, কারণ আমি সাম্রাজ্যবাদীদের ঘুষ প্রত্যাখ্যান করি।’
১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লুমুম্বা ও কাসাভুবুকে পদচ্যুত করা হয়। ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হন লুমুম্বা। জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয় কঙ্গোর স্বাধীনতার স্থপতি লুমুম্বাকে। এরপর কঙ্গো চলে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে।
মাত্র ৩৫ বছরের একটি জীবন পেয়েছিলেন প্যাট্রিস লুমুম্বা। ক্ষণস্থায়ী সে জীবন উৎসর্গিত হয়েছিল জন্মভূমির স্বাধীনতার লড়াইয়ে। নিজের জীবন দিয়ে ছিন্ন করে দিয়েছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল। আজও তাই সারা দুনিয়ায় মুক্তিকামী মানুষেরা লুমুম্বাকে স্মরণ করে সশ্রদ্ধ চিত্তে, প্রেরণা নেয় লুমুম্বার জীবন থেকে।
শান্তনু মজুমদার: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
করতে পারার সক্ষমতা আর কঙ্গোর মানুষের সরলতা। কঙ্গো নামে পরিচিত মধ্য আফ্রিকার দেশটির উপনিবেশে পরিণত হওয়ার ইতিহাস বাংলার ইতিহাসকেও যেন ছাড়িয়ে যায়। আঠারো শতকের মাঝামাঝি বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়েছিল একটি কোম্পানির হাতে।
কঙ্গোর ইতিহাস আরও করুণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে এই দেশটি অন্য কোনো দেশ এমনকি বাংলার মতো কোনো একটি কোম্পানি নয়; বরং একজন মাত্র ব্যক্তি বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৮৭৬ সালের দিক থেকে কঙ্গো বেসিন অঞ্চলটিকে হস্তগত করার কুশলী উদ্যোগ শুরু করেন তিনি। এক দশকের কম সময়ের ব্যবধানে, ১৮৮৫ সালে ইউরোপের অন্য শক্তিগুলোর সঙ্গে রফার ভিত্তিতে কঙ্গো বেসিন লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত উপনিবেশে পরিণত হয়। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে এই ভূখণ্ডের নামকরণ করা হয় কঙ্গো ফ্রি স্টেট! পরবর্তী দুই দশকে ফ্রি স্টেট কর্তৃপক্ষের নিপীড়ন-নির্যাতন ও লুটপাট চরমে পৌঁছে যায়। এ অবস্থায় উপনিবেশ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে ১৯০৮ সালে বেলজিয়াম সরাসরি দেশটির নিয়ন্ত্রণভার হাতে নেয়। এবার কঙ্গোর নাম হয় বেলিজিয়ান কঙ্গো! বেলিজিয়ামের রাজার জায়গায় বেলজিয়াম রাষ্ট্র এসে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ধরনগুলোকে আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে।
তখন ১৯২৫ সাল। উপনিবেশের সূর্য মধ্য গগনে। শাসন-শোষণের সুচারু ব্যবস্থাপনা আর তথাকথিত ‘হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’-এর নামে অশ্বেতাঙ্গদের ওপরে শ্বেতাঙ্গদের শাসনের বৈধতার প্রচারণার জোয়ারে কঙ্গো তখন নিস্তেজ, প্রতিরোধহীন। এমনি এক বন্ধ্যা সময়ে স্বাধীন কঙ্গো রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিস লুমুম্বার জন্ম দেশের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ কাসাইয়ের সানকুরা অঞ্চলের ওনালুয়া গ্রামে। উপনিবেশের আশাহীন বাস্তবতায় জন্ম নেওয়া লুমুম্বাকে শিক্ষক বানানোর স্বপ্ন দেখেন কৃষক পিতা। কিশোর লুমুম্বাকে পাঠানো হয় একটি মিশনারি স্কুলে। নামে স্কুল, আসলে কালো মানুষদের কায়িক শ্রম প্রশিক্ষণকেন্দ্র। তবে লুমুম্বার পড়ার দারুণ আগ্রহ দেখে শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে বই ধার দিতেন স্কুলে বসে সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত পড়ার জন্য। রাতে পড়ার জন্য বই বাড়ি নেওয়ার প্রশ্ন আসে না; কারণ সন্ধ্যা হলে বাড়িতে আলো জ্বালানোর সামর্থ্য লুমুম্বাদের ছিল না।
কিশোর লুমুম্বা গ্রামের পুরোনো আমলের লোকদের কাছে শোনেন লিওপোল্ডের আমলের নিষ্ঠুরতার কাহিনি। মালিকের জন্য ঠিকঠাকমতো রাবার আর হাতির দাঁত সংগ্রহ করতে না পারলে কেটে নেওয়া হতো হাত। কে কার হাত কাটে? সাদা বেলজিয়াম কালো কঙ্গোর হাত কাটে। এ সময় থেকেই লুমুম্বা বুঝি বুঝতে শুরু করেন কীভাবে নিজেরই দেশে নিজেরই ‘দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায় ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়’। বেড়ে উঠতে উঠতে আপন মনে পড়তে পড়তে ফরাসি চিন্তাবিদদের ভালোবাসতে শুরু করেন লুমুম্বা। ভলতেয়ার, রুশো, ভিক্টর হুগো ও মলিয়ের ভর করে তাঁকে। লুমুম্বা বুঝতে শুরু করেন গ্রামের প্রাচীনদের মুখে শোনা রক্ত ঝরার ইতিহাস আসলে ইতিহাস হয়ে থেমে থাকেনি। তরুণ লুমুম্বা বুঝে যান, লিওপোল্ডের কঙ্গো ফ্রি স্টেটের সঙ্গে বেলিজিয়ান কঙ্গোর কোনো ভেদ নেই।
লুমুম্বার শিক্ষাজীবন আঠারোতেই শেষ হয়ে যায়। অতঃপর এ শহর-সে শহরে ছোট ছোট চাকরি। ১৯৪৪ সালে এসে ঠাঁই নেন স্ট্যানলিভিল শহরে। বিরাট শহর। বড় বড় বাড়ি, বড় বড় গাড়ি, শানবাঁধানো ফুটপাত, সুইমিংপুল, ফুলেল পার্ক, রং বাহারি পোশাক। লুমুম্বা দেখেন এসবের কোনো কিছু কঙ্গোবাসী তথা আফ্রিকান তথা কালো মানুষদের জন্য নয়। তারা বাসের পেছন সিটে বসে; তারা সাহেব এলাকার বাইরে থাকে। রেস্টুরেন্ট, থিয়েটারসহ হরেক মজা সব সাদা সাহেবদের জন্য। স্ট্যানলিভিল লুমুম্বাকে ভবিষ্যতের লুমুম্বা বানাতে থাকে।
মৃত্যুর এক বছর আগে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর লুমুম্বা, হাতে শেকলের ক্ষত, জানুয়ারি ১৯৬০সময়টাও লক্ষ করার মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষাশেষি। জার্মানির ভয়ে লন্ডন শহরে আস্তানা গাড়া বেলজিয়ামের প্রবাসী সরকারের পুরো খরচ বহন করতে হচ্ছে কঙ্গোকে। দশকের পর দশক ধরে বেলজিয়ামের হাতে লুণ্ঠিত কঙ্গোর জেগে ওঠার সময় এটা। আসলে এটা গোটা আফ্রিকার জেগে ওঠার সময়। ঔপনিবেশিক শাসকেরাও যেন দেয়ালের লিখন পড়তে শুরু করেছে। লুমুম্বার সঙ্গে কঙ্গোর বুদ্ধিজীবী আর উদারপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গে জানাশোনার শুরু এ সময় থেকেই। ১৯৪৭ সাল নাগাদ লুমুম্বাকে শ্রমিক ইউনিয়ন আর নানান বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায়। আফ্রিকাতে বর্ণ-সম্পর্ক উন্নত করার প্রয়াসেও শামিল হন লুমুম্বা। ১৯৫০-এর দশকের শুরুতেই ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী উদারপন্থী পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। এ সময় তাঁর কলমে আরও আসে কবিতা, কঙ্গো আর কালো মানুষের জন্য কবিতা।
১৯৫৫ সাল লুমুম্বার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। এই বছর বেলজিয়ামের রাজা বদোয়াঁ কঙ্গো সফর করেন। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে রাজার কথা শুনতে পারার সুযোগ পাওয়া হাতে গোনা মাত্র কয়জন কঙ্গোবাসীর একজন হতে পারেন লুমুম্বা। রাজ দর্শনকালে রাজার সঙ্গে সামান্য কথাবার্তা হয় তাঁর। এই কথাবার্তার ধারাবাহিকতায় কঙ্গোর ভবিষ্যৎ নিয়েও লুমুম্বার সঙ্গে মতবিনিময় হয় বদোয়াঁর। এই ঘটনা লুমুম্বাকে জাতীয় পরিচিত দেয়। অন্যদিক এই ঘটনায় ঔপনিবেশিক প্রশাসনের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি। সহকর্মীর টাকা চুরির মিথ্যা অভিযোগ এনে ১১ মাস জেল খাটানো হয় তাঁকে। এই ঘটনা লুমুম্বাকে কিছুদিনের জন্য মানসিকভাবে খানিকটা দমিয়ে দিলেও লুমুম্বার ভেতরের আসল লুমুম্বাকে নিঃশেষ করতে পারেনি। আর সে কারণেই দেখা যায়, সারা বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসনাবসান ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের ধ্বনিকে কঙ্গোতে প্রতিধ্বনিত করায় লুমুম্বা থাকেন সবার সামনে।
১৯৫৭ সালের মার্চের শুরুতে আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে ঘানা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়। ঘানার স্বাধীনতার হিল্লোল পুরো আফ্রিকাতে বয়ে যায়। স্বাধীনতা সম্ভব—এই বোধের জাগরণের চাপে পড়ে মহাদেশের প্রধান দুই ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো বেলজিয়াম কর্তৃপক্ষও কঙ্গোর জন্য কিছু রাজনৈতিক ছাড়ে বাধ্য হয়। এ সময় কঙ্গোতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। লুমুম্বার নেতৃত্বে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে গঠিত হয় দ্য ন্যাশনাল কঙ্গোলিজ মুভমেন্ট (এমএনসি)। সংগঠনের কাজে সারা দেশে ঘুরতে শুরু করেন লুমুন্বা। জনগণের মনের কথা পড়তে পারার সক্ষমতায় অনতিবিলম্বে লুমুম্বার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় অমোঘ সেই শব্দ, স্বাধীনতা। কোনো দ্বিধা নয়, কোনো আপস নয়, ভয় নয়, পিছুটান নয়—কঙ্গোর জন্য তিনি চাইলেন স্বাধীনতা। লুমুম্বা বললেন, ‘কঙ্গো আমাদের দেশ। আমাদের দেশে অবশ্যই আমরাই হব আমাদের প্রভু। তাই আসুন, আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করা যাক। আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই আর স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে যাই।’
লুমুম্বার এমএনসির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে অনুমেয়ভাবেই জেল-জুলুম আর অর্থের জোয়ারে আন্দোলন নষ্ট করে দেওয়ার রাস্তায় নামে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তত দিনে লুমুম্বার ডাক কঙ্গোবাসীর অন্তর স্পর্শ করেছে। উত্তাল পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির প্রয়োগ জোরদার করে শাসকেরা। কিন্তু তেমন কাজ হয় না। কিছু কিছু সংস্কার প্রস্তাব করেও পরিস্থিতি অনুকূলে নিতে ব্যর্থ হয় শাসকেরা। ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে ঘানার আক্রাতে অনুষ্ঠিত প্যান-প্যাসিফিক পিপলস কনফারেন্সে যোগ দিয়ে কেবল কঙ্গো নয়, গোটা আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসনমুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন লুমুম্বা। ১৯৫৯ সালজুড়ে সব রাজনৈতিক দলকে মতৈক্যে আনতে সর্বশক্তি ব্যয় করেন তিনি। কিন্তু ১৯৬০-এর মে মাসে জাতীয় নির্বাচন লুমুম্বার প্রচেষ্টার পক্ষে কথা বলেনি। ১৩৭ আসনের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে লুমুম্বার এমএনসি মাত্র ৩৩ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কঙ্গোর আরেক জাতীয়তাবাদী নেতা জোসেফ কাসাভুবুর আবাকো দল পায় ১৩টি আসন। বিদ্যমান বাস্তবতায় নিরুপায় লুমুম্বা কাসাভুবুকে প্রেসিডেন্ট পদ দিয়ে নিজে হলেন কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এই নাজুক ধারাবাহিকতাতেই জুনে স্বাধীন হয় কঙ্গো।
কঙ্গো হাতছাড়া হয়ে গেলেও কঙ্গোতে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাখতে সক্ষম হয় এত দিনের প্রভুরা। কঙ্গোজুড়ে অরাজকতা ছড়িয়ে দেওয়ায় কাজে লাগানো হয় অনুগত রাজনীতিক ও সেনাবাহিনীকে। অল্প কিছু দিন যেতে না যেতেই খনিজসমৃদ্ধ কাতাঙ্গানা প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাতাঙ্গানা ফিরিয়ে আনতে আমেরিকার পরামর্শে লুমুম্বা জাতিসংঘ বাহিনীকে ডেকে আনেন, কিন্তু তাদের কাজে নামাতে ব্যর্থ হন। এই পরিস্থিতিতে কঙ্গোর সহায়তায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে এলে লুমুম্বার ভবিষ্যৎ এঁকে ফেলে সাম্রাজ্যবাদীরা। বিষয়টি তখন আর কঙ্গো বনাম বেলজিয়ামে সীমাবদ্ধ থাকে না। মধ্য আফ্রিকার এই দেশে লুমুম্বার মধ্যে দিয়ে ‘কমিউনিজমের ভূত’ দেখতে শুরু করে আমেরিকা। লুমুম্বাকে ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত তখনই হয়ে যায়।
এই প্রচারণার বিপদ বুঝতে সময় লাগেনি লুমুম্বার। সে সময় ফরাসি দৈনিক ফ্রাঁস-সোয়্যাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। ঔপনিবেশিক শাসকেরা সারা দেশে আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে, কারণ আমি একজন বিপ্লবী। আমাদের মানব মর্যাদাকে তাচ্ছিল্য করা ঔপনিবেশিক শাসনের আমি অবসান দাবি করি। তারা আমাকে কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে, কারণ আমি সাম্রাজ্যবাদীদের ঘুষ প্রত্যাখ্যান করি।’
১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লুমুম্বা ও কাসাভুবুকে পদচ্যুত করা হয়। ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার হন লুমুম্বা। জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয় কঙ্গোর স্বাধীনতার স্থপতি লুমুম্বাকে। এরপর কঙ্গো চলে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে।
মাত্র ৩৫ বছরের একটি জীবন পেয়েছিলেন প্যাট্রিস লুমুম্বা। ক্ষণস্থায়ী সে জীবন উৎসর্গিত হয়েছিল জন্মভূমির স্বাধীনতার লড়াইয়ে। নিজের জীবন দিয়ে ছিন্ন করে দিয়েছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল। আজও তাই সারা দুনিয়ায় মুক্তিকামী মানুষেরা লুমুম্বাকে স্মরণ করে সশ্রদ্ধ চিত্তে, প্রেরণা নেয় লুমুম্বার জীবন থেকে।
শান্তনু মজুমদার: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়