শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

প্রতিযোগিতার যুগ ও অনুবাদভিত্তিক বিনোদন | ফাহিম আহমেদ

সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশের বিনোদন জগতের তারকারা বহু বিদেশি সিরিয়ালের বাংলা অনুবাদকৃত সম্প্রচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। কিছুদিন আগে ভারতীয় চ্যানেলে দেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকেরা। তবে কোন এক বিচিত্র কারণে দাবি আদায় না করেই সে আন্দোলনটি স্তিমিত হয়। কিন্তু এ আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে যে বিষয়টি এখনও উঠে আসেনি তা হলো পে-চ্যানেলের দাবি। বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি
চ্যানেলের সংখ্যা ৪১ টি। কিন্তু এর মাঝে একটিও পে চ্যানেল নেই। অর্থাত্ বাংলাদেশি চ্যানেল দেখানোর জন্য ক্যাবেল অপারেটররা চ্যানেলগুলোকে কোন ফি প্রদান করেন না। এর ফলে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও অত্যাধিক বিজ্ঞাপন নির্ভর। বাংলাদেশের ক্যাবেল অপারেটররা এক অদ্ভুত উট! এদের না আছে নির্দিষ্ট সংখ্যক চ্যানেল দেয়ার ক্ষমতা, না আছে দর্শকের ইচ্ছা অনুযায়ী কোন চ্যানেল নিশ্চিত করার দক্ষতা। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় এদের সাথে চ্যানেল মালিকেরা সর্বদাই হেরে যান। আর এ সুযোগ নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতারা টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচারকে নিজেদের মতো নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোতে অধিক বিজ্ঞাপন বিরতির সাথে অন্যান্য দেশের চ্যানেলের বিজ্ঞাপন বিরতির মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে এ পে-চ্যানেল নীতি।
কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ একটি দাবি বাদ রেখে নাট্যকর্মীদের বিদেশি অনুষ্ঠানের বাংলা অনুবাদকৃত সম্প্রচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া কতটা যৌক্তিক তা বোধগম্য নয়। দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে অনেককেই বলতে দেখা যায়, “দেশের মানুষ এখন আর বাংলা নাটক দেখতে চায় না”। কথাটি শতভাগ সত্যি নয়। কেননা অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন বিরতি, অপরিপক্ব অভিনয় ও কাহিনী, দুর্বল সংলাপ ইত্যাদি বিষয় দেশীয় দর্শকদের বিদেশি বিনোদনের দিকে বেশি আকৃষ্ট করছে। বাংলাদেশি বিনোদনের চেয়ে বিদেশি বিনোদনের প্রতি এদেশের মানুষের আকর্ষণের পেছনে আরো বহু কারণ রয়েছে যা ব্যাখ্যা করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বাংলা নাটক আধুনিক সময়ের মানুষ যদি দেখতে নাই পছন্দ করতো তাহলে আনিসুল হকের “সিক্সটি নাইন”, ইফতেখার আহমেদ ফাহমি ও রেদওয়ান রনির “হাউসফুল” মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারতো না। 
ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদ ও বিশ্বায়নের যুগে অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক একটি খাত হলো বিনোদন জগত। এখানে টিকে থাকতে ও সফল হতে শুধু দেশপ্রেমের দোহাই দেয়া যথেষ্ট নয়। রিমোট নামক বস্তুটিই বর্তমান ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রধান অস্র। যে সকল অভিনেতা-অভিনেত্রী বিদেশি অনুবাদকৃত সিরিয়ালের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তাদের উচিত বিদেশি বই ও মঞ্চনাটকের বাংলা অনুবাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয়া। যাদের মনে হয় বিদেশি নাটকের বাংলা অনুবাদ গ্রহণ করার মাধ্যমে আমাদের সমাজ বিষ গ্রহণ করছে তাদের জন্য একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করব। একবার রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী একসঙ্গে বসে সকালের নাশতা করছিলেন। তো গান্ধী লুচি পছন্দ করতেন না, তাই তাঁকে ওটসের পরিজ (Porridge of Oats) খেতে দেওয়া হয়েছিল; আর রবীন্দ্রনাথ খাচ্ছিলেন গরম গরম লুচি। গান্ধী তাই না দেখে বলে উঠলেন, ‘গুরুদেব, তুমি জানো না যে তুমি বিষ খাচ্ছ।’ উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বিষই হবে; তবে এর অ্যাকশন খুব ধীরে। কারণ, আমি বিগত ষাট বছর যাবৎ এই বিষ খাচ্ছি।’ আলিফ-লায়লা, হাতেম-তায়ি, মাক-গাইভার, নাইট-রাইডারস এর মত বিদেশি সিরিয়ালের বাংলা অনুবাদ বিটিভিতে দেখেই বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বড় হয়েছে এবং এখনও তাদের চিন্তার জগত বহাল তবিয়তেই আছে। বাংলাদেশি টেলিভিশন বিনোদনকে বিশ্বায়নের বাজারে টিকে থাকতে হলে শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ও প্রতিযোগীতা করার মানসিক প্রস্তুতিই সুফল এনে দিতে পারে যার কোন বিকল্প নেই।

ফাহিম আহমেদ,
শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়