২৪ জানুয়ারি ’৭২ অস্ত্র জমা নেওয়ার পর টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে বঙ্গপিতার ভাষণের শেষ অংশ। আমরা কারও সঙ্গে শত্রুতা চাই না। আপনারা আগ্রাসন বন্ধ করুন। আজ রাশিয়া আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। আপনারাও দিন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বাস্তব সত্য। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। আমরা জোটনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। আমরা শান্তি ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।
পৃথিবীর যেখানেই স্বাধিকার আন্দোলন হবে, মুক্তির আন্দোলন হবে, বাংলাদেশ সাধ্যমতো মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আমি সালাম জানাই বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষদের, রাশিয়া, যুগোস্লাভিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশবাসী ও সরকারকে। সালাম জানাই ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানিসহ আমেরিকার প্রগতিশীল মানুষদের, যারা আমাদের আন্দোলন সমর্থন করেছেন। পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তারা শান্তিতে থাকুন, এটা আমরাও চাই। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে অত্যাচার করেছে তার কোনো তুলনা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এত অল্প সময়ে এত লোক মারা যায়নি, যা আমার বাংলায় মারা গেছে। অত্যাচারী সৈন্যদের বিচার হবেই হবে। পাকিস্তান এখনো যে বাঙালি ভাইদের আটকে রেখেছে, অসদাচরণ করছে, পাকিস্তানের জনগণ, আপনারা আপনাদের সরকারকে তা বন্ধ করতে বলুন। আমার মানুষদের সসম্মানে দেশে আসায় সাহায্য করুন।
পৃথিবীর যেখানেই স্বাধিকার আন্দোলন হবে, মুক্তির আন্দোলন হবে, বাংলাদেশ সাধ্যমতো মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আমি সালাম জানাই বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষদের, রাশিয়া, যুগোস্লাভিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশবাসী ও সরকারকে। সালাম জানাই ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানিসহ আমেরিকার প্রগতিশীল মানুষদের, যারা আমাদের আন্দোলন সমর্থন করেছেন। পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তারা শান্তিতে থাকুন, এটা আমরাও চাই। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে অত্যাচার করেছে তার কোনো তুলনা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এত অল্প সময়ে এত লোক মারা যায়নি, যা আমার বাংলায় মারা গেছে। অত্যাচারী সৈন্যদের বিচার হবেই হবে। পাকিস্তান এখনো যে বাঙালি ভাইদের আটকে রেখেছে, অসদাচরণ করছে, পাকিস্তানের জনগণ, আপনারা আপনাদের সরকারকে তা বন্ধ করতে বলুন। আমার মানুষদের সসম্মানে দেশে আসায় সাহায্য করুন।
চীন, আমেরিকাসহ অন্য কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা স্বীকৃতি দিন। আমার দেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে কোনো উপায় নেই। ’
জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমরা সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছি, আমরা সংগ্রাম করেই জয়ী হব। আমরা কোনো অন্যায় করিনি, তাই হার মানব না। ’
‘জয় বাংলা, জয় কাদেরিয়া বাহিনী,
এবারের সংগ্রাম- দেশ গড়ার সংগ্রাম,
এবারে সংগ্রাম- মুক্তির সংগ্রাম। ’
স্বাধীনতা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, পাকিস্তানের হাতে তার গ্রেফতার— এসব নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। কথা অবশ্যই হবে কিন্তু মাত্রা ছাড়া কথা অর্থহীন। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার করা খুবই বেদনাদায়ক। বিরোধী দলের নেত্রী শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ করলেন, স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে প্রশ্ন তুললেন— এসব কি উচিত? কিন্তু তিনি সেই অনুচিত কাজটি করে জাতীয় জীবনে কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা দিলেন। আবার শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানিদের ঢুকিয়ে দেওয়া চর এটা প্রতিষ্ঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না? আবার শুনছি, শুধু অনুচর নয়, জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের চেষ্টা করেছেন। নিশ্চয়ই জিয়াউর রহমান এখন বেশ বড়সড় নেতা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় তেমন ছিলেন না। পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার, কনফেডারেশন করার তার তখন পজিশন বা অবস্থান ছিল না। পাকিস্তানের সঙ্গে আঁতাত করার চেষ্টা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আর সরকারি আমলা মাহবুবুল আলম চাষী। মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমানের সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে তেমন খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। মাত্র দুইবার কলকাতা গিয়েছিলেন, বাকি সময় সীমান্তে কাটিয়েছেন। আর মেজর খুব একটা বড় পদ নয়। তখনো ছিল না, এখনো না। নামেই মেজর, কাজে একটা কোম্পানি কমান্ডার। কোনো কোম্পানি কমান্ডারের স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ নেই। উঠতে বসতে ব্যাটালিয়নের সিওর কথা শুনতে হয়। বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের একটু সুবিধা ছিল তিনি তার অর্ধ সমাপ্ত অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের টুআইসি ছিলেন। যেহেতু সিও ছিল না, তাই তার কিছুটা স্বাধীনতা ছিল।
বিচার করতে হবে জিয়াউর রহমান যদি সত্যিই পাকিস্তানের চর হয়, পাকিস্তানের পক্ষের হয় তাহলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো কেন? আমরা কি প্রথমেই বিভ্রান্ত হলাম? ঠিক আছে ধরে নিলাম আমরা প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি। যুদ্ধ শুরু হলে যখন বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় তখন তাকে একটি সেক্টর কমান্ডার করা হলো। শুধু সেক্টর কমান্ডার নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে তিনটি বিশেষ ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল তার প্রথমটি করা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের নামে ‘জেড ফোর্স’।
‘জেড’ ইংরেজির শেষ অক্ষর হলেও জিয়ার নামে ‘জেড ফোর্স’-র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সবার আগে জুলাই মাসে। আর খালেদ মোশারফ এবং শফিউল্লাহর নামে ‘কে’ ও ‘এস’ ফোর্স করা হয়েছিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। আমরা এতই অপরিপক্ব ছিলাম যে, শত্রুপক্ষের লোককে সেক্টর কমান্ডার এবং তার নামে প্রথম একটা নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করলাম? যা হোক যুদ্ধের সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের সরকার না হয় এ সব ভুল করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে বীরউত্তম খেতাব দিল, সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান বানাল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দিবসে জিয়ার কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনানো হলো, কতবার দেখলাম সুগন্ধা থেকে গণভবন বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে জিয়াউর রহমানকে খাবার খেতে। এসবই পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের ফসল? আর আমরা এত বোকা বা অযোগ্য যে, কেউ কিছু বুঝতে বা ধরতে পারলাম না? তাহলে এখনো যে সব ষড়যন্ত্র হচ্ছে বঙ্গবন্ধুবিরোধীরা সবখানে গিজগিজ করছে আমরা কিছুই করতে পারছি না। এরকম করে আর কিছু নয়, বরং স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছি। পৃথিবীর ইতিহাসের বিস্ময় বাংলাদেশের সফল মুক্তিযুদ্ধকে বিফল করার চেষ্টা করছি। ষড়যন্ত্রের আগ্নেয়গিরির ওপর রাতদিন থেকে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে চুনকালি মেখে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেওয়ার যে বিশ্ব ইতিহাস রচনা করেছিলেন তা কি আমরা এভাবে ধূলিসাৎ করে দিতে চাই?
জিয়াউর রহমানের এক হুইসেলেই আমরা স্বাধীনতার লড়াই করেছি। জিয়াউর রহমানের ঘোষণা এবং নেতৃত্ব কর্তৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এটা যেমন অন্তঃসারশূন্য তেমনি জিয়াউর রহমান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন সেটাও অন্তঃসারশূন্য। জিয়াউর রহমান যদি আমাদের মতো একজন না হয়ে মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ নেতা হতেন তাহলে মুজিবনগর সরকার হবে কেন? জিয়ানগর সরকার হতো। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি, বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হতে যাবেন কেন? ওসব তো জিয়াউর রহমানের হওয়ার কথা। তাই জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে কর্তৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও আহ্বানে।
অভিযোগ অনেক। তাই উত্তরও হবে অনেক বেশি। অনেকেই বলেন ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারতেন। দিলে ৩০ লাখ লোকের জীবন যেত না। আমরা দুই-একদিনের মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যেতাম। তার মানে যারা আমাদের নেতা ছিলেন তারা আমাদের সমান বুদ্ধিও রাখতেন না। তাদের বুুদ্ধি হাঁটুতে নয়, মাথায় ছিল। বুকে ছিল অপরিসীম বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে এক সময় কয়েক বছর গারো পাহাড়ের পাদদেশে ছিলাম। সেখানকার মানুষ বড় বেশি সেকেলে, লেখাপড়া তেমন জানে না। একটু-আধটু লিখতে পড়তে যা জানে তা মিশনারিদের কল্যাণে ইংরেজিতে। তবে বিচার-বিবেচনা, মায়া-মমতা থাকলেও বুদ্ধি-শুদ্ধি তেমন দেখিনি। আমি যে টিলায় থাকতাম তার ৫০ গজের মধ্যে ঝরনার পাড় দিয়ে এক রাস্তা। এক বয়সী গারোকে প্রত্যেক দিন একই সময় সকালে দক্ষিণে এবং দুপুরে উত্তরে ফিরতে দেখতাম। সকালে হাঁড়িতে দুধ নিয়ে যেত, ফেরার সময় তামাক নিয়ে ফিরত। অনেক দিন দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সকালে যে তুমি দুধ নিয়ে যাও, দুধ কত বিক্রি কর? দুধের বদলে তুমি কি নিয়ে ফির? সে বলেছিল, ‘সকালে গিয়ে চায়ের দোকানে দুধ দিই। তারপর এক গ্লাস মিক্সার খাই। দুই-তিন ঘণ্টা বসে থাকি। তারপর আবার এক গ্লাস মিক্সার খেয়ে তামাক নিয়ে বাড়ি ফিরি। ’ এই তার সারা দিনের রুটিন। না হলেও একটানা দুই বছর দেখেছি। গারো বৃদ্ধের বেশ কয়টা গরু ছিল। সে পালত না, পালত তার বউ। কারণ গারো পাহাড়ে বাড়ি-ঘর, জমি-জমার কাজ ছেলেরা করে না, মেয়েরা করে। দেড়-দুই কেজি দুধ নিয়ে চায়ের দোকানে যায়। গিয়েই ভালো করে চিনি দিয়ে এক গ্লাস মিক্সার খায়। মিক্সার বলতে গ্লাসের চার ভাগের এক ভাগ দুধ, বাকিটা গরম পানি। পরিমাণ মতো চিনি দিয়ে গুলে খেয়ে নেয়। যেটুকু দুধ সে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে, বাড়িতে মিক্সার বানিয়ে খেলে ৪০ গ্লাসের কম হবে না। সেখানে তার হয়তো অতিরিক্ত কয়েক চামচ চিনি লাগবে। কিন্তু বাড়িতে চিনি নিয়ে নিজে দুধ গুলে মিক্সার বানিয়ে খাবে না, মিক্সার খাবে চায়ের দোকানে। চায়ের দোকানে দুধ দিয়ে সেখান থেকে তামাক নিয়ে যাবে— এই হলো তার কাজ। আমি ছেলেবেলায় প্রায় পাঁচ বছর গ্রামের স্কুলে পড়েছি। একেবারে নির্ধনের বাড়িতে যেমন থেকেছি, অনেক ধনী বাড়িতেও থেকেছি। হোস্টেলের পয়সা বাঁচাতে এক কাপালি বাড়িতে থাকতাম। তারা খুবই গরিব। তারা দুধ বেচে তামাক কিনত না। দুধ তারা খেত, আমাকে খেতে দিত। বরঞ্চ তাদের চাষ করা তামাক পাতা বেচে বাড়িতে ঘি আনতে দেখতাম। আবার ধনী মুসলমান বাড়িতে যখন থাকতাম তখন তাদের দুধ বেচে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে তামাক আনতে দেখেছি, এই হলো পার্থক্য। আমাদের নেতারা শুধু তামাক খেতেন না, তারা হাতের কব্জি ডুবিয়ে দুধও খেতেন।
বঙ্গবন্ধু যদি ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বলতেন এই মুহূর্তে আমি বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করলাম। এমনিতে ৯ মাসে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছে, তখন ওই সময়ই ১০-১৫ লাখ নিহত হতো। কারণ ৫০০ পাউন্ডের বোমা নিয়ে কয়েকটি পাকিস্তানি হেলিকপ্টার তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আকাশেই ছিল। তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বোমা ফেলতে তাদের উড়ে আসতে হতো না। ৩০ লাখ বাঙালি হত্যাকারী হিসেবে পাকিস্তান সারা পৃথিবীর কাছে নিন্দিত হয়েছিল। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেদিন ওইভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে সেই হত্যার দায় বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ে পড়ত, আমাদের ওপরও আসত। কোনো রাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতাবাদীকে স্বীকার করে না, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করায় রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। তা আমাদের ওপর প্রয়োগ করা হতো। কোনো প্রস্তুতি ছাড়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলে একদিনে ঢাকায় ১৫ লাখ, সারা দেশে আরও ৫০ লাখ লোক নিহত হতো। যার দায় পড়ত আমাদের ওপর। কাজের কাজ কিছুই হতো না। টিক্কা খান বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে ঈদের জামায়াতে বোমা ফেলেছিল। তাতে সরকারের কিছু আসে যায়নি। আমার বাবা বলতেন, ‘ছাগল চুনাতে ধরতে হয়। না হলে তিড়িং বিড়িং করে। ’ আমাদের নেতারাও সেভাবেই পাকিস্তান হানাদারদের নাস্তানাবুদ করেছিলেন। নিশ্চয় নেতাদের কারও কারও ব্যর্থতা ছিল কিন্তু সবার নয়। যারা ৭ মার্চে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা চেয়েছিলেন তারা সরাসরি ঘোষণা করলেইবা কি করতেন? ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি সে কথা কোথায় লেখা বা বলা আছে? বঙ্গবন্ধু তো বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। ’ আমরা তো সেটাকেই স্বাধীনতার ঘোষণা মনে করেছিলাম। গ্রাম-গঞ্জে, রাস্তা-ঘাটে আমরা সেদিন থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দিব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। ’ আর কিভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা দরকার? কই ছাত্র-যুবক-কৃষক-মেহনতি মানুষ-রাজনৈতিক কর্মী ছাড়া যারা এখন কথা বলেন, পাকিস্তান বাহিনীতে ছিলেন তারা কই কেউ তো তত্পর হননি, এগিয়ে আসেননি। বঙ্গবন্ধু যদি কৌশলী না হয়ে ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সরদারের মতো বেখেয়ালি হতেন তাহলে তার যেমন ক্ষতি হতো, আমাদেরও সর্বনাশ হতো। ‘ভেতরে বাইরে ১৯৭১’-এ একে খন্দকার বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ২৫ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভুল হয়েছে। বলতেই পারেন। পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ২৫ মার্চ গভীর রাতে। তিনি তখন ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। ২৫ মার্চের পর অনেক আর্মি-ইপিআর-পুলিশ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এই বয়োজ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা একেবারে একা একা ১৫ মে সীমান্ত অতিক্রম করে ১৭ মে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি এত সময় কি করেছেন? ভালো ছাত্র ছিলেন তাই কি জয়-পরাজয়ের হিসাব মিলিয়ে তারপর মন-প্রাণ পাকিস্তানে রেখে শুধু দেহ নিয়ে কি মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন? ২৫ মার্চের পর এক মুহূর্তের জন্যও জিয়াউর রহমান পাকিস্তানিদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাননি। তাকে বলা হচ্ছে পাকিস্তানের চর। অথচ একে খন্দকার ১৫ মে পর্যন্ত ঢাকার কুর্মিটোলায় থেকে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে একটা যুদ্ধবিমান নিয়ে যাননি। অথচ জিয়াউর রহমান তার পুরো ব্যাটালিয়নসহ যোগ দিয়েছিলেন। প্রশ্ন করতে চাই না, তবুও প্রশ্ন এসে যায়। চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিল খালেদ মোশারফ এবং সাফায়াত জামিলকে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিলেটের দিকে বের করে না দিলে তারা কি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারতেন? যে কোনো ব্যাটালিয়নে পাঁচটা কোম্পানি থাকে। চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন-সাড়ে তিন কোম্পানি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান তার অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট কখনো পুরো হয়নি। যার গঠনকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়। শুধু ৮ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট যারা ইনট্যাক্ট মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
২ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল জয়দেবপুরে। নেতৃত্বে ছিলেন শফিউল্লাহ। ঢাকার গায়ে জয়দেবপুরে থেকেই ২৮ মার্চ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারেননি কি হতে চলেছে। তার পুরো ব্যাটালিয়ন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তার মতো কমান্ডার না হয়ে অন্য কোনো ভালো নেতৃত্ব পেলে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধে হয়তো এক অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারত। যশোরের দিকে ছিল ৩ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট। কতভাবে বলার পরও তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। ১ নম্বরও সেভাবে নেয়নি। দুইটা ব্যাটালিয়ন তো পাকিস্তানেই ছিল। তাহলে কার আশায় ওভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আমরা মাঠে মরতে যেতাম? আমাদের যা ছিল তাই নিয়েই যুদ্ধের প্রস্তুতি চালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল এবং আমরা তাই করেছি। দোষ-ত্রুটি যা হওয়ার হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম