শনিবার, ৪ মার্চ, ২০১৭

ফিলিস্তিন ইস্যুতে এডওয়ার্ড সাইদ ও সালমান রুশদির কথোপকথন

গত শতকের একেবারে শেষের দিকে সেই ১৯৯৯ সালের কথা। ফিলিস্তিনে তখনো হামাসের উত্থান ঘটে নাই। তখনো ফিলিস্তিনের জনগণ একটি সেকুলার আধুনিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্যেই সংগ্রাম করছিলো। ইয়াসির আরাফাত তখনো ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন, কিন্তু তার জনপ্রিয়তা কমছিল। ক্যান্সারে আক্রান্ত এডওয়ার্ড সাইদ তখনো জীবিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ফিলিস্তিনের জনগণেরই নয়, তৃতীয় বিশ্বের সকল নির্যাতিত নিপিড়িত মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে তখনো তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। সালমান রুশদি সেই সময়ে সাইদের একটি সাক্ষাৎকার নেন।
সাক্ষাতকারটিতে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ মূখ্য ছিল। ছিল জীবন, মৃত্যু, গান, বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা, বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব, মানবতা নানাবিধ বিষয়ে আলোচনা। মূলত ফিলিস্তিন বিষয়ে প্রশ্নত্তরগুলো অনুবাদ করে সাক্ষাৎকারটি ইষৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করলাম।

সালমান রুশদিঃ জুস্টাস রেইড ওয়েইনার ‘কমেন্টারি’তে লিখেছেন, আপনি প্রকৃত ফিলিস্তিনি নন। সে দাবি করেছে আপনি জেরুজালেমে নয়, কায়রোতে বড় হয়েছেন, এবং আপনি মিথ্যাবাদি। তার মতে, যেহেতু আপনি কোন উদ্বাস্তু নন, তাই আপনার ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তুদের পক্ষে কথা বলার কোন অধিকার নেই।
এডওয়ার্ড সাইদঃ আমি ওয়েইনারের লেখা পড়েছি, তার বিপূল মিথ্যাচারে আমি হতবাক। আমার পরিবার বিষয়ে সে ভুল তথ্য দিয়েছে। তার পক্ষে বোঝা সম্ভব না, অথবা তার বোঝার ক্ষমতা নাই যে আমার পিতা ফিলিস্তিনে আমাদের পরিবারের সব সম্পত্তির অর্ধেক মালিক ছিলেন। এই সম্পত্তির মাঝে আমাদের নিজেদের বাড়িও ছিল। আমার আশি বছর বয়সী চাচাতো ভাই, ১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনে ফেরত গেছেন প্রথমবারের মতো। ১৯৪৮ সালে সে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এখন আমাদের সম্পত্তি উদ্ধারের সে চেষ্টা চালাচ্ছে।
ওয়েইনার যাদের সাথে কথা বলে আমার সম্বন্ধে লিখেছে, তাদের মধ্যে আমার মিশরিয় এবং ফিলিস্তিনি সহপাঠিরা আছেন। এদের মধ্যে একজন মিশরিয় ইহুদি ধর্মাবলম্বী আছেন, ওয়েইনারের তথ্য বিকৃতির কারনে তিনি ভয়ঙ্কর রকম ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। সবচেয়ে বাজে বিষয় হচ্ছে, ওয়েইনার আমার সাথে কোনদিন কথাই বলে নাই। সে দাবি করেছে আমার সেক্রেটারির সাথে তার কথা হয়েছে, যা পুরাপুরি মিথ্যা। সে আমাকে কোনদিন একটা চিঠিও পাঠায় নাই। .
রুশদিঃ কমেন্টারি যে শুধুমাত্র আপনার চরিত্রহননের জন্যে এই প্রবন্ধ ছাপিয়েছে তাতে আমি মোটেও অবাক হইনি। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে তাদের চিন্তা ভাবনা প্রশ্নবিদ্ধ।
সাইদঃ ক্ষতি করার চিন্তা থেকেই তারা এই কাজ করেছে। গত তিরিশ বছর ধরে ডানপন্থী জায়োনিস্টরা আমার পেছনে লেগে আছে। তারা আমাকে খন্ডন করতে চায় কিন্তু পারেনা। তাই এখন তারা মাইকেল মিলিকেনের টাকায় একজন গবেষক ভাড়া করেছে যে আমার জীবনের শুরুর দিনগুলো নিয়ে তিন বছর যাবৎ গবেষনা করেছে। কিন্তু গবেষনা করে কি আবিস্কার করেছে? আমি কি নাজি পার্টির সদস্য ছিলাম? খুনি ছিলাম না ড্রাগ ডিলার? কি নিয়ে তারা কথা বলতে চায়?
রুশদিঃ অসলো চুক্তি বিষয়ে আসি। আমার পুরো প্রাপ্ত বয়স্ক জীবনে আমি আপনাকে এবং আপনার লেখাকে যেভাবে জেনেছি বুঝেছি তাতে আপনার অসলো চুক্তির বিরোধিতা আমার বোধগম্য হয়নি। খুব বেশি শান্তির তরিকাতো আমাদের সামনে নেই। এই একটা শান্তিচুক্তিকে কি আমরা কাজে লাগাতে পারি না। কোন সাহসে আপনি এর বিরোধিতা করেন।?
সাইদঃ সত্ত্বরের দশকে যারা বলেছেন সামরিক পদ্ধতিতে দুই পক্ষের কারো জন্যেই কোন সমাধান আসবেনা, আমি তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলাম। খুব সম্ভবত আরবদের মধ্যে এই জাতীয় কথা যারা বলেন, আমিই তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। আমি পাশ্চাত্যে বসে যা কিছু বলছি, আরব প্রেসগুলাতেও তাই লেখি।
আমার মনে হয় আমি পিএলওর রাজনীতি অন্য যে কারো থেকে ভালো বুঝি, বিশেষ করে এই দেশে। আমার মনে হয়েছে, অসলো চুক্তি শুধু ফিলিস্তিনি দুর্বলতার প্রকাশই নয়, বরং বড় ধরণের অযোগ্যতা এবং ভুল হিসাবের কারণে হয়েছে, যার ফলাফল ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি আরাফাত গালফের যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেইনের পক্ষে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। কুয়েত এবং সৌদী আরব আরাফাতের কর্মদোষে ৩ থেকে ৪ হাজার ফিলিস্তিনিদের তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করেছে। অসলোর গোপন চুক্তি সে করেছে কেবল নিজেকে বাঁচানোর জন্যে। এই চুক্তি করার ক্ষেত্রে সে কোন যোগ্য লোকের পরামর্শ পেয়েছে বলে মনে হয় না। অসলো চুক্তিতে যে তিনজন উপস্থিত ছিলেন তাদের একজনও ইংরেজি জানেন না এবং তারা কেউ আইন বিশেষজ্ঞ না। এরা সেই ধরণের লোক যারা আপনাকে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাস করবে, ‘স্বাধীকার’ জিনিসটা কি? অটোনোমি শব্দের অর্থ কি? তাদের কাছে ফিলিস্তিনের একটা মানচিত্র পর্যন্ত ছিল না। এদের বেশিরভগ কোনদিন সেখানে যায় নাই। বেথেলহেম নিয়ে যারা মধ্যস্ততা করতে গেছেন তারা জীবনে কোনদিন বেথেলহেম চোখে দেখেন নাই। এমন আরো বহু উদাহরণ দেয়া যায়।
চুক্তি নিয়ে তারা আরাফাতের কাছে ফেরত গেছে। হোয়াইট হাউসের বাগানে বসে যে ব্যক্তি চুক্তিটি সাক্ষর করেছেন তার নাম আবু মাসন। তিনি বলেছেন, আরাফাত যে একটা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পান নাই তা বুঝতেও তার এক বছরের মতো সময় লেগেছে। আরাফাত শুধু তার নিজের স্ট্যাটাস সংক্রান্ত প্যারাটাই পড়েছেন। তা পড়েই ভেবেছেন তিনি প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র পেয়ে গেছেন। ধরে নেয়া যাক, এসবই হওয়ার কথা ছিল। ধরা যাক, তার আর কিছুই করার ছিল না। সেইক্ষেত্রে তার জনগণের প্রতি সত্যবাদী হওয়া উচিত ছিল। তিনি যদি জনগণকে বলতেন, আমরা এই পেয়েছি, এর বেশি কিছু নয়। তিনি যদি জনগণের সাহায্য চাইতেন, যদি বলতেন ‘আসো সবাই মিলে কিছু করার চেষ্টা করি। আর যদি তোমাদের পছন্দ না হয়, তো পদত্যাগ করার চেয়ে বেশি কিছু আমার করার নাই’। কিন্তু সে তা করে নাই। বরং সে মিথ্যা বলেছে। সে বলেছে আমরা সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছি, স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। আসলে আমরা কিছুই পাই নাই।
সেটলমেন্ট ইস্যুতে চুক্তিতে কিছু নাই, সরণার্থী ইস্যুতে কিছু নাই, জেরুজালেম ইস্যুতেও কোন সমাধানের কথা নাই। এটাকে এমনকি আর দশটা আরব রাষ্ট্রের মতো শোষনমূলক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি বললেও কম বলা হবে। অথচ এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়লের সমর্থন আছে। তারা খোলাখুলিই বলছে যে ফিলিস্তিনের জন্যে সার্বভৌমত্ব, মানচিত্র অথবা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চেয়ে একনায়কত্বের অধিনে থাকাই ভালো।
রুশদিঃ এসব প্রশ্নের কিছু তো ফিলিস্তিনে জনগণের প্রশ্ন। এই একনায়কত্ব ফিলিস্তিনের জনগণ মানবে বা না মানবেনা, সেই প্রশ্নের উত্তর তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
সাইদঃ অবশ্যই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে পঞ্চাশ শতাংসের উপর ফিলিস্তিনি জনগণ হলো সরণার্থী। আমি মনে করি না আরাফাত এখন আর ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। সে ওয়েস্ট ব্যাংক আর গাজার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, সে নিজেও তাই বলে। কিন্তু আমি আপনার সাথে একমত, এর উত্তর ফিলিস্তিনের জনগণকেই খুঁজে পেতে হবে। কিন্তু ফিলিস্তিনের জনগণ যখন সমালোচনা করে, আরাফাত তখন তাদেরকে জেলে ভরে। সে পত্রিকা বন্ধ করে দেয়, বই ব্যান করে। ছিয়ানব্বইয়ের মার্চে আল গোর জেরিকোতে গিয়ে আরাফাতকে বললো শান্তি প্রক্রিয়ার জন্যে নিরাপত্ত্বা আদালত তৈড়ি করতে। আল গোর একটা একনায়ক, দূর্ণিতীবাজ শাসক শ্রেণীকে মদদ দিল, তাও শান্তি প্রক্রিয়ার নামে। এই শান্তি প্রক্রিয়ার পেছনে যদি কোন ভালো উদ্দেশ্যই থাকতো, সত্যি সত্যি শান্তি প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা থাকতো, তাহলে বিগত তিরিশ বছর গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে ইসরায়লি দখলদারিত্বে যে নিপিড়ন, নির্যাতন চলেছে তা স্বিকার
করে নেয়া হলো না কেনো?

রুশদিঃ অসলো চুক্তির বিশেষত্ব ছিল যে দুই পক্ষই কিছু বিষয় পাশ কাটিয়েছে। এক পক্ষ গাড়ি বোমা হামলা নিয়ে কিছু বলে নাই, আরেকপক্ষ সরণার্থী শিবিরের প্রসঙ্গ তোলে নাই। এছাড়া তো শুরু করার উপায় নাই। অতীতের তিক্ততাগুলো পাশ না কাটিয়ে তো সামনে আগানো যাবে না।
সাইদঃ আমাদের সমাজটা ১৯৪৮ সালেই ধ্বংস করা হয়েছিল। আমরা এখনো এই বিষয়টা বুঝতে পারি না।
রুশদিঃ আপনি যা বলছেন তাতে মনে হচ্ছে কোন সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমাধানই সম্ভব না।
সাইদঃ মোটেই না। আমি বলছি না আমাদের যা কিছু ছিল সব ফেরত দিতে হবে। আপনি আমার কথা শুনছেন না। আমি বলছি, আমাদের অবশ্যই অতীতকে স্বিকার করতে হবে। শুধুমাত্র তাহলেই আমরা সামনে এগোতে পারবো।
রুশদিঃ অসলো চুক্তিতে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো রবিনের মুখ থেকে যে কথাগুলো বের হয়ে এসেছে। এই যে ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকারের কথা তার মুখ থেকে শোনা গেলো, তার ফলাফল তো এড়ানো যাবে না। ফিলিস্তিনের জনগণ এবং তাদের সংগ্রাম নিয়ে ইসরায়েলের শাসক শ্রেনী কয়েক প্রজন্ম যাবৎ যেসব মিথ্যাচার চালিয়েছে তার নিশ্চয় এতে অবসান হয়েছে।
সাইদঃ আমি দুঃখিত, আমার মনে হয় না রবিন হোয়াইট হাউসে কি বলেছে তা আপনি ঠিকমতো শুনেছেন। ফিলিস্তিনের জনগণ সম্বন্ধে সে কিছুই বলে নাই।
রুশদিঃ ফিলিস্তিনি জনগণ বলে যে একটা কিছু আছে তা তো সে স্বিকার করেছে। আমি বলছিনা, এর জন্যে আপনাকে কৃতজ্ঞ হতে হবে। একজন ইহুদীর জায়গা থেকে চিন্তা করলে, আমার ভাবনা হচ্ছে এখন বাস্তবতাকে স্বিকার করার সময় হয়েছে। এটা একটা শুরু। আমি জানি এটা কোন আদর্শ সমাধান না। কিন্তু অবশ্যই একটা শুরু।
সাইদঃ আপনি তো এখন আমার সাক্ষাতকার নেয়ার বদলে আমার সাথে তর্ক করছেন।
রুশদিঃ আপনার তাতে আপত্তি আছে কি?
সাইদঃ আমার কোন উপায় আছে কি?
রুশদিঃ অবশ্যই অনেক উপায় আছে।
সাইদঃ কিন্তু আমি কি বলছি আপনিতো তা শুনছেন না।
রুশদিঃ আমরা কি দ্বিমত পোষন করতে পারি?
সাইদঃ না না, তা কোন সমাধান না। আপনি যা বলছেন, যদি এসব কথাই বলেন, তাহলে আপনি ‘দুই রাষ্ট্র’ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। এর মানে হচ্ছে এই মাটিতে দুই ধরণের মানুষ আছে যারা সমান না। অনেকটা দক্ষিন আফ্রিকার একজন শেতাঙ্গকে বলার মতো যে, কালোরা যা চায় তা তাদের দিয়ে দাও এবং অতীতের সব কথা ভুলে যাও। একেবারেই ননসেন্স। আপনি তা করতে পারবেন না। সাউথ আফ্রিকানদের শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে যে, তারা বলেছে ‘এক মানুষ, এক ভোট, এবং একটা সত্য ও সদ্ভাবের কমিশন হোক’।
রুশদিঃ তা কোন ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান না।
সাইদঃ না, এটা ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান না। আমি নিজেই দুই রাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাস করি না। আমি এক রাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাস করি।
রুশদিঃ কিন্তু আপনি তো পরিবর্তন হয়েছেন।
সাইদঃ অবশ্যই হয়েছি। বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটাও একটা বাস্তবতা যে ইসরাইলের মোট জনসংখ্যার বিশ শতাংসই ফিলিস্তিনি, এরা সংখ্যায় লাখো লাখো। ফিলিস্তিনের আলাদা রাষ্ট্রে চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছা তাদের নাই, কারন তারা নাজারাহ এবং হাফিয়ার মতো এলাকায় থাকে, সেখানেই তাদের ঘর বাড়ি। তারা ওয়েস্ট ব্যাংকে কেনো যাবে? ফিলিস্তিন নামক এই অতি ক্ষুদ্র দেশের প্রতিটা ইঞ্চিতে এখন ইহুদী এবং আরবরা একে অন্যের সাথে জড়িয়ে গেছে। না চাইলেও পাশাপাশি বসবাস করছে। আর বসতি নির্মান ইস্যুতে কথা না বলে কোন সমাধান আমরা কিভাবে করি? ইসরায়েলের শাসকরাতো এখনো জমি দখল করেই যাচ্ছে।
রুশদিঃ বারাক তো বসতি স্থাপন বন্ধ করেছে।
সাইদঃ ওকে, কিন্তু এখানে আরো কিছু বিষয় আছে। আমি কি বলছি তা শুনেন। আমি বলছি যে তাদেরকে থাকতে দেন। কিন্তু সবার আগে ফিলিস্তিনিদের যারা ইসরাইলে থাকে তাদেরকে নাগরিকের অধিকার দেন। ইসরাইলকে এমন একটা রাষ্ট্র বানান যেটা নাগরিকদের রাষ্ট্র হবে, ইহুদীদের না।
রুশদিঃ দুই রাষ্ট্র তত্ত্বে যে ঝামেলা এবং দূর্বলতা আছে বলে আপনি দেখিয়ে দিয়েছেন আমি তার প্রতি সহানুভুতিশীল। কিন্তু আপনার আর ন্যোম চমস্কির মতো কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ছাড়া কেউতো বাইন্যাশনাল রাষ্ট্রের কোঁথা বলছে না, এর পক্ষে কোন রাজনৈতিক কার্যক্রম নাই।
সাইদঃ এখানেই আপনি কিছুটা ভুল করছেন। কমেন্টারি’তে আমাকে যে আক্রমন করা হয়েছে তার পেছনে কারন হলো ইসরাইলী ইহুদিদের মধ্যে আমার বক্তব্যের সমর্থকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত মার্চ মাসে ইসরাইলী এন্থ্রোপোলজিকাল এসোসিয়েশন আমাকে তাদের প্রধান বক্তা হিসাবে আমন্ত্রন জানিয়েছিল। প্রায় ৫/৬শ ইসরায়েলি একাডেমিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ‘দা কনসিকোয়েন্সেস অফ ১৯৪৮’ নামে আমি একটি প্রবন্ধ পাঠ করি যেখানে এক রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে বলেছি। জায়োনিস্টরা সব ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করতে চায়। আর ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের উত্থান হয়েছিল সব ইসরাইলিদের উচ্ছেদ করার জন্যে। আমি বলেছি যে এখন আর ফিলিস্তিন অথবা ইসরায়েলের পক্ষে একে অপরকে বাদ দিয়ে কোন ইতিহাস লেখা সম্ভব না। না চাইলেও এক মাটিতে তারা একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেছে। আমি বলেছি যে শুধু ইতিহাস না, বরং বর্তমান এবং ভবিষ্যতের নির্মান করতে গেলেও এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। আমি যে পরিমান সারা পেয়েছি শ্রোতাদের কাছ থেকে তা আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমি এই কথা বলতেও ভয় পাইনা যে, অনেক ফিলিস্তিনিই আমার সাথে এইক্ষেত্রে দ্বিমত পোষন করবেন। অধিকাংশই বলবে যে, মাত্র দশ বর্গ কিলোমিটার হলেও আমাদের নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র লাগবেই, আলাদা পতাকা লাগবেই। আমি এর সাথে একমত না।
রুশদিঃ আপনার এই কথায় আপনার লেখালেখির কেন্দ্রীয় কিছু বিষয় সামনে চলে আসলো। বিশেষ করে ‘রিপ্রেসেন্টেশন অফ দা ইন্টেলেকচুয়াল’এ গোত্রিয় অথবা জাতীয় স্বার্থে নিজের মত প্রকাশ না করে চুপ থাকার বিপক্ষে বলেছেন। আপনি বলেছেন, ‘সমালোচনার সাথে কোন আপোষ নয়’। আপনি আপনার আরব ছাত্রদের বলেন, ‘যদি ইহুদীদের বুঝতে চাও, তাহলে হলোকস্টের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী নিধন) কথা মনে রাখবা’। আপনি এই দায়িত্বটা নিয়েছেন বলে আমি খুব ভালো বোধ করি। তবে আমি একটু ভীতও হই যে, আপনাকে এসব কথা বলতে হচ্ছে কারণ তারা এইসব ইতিহাস জানে না।
সাইদঃ এ এক মহা সমস্যা। দানিয়াল বারেনবয়েম নামে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুর সাথে আমি কিছুদিন আগে ওয়েইমারে তিন সপ্তাহ কাটিয়েছি। সেখানে ‘ইয়ো ইয়ো মা’ নামে ইসরায়েল এবং আরবের বিভিন্ন দেশের তরুন মিউজিশিয়ানদের একটা ব্যান্ড ছিল। ওয়েইমার যেহেতু বুকেনওয়াল্ড থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দুরে, তাই এক বিকালে আমি তাদেরকে বুকেনওয়াল্ড নিয়ে গেলাম। আগ্রহের বিষয় হচ্ছে, ইহুদীদের জন্যে এই সফরের অর্থ এক আর আরবদের জন্যে আরেক। বুকেনওয়াল্ডে যাওয়ার আগের রাতে আমি তাদেরকে বলেছি। “ যদি তোমরা যদি এই সফরকে ইহুদী অভিজ্ঞতা থেকে বিচার করার চেষ্টা করো, তাহলে ভুল করবে। কারন এই অভিজ্ঞতা মানুষের অভিজ্ঞতা। মানুষ হিসাবে এই ইতিহাস আমাদেরকে বুঝতে হবে। সহজ কথায়, ইহুদী নিধনের ঘটনা গোটা মানবজাতির জন্যেই একট ভীতিকর ঘটনা যা গোটা মানবজাতিকেই ছোট করে”। আমার নিজের জন্যে, এবং আরব তরুনদের জন্যে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা।

পারভেজ আলম