মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

রফিক আজাদ: `বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে’

ষাটের দশকে যে কজন কবি নিজেদের নিজস্বতা দিয়ে বাংলা কবিতাকে আরও বিস্তৃত করে বললে কবি বা সাহিত্যিকদের চিরাচরিত ধ্যান ধারনাকে পালটে দিতে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন রফিক আজাদ তাঁদের অন্যতম প্রধান। সেই অর্থে রফিক ভাই খুবই বেপরোয়া ধরণের মানুষ ছিলেন। প্রথম দেখায় যে কেউই এই অঞ্চলের মানুষ হিসেবে মানবেন না। তাঁকে দেখে
আলাদা করে ফেলা যায় অতি দ্রুত। এর ওপর গলায় আবার একটা একান্ত নিজস্ব কণ্ঠস্বর। ওই কণ্ঠস্বর ছাড়া তাঁকে মানাতও না। চিকন স্বরে কথা বলেন। কাউকে গোনা গুণতির মধ্যেও আনতেন না। ষাটের দশকের উন্মাতাল কবি।

দেখতে কেমন ছিলেন কবি রফিক আজাদ?

অসম্ভব সুপুরুষ কি ছিলেন!

বাংলাদেশে কোন কবিকে নিয়ে কি কখনো কোন পত্রিকা কভার স্টোরি করেছিল?
শক্তিমান গল্পকার ইমদাদুল হক মিলন কবি রফিক আজাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন ,‘একটু দূরে কোণের দিককার টেবিলে বসে আছেন রফিক আজাদ৷ আমি তাকে চেহারায় চিনি৷ কুস্তিগিরদের মতো চেহারা৷ বেঁটে, তাগড়া জোয়ান৷ হাতকাটা গেঞ্জি পরেন, গলায় চেন, হাতে বালা৷ নাকের তলায় ইয়া গোঁফ, হাতে সারাক্ষণই সিগ্রেট৷ ঢাকার রাস্তায় ড্রাগ খেয়ে মোটরসাইকেল চালান৷ ‘বিচিত্রা’ তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল৷’

সদ্য স্বাধীন দেশে শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে কবি রফিক আজাদ তাঁর কবিতা দিয়ে, তারুণ্য দিয়ে, উন্মাদনা দিয়ে, টগবগে ক্রেজ দিয়ে সত্যি সত্যি জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। রফিক আজাদ মানে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনার বাইরে কিছু একটা।

নিজের সময়ের কথা বলতে গিয়ে কবি রফিক আজাদ সাহসের সঙ্গে সেই সময়ের কথা বলেছেন অকপটে। শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন কে নিয়ে ‘মিলনকে নিয়ে দুচার কথা’ এক লেখায় তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আমাদের পাঠকদের মধ্যে ঐ সময়ে শিল্পী সাহিত্যিকদের সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল তাদের পরনে থাকবে পাঞ্জাবি, ঢিলেঢালা পাজামা, পাজামাটা ঝাড়ুর কাজও করবে, পাঞ্জাবির নিচের দিকে অনেক ময়লা থাকবে, তারপর একটু রোগাটে –লম্বাটে, একটু উসকো খুসকো, একটু উদাসীন, কাঁধে আবার ঝোলা, হাতে বেলি ফুলের মালা-টালা হলে আরও ভাল- এই রকম আর কি। ষাটের দিকে আমি অধিকাংশ বাংলা ছাত্রছাত্রীকে দেখতাম ঐরকম। আমরাই প্রথম স্কিন টাইট জিন্স পড়া শুরু করি। বাংলা পড়লেই যে পোশাকে-আশাকে, আচার আচরণে অরকম হতে হতে হবে, ‘সখি আমায় ধরো গো, ধরো গো’ বলে শান্তিনিকেতনি হতে হবে, মেয়েলি স্বভাবের হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। শিল্পী তার লেখার সময় শিল্পি। অন্য সময় সে মানুষ। জীবনবাদী মানুষ। জীবনের সব কিছু সে উপভোগ করবে। তো সেই প্রচলিত ধারাকে আমরা একটু পালটে দিতে পেরেছিলাম। পরে এর সঙ্গে এসে যোগ দিল মিলন। তাতে করে বেশ জমেছিল। একবার যশোর প্রেসক্লাবে ঢাকা থেকে আমরা কয়েকজন শিল্পী সাহিত্যিক গিয়েছি। যখন আলাপ হচ্ছিল সবার সঙ্গে, পেছন থেকে বুড়ো ধরণের কে একজন মুখ ফসকে বলে ফেললো, শালারা লেখক, একজন কবি আবারও, দেখে মনে হয় জলদস্যু ।rofiq2

শুনে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, আমরা জলদস্যুবেশী বটে কিন্তু আমরা লেখক। এখন থেকে এধরণের লেখকই দেখবেন। কোণাপাঞ্জাবি আর দেখবেন না এই দেশে।’

হ্যাঁ, কবি রফিক আজাদরা সেই সময়ই কোন ধরণের ভাণ ভণিতা না করে সরাসরি আমূল পালটে দিয়েছিলেন সময়কে। শিল্পী সাহিত্যিকদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে ধরণের প্রচলিত ধ্যান ধারনা ছিল সেগুলো সমূলে উৎপাটন করে দিয়েছিলেন রফিক আজাদরা। এতো বছর পরে এসে ভাবলে বিস্মিত হতে হয় এটা ভেবে যে তাঁরা এক অর্থে একটা বিপরীত স্রোতের ভেতর এক ধরণের বিপ্লবই করেছেন ।

দুই ।।

‘ পাখি উড়ে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে
কঠিন মাটিতে৷
এই ভেবে কষ্ট পেয়েছিলে ’

রফিক আজাদ নিশ্চিত হয়ে, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন গল্পকারকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ঝুঁকিটা তিনি ইচ্ছে করলে না-ই নিতে পারতেন। না নিলে তাঁর এমন কোন ক্ষতি হত না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অহরহ এরকম ঘটছে। কিন্তু একজন পেশাদার সম্পাদকের পুরো দায়িত্বটা রফিক আজাদ বুঝে শুনে নিয়েছিলেন। পত্রিকার একজন রিপোর্টার জোসের ঠেলায়, আবেগের হুজুগে তার রিপোর্টে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে দু‘তিন লাইন লিখে ফেলেছে তার দায়িত্ব সম্পাদক না নিলে এমন কি আর ক্ষতি! রফিক আজাদ সম্পাদক হয়ে তাঁর পত্রিকার একজন রিপোর্টারকে নিজের ছেলের মত আগলে রেখে ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। ঝুঁকিটা সেই সময়ের জন্য সত্যিই মারাত্মক ছিল। নিজে বাংলা একাডেমীতে সরকারি চাকরি করেন। ‘উত্তরাধিকার’ দেখেন। দুপুরের পর সাপ্তাহিক ‘রোববার’ এর সম্পাদনার কাজ করেন। ’৮৩ সালের দিককার কথা। ‘নুরজাহান’ খ্যাত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন ‘আমার কবি রফিক আজাদ’ স্মৃতি গদ্যে লিখছেন,“রোববার বেরুবার আট-দশমাস পর আমি জার্মানিতে চলে গেলাম৷ জার্মানি তখন দুটো দেশ৷ আমি গেলাম পশ্চিম জার্মানিতে৷ বন শহরে আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল৷ প্রথমে গিয়ে তাদের কাছে উঠলাম৷ দিন বিশেক বনে থেকে চলে গেলাম স্টুটগার্টে৷ স্টুটগার্টে কয়েক মাস থেকে চলে গেলাম পাশের ছোট্ট শহর সিনডেলফিনগেনে৷ এই শহরটি বলা হয় মার্সিডিস সিটি৷ কারণ বিখ্যাত মার্সিডিস বেঞ্জের মূল কারখানা এই শহরে৷

জার্মানিতে গিয়েছিলাম রোজগারের আশায়৷ টাকা রোজগার করে জীবন বদলাব৷ হয়নি৷ প্রবাস জীবন আমি সহ্য করতে পারিনি৷ আমাদের দেশের নিম্নস্তরের শ্রমিকের কাজ ছাড়া কোন কাজে পয়সা নেই৷ ওইসব কাজ আমি করতে পারছিলাম না৷ তাছাড়া দেশে রয়ে গেছে কত প্রিয় মানুষ, কত প্রিয়জন, তাদের ছেড়ে আছি৷ আমার মন পড়ে থাকত দেশে, সেসব প্রিয় মানুষদের কাছে৷ মা-ভাইবোন তো আছেই, যুবতী হয়ে ওঠা প্রেমিকাটি আছে, বন্ধুবান্ধব আছে, লেখালেখি করে একটা জায়গা তৈরি করেছিলাম সেই জায়গাটি আছে আর আছেন রফিক আজাদ৷ আমি সবাইকে চিঠি লিখি৷ সবাই আমাকে চিঠি লেখে৷ রফিক ভাইকে চিঠি লিখি কিন্তু তার চিঠির কোন জবাব আসে না৷ দশ-বারোটি চিঠি লেখার পর তার একটা চিঠি পেলাম৷ চিঠির দুটো লাইন এখনও মনে আছে, ‘গদ্য লেখার ভয়ে আমি কাউকে চিঠি লিখি না৷ কিন্তু মনে মনে প্রতিদিন তোমাকে অনেক চিঠি লিখি৷ তুমি কেমন আছো, মিলন?’

imdadul-hoque-milonমনে আছে এই লাইনটি পড়ে আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম৷

জার্মানি থেকে ফিরে এলাম দু’বছর পর৷ যেদিন ফিরলাম, রফিক ভাইর সঙ্গে দেখা হল তার পরদিন৷ আমাকে দেখে কী যে খুশি হলেন! সেদিনই বেতন পেয়েছেন, বেতনের পুরো টাকাটা আমাকে নিয়ে দামি মদ খেয়ে শেষ করে দিলেন৷ একটা মাস কী করে সংসার চলবে একবারও ভাবলেন না৷

আবার আগের জীবনে ফিরে এলাম আমি৷ রোববারে নতুন করে চাকরি হল৷ ইত্তেফাক ভবনের সামনে ট্রাকচাপা পড়ে মারা গেল এক পথচারী৷ পুরো শরীর ঠিক আছে শুধু মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে ট্রাকের চাকা৷ মাথাটা চ্যাপ্টা হয়ে রাস্তার সঙ্গে মিশে গেছে৷ ট্রাক ড্রাইভারদের সঙ্গে পুলিশের টাকা-পয়সার সম্পর্ক৷ ট্রাফিক পুলিশের হাতে মোটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভার ট্রাক নিয়ে উধাও হয়ে গেল৷ আমি একটা রিপোর্ট লিখলাম রোববারে৷ পুলিশ সম্পর্কে একটা আপত্তিকর মন্তব্য করে ফেললাম৷ সেই লাইনটির ওপর ‘ছিপি’ লাগিয়ে বাজারে ছাড়া হলো পত্রিকা৷ ছিপি তুলে পুলিশরা সেই লাইন পড়ল এবং দেশের সব পুলিশ ক্ষেপে গেল৷ ’৮৩ সালের কথা৷ এমন কথাও আমার কানে আসতে লাগল গোপনে আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হবে৷ তখন পুলিশের উর্ধতন একজন আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন৷ তিনি লেখক৷ রফিক আজাদ যখন টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার তখন তার ছাত্র ছিল আরেফিন বাদল৷ বাদল ভাইয়ের সঙ্গে মোসলেহউদ্দিন সাহেবের খুবই খাতির৷ বাদল ভাইকে ধরে দিনের পর দিন ছুটোছুটি করে আমাকে রক্ষা করলেন রফিক ভাই৷ সেই আতংকের দিনে প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত রফিক ভাই আমার হাতটা ধরে রেখেছেন, আমার পাশে থেকেছেন৷ রাতের বেলা তার বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন আমাকে৷ নিজের বাড়িতে কিংবা অন্য কোথাও থাকলে পুলিশ যদি আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে!”

সময়টা ভাববার মত। তিরাশি সাল। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামল। রফিক আজাদের পত্রিকার এক রিপোর্টার পুলিশের বিরুদ্ধে জঘন্য ভাষায় আক্রমণাত্মক লাইন লিখেছে। সম্পাদক হিসেবে এর দায়ভার রফিক আজাদ না নিলে একজন সামান্য রিপোর্টার ইমদাদুল হক মিলনের কি হতো ?

চাকরি চলে যেত। জেল জরিমানা হতো কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু একটা হয়ে যেতে পারত। উড়িয়ে দেয়া যায় না সেসব সন্দেহ।

মিলন ভাইকে যখন বিভিন্ন সময় প্রাসঙ্গিকভাবে কিংবা অপ্রাসঙ্গিকভাবে অপার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে রোববার সম্পাদক কবি রফিক আজাদের এই ভালবাসার কথাকে স্মরণ করতে দেখেছি তখন টের পেয়েছি একজন সম্পাদক কিভাবে সেই গণ্ডি মাড়িয়ে একজন বড় মানুষ হয়ে উঠতে পারেন। বড় মানবিক হয়ে উঠতে পারেন। একজন বড় বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন।

তিন।।

‘বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে
বালক পড়েছে ভুল বই
পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই।’

বাংলাদেশে সাহিত্য সম্পাদকদের চরম আকালের দিনে যে ক’জন সম্পাদক বোদ্ধা , জাঁদরেল, পড়াশোনা জানা-অলা সম্পাদক ছিলেন তাঁদের মধ্যে রফিক আজাদ অনন্য। ‘উত্তরাধিকার’ আর ‘রোববার’ দিয়ে কতো লেখক কবিকে যে তিনি নিজের হাতে গড়ে পিঠে তৈরি করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। বন্ধু বৎসল বলে খ্যাতি ছিল তাঁর। ‘কবি’ তকমা লাগিয়ে একধরনের ‘ছাইয়া দিলমে আনা রে’ ভাব নিয়ে যত্রতত্র বিচরণ করার ঘোর বিরুদ্ধাচারনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। অসম্ভব আড্ডাবাজ হিসেবে জীবনের সব হিসেবকেই জটিল করে দিয়েছিলেন এই কবি। নানারকম বৈষয়িক মাপ ঝোঁকের মধ্যে জীবনের বিশাল পরিধিকে খাটো করার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবি রফিক আজাদ সেই ধারা বহাল তবিয়তে অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন। এখানেই তিনি আর সবার চেয়ে আলাদা। অনন্য। অনবদ্য।

মাহবুব রেজা সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক