মুরতাদ দুরকমের– ফিতরি ও মিলি। ফিতরি − ফিতরা মানে স্বভাবজ। স্বাভাবিকভাবে মুসলিম হয়ে জন্মে ইসলাম ছেড়ে দিলে হয় ‘মুরতাদ ফিতরি’। ‘মুরতাদ মিলি’ হল সে, যে অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করে তারপর ইসলাম ছেড়ে দেয়। এ নিবন্ধে আমরা দেখব এ ব্যাপারে ১. শরিয়া আইন কী বলে; ২. কোরান কী বলে; ৩. রাসুল (সা.) কী করেছেন; ৪. মওলানা মওদুদি (ও অন্যদের) মুরতাদ হত্যা সমর্থন কতটা বৈধ; ৫. অন্য বিশেষজ্ঞেরা কী বলেন এবং ৬. বাস্তবে কী ঘটেছে ও ঘটছে।
• শরিয়া আইনে মুরতাদকে তিন দিন সময় দেওয়া হয় তওবা করে ইসলামে ফিরে আসতে। সে তা না করলে মৃত্যুদণ্ড। (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ৩য় খণ্ড, ধারা ১২৭৬, শাফি ল’ ও.৮.২ ইত্যাদি)
• শরিয়ার অন্য একটি ভয়ানক আইন হল মুরতাদকে যে কেউ যে কোনো জায়গায় খুন করতে পারে, তাতে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না। (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খণ্ড, ধারা ৭২, শাফি ল’ ও.৫.৪ ইত্যাদি)
অর্থাৎ কোনো ধর্মান্ধ কাউকে মুরতাদ ঘোষণা করলে তাকে খুন করতে অন্য ধর্মান্ধকে উৎসাহিত করা হয়। মুসলিম বিশ্বে এমন ঘটনা ঘটেছে এবং খুনীর শাস্তি হয়নি।
• হানাফি আইনে নারী মুরতাদের আজীবন কারাবাস। (হেদায়া, পৃষ্ঠা ১৪৬)
• মুরতাদের বিয়ে, সাক্ষ্য ও উত্তরাধিকার বাতিল হয়ে যায়।
২. কোরান
• বিশ্বাসের স্বাধীনতা দেওয়া আছে।
সুরা ইউনুস ৯৯– “তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তি করিবে ইমান আনিবার জন্য?”
কাহ্ফ ২৯– “যার ইচ্ছা বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক।”,
নিসা ৮০– “আর যে লোক বিমুখ হইল, আমি আপনাকে (হে মুহাম্মদ!) তাহাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করি নাই।”
বাকারা ২৫৬– “ধর্মে জোর-জবরদস্তি নাই।” ইত্যাদি প্রায় ৩০টি আয়াত।
• মুরতাদের ওপরে কোরানে বেশকিছু আয়াত আছে, কিন্তু কোরানের কোথাও খুন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। বরং এর ভেতরে মানুষের নাক গলানো নিষেধ করা আছে। যেমন: বাকারা ২১৭, ইমরান ৮২, ৮৬, ১০৬, নাহল ১০৬, মুনাফিকুন ৩, তওবা ৬৬ ও ৭৪, নিসা ৯৪, ও নিসা ১৩৭– “যাহারা একবার মুসলমান হইয়া পরে আবার কাফের হইয়া গিয়াছে, আবার মুসলমান হইয়াছে এবং আবার কাফের হইয়াছে এবং কুফরিতেই উন্নতি লাভ করিয়াছে, আল্লাহ তাহাদের না কখনও ক্ষমা করিবেন, না পথ দেখাইবেন।”
অর্থাৎ কোরান সুস্পষ্ট ভাষায় মুরতাদকে ইসলামে ফিরে আসার সুযোগ ও অধিকার দিয়েছে, তাকে খুন করলে সেই খুন সরাসরি কোরান লঙ্ঘন হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কোরানের আরেকটা স্পষ্ট নির্দেশ আছে সুরা ইমরানের ৮৬ নম্বর আয়াতে। হারিথ নামে এক মুসলমান মুরতাদ হলে তার ওপর নাজিল হয়েছিল এ আয়াত:
“কেমন করে আল্লাহ এমন জাতীকে হেদায়েত দেবেন যারা ইমান আনার পর ও রাসুলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেওয়ার পরও তাদের কাছে প্রমাণ আসার পর কাফের হয়েছে?”
রাসুল (সা.) তাকে মৃত্যুদণ্ড কেন, কোনো শাস্তিই দেননি। (সিরাত – ইবনে হিশাম-ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ৩৮৪)
৩. রাসুল (সা.):
• বহু বিষয়ের মতো এ ব্যাপারেও পক্ষে-বিপক্ষে হাদিস আছে। কিন্তু সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে মুরতাদ হত্যার নাম ও ঘটনার বিবরণ নেই। আছে শুধু “রাসুল (সা.) বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি ধর্মত্যাগ করে তাহাকে হত্যা কর”– এই ধরনের বায়বীয় কথা। (বোখারি ২৮৫৪ নং হাদিস, মওলানা আবদুল জলিলের অনুবাদ)
পক্ষান্তরে, রাসুল (সা.) বিভিন্ন অপরাধে অনেক অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু কাউকে তিনি শুধুমাত্র ইসলাম ত্যাগের জন্য মৃত্যুদণ্ড তো দূরের কথা কোনো শাস্তিই দেননি। বরং তাঁর জীবনেই আমরা অন্তত চারজন মুরতাদের বিস্তারিত বিবরণ পাই যাদের তিনি কোনো শাস্তি দেননি। উদাহরণ দিচ্ছি:
• রাসুলের (সা.) ওহি-লেখক আবদুলা বিন সা’আদ মুরতাদ হয়ে মদিনা থেকে মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল এবং পরে ধরা পড়েছিলেন। (সিরাত – ইবনে হিশাম-ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ৫৫০)। হজরত ওসমান (রা.) পরে তাকে মিসরের গভর্নর করেছিলেন।
• হারিথ-এর ঘটনা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে– সিরাত – ইবনে হিশাম-ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ৩৮৪, সুরা ইমরান ৮৬ নম্বর আয়াতের পটভূমি হিসেবে।
• উবায়দুলাহ– সিরাত – ইবনে হিশাম-ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ৫২৭
• সহি বুখারি ৯ম খণ্ড হাদিস নং ৩১৮– জাবির বিন আবদুলা বলেন, এক বেদুইন আল্লাহর রাসুলের (সা.) কাছে বায়াত গ্রহণ করিল। পরে মদিনায় তাহার জ্বর হইলে সে আলাহর রাসুলের (সা.) নিকট আসিয়া বলিল, ‘হে আলাহর রাসুল (সা.), আমার বায়াত ফিরাইয়া দিন।’ রাসুল (সা.) সম্মত হইলেন না। তারপর সে আবার আসিয়া বলিল, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমার বায়াত ফিরাইয়া দিন।’ রাসুল (সা.) সম্মত হইলেন না। তারপর সে আবার আসিয়া বলিল, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমার বায়াত ফিরাইয়া দিন।’ রসুল (সা.) সম্মত হইলেন না। তারপর সে মদিনা ছাড়িয়া চলিয়া গেল। ইহাতে আলাহর রাসুল (সা.) বলিলেন, “মদিনা একটি উনুনের মতো– ইহা ভেজালকে বাহির করিয়া দেয় এবং ভালোকে পরিষ্কার ও উজ্জ্বল করে।”
৪. মওদুদি
মুরতাদকে হত্যার সমর্থনে নামকরা বই হল মওদুদির ‘দ্য পানিশমেন্ট অব দ্য অ্যাপোস্টেট অ্যাকর্ডিং টু দ্য ইসলামিক ল’। এ বইতে মওদুদি বলেছেন, “কোরান ও সুন্নাহ এ ব্যাপারে বিশেষ ব্যাখ্যা দেয় না।”
কথাটা ঠিক নয়, ওপরে কোরান-রাসুলের (সা.) স্পষ্ট উদাহরণ দেখানো আছে। তিনি সুরা তওবার আয়াত ১১ ও ১২-এর উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেছেন, ওখানে মুরতাদ হত্যার বিধান আছে। আয়াত দুটো হল, “যদি প্রতিশ্রুতির পর তাহারা তাহাদের শপথ ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে বিদ্রূপ করে তবে কুফর-প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর। কারণ ইহাদের কোনো শপথ নাই যাহাতে তাহারা ফিরিয়া আসে।”
মওদুদি বলেছেন, “এখানে ‘শপথ ভঙ্গ’ কোনোমতেই রাজনৈতিক চুক্তি হইতে পারে না। বরং ইহার পটভূমি নির্দেশ করে যে, ইহার অর্থ ‘ইসলাম গ্রহণ ও পরে ইসলাম ত্যাগ করা’।”
অবশ্যই রাজনৈতিক চুক্তিভঙ্গ হতে পারে। সুরা তওবার ওই আয়াতে মুরতাদের নামগন্ধও নেই। এর পটভূমি হল মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে যুদ্ধবিরতি, যুদ্ধ-চুক্তিভঙ্গ ও যুদ্ধচুক্তি বাতিল। এ পটভূমি ধরা আছে ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলোতে এবং বহু ইসলামি ওয়েবসাইটেও। তবে উদ্ধৃতি দিচ্ছি মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুবাদ করা বাংলা কোরান থেকে যেন সবার পক্ষে মিলিয়ে নিতে সুবিধে হয়। ৫৫৩ ও ৫৫৬ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃতি:
“সুরা তওবার সর্বত্র কতিপয় যুদ্ধ, যুদ্ধ-সংক্রান্ত ঘটনাবলী এবং এ-প্রসঙ্গে অনেকগুলো হুকুম-আহাকাম ও মাসায়েলের বর্ণনা রয়েছে।…হোদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল হয়ে যায়, যাতে ছিল দশ বছরকাল যুদ্ধ স্থগিত রাখার চুক্তি…এখানে (১১ নং আয়াতে) বলা হয় যে, কাফেররা যত শত্রুতা করুক, যত নিপীড়ন চালাক, যখন সে মুসলমান হয় তখন আল্লাহ (যেমন) তাদের কৃত অপরাধগুলো ক্ষমা করেন…আলোচ্য দ্বাদশ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, এরা যদি চুক্তি সম্পাদনের পর শপথ ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং ইসলামও গ্রহণ না করে, অধিকন্তু ইসলামকে নিয়ে বিদ্রূপ করে, তবে সেই কুফর-প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর।”
মওদুদি মুরতাদ হত্যার সমর্থনে টানার চেষ্টা করেছেন সুরা নিসাও (আয়াত ৮০)। কিন্তু মওদুদির বোধহয় মনে নেই যে, তিনি নিজেই তাঁর তফহিমুল কুরানে সুরা নিসার ৮০ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, “নবীজির প্রতি দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছে শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশ-নির্দেশ লোকদের কাছে পৌঁছানো এবং তিনি তাহাতে ভালোভাবেই সফল হইয়াছেন। তাহাদিগকে সত্যপথে বাধ্য করা তাঁহার দায়িত্ব ছিল না।”
এবারে মওদুদি নির্ভর করেছেন হযরত আবু বকরের (রা.) ওপর। তিনি বলেছেন, “দূরের কিছু গোত্র মুরতাদ হয়েছিল এবং হজরত আবু বকর সৈন্য পাঠিয়ে তাদের পরাজিত করেছেন।”
মওদুদি হজরত আবু বকরের (রা.) চিঠি উল্লেখ করে বলেছেন, হজরত আবু বকর নাকি তাঁর সিপাহসালারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘ইসলাম কবুল না করলে কাউকে জীবন্ত ছাড়বে না, আগুন জ্বালিয়ে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে এবং তাদের নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস বানিয়ে রাখবে।”
তাহলে কোথায় গেল বাকারা ২৫৬: “ধর্মে জোর-জবরদস্তি নাই”?
নবীজির (সা.) ওফাতের পর স্বভাবতই কিছু বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। কেউ কেউ নবীত্ব দাবি করে বসল, তাদের কিছু ‘সাহাবি’ও গজাল। তবে প্রধান কারণ হল, কিছু গোত্র মনে করত রাসুলের (সা.) গাদির-এ-খুম মাঠের বক্তৃতা ও অন্যান্য বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে হজরত আলীর (রা.) প্রথম খলিফা হওয়ার কথা। তখন জাকাত সরকারি বায়তুল মালে জমা হত। তারা হজরত আবু বকরের (রা.) সরকারকে অবৈধ সরকার মনে করে জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, ইসলাম ত্যাগ করেনি। হজরত আবু বকরের (রা.) এ যুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক, সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি সরকারবিরোধীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
[সূত্র: বিখ্যাত লেখক আলী আবদুল রাজিকের ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ফান্ডামেন্টালস অব অথরিটি’ (‘Islam and the fundamentals of authority’; a study of the Caliphate and government in Islam, পৃষ্ঠা ৫২০)]
এবারে মওদুদি সমর্থন নেওয়ার চেষ্টা করেছেন অতীতের ইমামদের থেকে। হ্যাঁ, প্রায় প্রত্যেক শরিয়া-ইমামই মুরতাদ হত্যার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু আমরা সেটা প্রত্যাখ্যান করি কোরানের ভিত্তিতে। আসল কথাটা হল, পরকীয়ার প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ডের মতো মুরতাদ হত্যার আইনও এসেছে ইহুদি কিতাব ‘ডিউটেরনমি’ থেকে। উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
“(যদি কেহ) বলে ‘চল আমরা অন্য স্রষ্টাকে সেবা করি’, তবে তোমরা নিশ্চয় তাহাকে হত্যা করিবে…তাহাকে প্রস্তরের আঘাতে হত্যা করিবে…” ইত্যাদি।
৫. অন্যান্য সূত্র
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন, মূল শব্দটা হল ‘রাদ্’। এর সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দগুলো ইরতাদা, রিদ্দা এবং মুরতাদ সবই হল স্বকর্ম। নিজে থেকে না বললে বা না করলে বাইরে থেকে কেউ কাউকে স্বকর্ম করাতে পারে না। যেমন আত্মহত্যা যে করে সে-ই করতে পারে, অন্যেরা খুন করতে পারে কিন্তু কাউকে আত্মহত্যা করাতে পারে না। ঠিক তেমনি মুরতাদও নিজে ঘোষণা করতে হয়, অন্য কেউ করিয়ে দিতে পারে না। চিরকাল বহু সুফি-দরবেশ ও ইসলামি বিশেষজ্ঞ এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন:
• ড. ইউসুফ কারজাভি (দৈনিক সংগ্রাম, ২৮ মার্চ ২০০৬ ও দৈনিক ইনকিলাব, ১৪ এপ্রিল ২০০৬)
• ইউরোপিয়ান ফতোয়া ও গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য ড. জামাল বাদাওয়ী
• আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কানাডার মওলানা মুবিন শেখ
আমাদের বাংলাদেশে শরিয়ার তাত্ত্বিক গুরু প্রাক্তন সচিব জনাব শাহ আবদুল হান্নান বলেছেন:
“অতীতের অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞের মতে সৈয়িদ মওদুদি প্রাচীন মতে (অর্থাৎ মুরতাদের মৃত্যুদণ্ডে – লেখক) বিশ্বাস করিতেন। বর্তমানের বেশির ভাগ ইসলামি বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে তাঁহার সহিত বা প্রাচীন বিশেষজ্ঞের সহিত একমত নহেন। যখন কোনো বিষয়ে মতভেদ হয় বা একাধিক মতামত হয় তখন কোনো একজন বিশেষজ্ঞের ইজতিহাদকে মানিতে কেহ বাধ্য নহে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই বিষয়ে সৈয়িদ মওদুদির সহিত একমত নহি।” (ইন্টারনেট, বাংলার নারী আলোচনা ফোরাম – ৭ এপ্রিল ২০০৬)
৬. বাস্তবতা
প্রতিপক্ষকে (রাজনৈতিক, সামরিক বা অন্যান্য) মুরতাদ ঘোষণা করে খুন, হেনস্থা বা দেশছাড়া করার ঘটনায় মুসলিম ইতিহাসে ভর্তি। পাকিস্তানে এটা হরহামেশাই হয়। অথচ অটোমান খলিফার আমলে মুরতাদ হত্যা এবং আরও কিছু শরিয়া আইন কয়েক শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছিল। (Research of Quiliam foundation, UK.)
১৭২৮ সালের অটোমান খলিফার আমলে শরিয়া-কোর্টের সিসিল দলিলের ‘শিকায়তে দফতরি’তে আমরা দেখি, জয়নাবের স্বামী ইব্রাহীম ইসলাম ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসকে অভিশাপ দিয়েছে, কাজেই সে মুরতাদ হয়ে গেছে। দুজন সাক্ষী দ্বারা এটা প্রমাণিত হলে কোর্ট ইব্রাহীমকে হত্যার রায় না দিয়ে শুধু বিয়ে বাতিলের রায় দিয়েছে (উইমেন, দ্য ফ্যামিলি অ্যাণ্ড ডিভোর্স লজ ইন ইসলামিক হিস্ট্রি: ড. আমিরা আজহারী সনবল, পৃষ্ঠা ১১৯)
মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও মুসলিম বিশ্বের স্বাধীনতার পরে এসব বর্বর আইন আবার ফিরে এসেছে।
উপসংহার
মওলানারা কোনো মুরতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন বলে আমার জানা নেই। সেটা উপেক্ষা করলেই তো “লা ইকরাহা ফিদ্বীন” বা “ধর্মে জবরদস্তি নেই” এর মর্যাদা রক্ষা হয়! এ মর্যাদা নবীজি (সা.) কীভাবে রক্ষা করেছেন তা দিয়ে শেষ করছি।
“উসামা বিন জায়েদ বলিয়াছে, ‘যখন আমি ও এক আনসার তাহাকে (মিরদাস বিন নাহিক নামে এক অমুসলিমকে যার গোত্রের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধ চলছিল – লেখক) আমাদের অস্ত্র দিয়া আক্রমণ করিয়া পাকড়াও করিলাম তখন সে কলমা উচ্চারণ করিল। কিন্তু আমরা থামিলাম না এবং তাহাকে হত্যা করিলাম।’ রাসুলের (সা.) নিকট আসিয়া আমরা এই ঘটনা বর্ণনা করিলে তিনি বলিলেন, ‘কলমার দায় হইতে কে তোমাকে রক্ষা করিবে, উসামা?’ আমি বলিলাম, ‘লোকটি শুধু মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচিবার জন্য কলমা উচ্চারণ করিয়াছে।’ কিন্তু তিনি প্রশ্নটি করিতেই থাকিলেন এবং করিতেই থাকিলেন। তখন আমি ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম এবং বলিলাম আমি আর কখনোই তাহাকে খুন করিব না যে কলমা উচ্চারণ করিয়াছে। তিনি বলিলেন, ‘আমার (মৃত্যুর) পরেও তুমি এইকথা বলিবে তো?’ আমি বলিলাম, ‘বলিব’।” (ইবনে হিশাম-ইবনে ইশাক, পৃষ্ঠা ৬৬৭)
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক না কেন যদি কলমা উচ্চারণ করে, তাকে হত্যা করার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। কলমার দায় বড় দায়, কলমার অপমান ইসলামের অপমান! ইমাম হাম্বলের মসনদ ৬ষ্ঠ খণ্ড ২৬০-র উদ্ধৃতিতে পাওয়া যায় রাসুলের (সা.) তীক্ষ্ণ প্রশ্ন: “তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ?”
(বহু হাদিসের সূত্রে ড. ত্বাহা জাবির আল আলওয়ানী – ‘দ্য এথিক্স অব ডিসএগ্রিমেণ্ট ইন ইসলাম’)
ইসলাম কোনো ‘ইঁদুর মারার কল’ নয় যে, এতে ঢোকা যাবে কিন্তু বেরনো যাবে না। হুংকারী মাওলানারা ভুলে যান যে কাউকে মুরতাদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর হত্যার হুমকি এসে পড়ে। অনেকে খুনও হয়, বিধবা আর এতিমের বুকফাটা আর্তনাদে কেঁপে ওঠে আল্লাহর আরশ। তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, রাসুলের (সা.) বড় বেদনা, বড় কষ্টের সেই উচ্চারণ:
“তুমি কি তাহার বক্ষ চিরিয়া দেখিয়াছ?”
লেখকের ‘শারিয়া কী বলে, আমরা কী করি’ বইয়ের “মুরতাদ হত্যার পক্ষে-বিপক্ষে” অধ্যায় থেকে সংক্ষেপিত। (http://www.shariakibole.com/)
কারো দরকার হলে উপরোক্ত সূত্রগুলোর কপি দেওয়া যেতে পারে।
হাসান মাহমুদ,
ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, মুসলিমস রিফর্ম মুভমেন্ট ও আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য
Find us on Facebook Nobin Kontho