শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭

প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন স্মারক

[১৯৭১ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি’ যে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গড়াবে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তা যথাসময়ে আঁচ করতে পেরেছে। তাই ২৬ মে, ১৯৭১ একটি গোপন স্মারকে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে তা জানিয়েছে তারা। মতামতের পাঠকদের আগ্রহের কথা ভেবে স্মারকটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন– আন্দালিব রাশদী]

১) সেক্রেটারি অব স্টেট, ওয়াশিংটন

প্রেসিডেন্টের জন্য স্মারক

বিষয়: সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি যখন এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, আমাদের বিশ্বাস করতে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এ পরিস্থিতি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে গিয়ে গড়াবে। এ ধরনের দ্বন্দ্বে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনের চাপ সৃষ্টি এবং পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অধিক সোভিয়েত সামরিক সহায়তা লাভের বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না।

তিনটি বিষয় যুদ্ধের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে:

(১) পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমাগত সামরিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা এবং পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে ধারনে অক্ষমতা; (২) শরণার্থীর প্রবাহে (ভারতীয় হিসেবে তিরিশ লক্ষ) ভারতের উপর প্রবল চাপ এবং (৩) বাঙালি গেরিলাদের জন্য সীমান্তের ওপার থেকে ভারতীয় সমর্থন।

যুদ্ধের সম্ভাবনা দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থের প্রতি নতুন এবং বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। আর পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট যতদিন না মিটবে এই হুমকি রয়ে যাবে। আমরা স্বীকার করি, এই সঙ্কট নিরসন পাকিস্তানের জন্য কতটা জরুরি এটা ইয়াহিয়া নিজে যতক্ষণ না অনুধাবন করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করার কোনো পদক্ষেপ তিনি নেবেন না। এটা বুঝাতে আমরা তাকে বাধ্য করতে পারছি না। তাই আমরা পাকিস্তানের জন্য আমাদের সহায়তায় কোনো রাজনৈতিক শর্ত আরোপ করতে পারছি না। আমরা মনে করি, এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে যাতে তার উপর অভ্যন্তরীন কোনো চাপ না পড়ে এবং তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন।

পাকিস্তান ও ভারতের ব্যাপারে দুদেশের যুদ্ধের ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষে আমরা বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। সে কার্যক্রমের তালিকা সংযুক্ত করা হল।

আমরা এখানে (ওয়াশিংটনে) এবং ইসলামাবাদে তিনটি মৌল বিষয়ের উপর জোর দিচ্ছি।

প্রথমত: পূর্ব পাকিস্তানে যেন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম শুরু হয়।

দ্বিতীয়ত: পূর্ব পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরিয়ে এনে ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের পাকিস্তানে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানানো একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রয়োজন পাকিস্তানও স্বীকার করেছে এবং ইয়াহিয়া প্রকৃত পাকিস্তানিদের ফিরে আসার একটি বিতর্কিত আহবান জানিয়েছেন।

তৃতীয়ত: সমস্যার একটি রাজনৈতিক সুরাহা করার জন্য আমরা জোর দিয়ে বলে যাচ্ছি, কিন্তু এতে তেমন কাজ হয়নি।

ভারতীয়দের ব্যাপারেও আমাদের তিন দফা কার্যক্রম:

প্রথমত: যেহেতু শরণার্থীর বোঝাই ভারতের জন্য প্রধান সমস্যা, আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবার বদলে শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর জোর দিচ্ছি যা বোঝা লাঘব করবে। ভারতের কেউ কেউ মনে করছেন, পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের সক্রিয়তার কারণে উ থান্ট (জাতিসংঘের মহাসচিব) অন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আমরা সহায়তা করে যাচ্ছি, তা আরও বৃদ্ধি করা হবে।

দ্বিতীয়: সীমান্ত পেরিয়ে গেরিলাদের সহায়তা প্রদানের বিষয়টি আমরা তুলে ধরেছি এবং তাদের সরাসরি সহযোগিতার পরিণতি সম্পর্কে একান্তে সতর্ক করে দিয়েছি।

তৃতীয়: ভারতীয়দের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াও যে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধান সম্ভব তা ভারতকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি এবং পাকিস্তানের ব্যাপারে আমরা কী অবস্থান নিয়েছি তা-ও গোপনীয়ভাবে ভারতকে অবহিত করেছি।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ যদি লেগেই যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আমাদের কন্টিনজেনসি পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছি।

উইলিয়াম পি রোজার্স

সংযুক্ত: গৃহীত কার্যক্রমের তালিকা

ভারত

ক. শরণার্থী ত্রাণ হিসেবে ২.৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই তহবিলে তিন লক্ষ শরণার্থীকে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পাঁচ লক্ষ ডলার জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনকে দেওয়া হয়েছে।

খ. জাতিসংঘের মহাসচিব এবং শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনকে আন্তর্জাতিক ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনায় উৎসাহিত ও সহায়তা করা হয়েছে।

গ. ত্রিপুরা থেকে আসামে শরণার্থীদের তুলে আনার জন্য এবং আসাম থেকে ত্রিপুরায় ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর জন্য ৪টি সি-১৩০ উড়োজাহাজ প্রদান অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে।

ঘ. পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ সহায়তা পরিচালনা এবং সঙ্কটের রাজনৈতিক সুরাহা অর্জনের জন্য আমরা কী করেছি তা ভারতকে অবহিত করা হয়েছে।

ঙ. পাকিস্তান প্রশ্নে সংযত হবার জন্য ভারতকে বলেছি এবং সরাসরি আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের সতর্ক করেছি।

পাকিস্তান

ক. পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিয়েছি যেন পূর্ব পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা পরিচালনার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবকে অনুরোধ জানায়। পাকিস্তান সরকার মাত্র অনুরোধ পাঠিয়েছে।

খ. ত্রাণ কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের জন্য আন্তঃবিভাগীয় ওয়ার্কিং গ্রুপ জরুরি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আমরা পিপল-৪৮০এর আওতায় খাদ্য সাহায্য প্রদান, (পূর্ব পাকিস্তানের) অভ্যন্তরে ত্রাণ পরিবহনের জন্য নৌযান ভাড়ার অর্থায়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের সহায়তার বিষয়ে পরিকল্পনা করছি।

গ. পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে, শান্তিপূর্ণ অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং শরণার্থীদের ফিরে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানিয়েছি।

ঘ. পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সুরাহা করতে এবং এই লক্ষ্যে প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনার সুস্পষ্ট বিবৃতি দিতে এবং অর্থনৈতিক স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা ইয়াহিয়াকে চাপ দিয়েছি।

ঙ. যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বন্দরে মালামাল জট হ্রাস, গুদামজাতকরণ এবং অভ্যন্তরীন বিতরণের সুবন্দোবস্ত করার বিষয়ে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবেন।

চ. বন্দর উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীন পরিবহন সুযোগ বৃদ্ধি করতে এবং জনগণের কাছে ত্রাণ ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেবার অনুমতি প্রদান করতে ইয়াহিয়াকে অনুরোধ করা হয়েছে।

ছ. বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতি সংযত আচরণ করতে পাকিস্তান সরকারকে বলা হয়েছে।

[উইলিয়াম রোজার্স ২২ জানুয়ারি, ১৯৬৯ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট ছিলেন। তারই উত্তরসূরী হেনরি কিসিঞ্জার। তার আগে কিসিঞ্জার ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।]

আন্দালিব রাশদী
কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক